মার্চ উপাখ্যান by মাহমুদুল বাসার
শুধু
১৯৭১ সালের মার্চ মাসই নয়, বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে মার্চ মাসটি
নানা কারণেই আমাদের কাছে গুরুত্ববহ। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তানের
লাহোরে বাঙালি নেতা, বাংলার প্রধানমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক
পাকিস্তান প্রস্তাব উত্থাপন করেছিলেন। তখন জিন্নাহ সাহেবের চেয়ে শেরে
বাংলার গুরুত্ব ছিল বেশি, তাই তাকে দিয়ে জিন্নাহ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন
করিয়েছিলেন। শেরে বাংলার প্রস্তাবে পাকিস্তান নামক কোনো রাষ্ট্রের ঘোষণা
ছিল না। ছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলগুলো স্বাধীন হবে। ১৯৪৬ সালের
নির্বাচনের পর জিন্নাহ কৌশলে লাহোর প্রস্তাবকে ছেঁটে তার মনগড়া পাকিস্তান
বানিয়েছিলেন। এ প্রস্তাবও উত্থাপন করেন বাঙালিদের আরেক নেতা হোসেন শহীদ
সোহরাওয়ার্দী, ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের পর মুসলিম লীগের অধিবেশনে। তখন শেরে
বাংলা জিন্নাহর কাছে নেই, ছিটকে পড়েছেন। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার প্রথম দফায়ই
আছে, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে, যা
পাকশাসকরা বরাবর অগ্রাহ্য করেছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই বাঙালিকে বোবা জাতিতে পরিণত করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তাই প্রস্তাব উঠেছিল, উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে বাঙালিরা ঢাকায় আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকায় সর্বাÍক হরতাল পালিত হয়েছিল। তদুপরি ছাত্রনেতারা, বাঙালি ভাষাসংগ্রামীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রতিবছর ১১ মার্চ ভাষা দিবস পালন করা হবে। ১১ মার্চের হরতালে পিকেটিং করার সময় অন্য নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকেও গ্রেফতার করা হয়।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব বাংলা সফরে আসেন। তার প্রভাব তখন তুঙ্গে। আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, তখনকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ প্রদানের সময় তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।’ উপস্থিত ছাত্রনেতারা ‘নো নো’ বলে জিন্নাহর ভাষণের প্রতিবাদ করেছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ। সেখানে বঙ্গবন্ধুও উপস্থিত ছিলেন। আবারও ২৩ মার্চ কার্জন হলে জিন্নাহ ভাষণ দেয়ার সময় বলেন, ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ তখন সেখানে যে তুমুল প্রতিবাদ হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এর আগে বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে বের হয়ে এসে ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় যে ছাত্রসভা হয়েছিল, তার সভাপতিত্ব করেছিলেন।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসেই জিন্নাহর ভাষাসংক্রান্ত ঘোষণার মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানের অপমৃত্যু ঘটে। বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক তার ‘মুক্তিসংগ্রাম’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, জিন্নাহ করাচি গিয়ে বেতার ভাষণে বাঙালিদের অশ্রাব্য গালি দিয়ে তার ক্রোধ সংবরণ করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক মার্চ মাস। ১ মার্চ বাঙালিরা বিজয়ের আনন্দে খোশমেজাজে গিয়েছিল ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা দেখতে। আকস্মিকভাবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কর্কশ কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হল সেই ঘোষণা, যে ঘোষণার সূত্র ধরে বাঙালিরা স্বাধীনতার মন্ত্রে সশস্ত্র যুদ্ধের দিকে যাত্রা শুরু করে। ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হল।’ সিদ্ধান্ত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১ মার্চ অধিবেশন বসবে। ক্রিকেটপ্রেমীদের অনেকে রেডিও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। বেতারে এ ঘোষণা শোনামাত্র স্টেডিয়াম ত্যাগ করে রাজপথে নেমে আসেন। সারা দেশ গর্জে ওঠে। বঙ্গবন্ধু তখন নির্বাচিত এমপিদের নিয়ে হোটেল পূর্বাণীতে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নে ব্যস্ত ছিলেন।
ঢাকা শহরের মানুষ জলস্রোতের মতো হোটেল পূর্বাণীর সামনে উপস্থিত হল। বঙ্গবন্ধু তাদের সামনে প্রত্যয়দীপ্ত এক ভাষণ দিলেন। বললেন, ৭ তারিখে তিনি কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। এর মধ্যে গঠিত হয়ে গেল স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ১ মার্চেই স্লোগান উঠেছিল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’
২ মার্চ ছাত্রনেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র-জনতার সামনে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ৩ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার পাঠ করেন। তারা পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ তারা বলেছিলেন, আজ থেকে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলবে। তারা বলেছিলেন, স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারা বিদেশী শক্তির কাছেও সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ, অগ্নিগর্ভ ভাষণ দেন। সাংবাদিক এবিএম মূসা ৭ মার্চের ভাষণকে সরাসরি যুদ্ধের ঘোষণা বলেন (মুজিব ভাই)। ড. আনিসুজ্জামান তার স্মৃতিচারণায় বলেছেন, যখন রেডিওতে শুনলাম বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ থেকে ঘোষিত হল, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তখন মনে হল পৃথিবীতে একটি নতুন দেশের জন্ম হল (আমার একাত্তর)।
১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গেটিসবার্গে দাস প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধে শহীদ সেনাদের উদ্দেশে যে সুলিখিত ভাষণটি দিয়েছিলেন, তার সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির তুলনা করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু একটি অস্থির পরিবেশে, মৃত্যুর ঝুলন্ত তরবারি সামনে রেখে এ অলিখিত ভাষণটি দিয়েছিলেন। তার মাথার ওপর পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান উড়ছিল। এ ভাষণে তিনি নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা দিয়ে রেখেছিলেন। দেশ শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি গ্রেফতার হয়ে যাবেন এ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। একজন নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচিত নেতা এর চেয়ে স্পষ্টভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন না। ‘যার যা আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক’- এ কথার তাৎপর্য কী? ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল,’- এ কথারই বা তাৎপর্য কী? ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা জীবনের তরে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেবে’- এ কথার তাৎপর্য কী? ‘পূর্ব বাংলা থেকে এক পয়সাও পশ্চিম পাকিস্তানে চালান হতে পারবে না’- এ কথার তাৎপর্য কী?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী পত্রিকা ৭ মার্চের ভাষণকে বলেছে ‘কবিতা’, আর বঙ্গবন্ধুকে বলেছে ‘রাজনীতির কবি’।
৭ মার্চের ভাষণের পরদিন থেকে শুরু হয় ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন। সাড়ে সাত কোটি মানুষ অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। পাকিস্তানের কর্তৃত্ব বলতে আর কিছুই ছিল না। ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশের সর্বত্র পাকিস্তানের খানসেনাদের বুলেটে বাঙালির রক্ত ঝরেছে। বাঙালি মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে বাঙালিরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুও তার ভাষণে বলেছেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।’
১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। তিনি এর কোনো গুরুত্ব দেননি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘যে দেশের সাধারণ মানুষ রাস্তাঘাটে মারা যাচ্ছে, সে দেশে আমার জন্মদিন-মৃত্যুদিনের কী গুরুত্ব আছে?’
২৫ মার্চের কালরাতে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পাকিস্তানি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত স্বাধীনতার দলিলপত্রের তৃতীয় খণ্ডে লেখা আছে, বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার বাণী ইপিআরের ওয়্যারলেস মারফত চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
মাহমুদুল বাসার : গবেষক ও লেখক
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই বাঙালিকে বোবা জাতিতে পরিণত করার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তাই প্রস্তাব উঠেছিল, উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। এর প্রতিবাদে বাঙালিরা ঢাকায় আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ঢাকায় সর্বাÍক হরতাল পালিত হয়েছিল। তদুপরি ছাত্রনেতারা, বাঙালি ভাষাসংগ্রামীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, প্রতিবছর ১১ মার্চ ভাষা দিবস পালন করা হবে। ১১ মার্চের হরতালে পিকেটিং করার সময় অন্য নেতাদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকেও গ্রেফতার করা হয়।
১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ পূর্ব বাংলা সফরে আসেন। তার প্রভাব তখন তুঙ্গে। আজকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, তখনকার রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ প্রদানের সময় তিনি বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু।’ উপস্থিত ছাত্রনেতারা ‘নো নো’ বলে জিন্নাহর ভাষণের প্রতিবাদ করেছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন পূর্ব বাংলা মুসলিম ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নঈমুদ্দীন আহমদ। সেখানে বঙ্গবন্ধুও উপস্থিত ছিলেন। আবারও ২৩ মার্চ কার্জন হলে জিন্নাহ ভাষণ দেয়ার সময় বলেন, ‘উর্দু হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।’ তখন সেখানে যে তুমুল প্রতিবাদ হয়েছিল, বঙ্গবন্ধু তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এর আগে বঙ্গবন্ধু কারাগার থেকে বের হয়ে এসে ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় যে ছাত্রসভা হয়েছিল, তার সভাপতিত্ব করেছিলেন।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসেই জিন্নাহর ভাষাসংক্রান্ত ঘোষণার মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানের অপমৃত্যু ঘটে। বিশিষ্ট গবেষক অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক তার ‘মুক্তিসংগ্রাম’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, জিন্নাহ করাচি গিয়ে বেতার ভাষণে বাঙালিদের অশ্রাব্য গালি দিয়ে তার ক্রোধ সংবরণ করেন।
এরই ধারাবাহিকতায় আসে ১৯৭১-এর ঐতিহাসিক মার্চ মাস। ১ মার্চ বাঙালিরা বিজয়ের আনন্দে খোশমেজাজে গিয়েছিল ঢাকা স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা দেখতে। আকস্মিকভাবে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কর্কশ কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হল সেই ঘোষণা, যে ঘোষণার সূত্র ধরে বাঙালিরা স্বাধীনতার মন্ত্রে সশস্ত্র যুদ্ধের দিকে যাত্রা শুরু করে। ইয়াহিয়া বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হল।’ সিদ্ধান্ত হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১ মার্চ অধিবেশন বসবে। ক্রিকেটপ্রেমীদের অনেকে রেডিও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন। বেতারে এ ঘোষণা শোনামাত্র স্টেডিয়াম ত্যাগ করে রাজপথে নেমে আসেন। সারা দেশ গর্জে ওঠে। বঙ্গবন্ধু তখন নির্বাচিত এমপিদের নিয়ে হোটেল পূর্বাণীতে সংবিধানের খসড়া প্রণয়নে ব্যস্ত ছিলেন।
ঢাকা শহরের মানুষ জলস্রোতের মতো হোটেল পূর্বাণীর সামনে উপস্থিত হল। বঙ্গবন্ধু তাদের সামনে প্রত্যয়দীপ্ত এক ভাষণ দিলেন। বললেন, ৭ তারিখে তিনি কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। এর মধ্যে গঠিত হয়ে গেল স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। ১ মার্চেই স্লোগান উঠেছিল, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর।’
২ মার্চ ছাত্রনেতারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্র-জনতার সামনে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ৩ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা পল্টন ময়দানে বঙ্গবন্ধুর উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলাদেশের ইশতেহার পাঠ করেন। তারা পরিষ্কার ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।’ তারা বলেছিলেন, আজ থেকে বাংলার মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলবে। তারা বলেছিলেন, স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানকে জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তারা বিদেশী শক্তির কাছেও সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিলেন।
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ, অগ্নিগর্ভ ভাষণ দেন। সাংবাদিক এবিএম মূসা ৭ মার্চের ভাষণকে সরাসরি যুদ্ধের ঘোষণা বলেন (মুজিব ভাই)। ড. আনিসুজ্জামান তার স্মৃতিচারণায় বলেছেন, যখন রেডিওতে শুনলাম বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠ থেকে ঘোষিত হল, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’, তখন মনে হল পৃথিবীতে একটি নতুন দেশের জন্ম হল (আমার একাত্তর)।
১৮৬৩ সালের ১৯ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন গেটিসবার্গে দাস প্রথার বিরুদ্ধে যুদ্ধে শহীদ সেনাদের উদ্দেশে যে সুলিখিত ভাষণটি দিয়েছিলেন, তার সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর ভাষণটির তুলনা করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু একটি অস্থির পরিবেশে, মৃত্যুর ঝুলন্ত তরবারি সামনে রেখে এ অলিখিত ভাষণটি দিয়েছিলেন। তার মাথার ওপর পাকিস্তানের যুদ্ধবিমান উড়ছিল। এ ভাষণে তিনি নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের রূপরেখা দিয়ে রেখেছিলেন। দেশ শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি গ্রেফতার হয়ে যাবেন এ ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। একজন নিয়মতান্ত্রিক নির্বাচিত নেতা এর চেয়ে স্পষ্টভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারেন না। ‘যার যা আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক’- এ কথার তাৎপর্য কী? ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল,’- এ কথারই বা তাৎপর্য কী? ‘আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা জীবনের তরে রাস্তাঘাট বন্ধ করে দেবে’- এ কথার তাৎপর্য কী? ‘পূর্ব বাংলা থেকে এক পয়সাও পশ্চিম পাকিস্তানে চালান হতে পারবে না’- এ কথার তাৎপর্য কী?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রভাবশালী পত্রিকা ৭ মার্চের ভাষণকে বলেছে ‘কবিতা’, আর বঙ্গবন্ধুকে বলেছে ‘রাজনীতির কবি’।
৭ মার্চের ভাষণের পরদিন থেকে শুরু হয় ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলন। সাড়ে সাত কোটি মানুষ অসহযোগ আন্দোলনে অংশ নিয়ে পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। পাকিস্তানের কর্তৃত্ব বলতে আর কিছুই ছিল না। ২৫ মার্চ ‘অপারেশন সার্চলাইট’ শুরু হওয়ার আগে বাংলাদেশের সর্বত্র পাকিস্তানের খানসেনাদের বুলেটে বাঙালির রক্ত ঝরেছে। বাঙালি মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বে ১৯ মার্চ জয়দেবপুরে বাঙালিরা বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুও তার ভাষণে বলেছেন, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে।’
১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন। তিনি এর কোনো গুরুত্ব দেননি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে বলেছিলেন, ‘যে দেশের সাধারণ মানুষ রাস্তাঘাটে মারা যাচ্ছে, সে দেশে আমার জন্মদিন-মৃত্যুদিনের কী গুরুত্ব আছে?’
২৫ মার্চের কালরাতে ঘুমন্ত বাঙালির ওপর পাকিস্তানি বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে। কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত স্বাধীনতার দলিলপত্রের তৃতীয় খণ্ডে লেখা আছে, বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণার বাণী ইপিআরের ওয়্যারলেস মারফত চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।
মাহমুদুল বাসার : গবেষক ও লেখক
No comments