‘চিৎকার শুনেও কেউ আসেনি’ by রুদ্র মিজান
‘বাঁচাও
বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছিলেন অভিজিৎ রায়ের স্ত্রী রাফিদা আহমেদ বন্যা।
বন্যার মাথা ও হাত থেকে তখন ফিনকি দিয়ে রক্ত ঝরছে। ঘটনাস্থলের আশপাশ দিয়ে
লোকজন হেঁটে যাচ্ছে। কেউ অদূরে দাঁড়িয়ে আছে। দাঁড়িয়ে আছেন একজন পুলিশ
সদস্যও। কিন্তু তাদের কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে যায়নি। এরই মধ্যে বন্যাও
রাস্তায় পড়ে যান। দৃশ্যটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটি চায়ের দোকান থেকে
দেখছিলেন আলোকচিত্রী জীবন আহমেদ। দোকানটি ঘটনাস্থলের কাছে হলেও উদ্যানের
ফটক দিয়ে বের হয়ে ঘটনাস্থলে যেতে হয়। এজন্য একটু সময় লাগে ঘটনাস্থলে
পৌঁছতে। জীবন জানিয়েছেন আহত অবস্থায় অভিজিৎ ও তার স্ত্রীকে হাসপাতালে নিয়ে
যান ঝুঁকি নিয়ে। হাসপাতালে নেয়ার সময় বন্যা ভেবেছিলেন আমিই তাদের ওপর
আক্রমণ করেছি। এজন্য তিনি ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করছিলেন। গতকাল
দুপুরে মানবজমিনের সঙ্গে আলাপকালে তিনি ওই দিনের বীভৎস ওই ঘটনার বর্ণনা
দেন। জানান, অভিজিৎ রায় ও তার স্ত্রীকে কিভাবে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে
যান তিনি। এ ঘটনার পর থেকে নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কায় আছেন জীবন।
ফটো এজেন্সি বাংলার চোখের নবীন এ কর্মী জানান, বৃহস্পতিবার রাত তখন প্রায় পৌণে ৯টা। বন্ধুদের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেঞ্চে বসে চা পান করছিলেন তিনি। প্রত্যক্ষদর্শী কেউ সাহায্যের হাত না বাড়ালেও জীবন ছুটে যান। তিনি ভেবেছিলেন বন্যাকে কেউ চাপাতি দিয়ে আঘাত করেছে। তিনি তার হাত ধরে বলেন, আপা আপনি উঠেন। আপানাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব। চোখ খুলে তাকিয়ে অসংলগ্ন প্রশ্ন করেন বন্যা। তিনি বলেন, কেন, এখানে কি হয়েছে। কারা এখানে কাকে মেরেছে? তাৎক্ষণিকভাবে কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না জীবন। এর মধ্যেই বন্যা ছুটে যান ফুটপাতে পড়ে থাকা রক্তাক্ত অভিজিতের কাছে। মুখে হাত বোলাতে বোলাতে বন্যা ডাকেন, ‘অভি ওঠো, ওঠো অভি...।’ ঠিক তখনই জীবন বুঝতে পারেন যে শুধু বন্যাই না, অভিজিৎকেও আঘাত করেছে সন্ত্রাসীরা। অভিজিৎ তখন নড়চড়া করছিলেন। তার মাথা থেকে রক্ত পড়ছিল। ফুটপাত, রাস্তা রক্তে ভেসে যায়।
মূল রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটি অটোরিকশা থামান জীবন। ওই অটোরিকশায় দুই যাত্রী ছিলেন। তাদের অনুরোধ করলে তারা নেমে যান। এরই মধ্যে অনেকেই এসে জড়ো হন। দীর্ঘদেহী অভিজিৎকে অটোরিকশায় করে নিয়ে যাওয়া যাবে না বলে আপত্তি জানান উপস্থিত অনেকে। জীবন বলেন, এটাতেই নিতে হবে। সময় ব্যয় করলে তাকে বাঁচানো যাবে না। তখন চার-পাঁচজন এগিয়ে যান। তাদের সহযোগিতায় অটোরিকশায় তোলা হয় অভিজিৎকে। দুই হাত দিয়ে অভিজিতের ক্ষত-বিক্ষত মাথা ধরে রাখেন জীবন। তার পেট-কোমর ছিল বন্যার বাহুর ওপরে। অভিজিতের দুই পা অটোরিকশার বাইরে ছিল। তাই অতি সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছিলেন চালক। জীবন চিৎকার করে সামনের যানবাহন চালকদের সাবধান করছিলেন। অটোরিকশা দোয়েল চত্বরের দিকে এগুতে থাকে। অটোরিকশাটি যখন বাংলা একাডেমির ফটকের সামনে তখন অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন বন্যা। জীবনের কাছে জানতে চান, কে আপনি, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন, আপনি কি আমাদের মেরে ফেলবেন?
জীবন নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, আপা আমি আপনাদের মেডিক্যালে নিয়ে যাচ্ছি। তা বিশ্বাস করতে চান না বন্যা। জীবনের পা ছুঁয়ে বলেন, আপনার পায়ে ধরি আপনি আমাদের মারবেন না। যা চান তাই দেব। শুধু আমাদের ছেড়ে দেন। বন্যা তখন ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। ওই সময়ে আতঙ্কের কথা প্রকাশ করতে গিয়ে জীবন বলেন, একটা চরম ঝুঁকি নিয়ে তাদের উদ্ধার করেছি। বন্যা যখন চিৎকার করছিলেন তখন ভেবেছি, অটোরিকশা থামিয়ে বন্যার কথা শুনে গণপিটুনি দিয়ে আমাকে মেরে ফেলতে পারে পথচারীরা। অটোরিকশা যখন দোয়েল চত্বরে তখন পেছনে তাকিয়ে একজন পুলিশকে দেখে ভরসা পাই। ঘটনাস্থলে তাকে দেখেছি দাঁড়িয়ে থাকতে। তিনি মোটরসাইকেলযোগে আমাদের পেছনে আসছিলেন। বন্যাকেও তিনি আশ্বস্ত করতে চান। বলেন, আপা, তাকিয়ে দেখেন পেছনে পুলিশ আছে। বন্যার চোখের নিচে ধারালো অস্ত্রের আঘাত। রক্ত লেগে আছে। যে কারণে তিনি পেছনে তাকিয়েও তা দেখতে পাননি। বন্যা বলেন, কোথায় পুলিশ। পুলিশ নেই। এ অবস্থাতেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে পৌঁছে যায় তাদের অটোরিকশা। অভিজিৎকে ধরে নামায় হাসপাতালের লোকজন। বন্যা চিৎকার করে বলছিলেন, ডাক্তার অভিকে বাঁচান। তার চিকিৎসা করুন। জীবনের তখন মাথা ঘুরছে। রক্তে ভিজে গেছে শরীরের অর্ধেক। তাৎক্ষণিকভাবে রক্তভেজা নীল রঙের টি-শার্ট পরিবর্তন করে ক্যামেরা মুছার জন্য ব্যাগে রাখা পুরনো টিশার্ট পরেন তিনি। জীবন জানান, কর্তব্যরত আনসাররা তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। জরুরি বিভাগের ফটকের বাইরে বসে ছিলেন তিনি। রাত ১০টা পর্যন্ত ঢামেক হাসপাতালে ছিলেন। অফিসে গিয়ে জানতে পারেন তিনি যাকে উদ্ধার করেছেন তিনি লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে ১০টায় তিনি মারা গেছেন।
জীবন বলেন, আমি তাদের পরিচয় জানতাম না। দুজন আহত মানুষ রাস্তায় পড়ে আছেন। কেউ তাদের সাহায্য করছে না। এটা দেখে একজন মানুষ হিসেবে আমি উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেছি। এই ঘটনার পর সাহায্যকারী হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্কে আছেন তিনি। এছাড়া এ রকম নির্মম দৃশ্য এর আগে দেখেননি তিনি। যে কারণে গত দুই রাত তিনি ঘুমাতে পারেননি বলে জানান।
দায় স্বীকারের সেই ‘টুইট’ করা হয়েছিল ইউকে থেকে
ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে টুইটটি ইউকে থেকে করা হয়েছিল বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে অভিজিৎকে হত্যার কিছুক্ষণ পরই ‘আনসার বাংলা ৭’ পরিচয়ে দায় স্বীকার করে একটি টুইট করা হয়। এদিকে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশের দায়িত্ব পালনে অবহেলা ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া তদন্তে সহযোগিতার জন্য সাত সদস্যের পৃথক আরেকটি কমিটিও গঠন করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম জানান, হত্যার দায় স্বীকার করে যে টুইটটি করা হয়েছিল তা ইউকে থেকে আপলোড করা হয় বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। এছাড়া স্পর্শকাতর এই ঘটনার সঙ্গে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিষয়টি মাথায় রেখেই তদন্ত কাজ করছেন বলে জানান তিনি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, অভিজিৎকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার কিছুক্ষণ পরই ‘আনসার বাংলা ৭’ একটি আইডি থেকে টুইটারে দায় স্বীকার করা হয়। টুইটারে বলা হয় ‘আল্লাহু আকবর, এ গ্রেট সাকসেস হেয়ার ইন বাংলাদেশ, টার্গেট ইজ ডাউন ইন ঢাকা’। এর কিছুক্ষণ পর অপর একটি টুইটে অভিজিতের রক্তাক্ত মাথা ধরে বসে থাকা স্ত্রী রাফিদার ছবি আপলোড করে বলা হয়, ‘এক্সক্লুসিভ, মে বি ইটস অভিজিৎ রায়’স ব্লাডি ওয়াইফ উইথ হাজব্যান্ড হেড। বিহেডেড, হি ওয়াজ এ টপ টার্গেট ফর লাস্ট ৩/৪ ইয়ারস।’ তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত দ্রুত টুইট করা মানেই যে টুইট করেছে তার সঙ্গে হত্যাকারীদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পরপরই কিলিং মিশনে থাকা কেউ এই খবরটি তাকে জানায়। ইউকেতে বসে সে দায় স্বীকার করে টুইটটি আপলোড করে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহভাজন উগ্রপন্থি জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতাকর্মীরা উচ্চ শিক্ষিত। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনেকেই এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। ওই সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীরা অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করেছে। এ কারণে চাপাতির হাতলে যেন হাতের ছাপ না পড়ে এজন্য হাতলে আগে থেকেই কাগজ ব্যবহার করেছিল। ব্যবহারের পর সেই কাগজও দুমড়ে-মুচড়ে নষ্ট করে দিয়ে গেছে। যাতে আঙুলের কোন ছাপ ধরা না পড়ে। তদন্ত সূত্র জানায়, গোয়েন্দারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অপারেশনাল উইংসের প্রধান রানাকে গ্রেপ্তারের জন্য হন্যে হয়ে চেষ্টা করছে। রানা সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, খুনিদের চিহ্নিত করতে তারা একুশে বইমেলা থেকে সংগৃহীত ভিডিও ফুটেজ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাদের ধারণা, হত্যকাণ্ডে অংশ নেয়াদের সহযোগীরা আগে থেকেই অভিজিতের পিছু নিয়েছিল। এমনকি সহযোগীদের কেউ কেউ সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে থেকে মোবাইলে ছবি তুলে আপলোড করেছে। এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ঢাকা মেডিক্যাল থেকেও ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে একুশে বইমেলা থেকে সংগৃহীত ভিডিও ফুটেজ দেখে কয়েকজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে তাদের বিস্তারিত কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
তদন্ত সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের পরপর নিহত অভিজিতের বাবার মুঠোফোন নম্বরে যে হুমকিটি এসেছিল তা বাংলাদেশের গাইবান্ধা এলাকা থেকে করা হয় বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মোবাইলে হুমকি দেয়া ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। গ্রেপ্তারের পর জানা যাবে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার কোন সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না? গোয়েন্দা সূত্র জানায়, তারা অনুসন্ধান করে দেখেছেন মোবাইলে হুমকি দেয়া নম্বরটিতে বেশিরভাগ সময় রাতের বেলায় কথা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, নিহত অভিজিতের পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে সংশ্লিষ্ট থানাকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
পুলিশের অবহেলা খতিয়ে দেখতে কমিটি: এদিকে চারপাশে পুলিশ থাকার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় অভিজিৎ রায়কে খুনের ঘটনায় পুলিশের দায়িত্ব পালনে কোন অবহেলা ছিল কি না তা খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মীর রেজাউল করিমের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটি গঠন করা হয়। অপরদিকে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে ও তদন্তে সহায়তার জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে সাত সদস্যের আরেকটি বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলামকে।
ফটো এজেন্সি বাংলার চোখের নবীন এ কর্মী জানান, বৃহস্পতিবার রাত তখন প্রায় পৌণে ৯টা। বন্ধুদের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেঞ্চে বসে চা পান করছিলেন তিনি। প্রত্যক্ষদর্শী কেউ সাহায্যের হাত না বাড়ালেও জীবন ছুটে যান। তিনি ভেবেছিলেন বন্যাকে কেউ চাপাতি দিয়ে আঘাত করেছে। তিনি তার হাত ধরে বলেন, আপা আপনি উঠেন। আপানাকে হাসপাতালে নিয়ে যাব। চোখ খুলে তাকিয়ে অসংলগ্ন প্রশ্ন করেন বন্যা। তিনি বলেন, কেন, এখানে কি হয়েছে। কারা এখানে কাকে মেরেছে? তাৎক্ষণিকভাবে কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না জীবন। এর মধ্যেই বন্যা ছুটে যান ফুটপাতে পড়ে থাকা রক্তাক্ত অভিজিতের কাছে। মুখে হাত বোলাতে বোলাতে বন্যা ডাকেন, ‘অভি ওঠো, ওঠো অভি...।’ ঠিক তখনই জীবন বুঝতে পারেন যে শুধু বন্যাই না, অভিজিৎকেও আঘাত করেছে সন্ত্রাসীরা। অভিজিৎ তখন নড়চড়া করছিলেন। তার মাথা থেকে রক্ত পড়ছিল। ফুটপাত, রাস্তা রক্তে ভেসে যায়।
মূল রাস্তায় দাঁড়িয়ে একটি অটোরিকশা থামান জীবন। ওই অটোরিকশায় দুই যাত্রী ছিলেন। তাদের অনুরোধ করলে তারা নেমে যান। এরই মধ্যে অনেকেই এসে জড়ো হন। দীর্ঘদেহী অভিজিৎকে অটোরিকশায় করে নিয়ে যাওয়া যাবে না বলে আপত্তি জানান উপস্থিত অনেকে। জীবন বলেন, এটাতেই নিতে হবে। সময় ব্যয় করলে তাকে বাঁচানো যাবে না। তখন চার-পাঁচজন এগিয়ে যান। তাদের সহযোগিতায় অটোরিকশায় তোলা হয় অভিজিৎকে। দুই হাত দিয়ে অভিজিতের ক্ষত-বিক্ষত মাথা ধরে রাখেন জীবন। তার পেট-কোমর ছিল বন্যার বাহুর ওপরে। অভিজিতের দুই পা অটোরিকশার বাইরে ছিল। তাই অতি সাবধানে গাড়ি চালাচ্ছিলেন চালক। জীবন চিৎকার করে সামনের যানবাহন চালকদের সাবধান করছিলেন। অটোরিকশা দোয়েল চত্বরের দিকে এগুতে থাকে। অটোরিকশাটি যখন বাংলা একাডেমির ফটকের সামনে তখন অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকেন বন্যা। জীবনের কাছে জানতে চান, কে আপনি, কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন, আপনি কি আমাদের মেরে ফেলবেন?
জীবন নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, আপা আমি আপনাদের মেডিক্যালে নিয়ে যাচ্ছি। তা বিশ্বাস করতে চান না বন্যা। জীবনের পা ছুঁয়ে বলেন, আপনার পায়ে ধরি আপনি আমাদের মারবেন না। যা চান তাই দেব। শুধু আমাদের ছেড়ে দেন। বন্যা তখন ‘বাঁচাও বাঁচাও’ বলে চিৎকার করতে থাকেন। ওই সময়ে আতঙ্কের কথা প্রকাশ করতে গিয়ে জীবন বলেন, একটা চরম ঝুঁকি নিয়ে তাদের উদ্ধার করেছি। বন্যা যখন চিৎকার করছিলেন তখন ভেবেছি, অটোরিকশা থামিয়ে বন্যার কথা শুনে গণপিটুনি দিয়ে আমাকে মেরে ফেলতে পারে পথচারীরা। অটোরিকশা যখন দোয়েল চত্বরে তখন পেছনে তাকিয়ে একজন পুলিশকে দেখে ভরসা পাই। ঘটনাস্থলে তাকে দেখেছি দাঁড়িয়ে থাকতে। তিনি মোটরসাইকেলযোগে আমাদের পেছনে আসছিলেন। বন্যাকেও তিনি আশ্বস্ত করতে চান। বলেন, আপা, তাকিয়ে দেখেন পেছনে পুলিশ আছে। বন্যার চোখের নিচে ধারালো অস্ত্রের আঘাত। রক্ত লেগে আছে। যে কারণে তিনি পেছনে তাকিয়েও তা দেখতে পাননি। বন্যা বলেন, কোথায় পুলিশ। পুলিশ নেই। এ অবস্থাতেই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে পৌঁছে যায় তাদের অটোরিকশা। অভিজিৎকে ধরে নামায় হাসপাতালের লোকজন। বন্যা চিৎকার করে বলছিলেন, ডাক্তার অভিকে বাঁচান। তার চিকিৎসা করুন। জীবনের তখন মাথা ঘুরছে। রক্তে ভিজে গেছে শরীরের অর্ধেক। তাৎক্ষণিকভাবে রক্তভেজা নীল রঙের টি-শার্ট পরিবর্তন করে ক্যামেরা মুছার জন্য ব্যাগে রাখা পুরনো টিশার্ট পরেন তিনি। জীবন জানান, কর্তব্যরত আনসাররা তাকে ভেতরে ঢুকতে দেয়নি। জরুরি বিভাগের ফটকের বাইরে বসে ছিলেন তিনি। রাত ১০টা পর্যন্ত ঢামেক হাসপাতালে ছিলেন। অফিসে গিয়ে জানতে পারেন তিনি যাকে উদ্ধার করেছেন তিনি লেখক, ব্লগার অভিজিৎ রায়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে ১০টায় তিনি মারা গেছেন।
জীবন বলেন, আমি তাদের পরিচয় জানতাম না। দুজন আহত মানুষ রাস্তায় পড়ে আছেন। কেউ তাদের সাহায্য করছে না। এটা দেখে একজন মানুষ হিসেবে আমি উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে গেছি। এই ঘটনার পর সাহায্যকারী হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্কে আছেন তিনি। এছাড়া এ রকম নির্মম দৃশ্য এর আগে দেখেননি তিনি। যে কারণে গত দুই রাত তিনি ঘুমাতে পারেননি বলে জানান।
দায় স্বীকারের সেই ‘টুইট’ করা হয়েছিল ইউকে থেকে
ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারে টুইটটি ইউকে থেকে করা হয়েছিল বলে গোয়েন্দারা নিশ্চিত হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার রাতে অভিজিৎকে হত্যার কিছুক্ষণ পরই ‘আনসার বাংলা ৭’ পরিচয়ে দায় স্বীকার করে একটি টুইট করা হয়। এদিকে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের সময় ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশের দায়িত্ব পালনে অবহেলা ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়া তদন্তে সহযোগিতার জন্য সাত সদস্যের পৃথক আরেকটি কমিটিও গঠন করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ-ডিএমপি।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম জানান, হত্যার দায় স্বীকার করে যে টুইটটি করা হয়েছিল তা ইউকে থেকে আপলোড করা হয় বলে তারা নিশ্চিত হয়েছেন। এছাড়া স্পর্শকাতর এই ঘটনার সঙ্গে ধর্মীয় উগ্রপন্থিদের বিষয়টি মাথায় রেখেই তদন্ত কাজ করছেন বলে জানান তিনি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, অভিজিৎকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যার কিছুক্ষণ পরই ‘আনসার বাংলা ৭’ একটি আইডি থেকে টুইটারে দায় স্বীকার করা হয়। টুইটারে বলা হয় ‘আল্লাহু আকবর, এ গ্রেট সাকসেস হেয়ার ইন বাংলাদেশ, টার্গেট ইজ ডাউন ইন ঢাকা’। এর কিছুক্ষণ পর অপর একটি টুইটে অভিজিতের রক্তাক্ত মাথা ধরে বসে থাকা স্ত্রী রাফিদার ছবি আপলোড করে বলা হয়, ‘এক্সক্লুসিভ, মে বি ইটস অভিজিৎ রায়’স ব্লাডি ওয়াইফ উইথ হাজব্যান্ড হেড। বিহেডেড, হি ওয়াজ এ টপ টার্গেট ফর লাস্ট ৩/৪ ইয়ারস।’ তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এত দ্রুত টুইট করা মানেই যে টুইট করেছে তার সঙ্গে হত্যাকারীদের সম্পৃক্ততা রয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পরপরই কিলিং মিশনে থাকা কেউ এই খবরটি তাকে জানায়। ইউকেতে বসে সে দায় স্বীকার করে টুইটটি আপলোড করে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডে জড়িত সন্দেহভাজন উগ্রপন্থি জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের নেতাকর্মীরা উচ্চ শিক্ষিত। বিশেষ করে ইংল্যান্ডে প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনেকেই এই সংগঠনের সঙ্গে জড়িত। ওই সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণকারীরা অতিমাত্রায় সতর্কতা অবলম্বন করেছে। এ কারণে চাপাতির হাতলে যেন হাতের ছাপ না পড়ে এজন্য হাতলে আগে থেকেই কাগজ ব্যবহার করেছিল। ব্যবহারের পর সেই কাগজও দুমড়ে-মুচড়ে নষ্ট করে দিয়ে গেছে। যাতে আঙুলের কোন ছাপ ধরা না পড়ে। তদন্ত সূত্র জানায়, গোয়েন্দারা আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের অপারেশনাল উইংসের প্রধান রানাকে গ্রেপ্তারের জন্য হন্যে হয়ে চেষ্টা করছে। রানা সম্প্রতি বাংলাদেশে এসেছে বলে গোয়েন্দাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, খুনিদের চিহ্নিত করতে তারা একুশে বইমেলা থেকে সংগৃহীত ভিডিও ফুটেজ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন। তাদের ধারণা, হত্যকাণ্ডে অংশ নেয়াদের সহযোগীরা আগে থেকেই অভিজিতের পিছু নিয়েছিল। এমনকি সহযোগীদের কেউ কেউ সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে থেকে মোবাইলে ছবি তুলে আপলোড করেছে। এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত হয়েছে। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা ঢাকা মেডিক্যাল থেকেও ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে জানা গেছে। এরই মধ্যে একুশে বইমেলা থেকে সংগৃহীত ভিডিও ফুটেজ দেখে কয়েকজনকে সন্দেহভাজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে তাদের বিস্তারিত কোন তথ্য সংগ্রহ করতে পারেনি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
তদন্ত সূত্র জানায়, হত্যাকাণ্ডের পরপর নিহত অভিজিতের বাবার মুঠোফোন নম্বরে যে হুমকিটি এসেছিল তা বাংলাদেশের গাইবান্ধা এলাকা থেকে করা হয় বলে জানা গেছে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, মোবাইলে হুমকি দেয়া ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তাকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। গ্রেপ্তারের পর জানা যাবে হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে তার কোন সম্পৃক্ততা রয়েছে কি না? গোয়েন্দা সূত্র জানায়, তারা অনুসন্ধান করে দেখেছেন মোবাইলে হুমকি দেয়া নম্বরটিতে বেশিরভাগ সময় রাতের বেলায় কথা হয়। ঢাকা মহানগর পুলিশের উপ-কমিশনার (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, নিহত অভিজিতের পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে সংশ্লিষ্ট থানাকে বিশেষ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
পুলিশের অবহেলা খতিয়ে দেখতে কমিটি: এদিকে চারপাশে পুলিশ থাকার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় অভিজিৎ রায়কে খুনের ঘটনায় পুলিশের দায়িত্ব পালনে কোন অবহেলা ছিল কি না তা খতিয়ে দেখতে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) মীর রেজাউল করিমের নেতৃত্বে তিন সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটি গঠন করা হয়। অপরদিকে আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচনে ও তদন্তে সহায়তার জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে সাত সদস্যের আরেকটি বিশেষ টিম গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলামকে।
No comments