পাকিস্তান চ্যাম্পিয়ন
ভারতের কাছে হেরে শুরু। ভারতকে হারিয়ে শেষ। সব সমীকরণ উল্টে দিয়ে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে উঠে আসা পাকিস্তান তাদের সেরাটা যেন তুলে রেখেছিল শেষ মহারণের জন্য। ওভালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির রবিবাসরীয় ফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে ব্যাটে-বলে রীতিমতো উড়িয়ে দিল পাকিস্তান। ১৮০ রানের দাপুটে জয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির শিরোপা উঠল চিরকালের অননুমেয় দলটির হাতে। স্বপ্নের ফাইনালে টস হেরে প্রথমে ব্যাট করে ম্যাচসেরা ফখর জামানের দুরন্ত শতকে চার উইকেটে ৩৩৮ রানের পাহাড় গড়েছিল পাকিস্তান। এরপর মোহাম্মদ আমির ও হাসান আলীর আগুনে বোলিংয়ে ভারতকে ৩০.৩ ওভারে মাত্র ১৫৮ রানে অলআউট করে গ্রুপপর্বের সেই হারের মধুর প্রতিশোধ নিলেন সরফরাজরা। আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টের নকআউট ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে এটাই পাকিস্তানের প্রথম জয়। পাকিস্তানের ব্যাটসম্যানরা যেখানে শেষ করেছিলেন, ঠিক সেখান থেকেই যেন শুরু করেন বোলাররা। মাত্র ৩৩ রানের মধ্যে রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলি ও শিখর ধাওয়ানকে ফিরিয়ে ভারতের ব্যাটিং মেরুদণ্ড ভেঙে দেন পিঠের চোট কাটিয়ে ফেরা আমির। তার দুর্দান্ত এক স্পেলই লিখে দেয় ফাইনালের ভাগ্য। প্রথম ওভারে রোহিতকে এলবিডব্ল–র ফাঁদে ফেলার পর নিজের পরের ওভারে কোহলিকেও সাজঘরের পথ দেখিয়ে দেন আমির। আগের বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে বেঁচে যাওয়া কোহলি পরের বলে পয়েন্টে তুলে দেন ক্যাচ। ছয় রানে দুই উইকেট হারানোর ধাক্কা আর সামলে উঠতে পারেনি ভারত। নবম ওভারে আমিরের তৃতীয় শিকার হয়ে ফেরেন ধাওয়ান। এরপর যুবরাজ ও কেদার যাদবের উইকেট তুলে নেন তরুণ স্পিনার শাদাব খান। মাঝে এমএস ধোনিকে ফেরান হাসান আলী। ৭২ রানে ছয় উইকেট পড়ে যাওয়ার পর হার্দিক পান্ডিয়ার ৪৩ বলে ৭৬ রানের ঝড়ো ইনিংসও ভারতকে আর ম্যাচে ফেরাতে পারেনি। পান্ডিয়া রানআউট হওয়ার পর দ্রুত ভারতের লেজটা ছেঁটে দেন জুনায়েদ খান ও হাসান। মাত্র ছয় রানে শেষ চার উইকেট হারায় ভারত। সমান তিনটি করে উইকেট নিয়েছেন আমির ও হাসান। এ ছাড়া শাদাব দুটি ও জুনায়েদ পেয়েছেন এক উইকেট। পাঁচ ম্যাচে ১৩ উইকেট নেয়া হাসান আলীর হাতে উঠেছে টুর্নামেন্টসেরার পুরস্কার। গোটা টুর্নামেন্টে দুর্ধর্ষ ফর্মে থাকা ভারত ফাইনালের চাপটাই যেন নিতে পারল না। অন্যদিকে টুর্নামেন্টের শুরুতে যাদের কেউ গোনায় ধরেনি, সেই পাকিস্তান একের পর এক চমক দেখানোর পর ফাইনালে ভারতকে নির্দয়ভাবে গুঁড়িয়ে দিয়ে শেষ হাসি হাসল। এ জন্যই বোধহয় বলা হয়, গৌরবময় অনিশ্চয়তার খেলা ক্রিকেট। একইদিনে লন্ডনে ওয়ার্ল্ড হকি লীগের সেমিফাইনালে পাকিস্তানকে ৭-১ গোলে উড়িয়ে দিয়ে ভারত চলে গেছে ফাইনালে। ক্রিকেটে হল উল্টোটা। এদিকে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়ের সুবাদে বাংলাদেশকে সাতে ঠেলে ওয়ানডে র্যাংকিংয়ে ছয়ে উঠে এলো পাকিস্তান। চাপে ভেঙে পড়া যাদের অভ্যাস, সেই পাকিস্তানকে ফাইনালে দেখা গেল অন্য চেহারায়। বোলিংয়ে আগুন ঝরানোর আগে দুরন্ত ব্যাটিংয়ে ম্যাচের প্রথম ভাগটা নিজেদের করে নেয় সরফরাজ আহমেদের দল। ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে শতকে বিশাল সংগ্রহের ভিতটা গড়ে দেন ওপেনার ফখর জামান (১১৪)। ১২৮ রানের উদ্বোধনী জুটিতে তাকে যোগ্য সঙ্গ দিয়েছেন আজহার আলী (৫৯)। ইনিংসের শেষভাগে ঝড় তোলেন মোহাম্মদ হাফিজ (৫৭*)। মাত্র তিন রানে জীবন পাওয়া ফখরই ছিলেন পাকিস্তানের ইনিংসের প্রাণ।
এ টুর্নামেন্টেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে গ্রুপপর্বের দ্বিতীয় ম্যাচে আন্তর্জাতিক অভিষেক হয়েছিল তার। অভিষেকে ৩১ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলার পর টানা দুই ফিফটিতে আলাদাভাবে নজর কেড়েছিলেন। তবে সেরাটা যেন ফাইনালের জন্যই জমিয়ে রেখেছিলেন ফখর। ক্যারিয়ারের চতুর্থ ওয়ানডেতে প্রথম সেঞ্চুরি, সেটিও ভারতের বিপক্ষে স্নায়ুচাপের ফাইনালে! ভারতের বোলারদের রীতিমতো কাঁদিয়ে ছেড়েছেন ফখর। ভুবনেশ্বর কুমারই শুধু ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি রাশটা টেনে না ধরলে পাকিস্তানের সংগ্রহ অনায়াসে সাড়ে তিনশ’ ছাড়িয়ে যেত। শেষ ১০ ওভারে ৯১ ও শেষ পাঁচ ওভারে ৪৪ রান তুলেছে পাকিস্তান। ভুবনেশ্বর ও জাসপ্রিত বুমরাহ শেষ চার ওভারে দিয়েছেন মাত্র ৩২ রান। ১০ ওভারে ৪৪ রান দিয়ে এক উইকেট নেয়া ভুবনেশ্বরই ভারতের সেরা বোলার। এ ছাড়া একটি করে উইকেট পেয়েছেন হার্দিক পান্ডিয়া ও কেদার যাদব। সবচেয়ে বেশি মার খেয়েছেন দুই স্পিনার অশ্বিন ও জাদেজা। টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামা পাকিস্তানের শুরুটা ছিল সতর্ক। ব্যক্তিগত তিন রানে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়েও বুমরাহর ‘নো’ বলের কল্যাণে বেঁচে যান ফখর। এরপরই পাকিস্তানের রান উৎসবের শুরু। ২৩ ওভারে ১২৮ রানের দারুণ এক উদ্বোধনী জুটি গড়েন ফখর ও আজহার। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি তো বটেই, আইসিসির কোনো টুর্নামেন্টেই ভারতের বিপক্ষে এটি পাকিস্তানের প্রথম শতরানের জুটি। ২৩তম ওভারের শেষ বলে আজহারের রানআউটে ভাঙে এই জুটি। ৭১ বলে ৫৯ করে আজহার ফিরলেও কোনো সমস্যা হয়নি পাকিস্তানের। দ্বিতীয় উইকেটে বাবর আজমের সঙ্গে ৭২ রানের আরেকটি দারুণ জুটি গড়েন ফখর। ৬০ বলে ফিফটি ছোঁয়া ফখর সেঞ্চুরি তুলে নেন ৯২ বলে। হার্দিক পান্ডিয়ার বলে ক্যাচ তুলে বিদায় নেয়ার আগে ১২টি চার ও তিন ছক্কায় ১০৬ বলে ১১৪ রান করেন ফখর। শোয়েব মালিক (১২) বেশিক্ষণ টিকতে পারেননি। ৫২ বলে ৪৬ করে ৪৩তম ওভারে কেদার যাদবের শিকার হয়ে ফেরেন বাবর আজম। এরপর পঞ্চম উইকেটে মোহাম্মদ হাফিজ ও ইমাদ ওয়াসিমের ৭১ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি এবারের আসরে সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ এনে দেয় পাকিস্তানকে। ৩৭ বলে চার বাউন্ডারি ও তিন ছক্কায় ৫৭ রানে অপরাজিত থাকেন হাফিজ। অন্যপ্রান্তে ইমাদ ২১ বলে করেন অপরাজিত ২৫।
No comments