অমর্ত্য সেন অন্ধকারের মধ্যে আশার আলো ছড়াতে পারতেন by মইনুল হোসেন
আলোচনা না করলে কিছু বদলানো সম্ভব নয়: অমর্ত্য সেন |
নোবেল
পুরস্কার বিজয়ী প্রফেসর অমর্ত্য সেনের বাংলাদেশ সফরে আসা বাংলাদেশের জন্য
বিরাট সম্মানের বিষয়। তার সাম্প্রতিক সফরটি এমন সময়ে হল যখন বাংলাদেশ
বিপথগামী রাজনৈতিক নেতৃত্বের কারণে গৃহযুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলেছে। এ সময়ে
জনগণের উদ্দেশে চিন্তাবিদ হিসেবে যিনি কিছু বলবেন তিনি যে-ই হোন না কেন,
তিনি তো অন্ধকারের মধ্যে কিছু আশার আলো ছড়াবেন।
গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর তার পর্যবেক্ষণ যতই গভীর হোক না কেন, তা এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যা বিভিন্নজন তাদের স্বার্থের অনুকূলে ব্যাখ্যা করতে পারে। মহলবিশেষ তার বরাত দিয়ে বলতে পারে, যেমনটি তারা আগে থেকেই বলে আসছে যে, ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যতিরেকেও গণতন্ত্র হতে পারে। অন্যরা ভিন্নভাবেও ব্যাখ্যা করতে পারে। একটি বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক তার বক্তৃতা এ শিরোনাম দিয়ে ছেপেছে, ব্যক্তিস্বাধীনতার বিনিময়ে গণতন্ত্র নয়। এ শিরোনাম বলে দিচ্ছে কেমন করে বক্তব্যের তত্ত্বগত অর্থ যাই হোক না কেন সহজ অর্থে ভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে। গণতন্ত্র চাই কিন্তু ব্যক্তিস্বাধীনতা বাদ দিয়ে নয়। যেন ব্যক্তিস্বাধীনতা ছাড়াও গণতন্ত্র হতে পারে।
আমাদের দেশে বিদ্যমান পটভূমিতে অধ্যাপক সেনের গণতন্ত্র সম্পর্কিত অভিমত বিশেষ তাৎপর্য বহন না করে পারে না, যখন বাংলাদেশ গণতন্ত্রের জন্য সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ সংকট মোকাবেলা করছে। আর যেটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একেবারেই অবিশ্বাস্য, তা হল এ সংকটের উদ্ভব ঘটেছে নতুন করে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে, যার প্রতিশ্র“তি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার সমর্থকরা সেই প্রতিশ্র“তি ভুলে থাকার সব রকম কৌশল গ্রহণ করছেন। ব্যক্তিস্বাধীনতা যেখানে সুরক্ষিত নয়, সেখানে গণতন্ত্র থাকার প্রশ্ন ওঠে না। গণতন্ত্রের প্রয়োজন হয় সবার ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার জন্য।
নির্বাচনী ইস্যু নিয়ে সরকারের দুঃসহনীয় নিবর্তনমূলক আচরণ দেশকে এক জীবনবিধ্বংসী সংঘাতে ঠেলে দিয়েছে। আর সেই সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে পুলিশি শক্তির সঙ্গে রাস্তার শক্তি। পরিস্থিতির বিশেষ আতংকের দিক হচ্ছে, সরকারের কোন এজেন্সি কার কর্তৃত্বে কি করছে তা জানার উপায় নেই। কে কখন কীভাবে কার হাতে গুম হবে বা মৃৃত্যুবরণ করবে তার কারণ দর্শানোর কেউ নেই। চলছে শুধু গ্রেফতার আর গ্রেফতার।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে আইন প্রয়োগ করার সময় আত্মবিশ্বাস ও পেশাদারিত্বের স্বাক্ষর রাখতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের লুকোচুরির আশ্রয় নেয়া যাবে না। আইনসম্মতভাবে যদি কাউকে গ্রেফতার করতে হয় তবে পুলিশের উচিত হবে এ ব্যাপারে কোনো রকম অনিশ্চয়তার আতংক সৃষ্টি না করা।
দেশে যখন হিংসার রাজনীতি চলে, হরদম ধরপাকড় হতে থাকে, কে কখন কীভাবে নিখোঁজ হবে তা যে-কারও জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে পড়ে, তখন পুলিশের গ্রেফতার এবং দুষ্কৃতকারীদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নিশ্চিত করা বাঞ্ছনীয়। কাউকে গ্রেফতার করা হলে স্থানীয় পুলিশকে অবশ্যই বিষয়টি জানাতে হবে এবং মধ্যরাতে দরজায় কড়ানাড়া পরিহার করতে হবে। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পুলিশের দ্বারা হতে পারে না। পরাধীন ব্রিটিশ আমলেও গভীর রাতে কাউকে গ্রেফতার করা হতো না। স্বাধীন দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেই দায়িত্ব ও দেশপ্রেম বেশি থাকতে হয়। তারা অনেকের চেয়ে বেশি শিক্ষিত এবং তাদের মধ্যে সচেতনতাও বেশি থাকার কথা। পুলিশ এমনভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করতে পারে না, যাতে আইনভঙ্গকারীরা নির্ভয়ে সাধারণ পোশাকে পুলিশ সাজার সুযোগ নিতে পারে। নিজেদের অপরাধগুলো পুলিশের কাঁধে চাপাতে পারে।
প্রফেসর সেনকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন পত্রিকায় বলা হয়েছে : গণতন্ত্রের জন্য ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করতে হবে সেটা আমি বিশ্বাস করি না। গণতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিস্বাধীনতা সংকুচিত করার ওপর জোর দিতে গিয়ে তার বক্তব্যে এমন ধারণা সৃষ্টি হওয়া অমূলক নয় যে, সরকার গণতন্ত্র রক্ষা করার ব্যাপারে আগ্রহী। অথচ ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা গণতন্ত্র নয়। সরকার গণতন্ত্র রক্ষার জন্য মাথা ঘামাচ্ছে এটা মোটেই বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র নয়। সরকারকে বিপরীত পথেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গণতন্ত্র রক্ষা পাবে কিনা এটাই মূল সংকট। গণতন্ত্রের জন্য এদেশের জনগণ যে সংগ্রাম করেছে, যুদ্ধ করেছে এটাই যেন মিথ্যা প্রমাণিত হতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে এমন এক অসহায় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে মনে হয় না ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব পালনে সরকারের কোনো সদিচ্ছা আছে। রাজনৈতিকভাবে কারও কোনো ভিন্ন মতই সরকারের কাছে গ্রহণীয় হচ্ছে না। ভিন্ন মত পোষণকারীকে দেশ ও জাতির শত্র“ হিসেবে দেখতে পারলেই যেন সরকার সফল হবে। ভেবে দেখা হচ্ছে না, যুক্তিবাদী রাজনীতি বিসর্জন দেয়ার পরিণতিই হল সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি। তাই পরিষ্কার ভাষায় খোলাখুলিভাবেই মুক্তচিন্তার পণ্ডিতদের সঠিক কথাটি বলতে হবে। ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষাই গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রই ব্যক্তিস্বাধীনতা।
সংলাপ নয়, নির্বাচন নয়, এরকম অবস্থা আর যাই হোক কোনো গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য নয়। নোবেল বিজয়ী সেন ঠিকই বলেছেন, গণতন্ত্রের বিভিন্ন দিক আছে। এ বক্তব্যের দ্বারা তিনি নিশ্চয়ই এটা বোঝাতে চান নাই যে, গণতন্ত্রের কোনো কোনো দিককে বাদ দিয়েও গণতন্ত্র চলতে পারে। অথচ এরূপ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেয়ার জন্য সরকারের আশপাশে অনেকেই আছেন। তারা প্রধানমন্ত্রীকে বোঝাবেন যে, গণতন্ত্রের সবদিকই অর্থাৎ সংলাপের রাজনীতি বা জনগণের নির্বাচন মানতে হবে, এমনটি নয়।
এখন গোটা ঢাকা মহানগরীতে একজন আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যের পোস্টার শোভা পাচ্ছে। পোস্টারটির ওপর প্রফেসর সেনের নজর পড়েছে কিনা আমরা নিশ্চিত নই। এই পোস্টারে বলিষ্ঠভাবে এবং উচ্চস্বরে বলা হয়েছে, আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র। এ ধরনের চিন্তাভাবনা কেবল কোনো একজন আওয়ামী লীগ নেতার নয়, সংসদেও এ ধরনের রাজনৈতিক থিওরি পেশ করা হয়েছে। বর্তমান সরকারে এমন কিছু প্রভাবশালী লোক আছেন যারা গণতন্ত্রের নাম নিশানা রক্ষায় একদম বিশ্বাসী নন।
কিন্তু সত্যিকারের উন্নয়ন এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রগতি কোনো দেশ অর্জন করতে পারে না যদি সেই দেশের সরকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এড়াতে নির্বাচনকে ভয় পায়। অর্থনীতিবিদ প্রফেসর সেন এটা ভালো জানেন যে, সত্যিকারের উন্নয়ন সাজানো অংকের হিসাবে পরিমাপ করা যায় না। সেটা পরিমাপ করতে হয় জনগণের সুখ-শান্তি ও জীবনমানের গড় উন্নতির নিরিখে। আর সেই জীবনমানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জীবনের মৌলিক নিরাপত্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। পুলিশি তৎপরতার মাধ্যমে জনমনে নিরাপত্তাহীনতার আতংক সৃষ্টি কোনো দায়িত্বশীল উন্নয়নকামী সরকারের কাজ হতে পারে না। সন্ত্রাস দমনের নামে সরকার কীভাবে সন্ত্রাসী তৎপরতায় মদদ জুগিয়েছে তা তো যে কারও কাছে এখন পরিষ্কার।
প্রফেসর সেনের বক্তব্যে উন্নয়নের জন্য অধিকতর শক্তিশালী সরকারের প্রসঙ্গ এসেছে। সে বিষয়টিও সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করে দেখা দরকার- যাতে সরকার এর ভুল ব্যাখ্যা করতে না পারে।
কোনো সরকার পুলিশি শক্তির ওপর নির্ভর করে শক্তিশালী হতে পারে না। জনগণের দৃঢ় সমর্থনপুষ্ট হলেই সরকার শক্তিশালী হতে পারে।
বর্তমান সরকার যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হতে পারেনি এটাই এ সরকারের বড় দুর্বলতা। এখন যদি বলা হয় উন্নয়নের জন্য এ সরকারকে অধিকতর শক্তিশালী হতে হবে তাহলে এটাই বোঝানো হবে যে, গণতান্ত্রিকভাবে উন্মুক্ত ও জবাবদিহিমূলক সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য উপযোগী নয়।
গণতন্ত্র হত্যাকারী সব একনায়কই দেশের উন্নয়নের জন্য শক্তিশালী সরকারের অজুহাত দেখিয়ে থাকেন। যেহেতু একনায়কত্ববাদী সরকার হচ্ছে ভয়ভীতির সরকার, ব্যক্তিস্বাধীনতার সরকার নয়, তাই ডিক্টেটররা যা বলে তাকে সত্য বলে স্বীকার করার বাধ্যবাধকতা থাকে। আর এটাও অজানা নয় যে, একনায়করা টিকে থাকে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে। উন্নয়নের গালভরা কথা তাদের শোনাতে হয়।
এটাও সর্বজনীন সত্য যে, যেখানে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার হাত ধরাধরি করে চলে এবং বিরোধী মতকে স্তব্ধ করে দেয়া হয় সেখানে ন্যায়ভিত্তিক উন্নয়ন হতে পারে না। যুদ্ধের মতো একনায়কত্ববাদী শাসনেও প্রথম বলি হয় সত্য।
দেশকে চরম নৈরাজ্য এবং ধ্বংসস্তূপের মধ্যে রেখেই তাদের বিদায় নিতে হয়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের অবস্থা দেখলেই বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হবে। দেশ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, জনজীবনে নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। প্রাণে বাঁচার জন্য লাখ লাখ লোককে সবকিছু ছেড়ে বিদেশে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। চারদিক দিয়ে বিদেশী অস্ত্রধারীরা দেশে ঢুকছে। তবুও তিনি ক্ষমতা ছাড়ার কথা ভাবতে পারছেন না। ক্ষমতা পাগলরা প্রশ্রয় পেলে যা হয় তার সেটাই হয়েছে।
নোবেল বিজয়ী পণ্ডিতের রাজনৈতিক বক্তব্যে নানা ধরনের অস্পষ্টতা থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা থাকায় তার বিভিন্ন গভীর চিন্তামূলক মন্তব্য কতটা সঠিকভাবে গ্রহণ করা হবে এবং আমাদের চিন্তাভাবনায় কতটা কল্যাণধর্মী প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে সন্দেহ থাকার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
বাংলাদেশের এমন সময় তিনি আমাদের গণতন্ত্র ও অর্থনীতি নিয়ে মতামত প্রকাশ করেছেন যখন গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার পথে এবং অর্থনীতিও বিপর্যস্ত। দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তা তো ব্যবসায়ী সমাজসহ আমাদের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরাই বলছেন। অথচ বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে প্রফেসর সেনের কাছ থেকে শুনতে হল প্রশংসার পর প্রশংসা।
বর্তমানে আমরা যে ধরনের সর্বনাশা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছি, জনগণ যেখানে আতংক এবং নিরাপত্তাহীতার মধ্যে কাল কাটাচ্ছে, সেখানে প্রফেসর সেনের উপস্থিতি সরকার ও দেশবাসীর জন্য প্রভূত সুফলদায়ক হতে পারত, যদি তিনি বাংলাদেশের একজন সুহৃদ হিসেবে অধিকতর বাস্তবধর্মী বক্তব্য রাখতে পারতেন। বাংলাদেশের মানুষতো তাকে একজন আপনজন হিসেবে গ্রহণ করতে বা তার প্রতি প্রাণঢালা শ্রদ্ধা জানাতে কখনও এতটুকু কার্পণ্য করেনি।
আমরা জানি, আমাদের যে-ই যত কথা বলি না কেন, আমাদের বৃত্তবন্দি দলীয় রাজনীতিকে মুক্ত করতে না পারলে গণতন্ত্রকে নিরাপদ আশ্রয় দেয়া যাবে না। জাতির চরম সংকটের সময় জনগণ তাদের শুভাকাক্সক্ষীদের পাশে দেখতে চায়। সহজভাবে সহজ কথাটি বলতে হবে : নির্বাচন দিতে হবে। দেশের ভালো-মন্দের ব্যাপারে জনগণের রায় মানতে হবে।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
গণতন্ত্র ও ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর তার পর্যবেক্ষণ যতই গভীর হোক না কেন, তা এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে যা বিভিন্নজন তাদের স্বার্থের অনুকূলে ব্যাখ্যা করতে পারে। মহলবিশেষ তার বরাত দিয়ে বলতে পারে, যেমনটি তারা আগে থেকেই বলে আসছে যে, ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যতিরেকেও গণতন্ত্র হতে পারে। অন্যরা ভিন্নভাবেও ব্যাখ্যা করতে পারে। একটি বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক তার বক্তৃতা এ শিরোনাম দিয়ে ছেপেছে, ব্যক্তিস্বাধীনতার বিনিময়ে গণতন্ত্র নয়। এ শিরোনাম বলে দিচ্ছে কেমন করে বক্তব্যের তত্ত্বগত অর্থ যাই হোক না কেন সহজ অর্থে ভিন্ন ব্যাখ্যা হতে পারে। গণতন্ত্র চাই কিন্তু ব্যক্তিস্বাধীনতা বাদ দিয়ে নয়। যেন ব্যক্তিস্বাধীনতা ছাড়াও গণতন্ত্র হতে পারে।
আমাদের দেশে বিদ্যমান পটভূমিতে অধ্যাপক সেনের গণতন্ত্র সম্পর্কিত অভিমত বিশেষ তাৎপর্য বহন না করে পারে না, যখন বাংলাদেশ গণতন্ত্রের জন্য সর্বাপেক্ষা ভয়াবহ সংকট মোকাবেলা করছে। আর যেটা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একেবারেই অবিশ্বাস্য, তা হল এ সংকটের উদ্ভব ঘটেছে নতুন করে মধ্যবর্তী নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবিতে, যার প্রতিশ্র“তি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী দিয়েছিলেন। কিন্তু সরকার সমর্থকরা সেই প্রতিশ্র“তি ভুলে থাকার সব রকম কৌশল গ্রহণ করছেন। ব্যক্তিস্বাধীনতা যেখানে সুরক্ষিত নয়, সেখানে গণতন্ত্র থাকার প্রশ্ন ওঠে না। গণতন্ত্রের প্রয়োজন হয় সবার ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার জন্য।
নির্বাচনী ইস্যু নিয়ে সরকারের দুঃসহনীয় নিবর্তনমূলক আচরণ দেশকে এক জীবনবিধ্বংসী সংঘাতে ঠেলে দিয়েছে। আর সেই সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে পুলিশি শক্তির সঙ্গে রাস্তার শক্তি। পরিস্থিতির বিশেষ আতংকের দিক হচ্ছে, সরকারের কোন এজেন্সি কার কর্তৃত্বে কি করছে তা জানার উপায় নেই। কে কখন কীভাবে কার হাতে গুম হবে বা মৃৃত্যুবরণ করবে তার কারণ দর্শানোর কেউ নেই। চলছে শুধু গ্রেফতার আর গ্রেফতার।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে আইন প্রয়োগ করার সময় আত্মবিশ্বাস ও পেশাদারিত্বের স্বাক্ষর রাখতে হবে। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের লুকোচুরির আশ্রয় নেয়া যাবে না। আইনসম্মতভাবে যদি কাউকে গ্রেফতার করতে হয় তবে পুলিশের উচিত হবে এ ব্যাপারে কোনো রকম অনিশ্চয়তার আতংক সৃষ্টি না করা।
দেশে যখন হিংসার রাজনীতি চলে, হরদম ধরপাকড় হতে থাকে, কে কখন কীভাবে নিখোঁজ হবে তা যে-কারও জন্য দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে পড়ে, তখন পুলিশের গ্রেফতার এবং দুষ্কৃতকারীদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য নিশ্চিত করা বাঞ্ছনীয়। কাউকে গ্রেফতার করা হলে স্থানীয় পুলিশকে অবশ্যই বিষয়টি জানাতে হবে এবং মধ্যরাতে দরজায় কড়ানাড়া পরিহার করতে হবে। সন্ত্রাসী কার্যকলাপ পুলিশের দ্বারা হতে পারে না। পরাধীন ব্রিটিশ আমলেও গভীর রাতে কাউকে গ্রেফতার করা হতো না। স্বাধীন দেশের সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যেই দায়িত্ব ও দেশপ্রেম বেশি থাকতে হয়। তারা অনেকের চেয়ে বেশি শিক্ষিত এবং তাদের মধ্যে সচেতনতাও বেশি থাকার কথা। পুলিশ এমনভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালিত করতে পারে না, যাতে আইনভঙ্গকারীরা নির্ভয়ে সাধারণ পোশাকে পুলিশ সাজার সুযোগ নিতে পারে। নিজেদের অপরাধগুলো পুলিশের কাঁধে চাপাতে পারে।
প্রফেসর সেনকে উদ্ধৃত করে বিভিন্ন পত্রিকায় বলা হয়েছে : গণতন্ত্রের জন্য ব্যক্তিস্বাধীনতাকে খর্ব করতে হবে সেটা আমি বিশ্বাস করি না। গণতন্ত্রের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যক্তিস্বাধীনতা সংকুচিত করার ওপর জোর দিতে গিয়ে তার বক্তব্যে এমন ধারণা সৃষ্টি হওয়া অমূলক নয় যে, সরকার গণতন্ত্র রক্ষা করার ব্যাপারে আগ্রহী। অথচ ব্যক্তিস্বাধীনতা খর্ব করা গণতন্ত্র নয়। সরকার গণতন্ত্র রক্ষার জন্য মাথা ঘামাচ্ছে এটা মোটেই বাংলাদেশের বাস্তব চিত্র নয়। সরকারকে বিপরীত পথেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। গণতন্ত্র রক্ষা পাবে কিনা এটাই মূল সংকট। গণতন্ত্রের জন্য এদেশের জনগণ যে সংগ্রাম করেছে, যুদ্ধ করেছে এটাই যেন মিথ্যা প্রমাণিত হতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশে এমন এক অসহায় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তাতে মনে হয় না ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব পালনে সরকারের কোনো সদিচ্ছা আছে। রাজনৈতিকভাবে কারও কোনো ভিন্ন মতই সরকারের কাছে গ্রহণীয় হচ্ছে না। ভিন্ন মত পোষণকারীকে দেশ ও জাতির শত্র“ হিসেবে দেখতে পারলেই যেন সরকার সফল হবে। ভেবে দেখা হচ্ছে না, যুক্তিবাদী রাজনীতি বিসর্জন দেয়ার পরিণতিই হল সন্ত্রাসবাদী রাজনীতি। তাই পরিষ্কার ভাষায় খোলাখুলিভাবেই মুক্তচিন্তার পণ্ডিতদের সঠিক কথাটি বলতে হবে। ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষাই গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্রই ব্যক্তিস্বাধীনতা।
সংলাপ নয়, নির্বাচন নয়, এরকম অবস্থা আর যাই হোক কোনো গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য নয়। নোবেল বিজয়ী সেন ঠিকই বলেছেন, গণতন্ত্রের বিভিন্ন দিক আছে। এ বক্তব্যের দ্বারা তিনি নিশ্চয়ই এটা বোঝাতে চান নাই যে, গণতন্ত্রের কোনো কোনো দিককে বাদ দিয়েও গণতন্ত্র চলতে পারে। অথচ এরূপ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দেয়ার জন্য সরকারের আশপাশে অনেকেই আছেন। তারা প্রধানমন্ত্রীকে বোঝাবেন যে, গণতন্ত্রের সবদিকই অর্থাৎ সংলাপের রাজনীতি বা জনগণের নির্বাচন মানতে হবে, এমনটি নয়।
এখন গোটা ঢাকা মহানগরীতে একজন আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যের পোস্টার শোভা পাচ্ছে। পোস্টারটির ওপর প্রফেসর সেনের নজর পড়েছে কিনা আমরা নিশ্চিত নই। এই পোস্টারে বলিষ্ঠভাবে এবং উচ্চস্বরে বলা হয়েছে, আগে উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র। এ ধরনের চিন্তাভাবনা কেবল কোনো একজন আওয়ামী লীগ নেতার নয়, সংসদেও এ ধরনের রাজনৈতিক থিওরি পেশ করা হয়েছে। বর্তমান সরকারে এমন কিছু প্রভাবশালী লোক আছেন যারা গণতন্ত্রের নাম নিশানা রক্ষায় একদম বিশ্বাসী নন।
কিন্তু সত্যিকারের উন্নয়ন এবং টেকসই অর্থনৈতিক প্রগতি কোনো দেশ অর্জন করতে পারে না যদি সেই দেশের সরকার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা এড়াতে নির্বাচনকে ভয় পায়। অর্থনীতিবিদ প্রফেসর সেন এটা ভালো জানেন যে, সত্যিকারের উন্নয়ন সাজানো অংকের হিসাবে পরিমাপ করা যায় না। সেটা পরিমাপ করতে হয় জনগণের সুখ-শান্তি ও জীবনমানের গড় উন্নতির নিরিখে। আর সেই জীবনমানের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে জীবনের মৌলিক নিরাপত্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা। পুলিশি তৎপরতার মাধ্যমে জনমনে নিরাপত্তাহীনতার আতংক সৃষ্টি কোনো দায়িত্বশীল উন্নয়নকামী সরকারের কাজ হতে পারে না। সন্ত্রাস দমনের নামে সরকার কীভাবে সন্ত্রাসী তৎপরতায় মদদ জুগিয়েছে তা তো যে কারও কাছে এখন পরিষ্কার।
প্রফেসর সেনের বক্তব্যে উন্নয়নের জন্য অধিকতর শক্তিশালী সরকারের প্রসঙ্গ এসেছে। সে বিষয়টিও সঠিক পরিপ্রেক্ষিতে বিচার করে দেখা দরকার- যাতে সরকার এর ভুল ব্যাখ্যা করতে না পারে।
কোনো সরকার পুলিশি শক্তির ওপর নির্ভর করে শক্তিশালী হতে পারে না। জনগণের দৃঢ় সমর্থনপুষ্ট হলেই সরকার শক্তিশালী হতে পারে।
বর্তমান সরকার যথাযথ প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত হতে পারেনি এটাই এ সরকারের বড় দুর্বলতা। এখন যদি বলা হয় উন্নয়নের জন্য এ সরকারকে অধিকতর শক্তিশালী হতে হবে তাহলে এটাই বোঝানো হবে যে, গণতান্ত্রিকভাবে উন্মুক্ত ও জবাবদিহিমূলক সরকার দেশের উন্নয়নের জন্য উপযোগী নয়।
গণতন্ত্র হত্যাকারী সব একনায়কই দেশের উন্নয়নের জন্য শক্তিশালী সরকারের অজুহাত দেখিয়ে থাকেন। যেহেতু একনায়কত্ববাদী সরকার হচ্ছে ভয়ভীতির সরকার, ব্যক্তিস্বাধীনতার সরকার নয়, তাই ডিক্টেটররা যা বলে তাকে সত্য বলে স্বীকার করার বাধ্যবাধকতা থাকে। আর এটাও অজানা নয় যে, একনায়করা টিকে থাকে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে। উন্নয়নের গালভরা কথা তাদের শোনাতে হয়।
এটাও সর্বজনীন সত্য যে, যেখানে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার হাত ধরাধরি করে চলে এবং বিরোধী মতকে স্তব্ধ করে দেয়া হয় সেখানে ন্যায়ভিত্তিক উন্নয়ন হতে পারে না। যুদ্ধের মতো একনায়কত্ববাদী শাসনেও প্রথম বলি হয় সত্য।
দেশকে চরম নৈরাজ্য এবং ধ্বংসস্তূপের মধ্যে রেখেই তাদের বিদায় নিতে হয়। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট আসাদের অবস্থা দেখলেই বিষয়টি অনেকটা পরিষ্কার হবে। দেশ ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে, জনজীবনে নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। প্রাণে বাঁচার জন্য লাখ লাখ লোককে সবকিছু ছেড়ে বিদেশে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে। চারদিক দিয়ে বিদেশী অস্ত্রধারীরা দেশে ঢুকছে। তবুও তিনি ক্ষমতা ছাড়ার কথা ভাবতে পারছেন না। ক্ষমতা পাগলরা প্রশ্রয় পেলে যা হয় তার সেটাই হয়েছে।
নোবেল বিজয়ী পণ্ডিতের রাজনৈতিক বক্তব্যে নানা ধরনের অস্পষ্টতা থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভূয়সী প্রশংসা থাকায় তার বিভিন্ন গভীর চিন্তামূলক মন্তব্য কতটা সঠিকভাবে গ্রহণ করা হবে এবং আমাদের চিন্তাভাবনায় কতটা কল্যাণধর্মী প্রভাব ফেলবে তা নিয়ে সন্দেহ থাকার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
বাংলাদেশের এমন সময় তিনি আমাদের গণতন্ত্র ও অর্থনীতি নিয়ে মতামত প্রকাশ করেছেন যখন গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার পথে এবং অর্থনীতিও বিপর্যস্ত। দেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের কারণে দেশের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে, তা তো ব্যবসায়ী সমাজসহ আমাদের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদরাই বলছেন। অথচ বাংলাদেশে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে প্রফেসর সেনের কাছ থেকে শুনতে হল প্রশংসার পর প্রশংসা।
বর্তমানে আমরা যে ধরনের সর্বনাশা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে রয়েছি, জনগণ যেখানে আতংক এবং নিরাপত্তাহীতার মধ্যে কাল কাটাচ্ছে, সেখানে প্রফেসর সেনের উপস্থিতি সরকার ও দেশবাসীর জন্য প্রভূত সুফলদায়ক হতে পারত, যদি তিনি বাংলাদেশের একজন সুহৃদ হিসেবে অধিকতর বাস্তবধর্মী বক্তব্য রাখতে পারতেন। বাংলাদেশের মানুষতো তাকে একজন আপনজন হিসেবে গ্রহণ করতে বা তার প্রতি প্রাণঢালা শ্রদ্ধা জানাতে কখনও এতটুকু কার্পণ্য করেনি।
আমরা জানি, আমাদের যে-ই যত কথা বলি না কেন, আমাদের বৃত্তবন্দি দলীয় রাজনীতিকে মুক্ত করতে না পারলে গণতন্ত্রকে নিরাপদ আশ্রয় দেয়া যাবে না। জাতির চরম সংকটের সময় জনগণ তাদের শুভাকাক্সক্ষীদের পাশে দেখতে চায়। সহজভাবে সহজ কথাটি বলতে হবে : নির্বাচন দিতে হবে। দেশের ভালো-মন্দের ব্যাপারে জনগণের রায় মানতে হবে।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনজীবী ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
No comments