জঙ্গিদের ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড by বদরুদ্দীন উমর
অপরাধের
জন্য শাস্তির ব্যবস্থা না থাকলে অথবা অপরাধীদের শাস্তির ব্যাপারে
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নিজের দায়িত্ব পালনে কর্তব্য কাজ বিবেচনা না করলে দেশে
যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, বাংলাদেশে এখন তা-ই হয়েছে। এটা যে রাতারাতি হয়েছে
এমন নয়। ১৯৭২ সাল থেকে প্রতিটি সরকার নিজেই আইনের বাইরে কাজ করে যেভাবে
জনগণের ওপর নির্যাতন করে এসেছে, তার ভয়াবহ পরিণতিই এখন দেখা যাচ্ছে। পুলিশ,
র্যাব, বিজিবি ইত্যাদি আইনশৃংখলা রক্ষাকারী সংস্থা নিজেরাই এনকাউন্টার,
ক্রসফায়ার, গুম ইত্যাদির মাধ্যমে যেভাবে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড
স্বেচ্ছাচারিতার মতো করে চালিয়ে এসেছে, তার প্রভাব সরকারের বাইরে থাকা নানা
প্রকার লোকদের ওপরও দেখা যাচ্ছে। এটাই স্বাভাবিক। চুরি, ডাকাতি,
খুন-খারাবি যারা করে, তাদের ধরা যাদের কাজ তারা নিজেরাই যদি এসব কাজ করে
তাহলে চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসীরা যে এসব অপরাধ করতে উৎসাহী ও বেপরোয়া হবে এতে
বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। এর পরিণতিতে সাধারণভাবে সমাজের অপরাধিকীকরণের
মাত্রা বৃদ্ধি পেতে থাকার কথা, যা বাংলাদেশে পেয়েছে।
বাংলাদেশে এখন নানা ধরনের অপরাধের ঘটনা ব্যাপকভাবে হচ্ছে। সংবাদপত্রে এসবের রিপোর্ট প্রত্যেক দিনই এমনভাবে থাকে যে মনে হয় বাংলাদেশ এখন পরিণত হয়েছে অপরাধীদের এক অভয়ারণ্যে। জেলহাজতে মৃত্যু, ক্রসফায়ারে মৃত্যু, গুম-খুন ইত্যাদির ঘটনা পুলিশ, র্যাব যেভাবে ঘটিয়ে চলেছে তাতে এই সরকারি সংস্থাগুলোকে এখন আর কেউ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বলে মনে করে না। সাধারণ মানুষের চেতনায় এরা এখন অপরাধ জগতেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটা হওয়ার কারণে পুলিশ এখন আর জননিরাপত্তা নিজের দায়িত্ব মনে করে না। মনে হয়, এদের দায়িত্ব শুধু সরকারি লোকদের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখা। সরকারি অনুষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা বিষয়ে সংবাদপত্রে প্রায়ই দেখা যায় অনুষ্ঠানের জায়গায় ‘নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদর’ বিছিয়ে রাখার কথা। নিরাপত্তার এই চাদর পুলিশ, র্যাব, ডিবি ঠিকই বিছিয়ে রাখে। এর ফলে সরকারি অনুষ্ঠানগুলো নিরাপদ থাকে। সরকারি লোকদের ওপর হামলা হয় না। এটা ভালো কথা। কিন্তু সরকারি লোকদের জন্য পুলিশ কর্তৃপক্ষ যে দায়িত্ব পালন করে, সে দায়িত্ব জনগণের নিরাপত্তার জন্য পালন করাও পুলিশের একই প্রকার কর্তব্য। এ কর্তব্যে অবহেলা সমাজের জন্য বিপজ্জনক। এ বিপদ এখন বাংলাদেশের জনগণের ওপর খাঁড়ার মতো ঝুলছে।
২৬ ফেব্রুয়ারি রাত প্রায় ৯টার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পার্শ্ববর্তী ফুটপাতের ওপর অভিজিৎ রায় নামে এক লেখক ও তার স্ত্রীর ওপর দু’জন সন্ত্রাসী সশস্ত্র হামলা করে। চাপাতির আঘাতে অভিজিতের মাথায় গর্ত হয়ে যায়। অনেক কোপ তার ওপর পড়ে। তাকে রক্ষার জন্য তার স্ত্রী রাফিদা আহমদ চেষ্টা করলে তাকেও তারা চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। এ সময় তিনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করলে কাছাকাছি উপস্থিত লোকজন এবং পুলিশ কেউই এগিয়ে আসেনি। সন্ত্রাসীরা তাদের অপরাধ কর্ম করে, তাদের অস্ত্র ফেলে দিয়ে কোনো বাধার মুখোমুখি না হয়ে নিরাপদে পালিয়ে যায়। এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার যে, এ সময়ে ওই এলাকায় ছাত্রসহ বহু লোক উপস্থিত ছিল। তাদের উপস্থিতি জমজমাট ছিল, কারণ জায়গাটি বাংলা একাডেমি বইমেলার একেবারে পার্শ্ববর্তী। এছাড়া সেখানে ছিল পুলিশের উপস্থিতি। বইমেলা এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে তারা নিযুক্ত ছিল। কিন্তু ঘটনার সময় তারা কাছাকাছি থাকলেও সাহায্যের জন্য অভিজিতের স্ত্রীর চিৎকারে এগিয়ে আসেনি। তারা ক্রসফায়ারে সিদ্ধহস্ত হলেও এই সন্ত্রাসী খুনিদের গুলি করার কোনো চেষ্টা তারা করেনি। পুলিশ কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সাফাই গেয়ে বলা হয়েছে যে, পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দূরে থাকায় তাদের পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যেখানে ‘নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদর’ বিছিয়ে রাখার কথা, সেখানে কেন পুলিশ অবলোকনকারীর ভূমিকায় দাঁড়িয়ে থাকে? এভাবে পুলিশ থাকা না থাকার মধ্যে পার্থক্য কী? এসব প্রশ্ন স্বাভাবিক। এ প্রশ্ন এখন বিভিন্ন মহল থেকে করা হচ্ছে। জনগণের অর্থে প্রতিপালিত এই বাহিনী যদি জনগণের কোনো কাজে না লাগে তাহলে এর প্রয়োজন কী?
অভিজিৎ রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অজয় রায়ের পুত্র। তিনি সপরিবারে থাকতেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এ বছর তার তিনটি বই মেলায় প্রকাশিত হওয়া উপলক্ষে তিনি ঢাকা এসেছিলেন। ২৬ তারিখে রাত আটটার পর মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে ফুটপাতের ওপর দিয়ে হেঁটে চলার সময় তিনি সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হন। সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, ধর্মীয় সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তার ব্লগে লেখালেখির কারণে তিন-চার বছর ধরেই তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল সন্ত্রাসীরা। ফারাবী নামে এক সন্ত্রাসীর এ হুমকির বিষয়ে এক সংবাদপত্র রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, সে ২০১৪ সালের ৯ মে তার ফেসবুকে লিখেছিল, ‘অভিজিৎ রায় আমেরিকায় থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব নয়। তবে সে যখন দেশে আসবে তখন তাকে হত্যা করা হবে’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৮.০২.২০১৫)। এর থেকে স্পষ্ট হুমকি আর কী হতে পারে? তিন-চার বছর ধরেই বাংলা ব্লগে অভিজিৎকে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে আসছিল উপরোক্ত ফারাবী। অনলাইনে প্রচারিত ব্লগারদের হিটলিস্টেও রাখা হয়েছিল অভিজিৎকে। হত্যার পর আনসার বাংলা-৭ নামে এক সন্ত্রাসী গ্র“প এর দায় স্বীকার করে বার্তা প্রচার করেছে। এরাও তিন-চার বছর ধরে অভিজিৎকে ‘ভিআইপি টার্গেট’ হিসেবে রাখার কথা বলে এসেছে। এসব থেকে বোঝার কোনো অসুবিধা নেই যে, ২৬ ফেব্রুয়ারির এ হত্যাকাণ্ড ধর্মান্ধ জঙ্গিদেরই পরিকল্পিত কাজ।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার-আলবদর বাহিনী ও জামায়াতের লোকরা যেসব হত্যাকাণ্ড করেছিল তার বিচারের প্রক্রিয়া এখন চলছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের লোকদের কানফাটা আওয়াজের শেষ নেই। এই বিচার অবশ্যই দরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশেষভাবে বলা দরকার যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী এবং বর্তমানে সক্রিয় ইসলামী জঙ্গিদের অপরাধ তৎপরতার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সাধারণ অবস্থায় এই শেষোক্তরা যে হত্যাকাণ্ড করেছে, যেসব অপরাধ করছে তাতে এরা যুদ্ধাপরাধীদের মতোই, অথবা তার থেকেও বেশি শাস্তিযোগ্য। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর এদের অপরাধ কাণ্ড সারা দেশে অপরাধীকীকরণের মাত্রা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি এবং ধর্মের নামে চিন্তার জগৎকে বিষাক্ত করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এদের বিরুদ্ধে পুলিশ, র্যাব ইত্যাদির যে তৎপরতা প্রয়োজন সেটা না থাকলেও এ ক্ষেত্রে তাদের দাবি খুব সোচ্চার। তাদের এই দাবি এবং কার্যক্ষেত্রে তাদের ভূমিকার মধ্যে যে কত তফাৎ তার এক বড় উদাহরণ হল ২৬ তারিখে অভিজিৎ রায়ের হত্যার ঘটনা।
এ প্রসঙ্গে অন্য একটি ঘটনার উল্লেখ প্রয়োজন। মাত্র কয়েকদিন আগে মিরপুরে তিনজন যুবককে রাত্রিকালে হত্যা করা হয়। ঘটনাটি ঘটে মিরপুর থানার পার্শ্ববর্তী জায়গায়। পুলিশ বলে যে, এই মৃত্যু ঘটেছে গণপিটুনির কারণে। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওই তিনজনের কেউই গণপিটুনিতে মারা যায়নি। তারা মারা গেছে বুলেটবিদ্ধ হয়ে। তাদের তিনজনের গায়ে মোট ৫৬টি গুলির আঘাত চিহ্ন আছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তাদের মৃতদেহের ছবিতেও স্পষ্টভাবেই এ চিহ্ন দেখা যায়। এর থেকে বোঝার অসুবিধা নেই যে, গণপিটুনিতে তিন যুবকের মৃত্যু হয়নি। তাছাড়া গণপিটুনি দেয়ার সময় লোকজন ঘটনাস্থলে বন্দুক নিয়ে গিয়ে কাউকে গুলি করে না। কাজেই এটা ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং পুলিশ যেভাবে একে গণপিটুনি বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে, তাতে এটা ধরে নেয়া ভুল হবে না যে, এ কাজ পুলিশেরই। এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার ইত্যাদিতে অভ্যস্ত পুলিশ ও র্যাব বেপরোয়াভাবে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে চালিয়ে যাচ্ছে। মিরপুরের হত্যাকাণ্ড হল তারই এক দৃষ্টান্ত।
এ ঘটনার অন্যদিক হল, মিরপুরের এই হত্যাকাণ্ডের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও এর বিরুদ্ধে কোনো উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। কোনো বিক্ষোভ, বুদ্ধিজীবীদের টকশোর আলোচনা, পত্রপত্রিকায় কোনো আলোচনা দেখা যায়নি। মনে হয়, এ কাজ পুলিশের, এটা জানার পর সবাই নিশ্চিত হয়েছে! কাজেই ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে তার বিরোধিতা ও প্রতিবাদ ব্যাপকভাবে হলেও পুলিশের এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সবাই নীরব আছে!! বলাই বাহুল্য যে, এ নীরবতাই বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের অন্যতম ভিত্তি।
২৮.০২.২০১৫
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
বাংলাদেশে এখন নানা ধরনের অপরাধের ঘটনা ব্যাপকভাবে হচ্ছে। সংবাদপত্রে এসবের রিপোর্ট প্রত্যেক দিনই এমনভাবে থাকে যে মনে হয় বাংলাদেশ এখন পরিণত হয়েছে অপরাধীদের এক অভয়ারণ্যে। জেলহাজতে মৃত্যু, ক্রসফায়ারে মৃত্যু, গুম-খুন ইত্যাদির ঘটনা পুলিশ, র্যাব যেভাবে ঘটিয়ে চলেছে তাতে এই সরকারি সংস্থাগুলোকে এখন আর কেউ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী বলে মনে করে না। সাধারণ মানুষের চেতনায় এরা এখন অপরাধ জগতেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটা হওয়ার কারণে পুলিশ এখন আর জননিরাপত্তা নিজের দায়িত্ব মনে করে না। মনে হয়, এদের দায়িত্ব শুধু সরকারি লোকদের নিরাপত্তার দিকে খেয়াল রাখা। সরকারি অনুষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা বিষয়ে সংবাদপত্রে প্রায়ই দেখা যায় অনুষ্ঠানের জায়গায় ‘নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদর’ বিছিয়ে রাখার কথা। নিরাপত্তার এই চাদর পুলিশ, র্যাব, ডিবি ঠিকই বিছিয়ে রাখে। এর ফলে সরকারি অনুষ্ঠানগুলো নিরাপদ থাকে। সরকারি লোকদের ওপর হামলা হয় না। এটা ভালো কথা। কিন্তু সরকারি লোকদের জন্য পুলিশ কর্তৃপক্ষ যে দায়িত্ব পালন করে, সে দায়িত্ব জনগণের নিরাপত্তার জন্য পালন করাও পুলিশের একই প্রকার কর্তব্য। এ কর্তব্যে অবহেলা সমাজের জন্য বিপজ্জনক। এ বিপদ এখন বাংলাদেশের জনগণের ওপর খাঁড়ার মতো ঝুলছে।
২৬ ফেব্রুয়ারি রাত প্রায় ৯টার সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পার্শ্ববর্তী ফুটপাতের ওপর অভিজিৎ রায় নামে এক লেখক ও তার স্ত্রীর ওপর দু’জন সন্ত্রাসী সশস্ত্র হামলা করে। চাপাতির আঘাতে অভিজিতের মাথায় গর্ত হয়ে যায়। অনেক কোপ তার ওপর পড়ে। তাকে রক্ষার জন্য তার স্ত্রী রাফিদা আহমদ চেষ্টা করলে তাকেও তারা চাপাতি দিয়ে আঘাত করে। এ সময় তিনি সাহায্যের জন্য চিৎকার করলে কাছাকাছি উপস্থিত লোকজন এবং পুলিশ কেউই এগিয়ে আসেনি। সন্ত্রাসীরা তাদের অপরাধ কর্ম করে, তাদের অস্ত্র ফেলে দিয়ে কোনো বাধার মুখোমুখি না হয়ে নিরাপদে পালিয়ে যায়। এখানে বিশেষভাবে বলা দরকার যে, এ সময়ে ওই এলাকায় ছাত্রসহ বহু লোক উপস্থিত ছিল। তাদের উপস্থিতি জমজমাট ছিল, কারণ জায়গাটি বাংলা একাডেমি বইমেলার একেবারে পার্শ্ববর্তী। এছাড়া সেখানে ছিল পুলিশের উপস্থিতি। বইমেলা এলাকায় নিরাপত্তার দায়িত্বে তারা নিযুক্ত ছিল। কিন্তু ঘটনার সময় তারা কাছাকাছি থাকলেও সাহায্যের জন্য অভিজিতের স্ত্রীর চিৎকারে এগিয়ে আসেনি। তারা ক্রসফায়ারে সিদ্ধহস্ত হলেও এই সন্ত্রাসী খুনিদের গুলি করার কোনো চেষ্টা তারা করেনি। পুলিশ কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সাফাই গেয়ে বলা হয়েছে যে, পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে দূরে থাকায় তাদের পক্ষে সেখানে যাওয়া সম্ভব হয়নি। যেখানে ‘নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তার চাদর’ বিছিয়ে রাখার কথা, সেখানে কেন পুলিশ অবলোকনকারীর ভূমিকায় দাঁড়িয়ে থাকে? এভাবে পুলিশ থাকা না থাকার মধ্যে পার্থক্য কী? এসব প্রশ্ন স্বাভাবিক। এ প্রশ্ন এখন বিভিন্ন মহল থেকে করা হচ্ছে। জনগণের অর্থে প্রতিপালিত এই বাহিনী যদি জনগণের কোনো কাজে না লাগে তাহলে এর প্রয়োজন কী?
অভিজিৎ রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অজয় রায়ের পুত্র। তিনি সপরিবারে থাকতেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। এ বছর তার তিনটি বই মেলায় প্রকাশিত হওয়া উপলক্ষে তিনি ঢাকা এসেছিলেন। ২৬ তারিখে রাত আটটার পর মেলা প্রাঙ্গণ থেকে বের হয়ে ফুটপাতের ওপর দিয়ে হেঁটে চলার সময় তিনি সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হন। সংবাদপত্রের রিপোর্ট থেকে দেখা যায় যে, ধর্মীয় সন্ত্রাস ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে তার ব্লগে লেখালেখির কারণে তিন-চার বছর ধরেই তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল সন্ত্রাসীরা। ফারাবী নামে এক সন্ত্রাসীর এ হুমকির বিষয়ে এক সংবাদপত্র রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে যে, সে ২০১৪ সালের ৯ মে তার ফেসবুকে লিখেছিল, ‘অভিজিৎ রায় আমেরিকায় থাকে। তাই তাকে এখন হত্যা করা সম্ভব নয়। তবে সে যখন দেশে আসবে তখন তাকে হত্যা করা হবে’ (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২৮.০২.২০১৫)। এর থেকে স্পষ্ট হুমকি আর কী হতে পারে? তিন-চার বছর ধরেই বাংলা ব্লগে অভিজিৎকে প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে আসছিল উপরোক্ত ফারাবী। অনলাইনে প্রচারিত ব্লগারদের হিটলিস্টেও রাখা হয়েছিল অভিজিৎকে। হত্যার পর আনসার বাংলা-৭ নামে এক সন্ত্রাসী গ্র“প এর দায় স্বীকার করে বার্তা প্রচার করেছে। এরাও তিন-চার বছর ধরে অভিজিৎকে ‘ভিআইপি টার্গেট’ হিসেবে রাখার কথা বলে এসেছে। এসব থেকে বোঝার কোনো অসুবিধা নেই যে, ২৬ ফেব্রুয়ারির এ হত্যাকাণ্ড ধর্মান্ধ জঙ্গিদেরই পরিকল্পিত কাজ।
১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার-আলবদর বাহিনী ও জামায়াতের লোকরা যেসব হত্যাকাণ্ড করেছিল তার বিচারের প্রক্রিয়া এখন চলছে। এ নিয়ে আওয়ামী লীগ সরকার ও তাদের লোকদের কানফাটা আওয়াজের শেষ নেই। এই বিচার অবশ্যই দরকার। কিন্তু এক্ষেত্রে বিশেষভাবে বলা দরকার যে, ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী এবং বর্তমানে সক্রিয় ইসলামী জঙ্গিদের অপরাধ তৎপরতার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সাধারণ অবস্থায় এই শেষোক্তরা যে হত্যাকাণ্ড করেছে, যেসব অপরাধ করছে তাতে এরা যুদ্ধাপরাধীদের মতোই, অথবা তার থেকেও বেশি শাস্তিযোগ্য। কারণ মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর এদের অপরাধ কাণ্ড সারা দেশে অপরাধীকীকরণের মাত্রা ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি এবং ধর্মের নামে চিন্তার জগৎকে বিষাক্ত করছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও এদের বিরুদ্ধে পুলিশ, র্যাব ইত্যাদির যে তৎপরতা প্রয়োজন সেটা না থাকলেও এ ক্ষেত্রে তাদের দাবি খুব সোচ্চার। তাদের এই দাবি এবং কার্যক্ষেত্রে তাদের ভূমিকার মধ্যে যে কত তফাৎ তার এক বড় উদাহরণ হল ২৬ তারিখে অভিজিৎ রায়ের হত্যার ঘটনা।
এ প্রসঙ্গে অন্য একটি ঘটনার উল্লেখ প্রয়োজন। মাত্র কয়েকদিন আগে মিরপুরে তিনজন যুবককে রাত্রিকালে হত্যা করা হয়। ঘটনাটি ঘটে মিরপুর থানার পার্শ্ববর্তী জায়গায়। পুলিশ বলে যে, এই মৃত্যু ঘটেছে গণপিটুনির কারণে। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, ওই তিনজনের কেউই গণপিটুনিতে মারা যায়নি। তারা মারা গেছে বুলেটবিদ্ধ হয়ে। তাদের তিনজনের গায়ে মোট ৫৬টি গুলির আঘাত চিহ্ন আছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত তাদের মৃতদেহের ছবিতেও স্পষ্টভাবেই এ চিহ্ন দেখা যায়। এর থেকে বোঝার অসুবিধা নেই যে, গণপিটুনিতে তিন যুবকের মৃত্যু হয়নি। তাছাড়া গণপিটুনি দেয়ার সময় লোকজন ঘটনাস্থলে বন্দুক নিয়ে গিয়ে কাউকে গুলি করে না। কাজেই এটা ছিল একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড এবং পুলিশ যেভাবে একে গণপিটুনি বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে, তাতে এটা ধরে নেয়া ভুল হবে না যে, এ কাজ পুলিশেরই। এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার ইত্যাদিতে অভ্যস্ত পুলিশ ও র্যাব বেপরোয়াভাবে এ ধরনের হত্যাকাণ্ড দেশজুড়ে চালিয়ে যাচ্ছে। মিরপুরের হত্যাকাণ্ড হল তারই এক দৃষ্টান্ত।
এ ঘটনার অন্যদিক হল, মিরপুরের এই হত্যাকাণ্ডের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলেও এর বিরুদ্ধে কোনো উল্লেখযোগ্য প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। কোনো বিক্ষোভ, বুদ্ধিজীবীদের টকশোর আলোচনা, পত্রপত্রিকায় কোনো আলোচনা দেখা যায়নি। মনে হয়, এ কাজ পুলিশের, এটা জানার পর সবাই নিশ্চিত হয়েছে! কাজেই ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের আক্রমণের বিরুদ্ধে সঠিকভাবে তার বিরোধিতা ও প্রতিবাদ ব্যাপকভাবে হলেও পুলিশের এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে সবাই নীরব আছে!! বলাই বাহুল্য যে, এ নীরবতাই বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের অন্যতম ভিত্তি।
২৮.০২.২০১৫
বদরুদ্দীন উমর : সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল
No comments