মমতার সঙ্গে কিছুক্ষণ এবং ... by আলী যাকের

সম্প্রতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকায় এসেছিলেন। সঙ্গে তাঁর সরকারের লোকজন যারা ছিলেন তার চেয়ে অনেক বেশি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষজন। আর অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গের কিছু ব্যবসায়ী। ঢাকায় তার অবস্থানকালে তারই ইচ্ছায় নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল বাংলাদেশের কিছু সংস্কৃতি সম্পৃক্ত ব্যক্তি এবং বুদ্ধিজীবীদের। মধ্যাহ্নভোজের আগে তাদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং আমাদের সংস্কৃতি বিষয়কমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বসেছিলেন শীর্ষ টেবিলে। আর অন্য অভ্যাগতরা বসেছিলেন তাদের মুখোমুখি, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গোলটেবিলের চারপাশে। এই সম্মিলনে সত্যিকার অর্থে একটি আড্ডার আমেজ ছিল এবং বাঙালির আড্ডায় যেমন হয়ে থাকে, নানাবিধ বিষয়ের সমাহার। একটি অতি সৌহার্দ্যপূর্ণ সমাবেশ ছিল এটি। আমি হেন এক নগণ্য ব্যক্তিও আমন্ত্রিত হয়ে গিয়েছিলাম ওইখানে। কথায় কথায় ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় বিষয়াদি উঠে আসছিল মাঝে মধ্যেই এবং সেটাই হওয়ার কথা। বাংলাদেশের সবার মনেই সবার ওপরে ছিল তিস্তার পানি বণ্টন সংক্রান্ত উৎকণ্ঠা। অতএব, বিভিন্ন সংস্কৃতজন তাদের নিজস্ব পরিশীলিত ভাষায় এই বিষয়টি সম্বন্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করেছেন। এ ধরনের দ্বিপক্ষীয় সমস্যা এত সহজ নয় যে, একটি কিংবা দুটি আলোচনায় এর সুরাহা হয়ে যাবে। এ কারণেই সেদিনের মধ্যাহ্নভোজে তাৎক্ষণিকভাবে এর কোনো সমাধান পাওয়া যেতে পারে এমন ধারণা কারও মনেই ছিল না। তিনি সংস্কৃতিসেবীদের নিজস্ব ভাষায় তাদের মনের কথা জানতে চেয়েছিলেন এবং বাংলাদেশি অতিথিরা নিজেদের আন্তরিক ভাষায় সেটি জানান দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে। একটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে এসেছিল এই কথোপকথন থেকে, তারা কেউ আবেগবর্জিত নিছক রাজনৈতিক ভাষায় কথা বলেননি। এটাই ছিল আমার জন্য বিশাল এক প্রাপ্তি।
পরবর্তীকালে আমি কতগুলো টেলিভিশন টকশোতে দেখলাম :বলা হয়েছে যে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ব্যবসা-বাণিজ্যিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গকে এই সম্মিলন থেকে দূরে রেখে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুদ্ধিজীবীদের বেছে নিয়েছেন এই কারণে যে, তিনি দ্বিপক্ষীয় সমস্যা জর্জরিত বিষয়গুলোর ব্যাপারে আলোচনা করতে আদৌ আগ্রহী ছিলেন না। এহেন কথাবার্তা শুনে আমি বেশ আমোদিত বোধ করেছি। ভেবেছি টকশো এবং বিদগ্ধজনকে ডেকে ডেকে বলি, আপনারা এই সম্মিলনে যাদের চেয়েছিলেন, তাদের সঙ্গে তো অনেকবার, অনেকভাবে দ্বিপক্ষীয় বিষয় নিয়ে ভারতীয়দের আলাপ-আলোচনা হয়েছে; কিন্তু অবশেষে কিছুই তো হয়নি। একবার না হয় বাকচাতুর্যের পরিবর্তে, আন্তরিকতা দিয়ে যুদ্ধজয় করা যায় কি-না সেটি পরীক্ষা করে দেখলেনই-বা! কী এমন ক্ষতি হয় তাতে? যারা এখনও সংস্কৃতিকে পরিহারযোগ্য বিবেচনা করে এসব তথাকথিত দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বিষয়ক আলাপ-আলোচনাকে কেবল বাগাড়ম্বরসর্বস্ব মানুষের জন্য নির্ধারিত রাখতে চান তাদের স্মরণ করিয়ে দেই যে, সংস্কৃতি দেশ, কাল এবং ব্যক্তিস্বার্থের অনেক ঊধর্ে্ব। অতএব, যে কোনো মানুষ সংস্কৃতজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় হৃদয়ের ছোঁয়াটি সহজেই বুঝতে পারেন। বুঝতে পারেন মানুষের অন্তর কী চায় এবং এই আন্তরিকতাকে উপেক্ষা করলে এর ফল খুব একটা ইতিবাচক হয় না।
লক্ষ্য করা সম্ভব হবে যে, বাংলাদেশের স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার যে চেতনা তার উন্মেষ মাতৃভাষার দাবি দিয়ে। ভাষা, সংস্কৃতির অন্তর্গত একটি বিষয়। কেবল ভাষা কেন? দৃষ্টির গোচরে এবং অগোচরে যেসব বিষয় আমাদের জাতিসত্তাকে স্বাতন্ত্র্য দিয়েছে তার সবই তো সংস্কৃতি উৎসারিত। যেমন_ খাদ্য, পোশাক-পরিচ্ছদ, সামাজিক আচার, ধর্ম, প্রায়োগিক শিল্পকলা, নানাবিধ শিল্পকর্ম এবং এমনকি মানুষে মানুষে পারস্পরিক সম্পর্ক। অতএব, দুই জাতি কিংবা রাষ্ট্রের মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভাষা হতে পারে একমাত্র সংস্কৃতি। এটিকে বাহন করলেই ভেতরের সত্যটিকে জানা যায় এবং সত্য জানতে পারলেই আলোচনায় ঐকান্তিকতা আসে এবং সমস্যার সমাধানের দিকে সত্যিকার অর্থে এগিয়ে যাওয়া যায়। স্মর্তব্য, ১৯৭১-এ আমরা যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেছিলাম, সেখানে বাঙালি সংস্কৃতির দ্বারা প্রাণিত বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যার যা আছে তাই তুলে নিয়েছিল হাতে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। এখানে 'স্বতঃপ্রবৃত্ত' শব্দটি প্রণিধানযোগ্য। ইংরেজিতে দুটি কথা আছে। একটি By Choice এবং অন্যটি  By Compulsion. আমাদের যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বাঙালি সামরিক ব্যক্তিবর্গ অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন By Compulsion.. তারা বীরের মতো যুদ্ধ করেছেন, শহীদ হয়েছেন এবং বিজয়ীও হয়েছেন। কিন্তু এই যুদ্ধ না করা ছাড়া তাদের কোনো গত্যন্তর ছিল না। যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অন্তর্গত থাকলে তাদের সবাইকে মেরে ফেলা হতো। ঠিক এর বিপরীতে বাঙালি শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী এবং সাধারণ মানুষ যুদ্ধে গিয়েছিল By Choice. তারা নিরাপদ দূরত্বে থাকতে চাইলে থাকতে পারতেন। তারা বাধ্য ছিলেন না যুদ্ধ করতে। এখানে আমার নিজের জন্য বিব্রতকর হলেও দু'একটি কথা বলতে চাই এই কারণে যে, কথাগুলো বলা দরকার। বাঙালি ও বাঙালির রাজনীতির সঙ্গে আমরা সম্পৃ্ক্ত ছিলাম সেই তরুণ বয়স থেকেই, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করি। পাকিস্তানিরা যখন বাঙালিদের আক্রমণ করল, তখন আমি একটি পাকিস্তানি কোম্পানিতে চাকরিরত ছিলাম। আমার বাসযোগ্য একটি ফ্ল্যাট ছিল এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল। আমি এ সবকিছুই ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধে চলে গিয়েছিলাম। কলকাতা আমার নানাবাড়ি। আমার কোম্পানির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক পাকিস্তানি ছিলেন এবং করাচিতে বসবাস করতেন। তিনি আমার কাছে একটি পত্র পাঠান, যেটি লন্ডন হয়ে কলকাতায় আমার নানাবাড়িতে পেঁৗছে '৭১-এর জুলাইয়ে। এই চিঠিতে তিনি বলেছিলেন, আমি যদি চাই তবে করাচিতে ফিরে যেতে পারি। কলকাতা থেকে লন্ডন হয়ে করাচি যাওয়ার টিকিট তিনি পাঠিয়ে দেবেন। এই চিঠিটি আমার হাতে আসে প্রায় সপ্তাহতিনেক পরে যখন যুদ্ধ প্রতিবেদনের কাজ শেষ করে কলকাতায় আসি। আমি প্রত্যুত্তরে তাকে লিখেছিলাম, 'আমি যা করছি, তা ভেবেচিন্তে করছি। বাংলাদেশ আমার মা। এটি আমার মায়ের প্রতি আমার ঋণ শোধের একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস মাত্র' এবং আমি নিশ্চিত, এই আবেগ আমার একক ছিল না, যারাই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যুদ্ধ করেছেন তাদের সবারই হৃদয়ের কথা ছিল এটি।
আমি আবারও বলি, আমার নিতান্ত ব্যক্তিগত এই ঘটনাটি এই প্রথম আমার পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিলাম, যে কারণে আমি বিব্রত। তবে জীবনের একটা এমন ক্রান্তিকালে এসে পেঁৗছেছি যে, যা কিছু সত্য কথা তা বলা প্রয়োজন বলে মনে করি। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আমার সেই চেতনা যা এখনও সব কাজে আমাকে অনুপ্রাণিত করে, তা সম্ভব হয়েছে ভাষা, শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতি আমার আনুগত্যের কারণে। অতএব, সংস্কৃতি এবং জীবনবোধকে বাইরে রেখে কোনো কর্মকাণ্ডে আন্তরিকতার খোঁজ করাটা এক ধরনের মূর্খতা। সেদিন সেই মধ্যাহ্নভোজে মমতার সঙ্গে কিছু কথার বিনিময়ে আমি নিশ্চিত, তিনি বাংলাদেশিদের হৃদয়ের কথা সম্যক উপলব্ধি করতে পেরেছেন এবং যেহেতু তিনি নিজেও সংস্কৃতির প্রতি অনুগত, সেই উপলব্ধি নিয়েই বুঝতে পেরেছেন আমাদের সুখ-দুঃখ, আমাদের কান্না-হাসি এবং আমাদের অন্তরের কথা।
সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.