ওয়াচডগের ভূমিকাই পালন করছে সংবাদপত্র -সাক্ষাৎকারে : সাখাওয়াত আলী খান by মশিউল আলম
সাখাওয়াত আলী খানের
জন্ম ১৯৪১ সালে ঢাকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও
স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন যথাক্রমে ১৯৬২ ও ১৯৬৩ সালে। ১৯৬৩ সালে
সাংবাদিকতায় ডিপ্লোমা ও ১৯৭০ সালে মাস্টার্স করেন। সাংবাদিকতা পেশায় যোগ
দেন ছাত্রাবস্থায়, প্রায় ১০ বছর এ পেশায় নিয়োজিত থাকার পর ১৯৭২ সালে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন, ১৯৮৯ সালে
পিএইচডি করেন এবং অধ্যাপক হন ১৯৯২ সালে। ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে কিছুদিন
শিক্ষকতা করেন যুক্তরাষ্ট্রের সাউদার্ন ইলিনয় ইউনিভার্সিটিতে। ২০০৮ সালে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। বর্তমানে একই
বিভাগে অনারারি প্রফেসর হিসেবে কর্মরত।
প্রথম আলো :দেশে প্রায় দুই মাস ধরে রাজনৈতিক সংকট ও সহিংসতা চলছে। একজন প্রাক্তন সাংবাদিক, সাংবাদিকতার অধ্যাপক ও পর্যবেক্ষক হিসেবে এই সময়কালে দেশের সংবাদমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশনা সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সাখাওয়াত আলী খান :বয়সের কারণে আমার দীর্ঘদিন সংবাদমাধ্যমের কর্মসম্পাদন দেখার সুযোগ হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের সাংবাদিকতার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। একটা সময় সংবাদমাধ্যমের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক ছিল। একটা সময় ছিল যখন ঢাকা শহরে কোনো দৈনিক সংবাদপত্রই ছিল না। সেই অবস্থার সঙ্গে তুলনা করতে গেলে বলতে হবে, আমরা অনেক অনেক দূর এগিয়েছি। সংবাদমাধ্যমেও সেটা আছে। পৃথিবীর কোন কোন দেশে সবচেয়ে ভালো সাংবাদিকতা হচ্ছে, এটার কোনো মাপকাঠি আমার কাছে নেই, বিভিন্ন উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের সাংবাদিকতার সঙ্গে তুলনা করে বলা যায়, আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। এই উন্নতি বা অগ্রসরতা এককথায় বিস্ময়কর; গুণগত মান এবং বিস্তৃতি—উভয় দিক থেকেই।
প্রথম আলো :চলমান রাজনৈতিক সংকট ও সহিংসতার প্রেক্ষাপটে আমাদের সংবাদমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশনা সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন...
সাখাওয়াত আলী খান :আমি সেদিকে আসছি। সাংবাদিকতার অগ্রগতির সঙ্গে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। এর মধ্যে রাজনীতি আছে, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, শিক্ষা আছে, এমনকি পরিবেশগত বিষয়ও আছে। এই সব দিক বিবেচনায় নিলে সাংবাদিকতার অগ্রগতি বেশ সন্তোষজনক। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রেও যদি একই সঙ্গে অগ্রগতি না ঘটে, তাহলে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাপক অগ্রগতি আশা করাটা বোধ হয় সঠিক নয়।
প্রথম আলো :এ মুহূর্তের অনেক কিছুই নির্ভর করছে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর...
সাখাওয়াত আলী খান :আমাদের সাংবাদিকতার প্রধান উপজীব্য রাজনীতি। এই রাজনীতির ক্ষেত্রে গুণগত মান বৃদ্ধি না পেলে, তাহলে সাংবাদিকতার গুণগত মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটা সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে আজকের একজন তরুণের কাছে মনে হতে পারে, সাংবাদিকতার অনেক ঘাটতি রয়েছে। এবং আসলে ঘাটতি যে নেই, তা নয়। উন্নতির অনেক জায়গা আছে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, আমাদের স্বাধীনতার চেতনা, যে শব্দটা বহুল ব্যবহৃত, তার সঙ্গে সাংবাদিকতার মূলধারার কোনো বিরোধ থাকা উচিত নয়।
প্রথম আলো :কিন্তু ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের একধরনের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। অনেক সময় ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, কিংবা হুমকিপূর্ণ কথাবার্তা শোনা যায়।
সাখাওয়াত আলী খান :ক্ষমতাসীন মহলের সঙ্গে সংবাদক্ষেত্রের ছোটখাটো খিটিমিটি অহরহ লেগেই থাকবে, এটা অনেক সময় গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য উপকারী হয়। সংবাদক্ষেত্রকে বলা হয় দ্য ফোর্থ এস্টেট, যদিও এ কথাটা আজকাল আর তেমন শোনা যায় না, কিন্তু সংবাদক্ষেত্রের এই ফোর্থ এস্টেটের ভূমিকা গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। সংবাদক্ষেত্র ফোর্থ এস্টেটের ভূমিকায় যদি একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে স্থিত থাকে, তাহলে ক্ষমতাসীন মহলের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই তার মতপার্থক্য হতে পারে, এবং সেটা কোনোভাবেই খারাপ কিছু নয়, বরং গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য দরকারি।
প্রথম আলো :আমাদের সাংবাদিকতার পেশাদারির দিকে কোনো পরিবর্তন কি আপনার চোখে পড়ে?
সাখাওয়াত আলী খান :এখন সংবাদপত্রগুলোয় অনুসন্ধানী ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন ভীষণভাবে কমে গেছে। এখন এ শব্দগুলো শুধু নামেই শোনা যায়। এই দুই ধরনের সাংবাদিকতার জন্য প্রয়োজনীয় মেধাবী মানুষ যে এখন নেই, সে কথা আমি বলব না। আমাদের দেশে এখন বেশ কিছু সাংবাদিক আছেন, যাঁদের মেধায় আমি বিস্মিত। কিন্তু অনুসন্ধানী ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলক সাংবাদিকতা বিস্ময়করভাবে কমে গেছে। এর পেছনে হয়তো রাজনীতি, আমলাতন্ত্র, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে উদারনৈতিকতার অভাব কাজ করে। অনেক সংবাদমাধ্যমের মালিক এখন ব্যবসায়ী, তাঁদের প্রভাব যে সংবাদমাধ্যমের ওপর পড়ছে না, এটা বলা কঠিন। রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাংবাদিকতার মধ্যেকার সম্পর্ক হয়তো এখন আগের তূলনায় অনেক জটিল হয়েছে। তার ফলে হয়তো গভীর অনুসন্ধানী ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলক সাংবাদিকতার অনুশীলন পেছনে পড়ে গেছে। সংবাদপত্র পরিচালনায় সাংবাদিকদের স্বাধীনতা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি একটা বিষয়। এই ক্ষেত্রে উদারমনা মালিকদের সংখ্যা বাড়লে সাংবাদিকতার আরও অনেক উন্নতি হবে।
প্রথম আলো :কেউ কেউ বলছেন, প্রায় দুই মাস ধরে দেশের সংবাদপত্রগুলোতে শুধু পেট্রলবোমা আর রাজনৈতিক সহিংসতার খবরই বেশি পরিবেশিত হচ্ছে। দেশ-জাতির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বা ইস্যু দৃষ্টির আড়ালে থেকে যাচ্ছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সাখাওয়াত আলী খান :এই সময়ে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, নাগরিক সেবাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয় যে কিছুটা চাপা পড়ে গেছে, তা ঠিক। কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষের এখনকার অবস্থাটা হচ্ছে এ রকম যে কোনো নিকটজন খুবই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তখন তাঁর চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষাই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান বিষয়। ঠিক তেমনই এখন পেট্রলবোমার কারণেই হোক, অন্যান্য রাজনৈতিক সহিংসতার কারণেই হোক, দেশমাতৃকার অবস্থা যখন সেই রকম গুরুতর, তখন তো তার দিকে সর্বপ্রকার দৃষ্টি দেওয়াই স্বাভাবিক। এখন দেশের অবস্থা সে রকম। পেট্রলবোমা বা চলমান রাজনৈতিক অবস্থায় দেশের সব মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে আক্রান্ত করে ফেলেছে। যত দিন পর্যন্ত এই অস্বাভাবিক অবস্থার অবসান না ঘটছে, তত দিন আমরা সাংবাদিকতার আদর্শ মডেল অনুসরণ করতে পারব না।
প্রথম আলো :দেশে রাজনৈতিক বৈরিতাপ্রসূত সংকট যে কানাগলিতে গিয়ে ঠেকেছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের কিছু করার আছে, নাকি শুধু এই অচলাবস্থার সংবাদ পরিবেশনের মধ্য দিয়েই সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়?
সাখাওয়াত আলী খান :খুবই কঠিনপ্রশ্ন, আবার একই সঙ্গে জরুরি প্রশ্নও বটে। সংবাদমাধ্যম কি শুধু পর্যবেক্ষক হিসেবে যা দেখবে তা-ই লিখবে? নাকি সংকট নিরসনেও ভূমিকা রাখবে? আমার বিবেচনায় সংবাদমাধ্যমের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব পর্যবেক্ষক ও সংবাদ পরিবেশকের। এটা তাদের পেশাগত দায়িত্ব, এ বিষয় তাদের একটা নীতি আছে। তবে সাংবাদিকেরা একই সঙ্গে দেশের নাগরিকও বটে। নাগরিকের দায়িত্বও তাঁদের পালন করা উচিত। সংবাদমাধ্যম যদি চলমান সংকট থেকে দেশকে মুক্ত করায় ভূমিকা রাখতে চায়, তাহলে আগে সাংবাদিকদের সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা কী পন্থায় কী ভূমিকা নিতে চান। শান্তির সময়ে সংবাদমাধ্যমের প্রধান ভূমিকা পর্যবেক্ষক ও সংবাদ পরিবেশকের। আপনি দেখবেন, জনগণকে জানাবেন। আর বিশেষ সংকটময় সময় সময় দেশের প্রতি, জাতির প্রতি, এমনকি পৃথিবী ও সভ্যতার প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেও সাংবাদিকেরা সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে পারেন।
প্রথম আলো :কিছুদিন আগে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর সম্পাদক পরিষদের এক বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়েছে, সংবাদপত্র ও প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা চলছে। এর এক দিন পরেই তথ্য মন্ত্রণালয় এক লিখিত বক্তব্যে বলল, সম্পাদক পরিষদের বক্তব্য বাস্তবতা-বিবর্জিত, সত্যের অপলাপ, পক্ষপাতমূলক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও দুর্ভাগ্যজনক। তথ্য মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্মরণকালের মধ্যে এখন সবচেয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য?
সাখাওয়াত আলী খান :অতিশয়োক্তি করা আমাদের দেশের মানুষের একটা সাধারণ প্রবণতা। বাস্তবতা-বিবর্জিত, সত্যের অপলাপ, উদ্দেশ্যমূলক ইত্যাদিও ক্লিশে কথা। সরকার এগুলো বলতেই পারে। কিন্তু এ রকম পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। কাজের কথা হলো দুই পক্ষ বসে আলোচনা করা। সম্পাদক-মালিক ও সরকার মুখোমুখি বসে সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করলেই তো পারে। দুই পক্ষ তো পরস্পরের শত্রু নয়, সংবাদমাধ্যম আছে গণতন্ত্র ও সুশাসনকে সমর্থন-সহযোগিতা করতে। সরকারেরও দায়িত্ব সেই লক্ষ্যেই কাজ করা। তাহলে দুই পক্ষের ভূমিকা তো পরস্পরের পরিপূরক। শুধু একটা বিষয় সবাইকে মেনে নিতে হবে যে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সব বিতর্কের ঊর্ধ্বের বিষয়। সরকারের ভুলত্রুটি, শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক চর্চাসহ বাকি সমস্ত বিষয়ে সংবাদমাধ্যম ওয়াচডগের ভূমিকা পালন করবে—এটাই তো তাদের দায়িত্ব। সে ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম যদি অনুভব করে যে তাদের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা চলছে, তাহলে সরকারের উচিত সেটা আমলে নেওয়া এবং দুই পক্ষ মুখোমুখি বসে আলোচনা করে সমস্যাগুলো দূর করার উদ্যোগ নেওয়া। কোনো রকমের ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ থাকা উচিত নয়।
প্রথম আলো :কিছুদিন আগেডেইলি স্টার নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের একটি পোস্টারের ছবিসহ খবর প্রকাশ করলে প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেন, পত্রিকাটি জঙ্গিদের মদদ দিচ্ছে, এ জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সাখাওয়াত আলী খান :আমার ধারণা,এটা একটা ভুল–বোঝাবুঝির ফল। ডেইলি স্টার-এর পূর্বাপর আচরণ প্রমাণ করে সংবাদপত্রটির অবস্থান সন্ত্রাস ও উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে। তবে এ ধরনের ছবি ছাপানোর ক্ষেত্রে ভালো করে বিচার-বিবেচনা করে নেওয়াই উচিত।
প্রথম আলো :আপনাকে অনেকধন্যবাদ।
সাখাওয়াত আলী খান :আপনাকেও ধন্যবাদ।
প্রথম আলো :দেশে প্রায় দুই মাস ধরে রাজনৈতিক সংকট ও সহিংসতা চলছে। একজন প্রাক্তন সাংবাদিক, সাংবাদিকতার অধ্যাপক ও পর্যবেক্ষক হিসেবে এই সময়কালে দেশের সংবাদমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশনা সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সাখাওয়াত আলী খান :বয়সের কারণে আমার দীর্ঘদিন সংবাদমাধ্যমের কর্মসম্পাদন দেখার সুযোগ হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের সাংবাদিকতার অনেক অগ্রগতি হয়েছে। একটা সময় সংবাদমাধ্যমের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক ছিল। একটা সময় ছিল যখন ঢাকা শহরে কোনো দৈনিক সংবাদপত্রই ছিল না। সেই অবস্থার সঙ্গে তুলনা করতে গেলে বলতে হবে, আমরা অনেক অনেক দূর এগিয়েছি। সংবাদমাধ্যমেও সেটা আছে। পৃথিবীর কোন কোন দেশে সবচেয়ে ভালো সাংবাদিকতা হচ্ছে, এটার কোনো মাপকাঠি আমার কাছে নেই, বিভিন্ন উন্নত গণতান্ত্রিক দেশের সাংবাদিকতার সঙ্গে তুলনা করে বলা যায়, আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। এই উন্নতি বা অগ্রসরতা এককথায় বিস্ময়কর; গুণগত মান এবং বিস্তৃতি—উভয় দিক থেকেই।
প্রথম আলো :চলমান রাজনৈতিক সংকট ও সহিংসতার প্রেক্ষাপটে আমাদের সংবাদমাধ্যমের সংবাদ পরিবেশনা সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন...
সাখাওয়াত আলী খান :আমি সেদিকে আসছি। সাংবাদিকতার অগ্রগতির সঙ্গে পারিপার্শ্বিক অবস্থার সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। এর মধ্যে রাজনীতি আছে, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য আছে, শিক্ষা আছে, এমনকি পরিবেশগত বিষয়ও আছে। এই সব দিক বিবেচনায় নিলে সাংবাদিকতার অগ্রগতি বেশ সন্তোষজনক। তবে অন্যান্য ক্ষেত্রেও যদি একই সঙ্গে অগ্রগতি না ঘটে, তাহলে সাংবাদিকতার ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নভাবে ব্যাপক অগ্রগতি আশা করাটা বোধ হয় সঠিক নয়।
প্রথম আলো :এ মুহূর্তের অনেক কিছুই নির্ভর করছে রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর...
সাখাওয়াত আলী খান :আমাদের সাংবাদিকতার প্রধান উপজীব্য রাজনীতি। এই রাজনীতির ক্ষেত্রে গুণগত মান বৃদ্ধি না পেলে, তাহলে সাংবাদিকতার গুণগত মান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একটা সীমাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এসব বিষয় বিবেচনায় নিলে আজকের একজন তরুণের কাছে মনে হতে পারে, সাংবাদিকতার অনেক ঘাটতি রয়েছে। এবং আসলে ঘাটতি যে নেই, তা নয়। উন্নতির অনেক জায়গা আছে। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, আমাদের স্বাধীনতার চেতনা, যে শব্দটা বহুল ব্যবহৃত, তার সঙ্গে সাংবাদিকতার মূলধারার কোনো বিরোধ থাকা উচিত নয়।
প্রথম আলো :কিন্তু ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে সংবাদমাধ্যমের একধরনের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক লক্ষ করা যায়। অনেক সময় ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার, কিংবা হুমকিপূর্ণ কথাবার্তা শোনা যায়।
সাখাওয়াত আলী খান :ক্ষমতাসীন মহলের সঙ্গে সংবাদক্ষেত্রের ছোটখাটো খিটিমিটি অহরহ লেগেই থাকবে, এটা অনেক সময় গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য উপকারী হয়। সংবাদক্ষেত্রকে বলা হয় দ্য ফোর্থ এস্টেট, যদিও এ কথাটা আজকাল আর তেমন শোনা যায় না, কিন্তু সংবাদক্ষেত্রের এই ফোর্থ এস্টেটের ভূমিকা গণতন্ত্র ও সুশাসনের জন্য অত্যন্ত জরুরি। সংবাদক্ষেত্র ফোর্থ এস্টেটের ভূমিকায় যদি একটি স্বতন্ত্র সত্তা হিসেবে স্থিত থাকে, তাহলে ক্ষমতাসীন মহলের সঙ্গে মাঝেমধ্যেই তার মতপার্থক্য হতে পারে, এবং সেটা কোনোভাবেই খারাপ কিছু নয়, বরং গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য দরকারি।
প্রথম আলো :আমাদের সাংবাদিকতার পেশাদারির দিকে কোনো পরিবর্তন কি আপনার চোখে পড়ে?
সাখাওয়াত আলী খান :এখন সংবাদপত্রগুলোয় অনুসন্ধানী ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন ভীষণভাবে কমে গেছে। এখন এ শব্দগুলো শুধু নামেই শোনা যায়। এই দুই ধরনের সাংবাদিকতার জন্য প্রয়োজনীয় মেধাবী মানুষ যে এখন নেই, সে কথা আমি বলব না। আমাদের দেশে এখন বেশ কিছু সাংবাদিক আছেন, যাঁদের মেধায় আমি বিস্মিত। কিন্তু অনুসন্ধানী ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলক সাংবাদিকতা বিস্ময়করভাবে কমে গেছে। এর পেছনে হয়তো রাজনীতি, আমলাতন্ত্র, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে উদারনৈতিকতার অভাব কাজ করে। অনেক সংবাদমাধ্যমের মালিক এখন ব্যবসায়ী, তাঁদের প্রভাব যে সংবাদমাধ্যমের ওপর পড়ছে না, এটা বলা কঠিন। রাজনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাংবাদিকতার মধ্যেকার সম্পর্ক হয়তো এখন আগের তূলনায় অনেক জটিল হয়েছে। তার ফলে হয়তো গভীর অনুসন্ধানী ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণমূলক সাংবাদিকতার অনুশীলন পেছনে পড়ে গেছে। সংবাদপত্র পরিচালনায় সাংবাদিকদের স্বাধীনতা দেওয়া অত্যন্ত জরুরি একটা বিষয়। এই ক্ষেত্রে উদারমনা মালিকদের সংখ্যা বাড়লে সাংবাদিকতার আরও অনেক উন্নতি হবে।
প্রথম আলো :কেউ কেউ বলছেন, প্রায় দুই মাস ধরে দেশের সংবাদপত্রগুলোতে শুধু পেট্রলবোমা আর রাজনৈতিক সহিংসতার খবরই বেশি পরিবেশিত হচ্ছে। দেশ-জাতির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা বা ইস্যু দৃষ্টির আড়ালে থেকে যাচ্ছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
সাখাওয়াত আলী খান :এই সময়ে দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, নাগরিক সেবাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় বিষয় যে কিছুটা চাপা পড়ে গেছে, তা ঠিক। কিন্তু আমাদের সাধারণ মানুষের এখনকার অবস্থাটা হচ্ছে এ রকম যে কোনো নিকটজন খুবই গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, তখন তাঁর চিকিৎসা ও সেবা-শুশ্রূষাই হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রধান বিষয়। ঠিক তেমনই এখন পেট্রলবোমার কারণেই হোক, অন্যান্য রাজনৈতিক সহিংসতার কারণেই হোক, দেশমাতৃকার অবস্থা যখন সেই রকম গুরুতর, তখন তো তার দিকে সর্বপ্রকার দৃষ্টি দেওয়াই স্বাভাবিক। এখন দেশের অবস্থা সে রকম। পেট্রলবোমা বা চলমান রাজনৈতিক অবস্থায় দেশের সব মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে আক্রান্ত করে ফেলেছে। যত দিন পর্যন্ত এই অস্বাভাবিক অবস্থার অবসান না ঘটছে, তত দিন আমরা সাংবাদিকতার আদর্শ মডেল অনুসরণ করতে পারব না।
প্রথম আলো :দেশে রাজনৈতিক বৈরিতাপ্রসূত সংকট যে কানাগলিতে গিয়ে ঠেকেছে, সেখান থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যমের কিছু করার আছে, নাকি শুধু এই অচলাবস্থার সংবাদ পরিবেশনের মধ্য দিয়েই সংবাদমাধ্যমের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়?
সাখাওয়াত আলী খান :খুবই কঠিনপ্রশ্ন, আবার একই সঙ্গে জরুরি প্রশ্নও বটে। সংবাদমাধ্যম কি শুধু পর্যবেক্ষক হিসেবে যা দেখবে তা-ই লিখবে? নাকি সংকট নিরসনেও ভূমিকা রাখবে? আমার বিবেচনায় সংবাদমাধ্যমের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব পর্যবেক্ষক ও সংবাদ পরিবেশকের। এটা তাদের পেশাগত দায়িত্ব, এ বিষয় তাদের একটা নীতি আছে। তবে সাংবাদিকেরা একই সঙ্গে দেশের নাগরিকও বটে। নাগরিকের দায়িত্বও তাঁদের পালন করা উচিত। সংবাদমাধ্যম যদি চলমান সংকট থেকে দেশকে মুক্ত করায় ভূমিকা রাখতে চায়, তাহলে আগে সাংবাদিকদের সম্মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তাঁরা কী পন্থায় কী ভূমিকা নিতে চান। শান্তির সময়ে সংবাদমাধ্যমের প্রধান ভূমিকা পর্যবেক্ষক ও সংবাদ পরিবেশকের। আপনি দেখবেন, জনগণকে জানাবেন। আর বিশেষ সংকটময় সময় সময় দেশের প্রতি, জাতির প্রতি, এমনকি পৃথিবী ও সভ্যতার প্রতি দায়িত্ববোধ থেকেও সাংবাদিকেরা সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ নিতে পারেন।
প্রথম আলো :কিছুদিন আগে দেশের সংবাদমাধ্যমগুলোর সম্পাদক পরিষদের এক বিবৃতিতে অভিযোগ করা হয়েছে, সংবাদপত্র ও প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা চলছে। এর এক দিন পরেই তথ্য মন্ত্রণালয় এক লিখিত বক্তব্যে বলল, সম্পাদক পরিষদের বক্তব্য বাস্তবতা-বিবর্জিত, সত্যের অপলাপ, পক্ষপাতমূলক, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও দুর্ভাগ্যজনক। তথ্য মন্ত্রণালয় দাবি করেছে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম স্মরণকালের মধ্যে এখন সবচেয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করছে। এ বিষয়ে আপনার মন্তব্য?
সাখাওয়াত আলী খান :অতিশয়োক্তি করা আমাদের দেশের মানুষের একটা সাধারণ প্রবণতা। বাস্তবতা-বিবর্জিত, সত্যের অপলাপ, উদ্দেশ্যমূলক ইত্যাদিও ক্লিশে কথা। সরকার এগুলো বলতেই পারে। কিন্তু এ রকম পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেওয়া কোনো কাজের কথা নয়। কাজের কথা হলো দুই পক্ষ বসে আলোচনা করা। সম্পাদক-মালিক ও সরকার মুখোমুখি বসে সমস্যাগুলো নিয়ে আলোচনা করলেই তো পারে। দুই পক্ষ তো পরস্পরের শত্রু নয়, সংবাদমাধ্যম আছে গণতন্ত্র ও সুশাসনকে সমর্থন-সহযোগিতা করতে। সরকারেরও দায়িত্ব সেই লক্ষ্যেই কাজ করা। তাহলে দুই পক্ষের ভূমিকা তো পরস্পরের পরিপূরক। শুধু একটা বিষয় সবাইকে মেনে নিতে হবে যে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সব বিতর্কের ঊর্ধ্বের বিষয়। সরকারের ভুলত্রুটি, শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক চর্চাসহ বাকি সমস্ত বিষয়ে সংবাদমাধ্যম ওয়াচডগের ভূমিকা পালন করবে—এটাই তো তাদের দায়িত্ব। সে ক্ষেত্রে সংবাদমাধ্যম যদি অনুভব করে যে তাদের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা চলছে, তাহলে সরকারের উচিত সেটা আমলে নেওয়া এবং দুই পক্ষ মুখোমুখি বসে আলোচনা করে সমস্যাগুলো দূর করার উদ্যোগ নেওয়া। কোনো রকমের ভুল-বোঝাবুঝির অবকাশ থাকা উচিত নয়।
প্রথম আলো :কিছুদিন আগেডেইলি স্টার নিষিদ্ধঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহ্রীরের একটি পোস্টারের ছবিসহ খবর প্রকাশ করলে প্রধানমন্ত্রী সংসদে বলেন, পত্রিকাটি জঙ্গিদের মদদ দিচ্ছে, এ জন্য তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সাখাওয়াত আলী খান :আমার ধারণা,এটা একটা ভুল–বোঝাবুঝির ফল। ডেইলি স্টার-এর পূর্বাপর আচরণ প্রমাণ করে সংবাদপত্রটির অবস্থান সন্ত্রাস ও উগ্রপন্থার বিরুদ্ধে। তবে এ ধরনের ছবি ছাপানোর ক্ষেত্রে ভালো করে বিচার-বিবেচনা করে নেওয়াই উচিত।
প্রথম আলো :আপনাকে অনেকধন্যবাদ।
সাখাওয়াত আলী খান :আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments