কী শর্তে আড়ি পাতা? by মিজানুর রহমান খান
বিশ্বের
দেশে দেশে আড়ি পাতা নিয়ে বড় ধরনের কোনো হুলুস্থুল বঁাধলেই অনেকেই জর্জ
অরওয়েলের নাইনটিন এইটি–ফোর নামের ব্যঙ্গ উপন্যাসটি স্মরণ করেন। অরওয়েলের
কল্পরাজ্যটাই ছিল এক আড়ি পাতার রাজ্য। এ রাজ্যের নৃপতি বিগ ব্রাদার, যার
মূল দর্শন হলো অব দ্য পাওয়ার, বাই দ্য পাওয়ার, ফর দ্য পাওয়ার। তাঁর একটি
উক্তি হলো: টোটালিটারিয়ানিজম (যে রাজনৈতিক দল একটি দল ভিন্ন অন্য কোনো
প্রতিদ্বন্দ্বী দলকে মানতে রাজি নয়) দ্বারা দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার চেয়ে
কারও বরং তেমন দেশে বাস করারই দরকার নেই। বিএনপি ও জামায়াত ২০০৬ সালে
আমাদের দেশটাকে অন্তত অনেকখানি আড়ি পাতা রাজ্যে রূপান্তরিত করে রেখে যায়।
সংবিধান বলেছে, জরুরি অবস্থায় গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারসংক্রান্ত ৪৩
অনুচ্ছেদটি স্থগিত করা যাবে না। অথচ খালেদা জিয়ার গড়ে দেওয়া আইন বলছে,
জরুরি অবস্থা না থাকলেও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ বা নৈরাজ্য দেখা দিলে এর
ব্যত্যয় ঘটানো যাবে। বেশি সরলীকরণ হবে কি না জানি না, তবে বিএনপি জঙ্গি
দমনের নামে একটি বেপরোয়া টেলিযোগাযোগ আইন করে ব্যক্তিস্বাধীনতার যে বারোটা
বাজিয়ে দিয়ে গেছে, তা জর্জ অরওয়েলের আড়ি পাতা রাজ্যকেই স্মরণ করিয়ে
দেয়। বিএনপি সম্ভবত কেবল জঙ্গি নয়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতেও
ওই গর্ত খুঁড়েছিল বলে আমি সন্দেহ করি। সেই গর্তে নিজের সঙ্গে তারা
দেশবাসীকেও ফেলেছে।
মাহমুদুর রহমান মান্না ও সাদেক হোসেন খোকার ফাঁস হওয়া আলোচিত কথোপকথন আমাদের আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাষ্ট্র কি বিশ্বস্ততার সঙ্গে সু-আইনের সুশাসনের শর্ত পূরণ করবে, নাকি আগেভাগে ফাঁস করে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করবে? রাষ্ট্র কোনো অবস্থাতেই মিডিয়া ট্রায়ালকে উৎসাহিত করতে পারে না, তাকে অবশ্যই আদালতের বিচারে আস্থাশীল হতে হবে। এটা না করা হলে সত্যি যখন কোনো উপযুক্ত ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের স্বার্থে দ্রুত বিচার কাম্য হবে, তখন তা বিঘ্নিত হতে পারে। আদালতে পেশযোগ্য কোনো বৈধ আলামতকে লিফলেট বানানোর কোনো প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আড়ি পাতা–সংশ্লিষ্ট মামলায় কারও বিচারের ক্ষেত্রে ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনে যে সুপ্রতিষ্ঠিত রক্ষাকবচ ছিল, তাও বাতিল হয়ে গেছে। বলা হয়েছে, সাক্ষ্য আইন লাগবে না, আড়ি পাতা মালমসলা দিয়েই বিচারকাজ চলবে। প্রযুক্তি আইনজ্ঞ তানজীব-উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে বিচার চাইতে হলে মাহমুদুর রহমানকেই মামলা ঠুকে আদালতে প্রমাণ করতে হবে যে তাঁদের কথোপকথন অবৈধভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কথোপকথন দলিল হিসেবে উপস্থাপন করলে রাষ্ট্রকে রেকর্ড করার দায় নিতে হবে। আর অবৈধভাবে রেকর্ড করা হলে তা পেশ করতে আদালতের অনুমতি লাগবে। সে ক্ষেত্রে যারা প্রকাশ করেছে, তাদের বিষয়টি গৌণ হয়ে যাবে।’
অবশ্য মাহমুদুর রহমান মান্না ও সাদেক হোসেন খোকা দুজনেই ওই টেলিফোন আলাপের কথা স্বীকার করেছেন। মার্কিন আইনে অবৈধ রেকর্ড অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবহার গ্রহণযোগ্য হয় না। ব্রিটেনেও চলে না, কিন্তু অন্যান্য প্রমাণ দিয়ে তা সমর্থিত হলে অবৈধ রেকর্ড বাধা হয় না। তবে সেখানে আড়ি পাতার শিকার হওয়া ব্যক্তির সুরক্ষায় আলাদা আদালতসহ অনেকগুলো সুরক্ষা আছে। আর বাংলাদেশে আড়ি পাতার ‘বৈধ’ আলামত ক্রমশ অজ্ঞাতনামা লিফলেটে পরিণত হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এর আগে দুই নেত্রীর টেলিফোন সংলাপ কারা কীভাবে ফাঁস করল, তা আমাদের এখনো অজানা রয়ে গেছে।
আমাদের আইনে সাধারণভাবে আড়ি পাতা নিষিদ্ধ। আপনি চাইলেই যে কারও ফোনে আড়ি পাততে পারেন না। অবৈধ আড়ি পাতাকে নিরুৎসাহিত করতে দুই বছরের জেল ও পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দেওয়ারও বিধান রাখা হয়েছে। তবে সরকার থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে না।
বিএনপির বিগত সরকারের আমলে টেলিযোগাযোগ আইনে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে বিশেষ বিধান আনা হয়েছিল। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে বিশ্বব্যাংকের এক প্রকল্পের আওতায় কামাল হোসেন অ্যাসোসিয়েটস টেলি আইনের খসড়া করেছিল। এর সঙ্গে যুক্ত থাকা তানজীব-উল আলম বলেন, ‘আমরা ১৯৯৭-৯৮ সালে খসড়া তৈরির সময় বিধান করেছিলাম যে বিটিআরসির কাজ হবে তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা। আইনটি প্রথমে আওয়ামী লীগই পাস করেছিল। কিন্তু টুইন টাওয়ার ও বাংলা ভাইদের জঙ্গিত্বে বদলে যাওয়া পটভূমিতে বিএনপি একে কঠোর করে। গোপনীয়তা সুরক্ষার বিধান বাস্তবে উল্টে যায়।’ তবে অনেকে দাবি করেন বিএনপি পরে যেসব বিধান ঢুকিয়েছিল, তেমন বিধান অন্যান্য দেশে রয়েছে। আমি এর সঙ্গে দ্বিমত করি। কারণ, জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে ভারতেও আড়ি পাতা বৈধ। কিন্তু তার সুষ্ঠু প্রয়োগে ব্রিটেনের মতো ভারতেও অসাধারণ রক্ষাকবচ দেওয়া আছে, সে তুলনায় বলা চলে বাংলাদেশের শাসকেরা তাঁদের প্রজাকুল বা সাবজেক্টদের জন্য তেমন কিছুর কথা একদম ভাবেননি।
২০০১ সালের আইনে ২০০৬ সালে ৯৭ক ধারা যুক্ত করে বলা হয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যেকোনো বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তথ্যাদি সংগ্রহ করা যাবে। তবে এ জন্য ‘সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য’ গোয়েন্দা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দিতে পারবে। এখানে ভারতীয় ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করলেই আপনার কাছে বাংলাদেশের নাগরিকের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারবিধ্বংসী ভয়ানক চিত্রটি পরিষ্কার হবে। ‘সরকার’ বলতে দিল্লির মতো ঢাকাতেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বোঝায়। আমাদের আইন বলছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে এই বিধান প্রয়োগযোগ্য হবে। স্বরাষ্ট্রের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার এনটিএমসি আছে। কিন্তু সেটা বাস্তবে কী করে চলে তা আমাদের জানা নেই।
বাক্স্বাধীনতার সঙ্গে ইন্টারনেট ইত্যাদি বিষয়ক কালাকানুন, যা বিএনপি-জামায়াত করে গেছে, তা সংবিধানের ৩৯ ও ৪৩ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’-এর শর্ত কতটা কী পূরণ করেছে, বিশেষ করে তা কীভাবে আওয়ামী লীগের ‘প্রগতিশীল’ শাসনের সঙ্গে খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। বিএনপি-জামায়াতের সৃষ্টি করা ডিক্রিগুলো দিয়ে আওয়ামী লীগ কীভাবে আইনের শাসন চালাচ্ছে, তার একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা হওয়া উচিত।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে তাদের মাইলফলক রায়ে যা বলেন, তা আমাদের দেশে অনুসরণীয় হওয়া উচিত। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খেয়াল-খুশিমাফিক আড়ি পাতার অনুমতি দিতে পারবে না। তাকে তার প্রতিটি আদেশে উপযুক্ত ও শক্তিশালী কারণ দেখাতে হবে। কোনো আদেশের মেয়াদ অনির্দিষ্টকাল হবে না। দুই মাস মেয়াদ থাকবে। এরপর আবার কারণ দেখিয়ে উপযুক্ত কমিটি দিয়ে বাড়ানো যাবে, কিন্তু তা ছয় মাসের বেশি হবে না। আবার এভাবে আড়ি পেতে যে রেকর্ড করা হবে, তা রেকর্ড করা থেকে দুই মাসের মধ্যে ব্যবহার ও তা ধ্বংস করে দিতে হবে। যেকোনো মূল্যে অবৈধ আড়ি পাতা এড়াতে হবে। কারও গোপনীয়তায় অনুপ্রবেশ হতে হবে ন্যূনতম।’ ১৯৯৬ সালে পিইউসিএল বনাম ভারত মামলায় বিচারপতি কুলদীপ সিং ও এস সগির আহমেদ রায়ের শুরুটাই করেছেন এই বলে যে আড়ি পাতা ব্যক্তির গোপনীয়তায় একটি মারাত্মক আগ্রাসন। আদালতের দেওয়া শর্তে আছে, কোনো রেকর্ডের কতটি অনুলিপি হবে, কতটুকুর ট্রান্সক্রিপশন হবে, কে কে দেখতে পাবেন, সেসব প্রাথমিক অনুমতির আদেশেই নির্দিষ্ট করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট এমনকি মন্ত্রিসভা, আইন ও টেলিযোগাযোগ—এই তিন সচিব দিয়ে রিভিউ কমিটি গঠনের উপায় বাতলে দেন। আমরা আশ্বস্ত হতে চাই যে আমাদের রাষ্ট্র ওই ধরনের কিংবা ন্যূনতম সংবেদনশীলতা বজায় রাখতে সংকল্পবদ্ধ। আমরা জানতে চাই, ২০০৬ সালের সংশোধনীতে দেওয়া ক্ষমতার কোনো অপব্যবহারের তদন্ত এ পর্যন্ত হয়েছে কি না? হলে তার ফলাফল কী?
ভারতের ওই রায়ে দেখি, আড়ি পাতা অপব্যবহারের ঘটনা সিবিআই তদন্ত করেছিল। আর তাতে দেখা যায়, ১৮০ দিনের সময়সীমা পেরোনোর পরেও ১১১টি কলে আড়ি পাতা চলছিল। একটি এজেন্সি কত কলে আড়ি পেতেছে তার লগবুক রাখেনি। ওই মামলায় নাগরিক সমাজের পক্ষে সুপারিশ ছিল যেকোনো আড়ি পাতার আদেশে কমিটির সইয়ের আগেই বিচার বিভাগীয় যাচাই-বাছাইয়ের দরকার হবে। আড়ি পাতার কোনো আদেশ হওয়ার ছয় সপ্তাহের মধ্যে তা একটি বোর্ডে আসবে। আমরা মনে রাখব, এই আড়ি পাতার সঙ্গে মিডিয়ার স্বাধীনতার নাড়ির সম্পর্ক থাকতে বাধ্য। সে জন্য বিচারপতি পি কে গোস্বামীর নেতৃত্বাধীন ভারতের দ্বিতীয় প্রেস কমিশন সুপারিশ করেছিল যে, যেভাবে কোনো ডিটেনশন আদেশ রিভিউ হয়, সেভাবে কোনো আড়ি পাতার আদেশ হওয়ার ছয় সপ্তাহের মধ্যে তা রিভিউর জন্য বোর্ডে আসবে।
উল্লেখ্য, আটকাদেশের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আমাদের সংবিধানে একটি উপদেষ্টা পর্ষদ করে দেওয়া আছে। এ রকম কোনো পর্ষদের কাছে আড়ি পাতার আদেশ রিভিউর জন্য প্রেরণের নিয়ম করা যায়। ওই পর্ষদ অনুমোদন না দিলে আড়ি পাতা তাৎক্ষণিক বন্ধ করতে হবে। আলামত ধ্বংস করতে হবে। আড়ি পাতা ক্ষমতার অপব্যবহারকে গুরুতর অসদাচরণ গণ্যে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২০০৬ সালের মে মাসে বিএনপির আড়ি পাতা আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরের দায়ের করা একটি রিটে হাইকোর্ট রুল জারি করেছিলেন। তিন সপ্তাহের মধ্যে এর উত্তরদানের আদেশে সাড়া দেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ। কিন্তু রাষ্ট্র নীরবতা বজায় রাখছে। তাই এসব বিষয়ে উচ্চ আদালতে আইনি লড়াইটা যত তাড়াতাড়ি বেগবান করা যায়, ততই উত্তম। আমরা একটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকারের সংকোচনের বিধানসংবলিত আড়ি পাতা আইনের বৈধতা পরখ ও তা প্রয়োগের ব্যাপারে স্বচ্ছতা চাই। একটি গাইডলাইন ও তার বাস্তবায়ন চাই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
মাহমুদুর রহমান মান্না ও সাদেক হোসেন খোকার ফাঁস হওয়া আলোচিত কথোপকথন আমাদের আরও একবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছে যে এ ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাষ্ট্র কি বিশ্বস্ততার সঙ্গে সু-আইনের সুশাসনের শর্ত পূরণ করবে, নাকি আগেভাগে ফাঁস করে দেওয়ার কৌশল অবলম্বন করবে? রাষ্ট্র কোনো অবস্থাতেই মিডিয়া ট্রায়ালকে উৎসাহিত করতে পারে না, তাকে অবশ্যই আদালতের বিচারে আস্থাশীল হতে হবে। এটা না করা হলে সত্যি যখন কোনো উপযুক্ত ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের স্বার্থে দ্রুত বিচার কাম্য হবে, তখন তা বিঘ্নিত হতে পারে। আদালতে পেশযোগ্য কোনো বৈধ আলামতকে লিফলেট বানানোর কোনো প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আড়ি পাতা–সংশ্লিষ্ট মামলায় কারও বিচারের ক্ষেত্রে ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইনে যে সুপ্রতিষ্ঠিত রক্ষাকবচ ছিল, তাও বাতিল হয়ে গেছে। বলা হয়েছে, সাক্ষ্য আইন লাগবে না, আড়ি পাতা মালমসলা দিয়েই বিচারকাজ চলবে। প্রযুক্তি আইনজ্ঞ তানজীব-উল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘এ বিষয়ে বিচার চাইতে হলে মাহমুদুর রহমানকেই মামলা ঠুকে আদালতে প্রমাণ করতে হবে যে তাঁদের কথোপকথন অবৈধভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কথোপকথন দলিল হিসেবে উপস্থাপন করলে রাষ্ট্রকে রেকর্ড করার দায় নিতে হবে। আর অবৈধভাবে রেকর্ড করা হলে তা পেশ করতে আদালতের অনুমতি লাগবে। সে ক্ষেত্রে যারা প্রকাশ করেছে, তাদের বিষয়টি গৌণ হয়ে যাবে।’
অবশ্য মাহমুদুর রহমান মান্না ও সাদেক হোসেন খোকা দুজনেই ওই টেলিফোন আলাপের কথা স্বীকার করেছেন। মার্কিন আইনে অবৈধ রেকর্ড অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবহার গ্রহণযোগ্য হয় না। ব্রিটেনেও চলে না, কিন্তু অন্যান্য প্রমাণ দিয়ে তা সমর্থিত হলে অবৈধ রেকর্ড বাধা হয় না। তবে সেখানে আড়ি পাতার শিকার হওয়া ব্যক্তির সুরক্ষায় আলাদা আদালতসহ অনেকগুলো সুরক্ষা আছে। আর বাংলাদেশে আড়ি পাতার ‘বৈধ’ আলামত ক্রমশ অজ্ঞাতনামা লিফলেটে পরিণত হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। এর আগে দুই নেত্রীর টেলিফোন সংলাপ কারা কীভাবে ফাঁস করল, তা আমাদের এখনো অজানা রয়ে গেছে।
আমাদের আইনে সাধারণভাবে আড়ি পাতা নিষিদ্ধ। আপনি চাইলেই যে কারও ফোনে আড়ি পাততে পারেন না। অবৈধ আড়ি পাতাকে নিরুৎসাহিত করতে দুই বছরের জেল ও পাঁচ কোটি টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দেওয়ারও বিধান রাখা হয়েছে। তবে সরকার থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত গোয়েন্দা ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হবে না।
বিএনপির বিগত সরকারের আমলে টেলিযোগাযোগ আইনে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে বিশেষ বিধান আনা হয়েছিল। শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে বিশ্বব্যাংকের এক প্রকল্পের আওতায় কামাল হোসেন অ্যাসোসিয়েটস টেলি আইনের খসড়া করেছিল। এর সঙ্গে যুক্ত থাকা তানজীব-উল আলম বলেন, ‘আমরা ১৯৯৭-৯৮ সালে খসড়া তৈরির সময় বিধান করেছিলাম যে বিটিআরসির কাজ হবে তথ্যের গোপনীয়তা রক্ষা করা। আইনটি প্রথমে আওয়ামী লীগই পাস করেছিল। কিন্তু টুইন টাওয়ার ও বাংলা ভাইদের জঙ্গিত্বে বদলে যাওয়া পটভূমিতে বিএনপি একে কঠোর করে। গোপনীয়তা সুরক্ষার বিধান বাস্তবে উল্টে যায়।’ তবে অনেকে দাবি করেন বিএনপি পরে যেসব বিধান ঢুকিয়েছিল, তেমন বিধান অন্যান্য দেশে রয়েছে। আমি এর সঙ্গে দ্বিমত করি। কারণ, জাতীয় নিরাপত্তার প্রয়োজনে ভারতেও আড়ি পাতা বৈধ। কিন্তু তার সুষ্ঠু প্রয়োগে ব্রিটেনের মতো ভারতেও অসাধারণ রক্ষাকবচ দেওয়া আছে, সে তুলনায় বলা চলে বাংলাদেশের শাসকেরা তাঁদের প্রজাকুল বা সাবজেক্টদের জন্য তেমন কিছুর কথা একদম ভাবেননি।
২০০১ সালের আইনে ২০০৬ সালে ৯৭ক ধারা যুক্ত করে বলা হয়, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা জনশৃঙ্খলার স্বার্থে যেকোনো বার্তা ও কথোপকথন প্রতিহত, রেকর্ড ধারণ বা তথ্যাদি সংগ্রহ করা যাবে। তবে এ জন্য ‘সরকার সময় সময় নির্ধারিত সময়ের জন্য’ গোয়েন্দা বা আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে নিয়োজিত সংস্থার কোনো কর্মকর্তাকে ক্ষমতা দিতে পারবে। এখানে ভারতীয় ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করলেই আপনার কাছে বাংলাদেশের নাগরিকের গোপনীয়তা রক্ষার অধিকারবিধ্বংসী ভয়ানক চিত্রটি পরিষ্কার হবে। ‘সরকার’ বলতে দিল্লির মতো ঢাকাতেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বোঝায়। আমাদের আইন বলছে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রীর অনুমোদনক্রমে এই বিধান প্রয়োগযোগ্য হবে। স্বরাষ্ট্রের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে ন্যাশনাল টেলিকম মনিটরিং সেন্টার এনটিএমসি আছে। কিন্তু সেটা বাস্তবে কী করে চলে তা আমাদের জানা নেই।
বাক্স্বাধীনতার সঙ্গে ইন্টারনেট ইত্যাদি বিষয়ক কালাকানুন, যা বিএনপি-জামায়াত করে গেছে, তা সংবিধানের ৩৯ ও ৪৩ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ‘যুক্তিসংগত বাধানিষেধ’-এর শর্ত কতটা কী পূরণ করেছে, বিশেষ করে তা কীভাবে আওয়ামী লীগের ‘প্রগতিশীল’ শাসনের সঙ্গে খাপে খাপ মিলে যাচ্ছে তা খতিয়ে দেখার দাবি রাখে। বিএনপি-জামায়াতের সৃষ্টি করা ডিক্রিগুলো দিয়ে আওয়ামী লীগ কীভাবে আইনের শাসন চালাচ্ছে, তার একটি তুলনামূলক পর্যালোচনা হওয়া উচিত।
ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে তাদের মাইলফলক রায়ে যা বলেন, তা আমাদের দেশে অনুসরণীয় হওয়া উচিত। ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বলেছেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খেয়াল-খুশিমাফিক আড়ি পাতার অনুমতি দিতে পারবে না। তাকে তার প্রতিটি আদেশে উপযুক্ত ও শক্তিশালী কারণ দেখাতে হবে। কোনো আদেশের মেয়াদ অনির্দিষ্টকাল হবে না। দুই মাস মেয়াদ থাকবে। এরপর আবার কারণ দেখিয়ে উপযুক্ত কমিটি দিয়ে বাড়ানো যাবে, কিন্তু তা ছয় মাসের বেশি হবে না। আবার এভাবে আড়ি পেতে যে রেকর্ড করা হবে, তা রেকর্ড করা থেকে দুই মাসের মধ্যে ব্যবহার ও তা ধ্বংস করে দিতে হবে। যেকোনো মূল্যে অবৈধ আড়ি পাতা এড়াতে হবে। কারও গোপনীয়তায় অনুপ্রবেশ হতে হবে ন্যূনতম।’ ১৯৯৬ সালে পিইউসিএল বনাম ভারত মামলায় বিচারপতি কুলদীপ সিং ও এস সগির আহমেদ রায়ের শুরুটাই করেছেন এই বলে যে আড়ি পাতা ব্যক্তির গোপনীয়তায় একটি মারাত্মক আগ্রাসন। আদালতের দেওয়া শর্তে আছে, কোনো রেকর্ডের কতটি অনুলিপি হবে, কতটুকুর ট্রান্সক্রিপশন হবে, কে কে দেখতে পাবেন, সেসব প্রাথমিক অনুমতির আদেশেই নির্দিষ্ট করতে হবে। সুপ্রিম কোর্ট এমনকি মন্ত্রিসভা, আইন ও টেলিযোগাযোগ—এই তিন সচিব দিয়ে রিভিউ কমিটি গঠনের উপায় বাতলে দেন। আমরা আশ্বস্ত হতে চাই যে আমাদের রাষ্ট্র ওই ধরনের কিংবা ন্যূনতম সংবেদনশীলতা বজায় রাখতে সংকল্পবদ্ধ। আমরা জানতে চাই, ২০০৬ সালের সংশোধনীতে দেওয়া ক্ষমতার কোনো অপব্যবহারের তদন্ত এ পর্যন্ত হয়েছে কি না? হলে তার ফলাফল কী?
ভারতের ওই রায়ে দেখি, আড়ি পাতা অপব্যবহারের ঘটনা সিবিআই তদন্ত করেছিল। আর তাতে দেখা যায়, ১৮০ দিনের সময়সীমা পেরোনোর পরেও ১১১টি কলে আড়ি পাতা চলছিল। একটি এজেন্সি কত কলে আড়ি পেতেছে তার লগবুক রাখেনি। ওই মামলায় নাগরিক সমাজের পক্ষে সুপারিশ ছিল যেকোনো আড়ি পাতার আদেশে কমিটির সইয়ের আগেই বিচার বিভাগীয় যাচাই-বাছাইয়ের দরকার হবে। আড়ি পাতার কোনো আদেশ হওয়ার ছয় সপ্তাহের মধ্যে তা একটি বোর্ডে আসবে। আমরা মনে রাখব, এই আড়ি পাতার সঙ্গে মিডিয়ার স্বাধীনতার নাড়ির সম্পর্ক থাকতে বাধ্য। সে জন্য বিচারপতি পি কে গোস্বামীর নেতৃত্বাধীন ভারতের দ্বিতীয় প্রেস কমিশন সুপারিশ করেছিল যে, যেভাবে কোনো ডিটেনশন আদেশ রিভিউ হয়, সেভাবে কোনো আড়ি পাতার আদেশ হওয়ার ছয় সপ্তাহের মধ্যে তা রিভিউর জন্য বোর্ডে আসবে।
উল্লেখ্য, আটকাদেশের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আমাদের সংবিধানে একটি উপদেষ্টা পর্ষদ করে দেওয়া আছে। এ রকম কোনো পর্ষদের কাছে আড়ি পাতার আদেশ রিভিউর জন্য প্রেরণের নিয়ম করা যায়। ওই পর্ষদ অনুমোদন না দিলে আড়ি পাতা তাৎক্ষণিক বন্ধ করতে হবে। আলামত ধ্বংস করতে হবে। আড়ি পাতা ক্ষমতার অপব্যবহারকে গুরুতর অসদাচরণ গণ্যে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
২০০৬ সালের মে মাসে বিএনপির আড়ি পাতা আইনের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে নিউ এজ সম্পাদক নূরুল কবীরের দায়ের করা একটি রিটে হাইকোর্ট রুল জারি করেছিলেন। তিন সপ্তাহের মধ্যে এর উত্তরদানের আদেশে সাড়া দেওয়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছিলেন তৎকালীন আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ। কিন্তু রাষ্ট্র নীরবতা বজায় রাখছে। তাই এসব বিষয়ে উচ্চ আদালতে আইনি লড়াইটা যত তাড়াতাড়ি বেগবান করা যায়, ততই উত্তম। আমরা একটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকারের সংকোচনের বিধানসংবলিত আড়ি পাতা আইনের বৈধতা পরখ ও তা প্রয়োগের ব্যাপারে স্বচ্ছতা চাই। একটি গাইডলাইন ও তার বাস্তবায়ন চাই।
মিজানুর রহমান খান: সাংবাদিক৷
mrkhanbd@gmail.com
No comments