বেঙ্গল শুপ ইন্ডাস্ট্রিজ- গ্রামে কারখানা, বিদেশে বিক্রি by সুজয় মহাজন ও এ বি এম রিপন
লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার বেঙ্গল শুর ইন্ডাস্ট্রিজে জুতা তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিকেরা l প্রথম আলো |
বেঙ্গল শুপ ইন্ডাস্ট্রিজ |
সকালের
কুয়াশা কাটতে না কাটতেই লক্ষ্মীপুর-রায়পুর সড়কে প্রতিদিন শত শত নারীর
লম্বা লাইন। অবরোধ-হরতালের মধ্যেও সবাই ছুটছেন একটি গন্তব্যে। কেউবা হেঁটে
আবার কেউবা সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা রিকশায় চড়ে।
এ দৃশ্য সাধারণত রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশে এবং চট্টগ্রামসহ তৈরি পোশাক কারখানাসমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে দেখা যায়। কিন্তু প্রত্যন্ত জনপদ লক্ষ্মীপুরে এ দৃশ্য নতুন আসা যেকোনো মানুষকে কৌতূহলী করে তুলবে। জানা গেল, সূর্যোদয়ের পর লক্ষ্মীপুর-রায়পুর সড়কে ছুটে চলা এসব নারী শিল্পশ্রমিক। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এসব নারীর হাত উৎপাদনের হাত।
যে শিল্পটিকে ঘিরে এ এলাকায় এমন দৃশ্য তৈরি হয়েছে, সেটির নাম বেঙ্গল শু ইন্ডাস্ট্রিজ। লক্ষ্মীপুর-রায়পুর সড়কের রাখালিয়া নামক স্থানে সড়কের পাশ ঘেঁষে প্রায় ১৬ একর জায়গা নিয়ে কারখানাটির অবস্থান। শতভাগ রপ্তানিমুখী চামড়াজাত জুতা তৈরির কারখানা এটি। ২০১১ সালে চালু হওয়া এ কারখানায় প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক কাজ করেন, যার ৮০ ভাগই নারী এবং বেশির ভাগই স্থানীয়।
স্থানীয় এলাকাবাসী ও কারখানাটির মালিক, কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে নানা তথ্য জানা গেছে। একসময় এটি ছিল সরকারি মালিকানাধীন নোয়াখালী টেক্সটাইল নামের একটি বস্ত্রকল। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০০৬ সালের শেষের দিকে বেসরকারীকরণ কমিশনের মাধ্যমে এর মালিকানা কিনে নেন বেঙ্গল শু ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক টিপু সুলতান, যিনি আগে থেকেই রাজধানীর হাজারীবাগে ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জন্মসূত্রে যিনি লক্ষ্মীপুরের সন্তান।
সম্প্রতি সরেজমিনে পরিদর্শনকালে কারখানাটির উপমহাব্যবস্থাপক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ২০১১ সালে এর উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়। ওই বছরের আগস্টে প্রথম চালান রপ্তানি করা হয়। প্রতি মাসে দেড় লাখ জোড়া জুতা তৈরির ক্ষমতা রয়েছে এটির। তবে মাত্র কয়েক বছরের প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এখন পর্যন্ত পূর্ণ মাত্রায় উৎপাদন সক্ষমতাকে কাজে লাগানো হয়নি।
কারখানার মালিক টিপু সুলতান জানান, তাঁর বাবার ইচ্ছা পূরণের জন্য নিজ জন্মস্থানে এ কারখানাটি সরকারের কাছ থেকে কিনে নিয়ে আবার সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় লোকজনের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার কিছুটা হলেও পরিবর্তন করা।
বেসরকারীকরণ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালে কারখানাটি দায়দেনাসহ প্রায় চার কোটি টাকায় ব্যক্তিমালিকানার হাতে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ওই স্থানে ১৯৭৮ সালে সরকারি উদ্যোগে নোয়াখালী টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যেটির উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। নব্বইয়ের দশকে এসে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নানা সমস্যায় পড়ে এটির উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। একপর্যায়ে মিলটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রত্যন্ত অঞ্চল হলেও এটিতে রয়েছে শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। বিদেশি ক্রেতা থেকে শুরু করে নারী ও পুরুষ শ্রমিক, কর্মকর্তাদের থাকার আলাদা ব্যবস্থা। রয়েছে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র, মেডিকেল সুবিধা, সার্বক্ষণিক চিকিৎসক-সুবিধা। এমনকি বিদেশি ক্রেতাদের যাতায়াতের সুবিধার্থে হেলিপ্যাডও তৈরি করা হয়েছে কারখানা-সংলগ্ন এলাকায়। বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে রয়েছে উচ্চক্ষমতার একাধিক জেনারেটর।
টিপু সুলতান জানান, মিলটি কেনার পর পুনঃসংস্কার ও আধুনিকায়নে প্রায় ৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৮৫ কোটি টাকার পণ্য বা জুতা রপ্তানি করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তিনি আরও জানান, ইতালি, জার্মানি, ইংল্যান্ড, কানাডা ও জাপানেই মূলত কারখানার পণ্য নিয়মিতভাবে রপ্তানি করা হয়। এ ছাড়া আমেরিকাসহ বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে।
কারখানা ঘুরে ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত এ কারখানাটিতে তৈরি হয় কানাডার বিখ্যাত এলডো ও বাটা, ইউরোপের হাসপাপিস ও জাপানের জুতার বৃহৎ চেইন শপ এবিসি ব্র্যান্ডের চামড়াজাত জুতা।
রপ্তানি শুরু ও বিশ্বের বিভিন্ন দামি ব্র্যান্ডের জুতা তৈরি করা হলেও এখন পর্যন্ত কারখানাটি লাভের মুখ দেখেনি বলে জানান টিপু সুলতান। তিনি বলেন, ‘কারখানাটিতে আমাদের বিনিয়োগ, উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ যে খরচ, তাতে লাভের মুখ দেখতে হলে প্রতিবছর গড়ে ৮০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করতে হবে। সেখানে এখন পর্যন্ত আমাদের বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক।’ তবে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের যে সুনাম, তাতে লাভের মুখ দেখতে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না বলে মনে করেন তিনি।
স্থানীয় মালিকানার প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় শ্রমিকের মাধ্যমে কারখানাটি পরিচালিত হয় বলে চলমান অবরোধ-হরতালেও উৎপাদন কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে এলাকার সব ধরনের মানুষের মধ্যেই মিলটি বিষয়ে বেশ সহানুভূতি রয়েছে। তাই লক্ষ্মীপুরের সহিংস রাজনীতির মধ্যেও এটির কার্যক্রম ব্যাহত হয়—এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এমনকি শ্রমিকদের কাজে যোগদানের ক্ষেত্রেও কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়নি।
কারখানাটির শ্রমিক স্বামী পরিত্যক্ত রহিমা বেগম জানান, স্বামী তাঁকে ফেলে চলে যাওয়ার পর দুই বছর আগে তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরি নেন। এখন চাকরির টাকায় দুই ছেলেকে লেখাপড়া করানোর পাশাপাশি পুরো সংসারের হাল ধরেছেন।
কারখানার শ্রমিক হাজেরা বেগম ও রূপালী রানী জানান, স্থানীয় পর্যায়ে এমন একটি প্রতিষ্ঠান থাকায় এ অঞ্চলের অসহায় অনেক মেয়ের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। মাস শেষে নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন তাঁরা। নিজ বাড়িতে থেকেই কাজ করতে পারছেন অনেক নারী। এতে করে পরিবার থেকে যেমন দূরে থাকতে হচ্ছে না, তেমনি বসবাসের পেছনে বাড়তি কোনো অর্থও ব্যয় হয় না। ফলে মাসের পুরো বেতনটাকে পরিবারের কাজে ভালোভাবে ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন। পাশাপাশি সংসারের ভালোমন্দ দেখভাল করতে পারছেন।
শ্রমিকেরা জানান, প্রতিষ্ঠানটির মালিক থেকে শুরু করে কর্মকর্তারা শ্রমিকদের বিষয়ে খুবই আন্তরিক। কাজের পাশাপাশি পারিবারিক বিষয়েও নানা ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করেন।
কাজের সুবিধার্থে কারখানা মালিকের পক্ষ থেকে প্রতিদিন দুপুরে দেড় সহস্রাধিক শ্রমিকের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। নিজস্ব উদ্যোগেই কারখানার অভ্যন্তরে খাবার তৈরি করা হয়। এ ছাড়া নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের জন্য আলাদা খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে মিলের অভ্যন্তরে।
কারখানাটির শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেতন-ভাতার দিক থেকে একটি মান বজায় রাখা হয়। অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য রয়েছে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। মোট শ্রমিকের মধ্যে ৮০ শতাংশই অদক্ষ। পরবর্তী সময়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাঁদের দক্ষ করে তোলা হয়েছে। নিয়োগের শুরুতে একজন শ্রমিক সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে অতিরিক্ত কাজের জন্য আলাদা ভাতা দেওয়া হয়।
সবশেষে টিপু সুলতান জানান, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অন্যান্য ব্যবসায়ীর মতো তিনিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। রপ্তানিমুখী চামড়া শিল্পের জন্য বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়টা ক্রয়াদেশ আসার সময়। এ সময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ থাকায় তিনি বেশ কয়েকজন বিশ্বখ্যাত ক্রেতার সম্ভাব্য ক্রয়াদেশ হারিয়েছেন। রপ্তানি বাজারে শক্ত অবস্থান তৈরির পর স্থানীয় বাজারের জন্যও পণ্য তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে বলে তিনি জানান।
এ দৃশ্য সাধারণত রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশে এবং চট্টগ্রামসহ তৈরি পোশাক কারখানাসমৃদ্ধ এলাকাগুলোতে দেখা যায়। কিন্তু প্রত্যন্ত জনপদ লক্ষ্মীপুরে এ দৃশ্য নতুন আসা যেকোনো মানুষকে কৌতূহলী করে তুলবে। জানা গেল, সূর্যোদয়ের পর লক্ষ্মীপুর-রায়পুর সড়কে ছুটে চলা এসব নারী শিল্পশ্রমিক। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এসব নারীর হাত উৎপাদনের হাত।
যে শিল্পটিকে ঘিরে এ এলাকায় এমন দৃশ্য তৈরি হয়েছে, সেটির নাম বেঙ্গল শু ইন্ডাস্ট্রিজ। লক্ষ্মীপুর-রায়পুর সড়কের রাখালিয়া নামক স্থানে সড়কের পাশ ঘেঁষে প্রায় ১৬ একর জায়গা নিয়ে কারখানাটির অবস্থান। শতভাগ রপ্তানিমুখী চামড়াজাত জুতা তৈরির কারখানা এটি। ২০১১ সালে চালু হওয়া এ কারখানায় প্রায় দেড় হাজার শ্রমিক কাজ করেন, যার ৮০ ভাগই নারী এবং বেশির ভাগই স্থানীয়।
স্থানীয় এলাকাবাসী ও কারখানাটির মালিক, কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে নানা তথ্য জানা গেছে। একসময় এটি ছিল সরকারি মালিকানাধীন নোয়াখালী টেক্সটাইল নামের একটি বস্ত্রকল। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর ২০০৬ সালের শেষের দিকে বেসরকারীকরণ কমিশনের মাধ্যমে এর মালিকানা কিনে নেন বেঙ্গল শু ইন্ডাস্ট্রিজের মালিক টিপু সুলতান, যিনি আগে থেকেই রাজধানীর হাজারীবাগে ট্যানারি শিল্পের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জন্মসূত্রে যিনি লক্ষ্মীপুরের সন্তান।
সম্প্রতি সরেজমিনে পরিদর্শনকালে কারখানাটির উপমহাব্যবস্থাপক জহিরুল ইসলাম চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, ২০১১ সালে এর উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়। ওই বছরের আগস্টে প্রথম চালান রপ্তানি করা হয়। প্রতি মাসে দেড় লাখ জোড়া জুতা তৈরির ক্ষমতা রয়েছে এটির। তবে মাত্র কয়েক বছরের প্রতিষ্ঠান হওয়ায় এখন পর্যন্ত পূর্ণ মাত্রায় উৎপাদন সক্ষমতাকে কাজে লাগানো হয়নি।
কারখানার মালিক টিপু সুলতান জানান, তাঁর বাবার ইচ্ছা পূরণের জন্য নিজ জন্মস্থানে এ কারখানাটি সরকারের কাছ থেকে কিনে নিয়ে আবার সচল করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এর উদ্দেশ্য ছিল স্থানীয় লোকজনের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে এলাকার আর্থসামাজিক অবস্থার কিছুটা হলেও পরিবর্তন করা।
বেসরকারীকরণ কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৪ সালে কারখানাটি দায়দেনাসহ প্রায় চার কোটি টাকায় ব্যক্তিমালিকানার হাতে স্থানান্তর করা হয়। এর আগে ওই স্থানে ১৯৭৮ সালে সরকারি উদ্যোগে নোয়াখালী টেক্সটাইল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল, যেটির উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হয়েছিল ১৯৮৪ সালে। নব্বইয়ের দশকে এসে গ্যাস, বিদ্যুৎসহ নানা সমস্যায় পড়ে এটির উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। একপর্যায়ে মিলটি পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রত্যন্ত অঞ্চল হলেও এটিতে রয়েছে শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য সব ধরনের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা। বিদেশি ক্রেতা থেকে শুরু করে নারী ও পুরুষ শ্রমিক, কর্মকর্তাদের থাকার আলাদা ব্যবস্থা। রয়েছে শিশু পরিচর্যা কেন্দ্র, মেডিকেল সুবিধা, সার্বক্ষণিক চিকিৎসক-সুবিধা। এমনকি বিদেশি ক্রেতাদের যাতায়াতের সুবিধার্থে হেলিপ্যাডও তৈরি করা হয়েছে কারখানা-সংলগ্ন এলাকায়। বিদ্যুতের বিকল্প হিসেবে রয়েছে উচ্চক্ষমতার একাধিক জেনারেটর।
টিপু সুলতান জানান, মিলটি কেনার পর পুনঃসংস্কার ও আধুনিকায়নে প্রায় ৭০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হয়েছে। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি ৮৫ কোটি টাকার পণ্য বা জুতা রপ্তানি করেছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। তিনি আরও জানান, ইতালি, জার্মানি, ইংল্যান্ড, কানাডা ও জাপানেই মূলত কারখানার পণ্য নিয়মিতভাবে রপ্তানি করা হয়। এ ছাড়া আমেরিকাসহ বিশ্বের আরও কয়েকটি দেশে ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করা হয়েছে।
কারখানা ঘুরে ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতিষ্ঠিত এ কারখানাটিতে তৈরি হয় কানাডার বিখ্যাত এলডো ও বাটা, ইউরোপের হাসপাপিস ও জাপানের জুতার বৃহৎ চেইন শপ এবিসি ব্র্যান্ডের চামড়াজাত জুতা।
রপ্তানি শুরু ও বিশ্বের বিভিন্ন দামি ব্র্যান্ডের জুতা তৈরি করা হলেও এখন পর্যন্ত কারখানাটি লাভের মুখ দেখেনি বলে জানান টিপু সুলতান। তিনি বলেন, ‘কারখানাটিতে আমাদের বিনিয়োগ, উৎপাদন ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ যে খরচ, তাতে লাভের মুখ দেখতে হলে প্রতিবছর গড়ে ৮০ কোটি টাকার পণ্য রপ্তানি করতে হবে। সেখানে এখন পর্যন্ত আমাদের বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণ প্রয়োজনের তুলনায় অর্ধেক।’ তবে এখন পর্যন্ত প্রতিষ্ঠানের যে সুনাম, তাতে লাভের মুখ দেখতে খুব বেশি দিন অপেক্ষা করতে হবে না বলে মনে করেন তিনি।
স্থানীয় মালিকানার প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় শ্রমিকের মাধ্যমে কারখানাটি পরিচালিত হয় বলে চলমান অবরোধ-হরতালেও উৎপাদন কার্যক্রম স্বাভাবিক রয়েছে। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে এলাকার সব ধরনের মানুষের মধ্যেই মিলটি বিষয়ে বেশ সহানুভূতি রয়েছে। তাই লক্ষ্মীপুরের সহিংস রাজনীতির মধ্যেও এটির কার্যক্রম ব্যাহত হয়—এ ধরনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এমনকি শ্রমিকদের কাজে যোগদানের ক্ষেত্রেও কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়নি।
কারখানাটির শ্রমিক স্বামী পরিত্যক্ত রহিমা বেগম জানান, স্বামী তাঁকে ফেলে চলে যাওয়ার পর দুই বছর আগে তিনি প্রতিষ্ঠানটিতে চাকরি নেন। এখন চাকরির টাকায় দুই ছেলেকে লেখাপড়া করানোর পাশাপাশি পুরো সংসারের হাল ধরেছেন।
কারখানার শ্রমিক হাজেরা বেগম ও রূপালী রানী জানান, স্থানীয় পর্যায়ে এমন একটি প্রতিষ্ঠান থাকায় এ অঞ্চলের অসহায় অনেক মেয়ের কর্মসংস্থানের সুযোগ হয়েছে। মাস শেষে নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন তাঁরা। নিজ বাড়িতে থেকেই কাজ করতে পারছেন অনেক নারী। এতে করে পরিবার থেকে যেমন দূরে থাকতে হচ্ছে না, তেমনি বসবাসের পেছনে বাড়তি কোনো অর্থও ব্যয় হয় না। ফলে মাসের পুরো বেতনটাকে পরিবারের কাজে ভালোভাবে ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছেন। পাশাপাশি সংসারের ভালোমন্দ দেখভাল করতে পারছেন।
শ্রমিকেরা জানান, প্রতিষ্ঠানটির মালিক থেকে শুরু করে কর্মকর্তারা শ্রমিকদের বিষয়ে খুবই আন্তরিক। কাজের পাশাপাশি পারিবারিক বিষয়েও নানা ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা করেন।
কাজের সুবিধার্থে কারখানা মালিকের পক্ষ থেকে প্রতিদিন দুপুরে দেড় সহস্রাধিক শ্রমিকের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। নিজস্ব উদ্যোগেই কারখানার অভ্যন্তরে খাবার তৈরি করা হয়। এ ছাড়া নারী ও পুরুষ শ্রমিকদের জন্য আলাদা খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে মিলের অভ্যন্তরে।
কারখানাটির শ্রমিক ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেতন-ভাতার দিক থেকে একটি মান বজায় রাখা হয়। অদক্ষ শ্রমিকদের জন্য রয়েছে নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। মোট শ্রমিকের মধ্যে ৮০ শতাংশই অদক্ষ। পরবর্তী সময়ে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাঁদের দক্ষ করে তোলা হয়েছে। নিয়োগের শুরুতে একজন শ্রমিক সর্বনিম্ন পাঁচ হাজার টাকা বেতন পান। এর বাইরে অতিরিক্ত কাজের জন্য আলাদা ভাতা দেওয়া হয়।
সবশেষে টিপু সুলতান জানান, দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে অন্যান্য ব্যবসায়ীর মতো তিনিও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। রপ্তানিমুখী চামড়া শিল্পের জন্য বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ সময়টা ক্রয়াদেশ আসার সময়। এ সময়ে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি খারাপ থাকায় তিনি বেশ কয়েকজন বিশ্বখ্যাত ক্রেতার সম্ভাব্য ক্রয়াদেশ হারিয়েছেন। রপ্তানি বাজারে শক্ত অবস্থান তৈরির পর স্থানীয় বাজারের জন্যও পণ্য তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে বলে তিনি জানান।
No comments