গম কেলেঙ্কারির হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে
ব্রাজিল থেকে দুই লাখ টন পচা গম আমদানির দায়ে খাদ্য অধিদপ্তরের গম আমদানিকালীন মহাপরিচালক (ডিজি) মো. সারওয়ার খানকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়েছে। প্রায় ৪২৬ কোটি টাকার গম কেলেঙ্কারি হলেও প্রশাসনিক ব্যবস্থা বলতে এটুকুই। এখনও পর্যন্ত এ গম আমদানি প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত পরিচালক (সংগ্রহ) সহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। গম কেলেঙ্কারি খতিয়ে দেখতে গঠিত হয়নি উচ্চ পর্যায়ের কোন তদন্ত কমিটি। গম সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ইমপেক্স কনসালট্যান্টস ও ওলাম ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। সব মিলিয়ে ব্রাজিল থেকে পচা গম আমদানির হোতারা এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দেয়ার পর এখন চলছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের অধীনে গমের স্যাম্পল সংগ্রহের কাজ। খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, ব্রাজিল থেকে আমদানি করা নিম্নমানের গমের নমুনা সারা দেশ থেকে রাজধানীতে আসছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনার ভিত্তিতে খাদ্য বিভাগ চিঠি দেয়ার পর জেলার নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা এসব নমুনা পাঠাচ্ছেন। এসব নমুনা পরীক্ষা নিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় লুকোচুরির আশ্রয় নিয়ে চলেছে। নমুনা আদতে কোথায় পরীক্ষা করা হবে এনিয়ে অন্ধকারে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। গতকাল পর্যন্ত ৩৩ জেলা থেকে ১৬১ প্যাকেট নমুনা পাঠিয়েছেন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরা। বর্তমানে দেশের ৫২ জেলায় ব্রাজিলের এই নিম্নমানের গম মজুত রয়েছে। এর মধ্যে ৩৫ হাজার টন বিতরণও করা হয়েছে। এদিকে নিম্নমানের এ গম নিয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী উষ্মা প্রকাশ করলেও খাদ্য মন্ত্রণালয় অনেকটা নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গম নিয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ কর্মকর্তাদের বক্তব্য, ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গম নিয়ে যত কথা হচ্ছে, তার সবই অনুমানভিত্তিক। সঠিক পরীক্ষা ছাড়া কেউ এ বিষয়ে কোন কথা বলতে পারে না। কারণ খাদ্য অধিদপ্তরের পরীক্ষায় জানা গেছে, ব্রাজিল থেকে আমদানি করা গম লাল, ছোট ও দেখতে খারাপ হলেও খাওয়ার অনুপযোগী নয়। দুবারের পরীক্ষায়ও এ গমে কোন সমস্যা পাওয়া যায়নি। খাদ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই প্রথম ব্রাজিল থেকে গম আমদানি করা হয়েছে। অতীতে ভারত, বুলগেরিয়া, রাশিয়া ও ইউক্রেনসহ কয়েকটি দেশ থেকে গম আমদানি করলেও ওই সব গমের বিষয়ে কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। এবারই প্রথম বড় মাপের গম আমদানি সম্পর্কে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এদিকে পুলিশ, আনসার-ভিডিপি, কোস্টগার্ড ও সেনাবাহিনী এবং ওএমএস ও কাবিখা’র মাধ্যমে গম গছাতে ব্যর্থ হয়েছে খাদ্য অধিদপ্তর। এখন ওএমএসের মাধ্যমে এসব গম আটা করে বিক্রি করার তৎপরতা চলছে। তবে ব্রাজিল থেকে আমদানি করা পচা গম এখন কেউই নিতে চাইছে না। কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ গমের আকার সরু। স্থানীয়ভাবে জিরা নামে পরিচিত। এই গম ব্রাজিলে সাধারণত পশুখাদ্য হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গন্ধযুক্ত বলে ওএমএস ডিলাররা ওই গম থেকে উৎপাদিত আটা নিচ্ছেন না। ফলে বিভিন্ন এলাকায় ১৫ দিন ধরে ওএমএসের মাধ্যমে আটা বিক্রি পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, খাদ্য বিভাগের সাবেক মহাপরিচালক মো. সারওয়ার খানের নির্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরে ব্রাজিল থেকে আনা প্রথম দফার গম বুঝে নেয়া হয়। এ সংক্রান্ত ফাইলের নোটে তিনি অনেক কাটাছেঁড়া করেন। দ্বিতীয় দফায় পাঠানো গমের মধ্যে ৫২ হাজার টন গম বন্দরে দুই সপ্তাহ ধরে জাহাজে পড়ে আছে। এসব গম নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর সরকারের উচ্চ পর্যায়ের হস্তক্ষেপ আমলে নিচ্ছে না খাদ্য অধিদপ্তর। আমদানিকারক ইমপেক্স ও ওলাম ইন্টারন্যাশনালকে নষ্ট গম ফেরত নিতে বলেছে খাদ্য অধিদপ্তর। খাদ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মহাজোট সরকারের গেল মেয়াদে গম আমদানি নিয়ে কোন ঝামেলা তৈরি হয়নি। এ আমলের শুরু থেকেই গম আমদানি নিয়ে ব্যবসায় নামে একটি শক্তিশালী চক্র। গত বছরের ২০শে মার্চের পর খাদ্য বিভাগ গম আমদানি নিয়ে কোন আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান না করে ১৯শে সেপ্টেম্বর ইউক্রেনের সঙ্গে জি-টু-জির ভিত্তিতে গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ইউক্রেনের প্রতি টন গমের দর নির্ধারণ করা হয় ২৯৭ ডলার। অথচ তখন বিশ্বে গমের দাম ছিল অনেক কম। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের খাদ্য পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) প্রকাশিত প্রতিবেদনে ইউক্রেনের চলতি এফওবি মূল্য দেখানো হয় ২৩৭ মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে টনপ্রতি সম্ভাব্য জাহাজ ভাড়া ৫০ মার্কিন ডলার দেখিয়ে বাংলাদেশের বন্দরে পৌঁছানোর সম্ভাব্য খরচ দেখানো হয়েছে ২৮৭ মার্কিন ডলার। এরপর অদৃশ্য কারণে ইউক্রেন থেকে গম আমদানির বিষয়টি ভেস্তে যায়। ফলে গম সংকট দেখা দিলে খাদ্য মন্ত্রণালয় তড়িঘড়ি করে ব্রাজিল থেকে গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। ওই গম নিয়েই এখন সারা দেশে তোলপাড় চলছে। খাদ্য মন্ত্রণালয় যদিও বিষয়টি নিয়ে খুব একটা পাত্তা দিচ্ছে না।
No comments