অর্চি আর কৌশিকিকে আমরা কী বলব? by আনিসুল হক
জয়নাল আবেদীন ও অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মাঝখানে অঞ্জন কুমার দে |
অঞ্জনের
ফোন পেলেই একটা আনন্দের ঢেউ খেলে যায় মনের মধ্যে। কী খবর অঞ্জন? বলতে না
বলতেই ওপার থেকে ভেসে আসছে, আনিস ভাই, অঞ্জন বলছি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান তো সামনের শুক্র-শনিবার। আপনি কখন আসবেন? মতি
ভাই তো দেশের বাইরে, আপনিই আসেন সকালে।
আমি বলি, অঞ্জন, ঠিক আছে। সকালেই আসব। কিন্তু আমি কিন্তু দিনক্ষণ ভুলে যাওয়ার ব্যাপারে চ্যাম্পিয়ন। নির্ঘাত ভুলে যাব। আবার মনে করিয়ে দিতে হবে।
একদম চিন্তা করবেন না আনিস ভাই। আমি আপনাকে আগের রাতে মনে করিয়ে দেব। শুক্রবার সকালেও মনে করিয়ে দেব।
গত বছর অঞ্জন বললেন, আনিস ভাই, সায়ীদ স্যার আর এসইএলের আবদুল আউয়াল স্যার যাচ্ছেন ময়মনসিংহ। জয়নাল আবেদীনের মমতাজ হাসপাতাল দেখতে। আপনি যাবেন?
আমি বললাম, অবশ্যই।
আমরা অনেকেই, সায়ীদ স্যার, আউয়াল স্যার আর অঞ্জনসমেত—একটা সুন্দর মাইক্রোবাসে চড়ে চললাম ময়মনসিংহ। সারাটা দিন অঞ্জনের সঙ্গে সময় কাটল।
অঞ্জন কুমার দে রাঙামাটির ছেলে। ছাত্রজীবন থেকেই সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা সেখানে একটা সাহিত্য সংগঠন তৈরি করেছিলেন। নাম ছিল সপ্তর্ষি। সাংবাদিকতাও করতেন রাঙামাটিতে। রাঙামাটিতে কম্পিউটার মুদ্রণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সেখান থেকেই হয়ে যান রাঙামাটির বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সংগঠক।
তারপর চলে আসেন ঢাকায়। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের ছায়াতলে থাকেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাজ করেন। কত কাজ! আলোর ইশকুল চলছে। বইপড়া কর্মসূচি চলছে। সারা দেশে লাখ লাখ ছেলেমেয়ের কাছে বই পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। তারা পড়ছে, পড়ে আবার মূল্যায়ন পরীক্ষায়ও বসছে। সেখান থেকে হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে আবার জড়ো করা হচ্ছে পুরস্কার দেওয়ার জন্য। পুরস্কার হিসেবেও তারা পাচ্ছে বই। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি যাচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়। চলছে নানা বিষয়ে উৎকর্ষ কার্যক্রম। উচ্চাঙ্গসংগীত কিংবা চলচ্চিত্র অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আছেন। সরকার থেকে আসা উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা আছেন। আর আছেন অঞ্জন দের মতো ব্রতী মানুষেরা।
অঞ্জনের বয়স ৪৭। তাঁর ছোট ছোট দুটো মেয়ে। বড়টা কৌশিকি, ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী। ছোটটা অর্চি। বয়স মোটে চার। অঞ্জনের পরিবার থাকে রাঙামাটিতেই। মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে অঞ্জন ঢাকা থেকে গেলেন রাঙামাটিতে। ফিরলেনও গত শনিবার। তারপর এল মেয়ের ফোন। ক্লাস ওয়ানে পড়া মেয়ের জীবনের প্রথম পরীক্ষা। বাবা, বাড়ি আসো। মেয়ের আবদার কোন বাবা রক্ষা না করে পারবেন? আমাদের অঞ্জন গত মঙ্গলবার রাতে রাঙামাটিগামী বাসে উঠে পড়লেন।
দেশে কোনো হরতাল নেই। অবরোধ নেই। কারও কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। ইউনিক পরিবহনের বাস। রাত ১০টায় ছেড়েছে। যাত্রীরা যাঁর যাঁর মতো করে ঝিমুচ্ছেন, ঘুমাচ্ছেন, কিংবা জেগে জেগে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছেন আলো-আঁধারিতে গাছগাছালির দ্রুত পেছনে ছুটে চলা। শবে বরাতের রাত। জোছনা তার ধবল চাদর বিছিয়ে রেখেছে প্রান্তরজুড়ে। হঠাৎই পেট্রলবোমা। দুটো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল সারা বাসে। অগ্নিদগ্ধ হলেন অনেক যাত্রী। একজন রাঙামাটি সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রঞ্জিত শর্মা। একজন আমাদের অঞ্জন।
অঞ্জনের মেয়ে কি পরীক্ষা দিতে গেছে গতকাল? আগামীকাল যাবে? অঞ্জন এখন শুয়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে। তাঁর শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। মুখমণ্ডলে ব্যান্ডেজ। অঞ্জনকে দেখতে যাইনি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার গেছেন নিউইয়র্কে, মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত বাংলা বইয়ের মেলা করতে। আমার উচিত তাঁকে দেখতে যাওয়া হাসপাতালে।
কিন্তু গিয়ে কী দেখব? সারা মুখ ও শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ ব্যান্ডেজে মোড়া অঞ্জনকে? এই দৃশ্য সহ্য করতে পারব?
চিকিৎসক সামন্তলাল সেন আছেন। তাঁর সঙ্গে আছেন ওই বিভাগের নিরলস চিকিৎসক ও সেবকেরা। একদল লোক একটা করে বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ পোড়াবে, মানুষ মারবে, আর চিকিৎসক সামন্তলাল সেনরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাবেন মানুষগুলোকে বাঁচাতে!একেকটা পরিবার ভেঙে পড়বে। কান্নার রোল পড়বে। পরিবারগুলো এলোমেলো হয়ে যাবে। কৌশিকি আর অর্চিরা অপেক্ষা করবে বাবার সুস্থতার জন্য।
এই যে পেট্রলবোমা ছোড়া যানবাহনে, এটা কী ধরনের কর্মসূচি? কাদের কর্মসূচি? কারা নির্দেশ দেয়? কারা তা বাস্তবায়ন করে? এদের দাবি কী? উদ্দেশ্য কী? কী তারা চরিতার্থ করতে চায়? এটা স্রেফ সন্ত্রাসবাদ। কোনো একটা উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বেসামরিক মানুষের ওপরে নির্বিচারে হামলার নামই সন্ত্রাসবাদ। এটাকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। এটা যদি রাজনৈতিক বিক্ষোভ হতো, তাহলে অবশ্যই বলতাম, ধোঁয়া থাকলে অবশ্যই আগুনও আছে, বিক্ষোভের কারণ দূর করুন। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় কঠোরতা ছাড়া বিকল্প থাকে না। না হলে সন্ত্রাসবাদ প্রশ্রয় পায়।
তবে অবশ্যই বিরোধী দলকে তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশের জন্য পরিসর দিতে হবে, অবকাশ দিতে হবে। শান্তিপূর্ণ মিছিল-সভা-সমাবেশ-ধর্মঘট করার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ কথা আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলব। কথা বলার অধিকার, সমবেত হওয়ার অধিকার গণতন্ত্রের আবশ্যকীয় শর্ত। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতার কোনো অবকাশ নেই। এই ধরনের অমানবিক আক্রমণ রুখতেই হবে, এর পুনরাবৃত্তি রোধ করতে পারতেই হবে।
জানি না কারা এসব করে। পরস্পরকে দোষারোপ করা হয়। আমরা শুধু বলব, মানুষ, তুমি মানবিক হও। মানুষ মারা কোনো রাজনীতি নয়। আহা, আমি ভাবি চার বছরের মেয়ে অর্চির কথা। আমি কল্পনা করি, ক্লাস ওয়ানে পড়া মেয়ে কৌশিকি উৎপলার মনের অবস্থাটা। পৃথিবীতে এমন কোনো দাবি নেই, যা অর্জন করার জন্য মানুষের প্রাণ হরণ করা যেতে পারে।
আজকের দিনে সন্ত্রাসবাদ কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্যই অর্জন করতে পারবে না। পৃথিবীর কোথাও সন্ত্রাসবাদীরা সফল হয়নি। আর রাজনৈতিক দাবি আদায় করার জন্য লাগে দূরদর্শিতা, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারার ক্ষমতা আর কর্মসূচি এবং আত্মত্যাগী নেতৃত্ব। নেতারা নিজেরা কষ্ট করবেন, স্বার্থ ত্যাগ করবেন, জুলুম সহ্য করবেন, তাঁরা জনগণকে কষ্ট দেবেন না, জনগণকে জিম্মি করবেন না, নিজেরা ত্যাগ স্বীকার করবেন। নেলসন ম্যান্ডেলা তা-ই করেছেন, মহাত্মা গান্ধী তা-ই করেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তা-ই করেছেন। নিজেরা কষ্ট করেছেন, কারাবাস করেছেন, অনশন করেছেন। জনগণের মাথায় বোমা ছোড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।
প্রার্থনা করি, অঞ্জন সুস্থ হয়ে উঠুন। প্রার্থনা করি, আর যাঁরা যাঁরা অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন গত মঙ্গলবার রাতে, তাঁদের সবাই সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন। অঞ্জন, আমরা আবার যাব বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে। রমনা পার্কের সবুজ প্রান্তরজুড়ে বসে রইবে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। তারা একে একে উঠে আসবে মঞ্চে। বইয়ের বান্ডেল তুলে দেওয়া হবে তাদের প্রত্যেকের হাতে। তাদের কলকাকলিতে সচকিত হয়ে উঠবে রমনার গাছগাছালি-পাখপাখালি। আপনি বারবার আসবেন মঞ্চে। বলবেন, আনিস ভাই, এর পরেরবার আপনার পালা। আপনি তুলে দেবেন ওদের হাতে বই। আমি বলব, ঠিক আছে ঠিক আছে। কোনো অসুবিধা নেই।
কিংবা আমরা আবার উঠব কোনো মাইক্রোবাসে। দেশের কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো জয়নাল আবেদীন হাসপাতাল বানাচ্ছেন, বা চালাচ্ছেন ইশকুল। কেউবা পরিবেশ রক্ষার জন্য, নদী রক্ষার জন্য আন্দোলন করছেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ছুটে যাচ্ছেন সেসব জায়গায়। সঙ্গে আছেন আপনি।
আলোকিত মানুষ চাই—বলেন সায়ীদ স্যার। একটা মোমবাতি থেকে এক শ মোমবাতি প্রজ্বালন করা যায়। এক শ মোমবাতি থেকে আলো জ্বলে উঠবে হাজার মোমবাতিতে। আমাদের কিশোর-তরুণেরা বই পড়ছে, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে, হয়ে উঠছে আলোকিত হৃদয়ের মানুষ। তাদের হৃদয়ের আলোয় আলো জ্বলে উঠবে কোটি কোটি মানুষের মনের সলতেতে। চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই আলোয় ঝলমল করছে পুরো বাংলাদেশ। মানুষের হৃদয়ের আলোয় নক্ষত্রশোভিত আকাশের মতো হয়ে আছে প্রিয় স্বদেশভূমি।
আপনি, অঞ্জন, সেই স্বপ্ন নিয়ে কাজ করে চলেছেন। পশুতুল্য ওই লোকগুলো আপনার বাসে ছুড়েছে পেট্রলবোমা। আপনি আর আপনার মতো কত মানুষ এই অযৌক্তিক নৃশংস অমানবিক আক্রমণের শিকার। যে কেউ যেকোনো মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারে, কেউ নিরাপদ নয় এদের হাত থেকে, সেই ভয়াবহ বার্তাটা আবার পাওয়া গেল!
কী বলব! পরম করুণাময়ের কাছে আকুতি জানাই, এদের সুমতি দাও। আর একটা মানুষও যেন এ ধরনের আক্রমণে দগ্ধ না হয়!
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
আমি বলি, অঞ্জন, ঠিক আছে। সকালেই আসব। কিন্তু আমি কিন্তু দিনক্ষণ ভুলে যাওয়ার ব্যাপারে চ্যাম্পিয়ন। নির্ঘাত ভুলে যাব। আবার মনে করিয়ে দিতে হবে।
একদম চিন্তা করবেন না আনিস ভাই। আমি আপনাকে আগের রাতে মনে করিয়ে দেব। শুক্রবার সকালেও মনে করিয়ে দেব।
গত বছর অঞ্জন বললেন, আনিস ভাই, সায়ীদ স্যার আর এসইএলের আবদুল আউয়াল স্যার যাচ্ছেন ময়মনসিংহ। জয়নাল আবেদীনের মমতাজ হাসপাতাল দেখতে। আপনি যাবেন?
আমি বললাম, অবশ্যই।
আমরা অনেকেই, সায়ীদ স্যার, আউয়াল স্যার আর অঞ্জনসমেত—একটা সুন্দর মাইক্রোবাসে চড়ে চললাম ময়মনসিংহ। সারাটা দিন অঞ্জনের সঙ্গে সময় কাটল।
অঞ্জন কুমার দে রাঙামাটির ছেলে। ছাত্রজীবন থেকেই সংস্কৃতিচর্চার সঙ্গে যুক্ত। তাঁরা সেখানে একটা সাহিত্য সংগঠন তৈরি করেছিলেন। নাম ছিল সপ্তর্ষি। সাংবাদিকতাও করতেন রাঙামাটিতে। রাঙামাটিতে কম্পিউটার মুদ্রণের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। সেখান থেকেই হয়ে যান রাঙামাটির বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সংগঠক।
তারপর চলে আসেন ঢাকায়। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের ছায়াতলে থাকেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের কাজ করেন। কত কাজ! আলোর ইশকুল চলছে। বইপড়া কর্মসূচি চলছে। সারা দেশে লাখ লাখ ছেলেমেয়ের কাছে বই পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। তারা পড়ছে, পড়ে আবার মূল্যায়ন পরীক্ষায়ও বসছে। সেখান থেকে হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে আবার জড়ো করা হচ্ছে পুরস্কার দেওয়ার জন্য। পুরস্কার হিসেবেও তারা পাচ্ছে বই। ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি যাচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়। চলছে নানা বিষয়ে উৎকর্ষ কার্যক্রম। উচ্চাঙ্গসংগীত কিংবা চলচ্চিত্র অ্যাপ্রিসিয়েশন কোর্স। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার আছেন। সরকার থেকে আসা উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা আছেন। আর আছেন অঞ্জন দের মতো ব্রতী মানুষেরা।
অঞ্জনের বয়স ৪৭। তাঁর ছোট ছোট দুটো মেয়ে। বড়টা কৌশিকি, ক্লাস ওয়ানের ছাত্রী। ছোটটা অর্চি। বয়স মোটে চার। অঞ্জনের পরিবার থাকে রাঙামাটিতেই। মায়ের অসুস্থতার খবর শুনে অঞ্জন ঢাকা থেকে গেলেন রাঙামাটিতে। ফিরলেনও গত শনিবার। তারপর এল মেয়ের ফোন। ক্লাস ওয়ানে পড়া মেয়ের জীবনের প্রথম পরীক্ষা। বাবা, বাড়ি আসো। মেয়ের আবদার কোন বাবা রক্ষা না করে পারবেন? আমাদের অঞ্জন গত মঙ্গলবার রাতে রাঙামাটিগামী বাসে উঠে পড়লেন।
দেশে কোনো হরতাল নেই। অবরোধ নেই। কারও কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি নেই। ইউনিক পরিবহনের বাস। রাত ১০টায় ছেড়েছে। যাত্রীরা যাঁর যাঁর মতো করে ঝিমুচ্ছেন, ঘুমাচ্ছেন, কিংবা জেগে জেগে জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখছেন আলো-আঁধারিতে গাছগাছালির দ্রুত পেছনে ছুটে চলা। শবে বরাতের রাত। জোছনা তার ধবল চাদর বিছিয়ে রেখেছে প্রান্তরজুড়ে। হঠাৎই পেট্রলবোমা। দুটো। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ল সারা বাসে। অগ্নিদগ্ধ হলেন অনেক যাত্রী। একজন রাঙামাটি সরকারি কলেজের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক রঞ্জিত শর্মা। একজন আমাদের অঞ্জন।
অঞ্জনের মেয়ে কি পরীক্ষা দিতে গেছে গতকাল? আগামীকাল যাবে? অঞ্জন এখন শুয়ে আছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে। তাঁর শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। মুখমণ্ডলে ব্যান্ডেজ। অঞ্জনকে দেখতে যাইনি। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার গেছেন নিউইয়র্কে, মুক্তধারা ফাউন্ডেশন আয়োজিত বাংলা বইয়ের মেলা করতে। আমার উচিত তাঁকে দেখতে যাওয়া হাসপাতালে।
কিন্তু গিয়ে কী দেখব? সারা মুখ ও শরীরের ঊর্ধ্বাঙ্গ ব্যান্ডেজে মোড়া অঞ্জনকে? এই দৃশ্য সহ্য করতে পারব?
চিকিৎসক সামন্তলাল সেন আছেন। তাঁর সঙ্গে আছেন ওই বিভাগের নিরলস চিকিৎসক ও সেবকেরা। একদল লোক একটা করে বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ পোড়াবে, মানুষ মারবে, আর চিকিৎসক সামন্তলাল সেনরা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাবেন মানুষগুলোকে বাঁচাতে!একেকটা পরিবার ভেঙে পড়বে। কান্নার রোল পড়বে। পরিবারগুলো এলোমেলো হয়ে যাবে। কৌশিকি আর অর্চিরা অপেক্ষা করবে বাবার সুস্থতার জন্য।
এই যে পেট্রলবোমা ছোড়া যানবাহনে, এটা কী ধরনের কর্মসূচি? কাদের কর্মসূচি? কারা নির্দেশ দেয়? কারা তা বাস্তবায়ন করে? এদের দাবি কী? উদ্দেশ্য কী? কী তারা চরিতার্থ করতে চায়? এটা স্রেফ সন্ত্রাসবাদ। কোনো একটা উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য বেসামরিক মানুষের ওপরে নির্বিচারে হামলার নামই সন্ত্রাসবাদ। এটাকে কঠোরভাবে দমন করতে হবে। এটা যদি রাজনৈতিক বিক্ষোভ হতো, তাহলে অবশ্যই বলতাম, ধোঁয়া থাকলে অবশ্যই আগুনও আছে, বিক্ষোভের কারণ দূর করুন। কিন্তু সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলায় কঠোরতা ছাড়া বিকল্প থাকে না। না হলে সন্ত্রাসবাদ প্রশ্রয় পায়।
তবে অবশ্যই বিরোধী দলকে তাদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশের জন্য পরিসর দিতে হবে, অবকাশ দিতে হবে। শান্তিপূর্ণ মিছিল-সভা-সমাবেশ-ধর্মঘট করার সাংবিধানিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। এ কথা আমরা আগেও বলেছি, এখনো বলব। কথা বলার অধিকার, সমবেত হওয়ার অধিকার গণতন্ত্রের আবশ্যকীয় শর্ত। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় সরকারের ব্যর্থতার কোনো অবকাশ নেই। এই ধরনের অমানবিক আক্রমণ রুখতেই হবে, এর পুনরাবৃত্তি রোধ করতে পারতেই হবে।
জানি না কারা এসব করে। পরস্পরকে দোষারোপ করা হয়। আমরা শুধু বলব, মানুষ, তুমি মানবিক হও। মানুষ মারা কোনো রাজনীতি নয়। আহা, আমি ভাবি চার বছরের মেয়ে অর্চির কথা। আমি কল্পনা করি, ক্লাস ওয়ানে পড়া মেয়ে কৌশিকি উৎপলার মনের অবস্থাটা। পৃথিবীতে এমন কোনো দাবি নেই, যা অর্জন করার জন্য মানুষের প্রাণ হরণ করা যেতে পারে।
আজকের দিনে সন্ত্রাসবাদ কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্যই অর্জন করতে পারবে না। পৃথিবীর কোথাও সন্ত্রাসবাদীরা সফল হয়নি। আর রাজনৈতিক দাবি আদায় করার জন্য লাগে দূরদর্শিতা, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে পারার ক্ষমতা আর কর্মসূচি এবং আত্মত্যাগী নেতৃত্ব। নেতারা নিজেরা কষ্ট করবেন, স্বার্থ ত্যাগ করবেন, জুলুম সহ্য করবেন, তাঁরা জনগণকে কষ্ট দেবেন না, জনগণকে জিম্মি করবেন না, নিজেরা ত্যাগ স্বীকার করবেন। নেলসন ম্যান্ডেলা তা-ই করেছেন, মহাত্মা গান্ধী তা-ই করেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও তা-ই করেছেন। নিজেরা কষ্ট করেছেন, কারাবাস করেছেন, অনশন করেছেন। জনগণের মাথায় বোমা ছোড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না।
প্রার্থনা করি, অঞ্জন সুস্থ হয়ে উঠুন। প্রার্থনা করি, আর যাঁরা যাঁরা অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন গত মঙ্গলবার রাতে, তাঁদের সবাই সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসুন। অঞ্জন, আমরা আবার যাব বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের অনুষ্ঠানে। রমনা পার্কের সবুজ প্রান্তরজুড়ে বসে রইবে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। তারা একে একে উঠে আসবে মঞ্চে। বইয়ের বান্ডেল তুলে দেওয়া হবে তাদের প্রত্যেকের হাতে। তাদের কলকাকলিতে সচকিত হয়ে উঠবে রমনার গাছগাছালি-পাখপাখালি। আপনি বারবার আসবেন মঞ্চে। বলবেন, আনিস ভাই, এর পরেরবার আপনার পালা। আপনি তুলে দেবেন ওদের হাতে বই। আমি বলব, ঠিক আছে ঠিক আছে। কোনো অসুবিধা নেই।
কিংবা আমরা আবার উঠব কোনো মাইক্রোবাসে। দেশের কোথাও না কোথাও কোনো না কোনো জয়নাল আবেদীন হাসপাতাল বানাচ্ছেন, বা চালাচ্ছেন ইশকুল। কেউবা পরিবেশ রক্ষার জন্য, নদী রক্ষার জন্য আন্দোলন করছেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ছুটে যাচ্ছেন সেসব জায়গায়। সঙ্গে আছেন আপনি।
আলোকিত মানুষ চাই—বলেন সায়ীদ স্যার। একটা মোমবাতি থেকে এক শ মোমবাতি প্রজ্বালন করা যায়। এক শ মোমবাতি থেকে আলো জ্বলে উঠবে হাজার মোমবাতিতে। আমাদের কিশোর-তরুণেরা বই পড়ছে, সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছে, হয়ে উঠছে আলোকিত হৃদয়ের মানুষ। তাদের হৃদয়ের আলোয় আলো জ্বলে উঠবে কোটি কোটি মানুষের মনের সলতেতে। চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই আলোয় ঝলমল করছে পুরো বাংলাদেশ। মানুষের হৃদয়ের আলোয় নক্ষত্রশোভিত আকাশের মতো হয়ে আছে প্রিয় স্বদেশভূমি।
আপনি, অঞ্জন, সেই স্বপ্ন নিয়ে কাজ করে চলেছেন। পশুতুল্য ওই লোকগুলো আপনার বাসে ছুড়েছে পেট্রলবোমা। আপনি আর আপনার মতো কত মানুষ এই অযৌক্তিক নৃশংস অমানবিক আক্রমণের শিকার। যে কেউ যেকোনো মুহূর্তে আক্রান্ত হতে পারে, কেউ নিরাপদ নয় এদের হাত থেকে, সেই ভয়াবহ বার্তাটা আবার পাওয়া গেল!
কী বলব! পরম করুণাময়ের কাছে আকুতি জানাই, এদের সুমতি দাও। আর একটা মানুষও যেন এ ধরনের আক্রমণে দগ্ধ না হয়!
আনিসুল হক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।
No comments