ঢাকার পর দিল্লি, বরফ গলানোর মমতা মিশন by সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়
হাঁটতে হাঁটতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, জানি না, শেষ পর্যন্ত যাওয়া হবে কি না। ওখানে যা চলছে!
হাওড়ায় পশ্চিমবঙ্গের অস্থায়ী সচিবালয় ‘নবান্ন’র একেবারে ওপরের তলায় ৫০ মিটার লম্বা ও ১০ মিটার চওড়া একটা ফাঁকা জায়গা আছে। ১৬ তলা বাড়ির মাথায় পাঁচিলঘেরা সেই উন্মুক্ত স্থানে দাঁড়ালে আদিগন্ত মুহূর্তের মধ্যে বেআবরু হয়ে যায়। দিকচক্রবাল রেখা ঝাপসা হয়ে আসে। এক পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে চিরস্রোতোস্বিনী গঙ্গা। এই স্থানটুকু মুখ্যমন্ত্রীর বড়ই প্রিয়। ‘ফিটনেস ফ্রিক’ মুখ্যমন্ত্রী সময় ও সুযোগ পেলেই এখানে হনহন করে হাঁটেন, হাঁটতে হাঁটতে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তও নেন। ঢাকায় যাওয়ার সাত দিন আগেও তিনি ঘোর অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন শেষমেশ যাওয়া হবে কি না। না হলে ওভাবে তিনি বলতেন না, প্রতিদিনই ওখানে যা চলছে...দেখছেনই তো কাগজে...যেতে পারব কি না তা-ই বুঝতে পারছি না।
সফর নিয়ে এই দোলাচলে থাকার কথা ঢাকাতেও তিনি শুনিয়েছিলেন। দ্বিতীয় দিনে দুই দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও বিনোদনের লোকজনের সমাবেশে অকপটে তাঁর সংশয়ের কথা স্বীকার করে যা বলেছিলেন, তার মর্মার্থ, রাজনীতিতে অনেক কিছুই ঘটে, অনেক খেলাই হয়। সে রকম একটা খেলারই শিকার হয়েছিলেন তিনি নিজেই, ২০১১ সালে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের সময়। তিস্তা চুক্তি নিয়ে তাঁকে ভুল বোঝানো হয়েছিল, অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দ্বিধাহীনভাবে জানাতে ভোলেননি, দিল্লি-ঢাকা সম্পর্কের উন্নতিতে তিনি কাঠবিড়ালির ভূমিকা পালন করবেন, সেতুবন্ধের কাজটুকু করে যাবেন। আর শোনান সেই অভয় বাণী, যা শুনতে উদ্গ্রীব হয়ে ছিল বাংলাদেশি মন। চার বছরের সব অভিমান এক লহমায় ঘুচিয়ে তিনি প্রকাশ্যেই জানিয়ে দেন তিস্তা চুক্তি নিয়ে তাঁর ওপর আস্থা রাখতে, দুশ্চিন্তা না করতে। বলেন, আমাদের-আপনাদের দুই দেশেরই কিছু সমস্যা আছে। বলেছিলেন, সব বাধা ভেঙে যখন এসেছি, তখন সব বাঁধন ঘুচে যাবে। এই সফর এক নতুন সূত্রপাত।
পরের দিন শেখ হাসিনার সঙ্গে ৩৫ মিনিট একান্ত আলাপচারিতার সময়েও তাঁকে তিনি এভাবে আশ্বস্ত করেছেন।
সোনারগাঁও হোটেলে গত ২০ ফেব্রুয়ারি মমতা যখন তাঁর ওপর ভরসা রাখার কথা শোনাচ্ছেন, তখন ভরদুপুর। প্রযুক্তির কল্যাণে এবং টেলিভিশনের দৌলতে মুহূর্তের মধ্যেই সেই কথা পৌঁছে যায় বাংলাদেশের কোণে কোণে। তাঁর এই অভয়দান বাংলাদেশের মানুষকে যে বিহ্বল ও চমকিত করেছে, আধা ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর কাছে সেই খবর চলে আসে। চার বছর ধরে যে আলোচনা থমকে ছিল, এই একটা কথায় তা যে ফের সচল হয়ে উঠবে এবং আজ হোক, কাল হোক তিস্তা চুক্তি যে দিনের আলো দেখবে, সেই বিশ্বাস পলকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে গেল। একের পর এক অতিথি সেই বিশাল ব্যাঙ্কোয়েট হলে মমতাকে স্রেফ এই কারণেই অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন। পড়ে গেল ‘সেলফি’ তোলার ধুম। ‘টেক স্যাভি’ মুখ্যমন্ত্রীও কাউকে নিরাশ করলেন না। আপাদমস্তক রাজনীতির মানুষ তিনি। তিনি জানতেন, সফরটা তিনি সফল করে ফেলেছেন।
সেই উপলব্ধি আমাদের হলো সে রাতে। একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ স্মরণ উপলক্ষে আমরা সদলে শহীদ মিনারের এক পাশে দাঁড়িয়ে। এই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবেই আমন্ত্রিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশাল ফুলের তোড়া নিয়ে তিনি নির্দিষ্ট করে দেওয়া জায়গায় দাঁড়িয়ে। তাঁর পাশে আমরা সবাই। ঠিক রাত ১২টায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধীরলয়ে এসে দাঁড়ালেন। ধারাভাষ্য শুরু হয়ে গেছে। সেনানীরা তাঁদের হয়ে পায়ে পা মিলিয়ে বয়ে নিয়ে গেলেন গোল ফুলের মালা। ছন্দ মেপে এগিয়ে তা স্থাপিত হলো শহীদবেদিতে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা জানানোর পর সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পালা। তাঁর পরে বাংলাদেশে আসা যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসের স্পিকার। মমতার ডাক তার পরেই। তাঁর পাশে ও পেছনে আমরা সবাই। শ্রদ্ধা জানিয়ে ফিরে এসে আবার সেই লাইনে দাঁড়িয়েছি। হঠাৎই দেখা গেল অন্তত ৪০ মিটার দূর থেকে হাসিনা এগিয়ে আসছেন। ২০ মিটার আসার পর মমতাও বুঝলেন হাসিনার নজরে তিনিই। বোঝামাত্র মমতাও ছিলে-ছেঁড়া ধনুকের মতো এগিয়ে গেলেন হাসিনার দিকে। তারপর দুই নেত্রীর প্রসারিত চার হাতে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন দুজনই। ঘুচে গেল প্রটোকলের সব বাধা, নিরাপত্তারক্ষীদের বজ্র আঁটুনি। দুজনে দুজনের হাত ধরে হাসিমুখে কথা বলছেন, ক্যামেরাবন্দী হচ্ছে সেই অপূর্ব দৃশ্য। রাজনীতিক ও কূটনীতিকদের শরীরী ভাষা পড়ার ক্ষমতা যাঁদের আছে, তাঁরা এটুকু অন্তত বুঝলেন, সম্পর্কের উষ্ণতার সংজ্ঞা কী রকম হয়।
আমার অনেক কথাই মনে পড়ে গেল। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা হাসিনা দিল্লি এসেছেন। উঠেছেন অশোকা হোটেলে। সাংসদ মমতার সরকারি বাড়িতে আমরা তীর্থের কাকের মতো বসে আছি। কখন আসেন, কখন আসেন, সেই প্রতীক্ষা। মমতা এসেছিলেন মাঝরাত কাবার করে। হাসিনাদির সঙ্গে কথা শেষ করা চাট্টিখানা কথা নাকি? প্রায় স্বগতোক্তির মতো শুনিয়েছিল মমতার স্বর। নবান্নে হাঁটতে হাঁটতেও বলছিলেন, এর আগে একবারই ঢাকা গিয়েছিলাম। ১৯৯৮ সালে। তৃণমূল কংগ্রেস গড়ার পরে। তখন উনি পিএম, এখনো পিএম। আমাদের মধ্যে অদ্ভুত একটা বোঝাপড়া আছে। অনেকেই নানা কথা বলছে। আমাকে হেয় করার চেষ্টা করছে। এই রাজনীতি আমি করি না। তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের ব্যগ্রতা ও আগ্রহের কথা তুলতে চাইছিলাম। মমতা থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ওটা আমার ওপর ছাড়ুন; বরং আপনাকে একটা খবর দিই। প্রথম আলোতে লিখে দিন, আমাদের রাজ্যে বাংলাদেশের যত জেলে (মৎস্যজীবী) বন্দী রয়েছেন, সবাইকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছি। আমি চাই ওঁরা সবাই আমি যাওয়ার আগে বাড়ি ফিরুন। আলিঙ্গনাবদ্ধ হাসিনা-মমতাকে দেখে ভাবার চেষ্টা করছিলাম, রসায়ন কী রকম হলে এমন একটা ছবি ধরা পড়ে।
ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ সরন, ডেপুটি হাইকমিশনার সন্দীপ চক্রবর্তী কিংবা এই সফরের জন্যই দিল্লি থেকে ঢাকা যাওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ বিভাগের যুগ্ম সচিব শ্রীপ্রিয়া রঙ্গনাথনকে দেখে মনে হলো, ভরসা রাখার পরামর্শ দিয়ে মমতা তাঁদের দুশ্চিন্তাও যেন কেড়ে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতার বৈঠকের পরে ভারতীয় কূটনীতিকদের শরীরী ভাষায় উৎফুল্ল ভাব। ভারতের পক্ষে সরকারিভাবে যে বিবৃতি সেই দিনেই পেশ করা হয়, তার ছত্রে ছত্রে ছিল আশার রামধনু। চার বছর ধরে থমকে থাকা তিস্তা চুক্তি ফের নাড়াচাড়ার স্তরে উঠে আসছে, চুক্তি বাস্তবায়নের পথে জগদ্দল পাথর নাড়ানো যাচ্ছে, অনড় মমতা নিজেই সেই উদ্যোগ নিয়েছেন—এটাই চূড়ান্ত ইতিবাচক।
প্রশ্ন হলো, অতঃ কিম। চার বছর আগে যে চুক্তিটি প্রায় সইয়ের পর্যায়ে চলে এসেছিল, মমতার তাতে সায় ছিল না। সেই চুক্তিকে মমতা ও হাসিনা দুজনের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে গেলে যা যা করা দরকার, ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়কে এখন তা করতে হবে। কীভাবে, তা নিয়ে এই বিভাগের মন্ত্রী উমা ভারতী এখনো মাথা ঘামাননি। এই চুক্তির মূল কারিগর তাঁরই মন্ত্রণালয়। ভারতের পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়, তাতে কিছু ‘টেকনিক্যাল ইস্যু’ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সেগুলোর নতুন করে সমাধান প্রয়োজন, যাতে বিষয়টির নিষ্পত্তি ঘটে, দুই পক্ষই উপকৃত হয় এবং তিস্তার জলের ওপর নির্ভরশীল লোকজনের কল্যাণ নিশ্চিত হয়। এই যে নতুন করে সমাধানের কথা বলা হয়েছে, তার মূল অর্থই হচ্ছে পুরোনো চুক্তির জায়গায় নতুনভাবে সমঝোতায় আসা, যা মূলত পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ খুশি মনে গ্রহণ করবে। নদীবিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র তিস্তার প্রবাহ ও দুই দেশের সেচবিশেষজ্ঞদের তথ্য খুঁটিয়ে দেখে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন, তার মূল নির্যাস ছিল, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত শুখা মৌসুমে তিস্তায় যত জল থাকে, তা বোরো চাষের জন্য নিমিত্তমাত্র। তাঁর প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুখা মৌসুমে ভারতের ৯ দশমিক ২২ লাখ হেক্টর ও বাংলাদেশের ৭ দশমিক ১১ লাখ হেক্টর জমি তিস্তার জলে কিছুতেই সেচসেবিত হতে পারে না। কারণ, দুই দেশের মিলিত জমি বোরো চাষের জন্য সেচসেবিত করতে হলে প্রয়োজন প্রতি সেকেন্ডে ১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার জলপ্রবাহ। শুখা মৌসুমে সেই জলের কমবেশি আট ভাগের এক ভাগ মাত্র তিস্তায় থাকে।
কল্যাণ রুদ্র কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, নদীর বহমান স্রোত সভ্যতাকে লালন করে। বহমান স্রোত ভূগর্ভের জলস্তরকে সমৃদ্ধ করে। সমস্ত পলি ও দূষণকে সাগরে টেনে নিয়ে যায়। প্লাবনভূমির কৃষিব্যবস্থাকে লালন করে এবং ভূবৈচিত্র৵ রক্ষা করে। স্রোতকে বহমান রাখতেও তাই নদীতে কিছু জল সারা বছর রাখা প্রয়োজন। এই শর্ত মেনে দুই দেশের ১৬ লাখ হেক্টর জমি কী করে শুখা মৌসুমে সেচসেবিত করা যায়, সেই প্রশ্নই কল্যাণ রুদ্রর কাছে মুখ্য।
মমতার অভয়দানের পর বিশেষজ্ঞদের পাল্টাপাল্টি দাবির এই জট কীভাবে ও কত দ্রুত খুলতে পারে, তার কোনো ধারণা এই মুহূর্তে ভারতের পররাষ্ট্র ও জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ে নেই। আন্তর্জাতিক এই চুক্তি নতুনভাবে করার আগে প্রথমে ভারতের অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য ঘোচাতে হবে। অর্থাৎ, তিস্তা নিয়ে প্রথমে দিল্লি ও কলকাতাকে একমত হতে হবে। তারপর সেই প্রস্তাবকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে বাংলাদেশের কাছে। এক কথায়, কেঁচে গণ্ডূষ করা।
মমতার সফরের প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছেছে। ২ মার্চ পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্কর তাঁর সার্ক যাত্রায় ঢাকা যাচ্ছেন। অবশ্যই সফরজুড়ে থাকবে তিস্তা বিতর্কের অবসানে মমতার বরাভয় মুদ্রা। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, মমতা নিজেই দিল্লি আসছেন মার্চ মাসের ৮-৯ তারিখে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যের দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে। ভোটের পর নরেন্দ্র মোদিকে মমতা অভিনন্দন জানাননি, আনুষ্ঠানিক কথাও বলেননি। সেই নিরিখে ক্ষমতা লাভের নয় মাস পর মোদি-মমতা মুখোমুখি হবেন। তিস্তার নতুন প্রক্রিয়ার শুরুও সেই সাক্ষাতে হবে না, কে বলতে পারে? বিশেষত, মমতা নিজেই যখন বরফ গলানোর মুডে রয়েছেন।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লির প্রতিনিধি।
হাওড়ায় পশ্চিমবঙ্গের অস্থায়ী সচিবালয় ‘নবান্ন’র একেবারে ওপরের তলায় ৫০ মিটার লম্বা ও ১০ মিটার চওড়া একটা ফাঁকা জায়গা আছে। ১৬ তলা বাড়ির মাথায় পাঁচিলঘেরা সেই উন্মুক্ত স্থানে দাঁড়ালে আদিগন্ত মুহূর্তের মধ্যে বেআবরু হয়ে যায়। দিকচক্রবাল রেখা ঝাপসা হয়ে আসে। এক পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে চিরস্রোতোস্বিনী গঙ্গা। এই স্থানটুকু মুখ্যমন্ত্রীর বড়ই প্রিয়। ‘ফিটনেস ফ্রিক’ মুখ্যমন্ত্রী সময় ও সুযোগ পেলেই এখানে হনহন করে হাঁটেন, হাঁটতে হাঁটতে প্রশাসনিক সিদ্ধান্তও নেন। ঢাকায় যাওয়ার সাত দিন আগেও তিনি ঘোর অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন শেষমেশ যাওয়া হবে কি না। না হলে ওভাবে তিনি বলতেন না, প্রতিদিনই ওখানে যা চলছে...দেখছেনই তো কাগজে...যেতে পারব কি না তা-ই বুঝতে পারছি না।
সফর নিয়ে এই দোলাচলে থাকার কথা ঢাকাতেও তিনি শুনিয়েছিলেন। দ্বিতীয় দিনে দুই দেশের শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ও বিনোদনের লোকজনের সমাবেশে অকপটে তাঁর সংশয়ের কথা স্বীকার করে যা বলেছিলেন, তার মর্মার্থ, রাজনীতিতে অনেক কিছুই ঘটে, অনেক খেলাই হয়। সে রকম একটা খেলারই শিকার হয়েছিলেন তিনি নিজেই, ২০১১ সালে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের সময়। তিস্তা চুক্তি নিয়ে তাঁকে ভুল বোঝানো হয়েছিল, অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দ্বিধাহীনভাবে জানাতে ভোলেননি, দিল্লি-ঢাকা সম্পর্কের উন্নতিতে তিনি কাঠবিড়ালির ভূমিকা পালন করবেন, সেতুবন্ধের কাজটুকু করে যাবেন। আর শোনান সেই অভয় বাণী, যা শুনতে উদ্গ্রীব হয়ে ছিল বাংলাদেশি মন। চার বছরের সব অভিমান এক লহমায় ঘুচিয়ে তিনি প্রকাশ্যেই জানিয়ে দেন তিস্তা চুক্তি নিয়ে তাঁর ওপর আস্থা রাখতে, দুশ্চিন্তা না করতে। বলেন, আমাদের-আপনাদের দুই দেশেরই কিছু সমস্যা আছে। বলেছিলেন, সব বাধা ভেঙে যখন এসেছি, তখন সব বাঁধন ঘুচে যাবে। এই সফর এক নতুন সূত্রপাত।
পরের দিন শেখ হাসিনার সঙ্গে ৩৫ মিনিট একান্ত আলাপচারিতার সময়েও তাঁকে তিনি এভাবে আশ্বস্ত করেছেন।
সোনারগাঁও হোটেলে গত ২০ ফেব্রুয়ারি মমতা যখন তাঁর ওপর ভরসা রাখার কথা শোনাচ্ছেন, তখন ভরদুপুর। প্রযুক্তির কল্যাণে এবং টেলিভিশনের দৌলতে মুহূর্তের মধ্যেই সেই কথা পৌঁছে যায় বাংলাদেশের কোণে কোণে। তাঁর এই অভয়দান বাংলাদেশের মানুষকে যে বিহ্বল ও চমকিত করেছে, আধা ঘণ্টার মধ্যেই তাঁর কাছে সেই খবর চলে আসে। চার বছর ধরে যে আলোচনা থমকে ছিল, এই একটা কথায় তা যে ফের সচল হয়ে উঠবে এবং আজ হোক, কাল হোক তিস্তা চুক্তি যে দিনের আলো দেখবে, সেই বিশ্বাস পলকের মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে গেল। একের পর এক অতিথি সেই বিশাল ব্যাঙ্কোয়েট হলে মমতাকে স্রেফ এই কারণেই অভিনন্দন জানিয়ে গেলেন। পড়ে গেল ‘সেলফি’ তোলার ধুম। ‘টেক স্যাভি’ মুখ্যমন্ত্রীও কাউকে নিরাশ করলেন না। আপাদমস্তক রাজনীতির মানুষ তিনি। তিনি জানতেন, সফরটা তিনি সফল করে ফেলেছেন।
সেই উপলব্ধি আমাদের হলো সে রাতে। একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদ স্মরণ উপলক্ষে আমরা সদলে শহীদ মিনারের এক পাশে দাঁড়িয়ে। এই অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবেই আমন্ত্রিত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিশাল ফুলের তোড়া নিয়ে তিনি নির্দিষ্ট করে দেওয়া জায়গায় দাঁড়িয়ে। তাঁর পাশে আমরা সবাই। ঠিক রাত ১২টায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধীরলয়ে এসে দাঁড়ালেন। ধারাভাষ্য শুরু হয়ে গেছে। সেনানীরা তাঁদের হয়ে পায়ে পা মিলিয়ে বয়ে নিয়ে গেলেন গোল ফুলের মালা। ছন্দ মেপে এগিয়ে তা স্থাপিত হলো শহীদবেদিতে। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধা জানানোর পর সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পালা। তাঁর পরে বাংলাদেশে আসা যুক্তরাজ্যের হাউস অব লর্ডসের স্পিকার। মমতার ডাক তার পরেই। তাঁর পাশে ও পেছনে আমরা সবাই। শ্রদ্ধা জানিয়ে ফিরে এসে আবার সেই লাইনে দাঁড়িয়েছি। হঠাৎই দেখা গেল অন্তত ৪০ মিটার দূর থেকে হাসিনা এগিয়ে আসছেন। ২০ মিটার আসার পর মমতাও বুঝলেন হাসিনার নজরে তিনিই। বোঝামাত্র মমতাও ছিলে-ছেঁড়া ধনুকের মতো এগিয়ে গেলেন হাসিনার দিকে। তারপর দুই নেত্রীর প্রসারিত চার হাতে আলিঙ্গনাবদ্ধ হলেন দুজনই। ঘুচে গেল প্রটোকলের সব বাধা, নিরাপত্তারক্ষীদের বজ্র আঁটুনি। দুজনে দুজনের হাত ধরে হাসিমুখে কথা বলছেন, ক্যামেরাবন্দী হচ্ছে সেই অপূর্ব দৃশ্য। রাজনীতিক ও কূটনীতিকদের শরীরী ভাষা পড়ার ক্ষমতা যাঁদের আছে, তাঁরা এটুকু অন্তত বুঝলেন, সম্পর্কের উষ্ণতার সংজ্ঞা কী রকম হয়।
আমার অনেক কথাই মনে পড়ে গেল। তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা হাসিনা দিল্লি এসেছেন। উঠেছেন অশোকা হোটেলে। সাংসদ মমতার সরকারি বাড়িতে আমরা তীর্থের কাকের মতো বসে আছি। কখন আসেন, কখন আসেন, সেই প্রতীক্ষা। মমতা এসেছিলেন মাঝরাত কাবার করে। হাসিনাদির সঙ্গে কথা শেষ করা চাট্টিখানা কথা নাকি? প্রায় স্বগতোক্তির মতো শুনিয়েছিল মমতার স্বর। নবান্নে হাঁটতে হাঁটতেও বলছিলেন, এর আগে একবারই ঢাকা গিয়েছিলাম। ১৯৯৮ সালে। তৃণমূল কংগ্রেস গড়ার পরে। তখন উনি পিএম, এখনো পিএম। আমাদের মধ্যে অদ্ভুত একটা বোঝাপড়া আছে। অনেকেই নানা কথা বলছে। আমাকে হেয় করার চেষ্টা করছে। এই রাজনীতি আমি করি না। তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের ব্যগ্রতা ও আগ্রহের কথা তুলতে চাইছিলাম। মমতা থামিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ওটা আমার ওপর ছাড়ুন; বরং আপনাকে একটা খবর দিই। প্রথম আলোতে লিখে দিন, আমাদের রাজ্যে বাংলাদেশের যত জেলে (মৎস্যজীবী) বন্দী রয়েছেন, সবাইকে মুক্তির নির্দেশ দিয়েছি। আমি চাই ওঁরা সবাই আমি যাওয়ার আগে বাড়ি ফিরুন। আলিঙ্গনাবদ্ধ হাসিনা-মমতাকে দেখে ভাবার চেষ্টা করছিলাম, রসায়ন কী রকম হলে এমন একটা ছবি ধরা পড়ে।
ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনার পঙ্কজ সরন, ডেপুটি হাইকমিশনার সন্দীপ চক্রবর্তী কিংবা এই সফরের জন্যই দিল্লি থেকে ঢাকা যাওয়া পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ বিভাগের যুগ্ম সচিব শ্রীপ্রিয়া রঙ্গনাথনকে দেখে মনে হলো, ভরসা রাখার পরামর্শ দিয়ে মমতা তাঁদের দুশ্চিন্তাও যেন কেড়ে নিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতার বৈঠকের পরে ভারতীয় কূটনীতিকদের শরীরী ভাষায় উৎফুল্ল ভাব। ভারতের পক্ষে সরকারিভাবে যে বিবৃতি সেই দিনেই পেশ করা হয়, তার ছত্রে ছত্রে ছিল আশার রামধনু। চার বছর ধরে থমকে থাকা তিস্তা চুক্তি ফের নাড়াচাড়ার স্তরে উঠে আসছে, চুক্তি বাস্তবায়নের পথে জগদ্দল পাথর নাড়ানো যাচ্ছে, অনড় মমতা নিজেই সেই উদ্যোগ নিয়েছেন—এটাই চূড়ান্ত ইতিবাচক।
প্রশ্ন হলো, অতঃ কিম। চার বছর আগে যে চুক্তিটি প্রায় সইয়ের পর্যায়ে চলে এসেছিল, মমতার তাতে সায় ছিল না। সেই চুক্তিকে মমতা ও হাসিনা দুজনের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে গেলে যা যা করা দরকার, ভারতের জলসম্পদ মন্ত্রণালয়কে এখন তা করতে হবে। কীভাবে, তা নিয়ে এই বিভাগের মন্ত্রী উমা ভারতী এখনো মাথা ঘামাননি। এই চুক্তির মূল কারিগর তাঁরই মন্ত্রণালয়। ভারতের পক্ষ থেকে যে বিবৃতি দেওয়া হয়, তাতে কিছু ‘টেকনিক্যাল ইস্যু’ উল্লেখ করে বলা হয়েছে, সেগুলোর নতুন করে সমাধান প্রয়োজন, যাতে বিষয়টির নিষ্পত্তি ঘটে, দুই পক্ষই উপকৃত হয় এবং তিস্তার জলের ওপর নির্ভরশীল লোকজনের কল্যাণ নিশ্চিত হয়। এই যে নতুন করে সমাধানের কথা বলা হয়েছে, তার মূল অর্থই হচ্ছে পুরোনো চুক্তির জায়গায় নতুনভাবে সমঝোতায় আসা, যা মূলত পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশ খুশি মনে গ্রহণ করবে। নদীবিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র তিস্তার প্রবাহ ও দুই দেশের সেচবিশেষজ্ঞদের তথ্য খুঁটিয়ে দেখে যে প্রতিবেদন তৈরি করেছিলেন, তার মূল নির্যাস ছিল, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত শুখা মৌসুমে তিস্তায় যত জল থাকে, তা বোরো চাষের জন্য নিমিত্তমাত্র। তাঁর প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুখা মৌসুমে ভারতের ৯ দশমিক ২২ লাখ হেক্টর ও বাংলাদেশের ৭ দশমিক ১১ লাখ হেক্টর জমি তিস্তার জলে কিছুতেই সেচসেবিত হতে পারে না। কারণ, দুই দেশের মিলিত জমি বোরো চাষের জন্য সেচসেবিত করতে হলে প্রয়োজন প্রতি সেকেন্ডে ১ হাজার ৬০০ ঘনমিটার জলপ্রবাহ। শুখা মৌসুমে সেই জলের কমবেশি আট ভাগের এক ভাগ মাত্র তিস্তায় থাকে।
কল্যাণ রুদ্র কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, নদীর বহমান স্রোত সভ্যতাকে লালন করে। বহমান স্রোত ভূগর্ভের জলস্তরকে সমৃদ্ধ করে। সমস্ত পলি ও দূষণকে সাগরে টেনে নিয়ে যায়। প্লাবনভূমির কৃষিব্যবস্থাকে লালন করে এবং ভূবৈচিত্র৵ রক্ষা করে। স্রোতকে বহমান রাখতেও তাই নদীতে কিছু জল সারা বছর রাখা প্রয়োজন। এই শর্ত মেনে দুই দেশের ১৬ লাখ হেক্টর জমি কী করে শুখা মৌসুমে সেচসেবিত করা যায়, সেই প্রশ্নই কল্যাণ রুদ্রর কাছে মুখ্য।
মমতার অভয়দানের পর বিশেষজ্ঞদের পাল্টাপাল্টি দাবির এই জট কীভাবে ও কত দ্রুত খুলতে পারে, তার কোনো ধারণা এই মুহূর্তে ভারতের পররাষ্ট্র ও জলসম্পদ মন্ত্রণালয়ে নেই। আন্তর্জাতিক এই চুক্তি নতুনভাবে করার আগে প্রথমে ভারতের অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য ঘোচাতে হবে। অর্থাৎ, তিস্তা নিয়ে প্রথমে দিল্লি ও কলকাতাকে একমত হতে হবে। তারপর সেই প্রস্তাবকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে হবে বাংলাদেশের কাছে। এক কথায়, কেঁচে গণ্ডূষ করা।
মমতার সফরের প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছেছে। ২ মার্চ পররাষ্ট্রসচিব এস জয়শঙ্কর তাঁর সার্ক যাত্রায় ঢাকা যাচ্ছেন। অবশ্যই সফরজুড়ে থাকবে তিস্তা বিতর্কের অবসানে মমতার বরাভয় মুদ্রা। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, মমতা নিজেই দিল্লি আসছেন মার্চ মাসের ৮-৯ তারিখে, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রাজ্যের দাবিদাওয়া নিয়ে আলোচনা করতে। ভোটের পর নরেন্দ্র মোদিকে মমতা অভিনন্দন জানাননি, আনুষ্ঠানিক কথাও বলেননি। সেই নিরিখে ক্ষমতা লাভের নয় মাস পর মোদি-মমতা মুখোমুখি হবেন। তিস্তার নতুন প্রক্রিয়ার শুরুও সেই সাক্ষাতে হবে না, কে বলতে পারে? বিশেষত, মমতা নিজেই যখন বরফ গলানোর মুডে রয়েছেন।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: প্রথম আলোর নয়াদিল্লির প্রতিনিধি।
No comments