আমার কথা কি তোমার ছিল মনে- এই ফাগুনে by মোকাম্মেল হোসেন
কিন্ডার জয়। এ ধরনের নাম আগে কখনও শুনিনি। এটা খাওয়ার জিনিস, না খেলনা- বুঝতে পারছি না! পরিষ্কার হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম-
: আব্বু, এইটা কী জিনিস?
বাপের অজ্ঞতায় জাহিন খুব মজা পেল। হাসতে হাসতে বলল-
: আরে! এইটা তো চকোলেট।
- চকোলেট!
: হুঁ। তুমি জান না?
- উহুঁ।
: এইটা চকোলেট। গোলগোল।
গোল-গোল চকোলেটের পরিবেশনা অতি চমৎকার। ডিম আকৃতির সুদৃশ্য প্লাস্টিকের ছোট্ট একটা কৌটা। তার ভেতর টিকটিকির ডিমের মতো জিনিসগুলো শোভা পাচ্ছে। সঙ্গে ফাউ হিসেবে একটা খেলনাও দেয়া হয়েছে। বোঝা যায়-দাদারা ডিমের ভেতরে ডিম ভরে এদেশীয় ভাইপো-ভাইঝিদের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করার আগে শিশু মনস্তত্ত্ব নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা করেছেন। কিছুক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখার পর দাম জিজ্ঞেস করতে যাব- ফোন বেজে উঠল। ওপাশ থেকে জাহিন বলল-
: আব্বু, অরেঞ্জ কালার আনবা না।
- কেন?
: অরেঞ্জ কালার মেয়েদের। আমার জন্য নীল কালার আনবা। নীল- বুঝছ?
- বুঝছি।
: তাড়াতাড়ি আসবা।
- আইচ্ছা।
ডিমের গায়ে লেপ্টে থাকা বিভিন্ন রঙের মোড়ক নিয়ে এতক্ষণ মাথা ঘামাইনি। জাহিনের কথায় বুঝতে পারলাম, এখানেও গূঢ় মনস্তত্ত্বের ব্যাপার আছে। দাম জিজ্ঞেস করলাম। দোকানদার রুপির মূল্যমান টাকায় রূপান্তরিত করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল-
: ৮০ টাকা।
দাম শুনে হালকা হোঁচট খেলাম। এরকম ছোট্ট কয়েকটা চকোলেটের দাম ৮০ টাকা! আমার লাগবে তিন কৌটা। একটা নিয়ে বাসায় হাজির হলে বাকি দুজন গাল ফোলাবে। গোল নিয়ে গণ্ডগোল দেখা দেবে। তিনটা মানে তিন আটে চব্বিশ। দুশ চল্লিশ টাকা। এই ছাতারমাথার জিনিসের চেয়ে অনেক কম দামে অন্যকিছু কিনে সবার হাতে তুলে দেয়া সম্ভব। গণপরিবেশনার ভাবনা বাস্তবায়ন করার আগে জাহিনের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। দেখি, সে রাজি হয় কিনা! ফোন করলাম। ওপাশ থেকে লবণ বেগম বলল-
: ফোন করছ কী জন্য!
আকাশ বলছে, এখন বসন্ত। বাতাস বলছে, এখন বসন্ত। গাছেরা বলছে, এখন বসন্ত। পাখিরা বলছে, এখন বসন্ত। এ রকম একটা পরিবেশে একটু রোমান্টিক হলে দোষ কী? বললাম-
: কোকিলের ডাক শুইন্যা মনটা ব্যাকুল হইছে। সেইজন্য তোমারে ফোন দিলাম।
- মিছা কথা।
: কোকিলের ডাক কি মিথ্যা?
- কোকিলের ডাক মিথ্যা না। তোমার কথা মিথ্যা।
: কেমনে মিথ্যা হইল!
- কোকিল কি এইবারই প্রথম ডাকতেছে? বিগত ১৪ বছর কোকিল লইয়া তো কোনো কথা শুনলাম না! কী জন্য ফোন করছ- সেইটা বল।
: তোমার আশেপাশে জাহিন আছে?
- আছে।
: দেও তো একটু।
দূরে কয়েকটা ফলের দোকান। দোকানে আপেল-আঙুর-কমলা-নাশপাতির পাশে বাউকুল, আপেলকুল, নারকেলকুল ইত্যাদি শোভা পাচ্ছে। জাহিন ফোন কানে ঠেকানোর পর সেদিকে তাকিয়ে বললাম-
: আব্বু, তোমার চকোলেট গোল। বরইও গোল। চকোলেটের বদলে বরই আনি?
- না।
: তাইলে আপেল?
- হো-হো! ভাইয়াদের জন্য আপেল, আর আমার জন্য চকোলেট। ঠিক আছে?
: আব্বু! আমি এই চকোলেটটা আনতে চাই না।
- কেন?
: দেখতে সুন্দর হইলেও মনে হইতেছে, জিনিসটা ভালো না। তোমার জন্য অন্য জিনিস আনি?
- কী জিনিস?
: সেইটা এখন বলতে চাইতেছি না। যা আনব- আশা করি, তোমার পছন্দ হবে।
- যদি পছন্দ না হয়?
: আব্বুর ওপর ভরসা রাখ।
শাহবাগ মোড়ের ভ্যারাইটি স্টোর পেছনে রেখে ফুটপাত ধরে হাঁটছি। কিছু দূর যাওয়ার পর একটা শিমূল ফুল টুপ করে মাথা স্পর্শ করে সামনে গড়িয়ে পড়ল। ফুলটা হাতে তুলে নিলাম। সেই কবে কোন কৈশোরে, কালিবাড়ি বাজারে দুর্গাপূজা দেখতে যাওয়ার পর প্রসাদ হাতে নিয়ে বসতেই একটা নূপুর উড়ে এসে বুকে লেগে সামনে গড়িয়ে পড়েছিল। হঠাৎ পাওয়া সেদিনের সেই উপহার যেভাবে পরম যতেœ পকেটে রেখে দিয়েছিলাম, আজও তাই করলাম।
বাংলা একাডেমির গেটে নারী ও পুরুষ পুলিশের সম্মিলিত বাহিনী বইমেলায় আগত নারী জাতির ব্যাগ পরীক্ষা করছে। ফুলে থাকা প্যান্টের পকেটের দিকে নজর পড়তেই পুলিশের এক নওজোয়ান আমাকে বললেন-
: আপনার পকেটে কী জিনিস- বাইর করেন।
জিনিসটা পকেট থেকে বের করলাম। তার নাকের কাছে ধরে হাসিমুখে বললাম-
: পুষ্প।
একাডেমি চত্বরের এবারের পরিবেশ সম্পূর্ণ অন্যরকম। আগে বইয়ের দোকানের ঘেরাটোপে এখানকার দুঘাটলা পুকুর অনেকটা অদৃশ্যই থেকে যেত। এবার কী সুন্দরভাবে সে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। শানবাঁধানো ঘাটে ছেলেমেয়েদের ভিড়। কেউ কেউ ছবি তুলছে। ঘাটের সর্বশেষ সিঁড়িতে বসে পা ঝুলিয়ে দিলাম। সংসার নিত্য যাতনাময়। যাতনা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ নানা পথ ও উপায় অনুসন্ধান করে। এ মুহূর্তে আমার জলের আশ্রয় নিতে ইচ্ছে করছে।
ঘাট থেকে অনেক নিচে অনড় জল। হঠাৎ বসন্তের বাতাস জলের বুক স্পর্শ করতেই সে কেঁপে উঠল। অলৌকিকতার রথে সওয়ার হয়ে নিচের জল ঘাট স্পর্শ করছে- এ ভাবনায় বিভোর হয়ে তাকে ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম।
বইমেলার আরেক অংশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এখানেও রয়েছে সুপরিকল্পনা ও যত্নের ছাপ। ঘুরে ঘুরে বইকেনার সময় নিজেকে একটুও ক্লান্ত মনে হল না। বাসায় ফেরার পর প্রথম জাহিনের হাতে বই তুলে দিলাম। তারপর অন্য দুছেলের হাতে। রঙ, ছবি ও বর্ণের বিস্ময়কর ভুবনে পা রেখে তিনজনই আনন্দে আত্মহারা। জাহিন চকোলেট নিয়ে কোনো প্রশ্ন করল না। বুঝতে পারলাম- বই উৎসবের স্রোত ওর মন থেকে চকোলেট-ফকলেটের সব ভাবনা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ছেলেদের আনন্দ দেখতে দেখতে লবণ বেগম বলল-
: শুধু বাচ্চাদের জন্যই আনছ? আমার জন্য আন নাই!
- আনি নাই মানে? অবশ্যই আনছি।
: কই?
আবারও শিমূল ফুল হাতে তুলে নিলাম। ছবিতে দেখা মোগল রাজা-বাদশাদের প্রেম নিবেদনের ভঙ্গি নকল করে লবণ বেগমের দিকে সেটা বাড়িয়ে দিতেই সে হেসে বলল-
: বইয়ের বদলে ফুল?
- হুঁ। বসন্ত উপহার।
: টুকাইয়া আনছ?
- প্রশ্নই আসে না। বৃক্ষ নিজে তোমার জন্য এ উপহার আমার হাতে তুইল্যা দিছে।
: মানে?
- এ আরেক লম্বা কাহিনী। বইমেলার উদ্দেশে ফুটপাতের উপর দিয়া হাঁটতেছি- হঠাৎ কানের কাছে কে যেন ফিসফিস কইরা বইল্যা উঠল, লবণ বেগমের জন্য বসন্ত উপহার আছে। নিতে ভুল কইরও না। কে কথা বলল, কে কথা বলল- দেখার জন্য ডাইনে-বাঁয়ে, উপরে-নিচে তালাশ করতেছি; এমন সময় টুপ কইরা মাথার উপর এই শিমুল ফুলটা পড়ল। বুঝতে পারলাম- একটু আগে শিমুলবৃক্ষই ফিসফিস কইরা কথা বলতেছিল। আর এই ফুলটা হইল তোমাকে দেওয়া তার উপহার।
কুলকুল হাসি বলে এক ধরনের হাসি আছে। লবণ বেগমের মুখে এখন সেই হাসির আভা। হাসি থামার পর সে বলল-
: প্রত্যেকটা জিনিস লইয়া একটা গল্প না বানাইলে তোমার চলে না!
- এইটা গল্প না, সত্য। বাস্তবিকই এই ঘটনা ঘটছে।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর খাটের নিচে লুকানো বইগুলো বের করে লবণ বেগমের মাথার কাছে রেখে দিলাম। সকালবেলা ঘুম ভাঙার পর প্রিয় কবি ও লেখকের বই পেয়ে লবণ বেগম নিশ্চয়ই অভিভূত হবে। তার অভিভূত হওয়ার দৃশ্যটি ভাবতেই আমার চোখের পাতা ভিজে গেল। প্রিয়জনের অভিভূত হওয়ার দৃশ্যের চেয়ে এ জগতে মধুর আর কোনো দৃশ্য আছে কি?
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
onnachitra.bd@gmail.com
: আব্বু, এইটা কী জিনিস?
বাপের অজ্ঞতায় জাহিন খুব মজা পেল। হাসতে হাসতে বলল-
: আরে! এইটা তো চকোলেট।
- চকোলেট!
: হুঁ। তুমি জান না?
- উহুঁ।
: এইটা চকোলেট। গোলগোল।
গোল-গোল চকোলেটের পরিবেশনা অতি চমৎকার। ডিম আকৃতির সুদৃশ্য প্লাস্টিকের ছোট্ট একটা কৌটা। তার ভেতর টিকটিকির ডিমের মতো জিনিসগুলো শোভা পাচ্ছে। সঙ্গে ফাউ হিসেবে একটা খেলনাও দেয়া হয়েছে। বোঝা যায়-দাদারা ডিমের ভেতরে ডিম ভরে এদেশীয় ভাইপো-ভাইঝিদের উদ্দেশ্যে প্রেরণ করার আগে শিশু মনস্তত্ত্ব নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা করেছেন। কিছুক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখার পর দাম জিজ্ঞেস করতে যাব- ফোন বেজে উঠল। ওপাশ থেকে জাহিন বলল-
: আব্বু, অরেঞ্জ কালার আনবা না।
- কেন?
: অরেঞ্জ কালার মেয়েদের। আমার জন্য নীল কালার আনবা। নীল- বুঝছ?
- বুঝছি।
: তাড়াতাড়ি আসবা।
- আইচ্ছা।
ডিমের গায়ে লেপ্টে থাকা বিভিন্ন রঙের মোড়ক নিয়ে এতক্ষণ মাথা ঘামাইনি। জাহিনের কথায় বুঝতে পারলাম, এখানেও গূঢ় মনস্তত্ত্বের ব্যাপার আছে। দাম জিজ্ঞেস করলাম। দোকানদার রুপির মূল্যমান টাকায় রূপান্তরিত করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বলল-
: ৮০ টাকা।
দাম শুনে হালকা হোঁচট খেলাম। এরকম ছোট্ট কয়েকটা চকোলেটের দাম ৮০ টাকা! আমার লাগবে তিন কৌটা। একটা নিয়ে বাসায় হাজির হলে বাকি দুজন গাল ফোলাবে। গোল নিয়ে গণ্ডগোল দেখা দেবে। তিনটা মানে তিন আটে চব্বিশ। দুশ চল্লিশ টাকা। এই ছাতারমাথার জিনিসের চেয়ে অনেক কম দামে অন্যকিছু কিনে সবার হাতে তুলে দেয়া সম্ভব। গণপরিবেশনার ভাবনা বাস্তবায়ন করার আগে জাহিনের অনুমতি নেয়া প্রয়োজন। দেখি, সে রাজি হয় কিনা! ফোন করলাম। ওপাশ থেকে লবণ বেগম বলল-
: ফোন করছ কী জন্য!
আকাশ বলছে, এখন বসন্ত। বাতাস বলছে, এখন বসন্ত। গাছেরা বলছে, এখন বসন্ত। পাখিরা বলছে, এখন বসন্ত। এ রকম একটা পরিবেশে একটু রোমান্টিক হলে দোষ কী? বললাম-
: কোকিলের ডাক শুইন্যা মনটা ব্যাকুল হইছে। সেইজন্য তোমারে ফোন দিলাম।
- মিছা কথা।
: কোকিলের ডাক কি মিথ্যা?
- কোকিলের ডাক মিথ্যা না। তোমার কথা মিথ্যা।
: কেমনে মিথ্যা হইল!
- কোকিল কি এইবারই প্রথম ডাকতেছে? বিগত ১৪ বছর কোকিল লইয়া তো কোনো কথা শুনলাম না! কী জন্য ফোন করছ- সেইটা বল।
: তোমার আশেপাশে জাহিন আছে?
- আছে।
: দেও তো একটু।
দূরে কয়েকটা ফলের দোকান। দোকানে আপেল-আঙুর-কমলা-নাশপাতির পাশে বাউকুল, আপেলকুল, নারকেলকুল ইত্যাদি শোভা পাচ্ছে। জাহিন ফোন কানে ঠেকানোর পর সেদিকে তাকিয়ে বললাম-
: আব্বু, তোমার চকোলেট গোল। বরইও গোল। চকোলেটের বদলে বরই আনি?
- না।
: তাইলে আপেল?
- হো-হো! ভাইয়াদের জন্য আপেল, আর আমার জন্য চকোলেট। ঠিক আছে?
: আব্বু! আমি এই চকোলেটটা আনতে চাই না।
- কেন?
: দেখতে সুন্দর হইলেও মনে হইতেছে, জিনিসটা ভালো না। তোমার জন্য অন্য জিনিস আনি?
- কী জিনিস?
: সেইটা এখন বলতে চাইতেছি না। যা আনব- আশা করি, তোমার পছন্দ হবে।
- যদি পছন্দ না হয়?
: আব্বুর ওপর ভরসা রাখ।
শাহবাগ মোড়ের ভ্যারাইটি স্টোর পেছনে রেখে ফুটপাত ধরে হাঁটছি। কিছু দূর যাওয়ার পর একটা শিমূল ফুল টুপ করে মাথা স্পর্শ করে সামনে গড়িয়ে পড়ল। ফুলটা হাতে তুলে নিলাম। সেই কবে কোন কৈশোরে, কালিবাড়ি বাজারে দুর্গাপূজা দেখতে যাওয়ার পর প্রসাদ হাতে নিয়ে বসতেই একটা নূপুর উড়ে এসে বুকে লেগে সামনে গড়িয়ে পড়েছিল। হঠাৎ পাওয়া সেদিনের সেই উপহার যেভাবে পরম যতেœ পকেটে রেখে দিয়েছিলাম, আজও তাই করলাম।
বাংলা একাডেমির গেটে নারী ও পুরুষ পুলিশের সম্মিলিত বাহিনী বইমেলায় আগত নারী জাতির ব্যাগ পরীক্ষা করছে। ফুলে থাকা প্যান্টের পকেটের দিকে নজর পড়তেই পুলিশের এক নওজোয়ান আমাকে বললেন-
: আপনার পকেটে কী জিনিস- বাইর করেন।
জিনিসটা পকেট থেকে বের করলাম। তার নাকের কাছে ধরে হাসিমুখে বললাম-
: পুষ্প।
একাডেমি চত্বরের এবারের পরিবেশ সম্পূর্ণ অন্যরকম। আগে বইয়ের দোকানের ঘেরাটোপে এখানকার দুঘাটলা পুকুর অনেকটা অদৃশ্যই থেকে যেত। এবার কী সুন্দরভাবে সে স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। শানবাঁধানো ঘাটে ছেলেমেয়েদের ভিড়। কেউ কেউ ছবি তুলছে। ঘাটের সর্বশেষ সিঁড়িতে বসে পা ঝুলিয়ে দিলাম। সংসার নিত্য যাতনাময়। যাতনা থেকে মুক্তি পেতে মানুষ নানা পথ ও উপায় অনুসন্ধান করে। এ মুহূর্তে আমার জলের আশ্রয় নিতে ইচ্ছে করছে।
ঘাট থেকে অনেক নিচে অনড় জল। হঠাৎ বসন্তের বাতাস জলের বুক স্পর্শ করতেই সে কেঁপে উঠল। অলৌকিকতার রথে সওয়ার হয়ে নিচের জল ঘাট স্পর্শ করছে- এ ভাবনায় বিভোর হয়ে তাকে ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম।
বইমেলার আরেক অংশ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। এখানেও রয়েছে সুপরিকল্পনা ও যত্নের ছাপ। ঘুরে ঘুরে বইকেনার সময় নিজেকে একটুও ক্লান্ত মনে হল না। বাসায় ফেরার পর প্রথম জাহিনের হাতে বই তুলে দিলাম। তারপর অন্য দুছেলের হাতে। রঙ, ছবি ও বর্ণের বিস্ময়কর ভুবনে পা রেখে তিনজনই আনন্দে আত্মহারা। জাহিন চকোলেট নিয়ে কোনো প্রশ্ন করল না। বুঝতে পারলাম- বই উৎসবের স্রোত ওর মন থেকে চকোলেট-ফকলেটের সব ভাবনা ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ছেলেদের আনন্দ দেখতে দেখতে লবণ বেগম বলল-
: শুধু বাচ্চাদের জন্যই আনছ? আমার জন্য আন নাই!
- আনি নাই মানে? অবশ্যই আনছি।
: কই?
আবারও শিমূল ফুল হাতে তুলে নিলাম। ছবিতে দেখা মোগল রাজা-বাদশাদের প্রেম নিবেদনের ভঙ্গি নকল করে লবণ বেগমের দিকে সেটা বাড়িয়ে দিতেই সে হেসে বলল-
: বইয়ের বদলে ফুল?
- হুঁ। বসন্ত উপহার।
: টুকাইয়া আনছ?
- প্রশ্নই আসে না। বৃক্ষ নিজে তোমার জন্য এ উপহার আমার হাতে তুইল্যা দিছে।
: মানে?
- এ আরেক লম্বা কাহিনী। বইমেলার উদ্দেশে ফুটপাতের উপর দিয়া হাঁটতেছি- হঠাৎ কানের কাছে কে যেন ফিসফিস কইরা বইল্যা উঠল, লবণ বেগমের জন্য বসন্ত উপহার আছে। নিতে ভুল কইরও না। কে কথা বলল, কে কথা বলল- দেখার জন্য ডাইনে-বাঁয়ে, উপরে-নিচে তালাশ করতেছি; এমন সময় টুপ কইরা মাথার উপর এই শিমুল ফুলটা পড়ল। বুঝতে পারলাম- একটু আগে শিমুলবৃক্ষই ফিসফিস কইরা কথা বলতেছিল। আর এই ফুলটা হইল তোমাকে দেওয়া তার উপহার।
কুলকুল হাসি বলে এক ধরনের হাসি আছে। লবণ বেগমের মুখে এখন সেই হাসির আভা। হাসি থামার পর সে বলল-
: প্রত্যেকটা জিনিস লইয়া একটা গল্প না বানাইলে তোমার চলে না!
- এইটা গল্প না, সত্য। বাস্তবিকই এই ঘটনা ঘটছে।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর খাটের নিচে লুকানো বইগুলো বের করে লবণ বেগমের মাথার কাছে রেখে দিলাম। সকালবেলা ঘুম ভাঙার পর প্রিয় কবি ও লেখকের বই পেয়ে লবণ বেগম নিশ্চয়ই অভিভূত হবে। তার অভিভূত হওয়ার দৃশ্যটি ভাবতেই আমার চোখের পাতা ভিজে গেল। প্রিয়জনের অভিভূত হওয়ার দৃশ্যের চেয়ে এ জগতে মধুর আর কোনো দৃশ্য আছে কি?
মোকাম্মেল হোসেন : সাংবাদিক
onnachitra.bd@gmail.com
No comments