প্রত্যাশিত বইমেলা by সালমা ইসলাম
এবার
একুশের গ্রন্থমেলার পরিসর বেড়েছে, পাঠকরা স্বস্তিতে মেলায় ঘুরে পছন্দের
বইটি সংগ্রহ করতে পারছেন, এ তথ্য মিডিয়ায় অব্যাহতভাবে প্রকাশিত হওয়ার
প্রেক্ষাপটে বইমেলার বিষয়ে অনেকেরই আগ্রহ বেড়েছে। তারা ধরেই নিয়েছেন,
একুশের গ্রন্থমেলা থেকে পছন্দের বইটি সংগ্রহ করতে গিয়ে অন্যান্য বছরের মতো
দুর্ভোগ পোহাতে হবে না। টানা হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি থাকায় অনেকেই
বইমেলায় যাওয়ার প্রোগ্রাম বাতিল করেছেন। মাসের শেষ শুক্রবার হরতাল না
থাকায় স্বাভাবিকভাবেই বইমেলা থেকে পছন্দের বইটি সংগ্রহ করতে দলে দলে মানুষ
মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে হাজির হয়েছেন। তারা মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখলেন সেই
পুরনো দৃশ্য- মেলার প্রবেশমুখে প্রচণ্ড ভিড়; কার আগে কে সোহরাওয়ার্দী
উদ্যানের বইমেলায় প্রবেশ করবে, চলছে সেই প্রতিযোগিতা। এ অবস্থায় বই কিনতে
আগ্রহী বয়স্ক ব্যক্তি ও মহিলাদের অনেকেই বই না কিনে ফিরে যাবেন, এটাই
স্বাভাবিক। পছন্দের বইটি না নিয়েই মেলা প্রাঙ্গণ থেকে কোনো পাঠকের ফিরে
যাওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক। টানা হরতাল-অবরোধের কারণে মেলায় প্রত্যাশিত
মাত্রায় বেচাকেনা না হওয়ার বিষয়ে প্রকাশকরা যখন চরম হতাশা প্রকাশ করছিলেন,
সেই সময় দলে দলে পাঠকের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলার প্রবেশমুখ থেকে
ফিরে যাওয়ার বিষয়টি তাদের হতাশাকে যে বাড়িয়ে তুলবে তাতে সন্দেহ কী? মেলা
আয়োজক কর্তৃপক্ষ কিছুটা দূরদর্শিতার পরিচয় দিলেই এমনটি হতো না। প্রতিবছর
শুক্র ও শনিবার মেলার প্রবেশমুখে প্রচণ্ড ভিড় হয়, এটি নতুন কিছু নয়। কাজেই এ
সমস্যার সমাধানে মেলা আয়োজক কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে, এটা
প্রত্যাশিত হলেও বাস্তবে দেখা গেল দুর্ভোগের পুরনো চিত্র। প্রচণ্ড ভিড়
উপেক্ষা করে বয়স্ক কোনো ব্যক্তি মেলায় প্রবেশ করতে গেলে যেকোনো সময়
অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও যে ঘটে যেতে পারে, এটাও অনুমান করা যায়।
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলায় প্রবেশমুখ থেকে কতসংখ্যক পাঠক হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন, এ হিসাব কখনোই পাওয়া যাবে না। সংখ্যাটা যত নগণ্যই হোক, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া দরকার। কারণ ফিরে যাওয়া বয়স্ক পাঠকদের বেশিরভাগই এসেছিলেন সপরিবারে বই কিনতে এবং মেলায় ঘুরতে। এত প্রস্তুতি নিয়ে যে বইমেলার আয়োজন করা হয়, উল্লিখিত বিষয়টিসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় তাদের বিবেচনার বাইরে থাকার বিষয়টি বিস্ময়কর। ভিড় এড়িয়ে বয়স্ক ও মহিলা পাঠকদের বইমেলায় প্রবেশ নিশ্চিত করার কাজটি কি খুব কঠিন? এ পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধীদের পক্ষে মেলা থেকে পছন্দের বইটি সংগ্রহ করা যে আরও কঠিন তা সহজেই অনুমান করা যায়।
বইমেলার আয়োজক কর্তৃপক্ষের কাছে উল্লিখিত সমস্যাগুলোর বিষয়ে তাৎক্ষণিক জবাব পাওয়া গেলেও জনগণ দৃশ্যমান সেবাই পেতে চায়; সেবার তাত্ত্বিক বর্ণনা নয়। বইমেলায় আগত বয়স্ক, মহিলা ও শিশুদের জন্য সার্ভিসচার্জের বিনিময়ে বিভিন্ন সেবা চালু করা হলে একে অনেকেই স্বাগত জানাবেন।
মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনার বিষয়টি যারা সত্যিকার অর্থে উপলব্ধি করে মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে হাজির হন; তারা মেলার প্রবেশমুখে দুর্ভোগের দৃশ্য দেখে বিস্মিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। এত আলোচনার পরও একুশের গ্রন্থমেলাকে কেন বৈশাখী মেলার আমেজ থেকে মুক্ত করা যাচ্ছে না, এটিও একটি বড় প্রশ্ন। গ্রন্থমেলায় প্রবেশমুখের বাধাগুলো দূর করা গেলে বই বিক্রি যে অনেক বেড়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বইমেলা ও এর আশপাশের এলাকাকে ধুলামুক্ত করার বিষয়টি প্রতিবছরই বিশেষভাবে আলোচিত হয়। এ সমস্যা সমাধানেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
সাভার, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর- এসব এলাকা থেকেও বিপুলসংখ্যক মানুষ একুশের গ্রন্থমেলায় এসে হাজির হন। এত দূর থেকে একজন পাঠক বইমেলায় এসে কী কী সমস্যার মুখোমুখি হন, তা চিহ্নিত করতে দীর্ঘ সময় গবেষণার দরকার নেই। কিন্তু আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, একুশে গ্রন্থমেলার নির্দিষ্ট কিছু সমস্যা নিয়ে প্রতিবছর মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচিত হলেও সমস্যাগুলো সমাধানে কার্যকর ও স্থায়ী উদ্যোগ নেয়া হয় না।
---- ২.
বাংলা একাডেমির অনুবাদ শাখাকে শক্তিশালী করার বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসে। বিভিন্ন ভাষায় আমাদের সাহিত্যের অনুবাদ নিয়েও আলোচনা হয়। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তা বহুল আলোচিত বিষয় হলেও আপাতত বিভিন্ন ভাষার গুরুত্¡পূর্ণ গ্রন্থাবলীর বাংলা অনুবাদের ওপর গুরুত্ব বাড়াতে হবে। একুশের গ্রন্থমেলা উপলক্ষে প্রতিবছর রেকর্ডসংখ্যক বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেসব বইয়ের কয়টি মানসম্মত সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, এটাই প্রত্যাশিত।
---- ৩.
বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলায় পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বই বিক্রির বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো লেখক তাদের নানা রকম দাবি পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ায় তুলে ধরেন। তারা একুশের গ্রন্থমেলাকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে দেখতে চান। বাংলা একাডেমি আয়োজিত এ মেলার সঙ্গে এ দেশের মানুষের কী আবেগ জড়িত, তা কি তারা বুঝতে পারবেন? যারা এ আবেগের কণামাত্র অনুভব করবেন, তারা কখনোই এ মেলাকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করবেন না।
পাঠকের চাহিদা বিবেচনা করে আলাদা একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজনের বিষয়টি চিন্তা করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা বইমেলার আয়োজন আরও বড় পরিসরে করা যেতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই যেন একুশের গ্রন্থমেলার ঐতিহ্য ক্ষুণ্ন না হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।
---- ৪.
একুশের গ্রন্থমেলা নিয়ে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বাইরেও ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ আগ্রহকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তাও বিবেচনায় রাখতে হবে। রাজধানীর বাইরে বড় ধরনের বইমেলা আয়োজনের খবর তেমন পাওয়া যায় না। এটি দুঃখজনক। সারা দেশে বিশেষত জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ব্যাপক পরিসরে বইমেলা নিয়মিত আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া না হলে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। জ্ঞানচর্চার সহায়ক পরিবেশ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তরুণরা যাতে মানসম্মত বইয়ের প্রতি মনোযোগী হয়, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি : প্রকাশক, দৈনিক যুগান্তর
সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বইমেলায় প্রবেশমুখ থেকে কতসংখ্যক পাঠক হতাশ হয়ে ফিরে গেছেন, এ হিসাব কখনোই পাওয়া যাবে না। সংখ্যাটা যত নগণ্যই হোক, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নেয়া দরকার। কারণ ফিরে যাওয়া বয়স্ক পাঠকদের বেশিরভাগই এসেছিলেন সপরিবারে বই কিনতে এবং মেলায় ঘুরতে। এত প্রস্তুতি নিয়ে যে বইমেলার আয়োজন করা হয়, উল্লিখিত বিষয়টিসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য বিষয় তাদের বিবেচনার বাইরে থাকার বিষয়টি বিস্ময়কর। ভিড় এড়িয়ে বয়স্ক ও মহিলা পাঠকদের বইমেলায় প্রবেশ নিশ্চিত করার কাজটি কি খুব কঠিন? এ পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধীদের পক্ষে মেলা থেকে পছন্দের বইটি সংগ্রহ করা যে আরও কঠিন তা সহজেই অনুমান করা যায়।
বইমেলার আয়োজক কর্তৃপক্ষের কাছে উল্লিখিত সমস্যাগুলোর বিষয়ে তাৎক্ষণিক জবাব পাওয়া গেলেও জনগণ দৃশ্যমান সেবাই পেতে চায়; সেবার তাত্ত্বিক বর্ণনা নয়। বইমেলায় আগত বয়স্ক, মহিলা ও শিশুদের জন্য সার্ভিসচার্জের বিনিময়ে বিভিন্ন সেবা চালু করা হলে একে অনেকেই স্বাগত জানাবেন।
মহান ভাষা আন্দোলনের চেতনার বিষয়টি যারা সত্যিকার অর্থে উপলব্ধি করে মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে হাজির হন; তারা মেলার প্রবেশমুখে দুর্ভোগের দৃশ্য দেখে বিস্মিত হবেন, এটাই স্বাভাবিক। এত আলোচনার পরও একুশের গ্রন্থমেলাকে কেন বৈশাখী মেলার আমেজ থেকে মুক্ত করা যাচ্ছে না, এটিও একটি বড় প্রশ্ন। গ্রন্থমেলায় প্রবেশমুখের বাধাগুলো দূর করা গেলে বই বিক্রি যে অনেক বেড়ে যাবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। বইমেলা ও এর আশপাশের এলাকাকে ধুলামুক্ত করার বিষয়টি প্রতিবছরই বিশেষভাবে আলোচিত হয়। এ সমস্যা সমাধানেও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে।
সাভার, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, গাজীপুর- এসব এলাকা থেকেও বিপুলসংখ্যক মানুষ একুশের গ্রন্থমেলায় এসে হাজির হন। এত দূর থেকে একজন পাঠক বইমেলায় এসে কী কী সমস্যার মুখোমুখি হন, তা চিহ্নিত করতে দীর্ঘ সময় গবেষণার দরকার নেই। কিন্তু আমরা দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, একুশে গ্রন্থমেলার নির্দিষ্ট কিছু সমস্যা নিয়ে প্রতিবছর মিডিয়ায় ব্যাপক আলোচিত হলেও সমস্যাগুলো সমাধানে কার্যকর ও স্থায়ী উদ্যোগ নেয়া হয় না।
---- ২.
বাংলা একাডেমির অনুবাদ শাখাকে শক্তিশালী করার বিষয়টি বারবার আলোচনায় আসে। বিভিন্ন ভাষায় আমাদের সাহিত্যের অনুবাদ নিয়েও আলোচনা হয়। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমি যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে, তা বহুল আলোচিত বিষয় হলেও আপাতত বিভিন্ন ভাষার গুরুত্¡পূর্ণ গ্রন্থাবলীর বাংলা অনুবাদের ওপর গুরুত্ব বাড়াতে হবে। একুশের গ্রন্থমেলা উপলক্ষে প্রতিবছর রেকর্ডসংখ্যক বই প্রকাশিত হয়। কিন্তু সেসব বইয়ের কয়টি মানসম্মত সে প্রশ্ন থেকেই যায়। বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে, এটাই প্রত্যাশিত।
---- ৩.
বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলায় পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের বই বিক্রির বিষয়টি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের কোনো কোনো লেখক তাদের নানা রকম দাবি পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ায় তুলে ধরেন। তারা একুশের গ্রন্থমেলাকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে দেখতে চান। বাংলা একাডেমি আয়োজিত এ মেলার সঙ্গে এ দেশের মানুষের কী আবেগ জড়িত, তা কি তারা বুঝতে পারবেন? যারা এ আবেগের কণামাত্র অনুভব করবেন, তারা কখনোই এ মেলাকে বাণিজ্যিক দৃষ্টিতে দেখার চেষ্টা করবেন না।
পাঠকের চাহিদা বিবেচনা করে আলাদা একটি আন্তর্জাতিক বইমেলা আয়োজনের বিষয়টি চিন্তা করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ঢাকা বইমেলার আয়োজন আরও বড় পরিসরে করা যেতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই যেন একুশের গ্রন্থমেলার ঐতিহ্য ক্ষুণ্ন না হয় সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।
---- ৪.
একুশের গ্রন্থমেলা নিয়ে বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর বাইরেও ব্যাপক আগ্রহ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এ আগ্রহকে কীভাবে কাজে লাগানো যায়, তাও বিবেচনায় রাখতে হবে। রাজধানীর বাইরে বড় ধরনের বইমেলা আয়োজনের খবর তেমন পাওয়া যায় না। এটি দুঃখজনক। সারা দেশে বিশেষত জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে ব্যাপক পরিসরে বইমেলা নিয়মিত আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া না হলে মানবিক মূল্যবোধের বিকাশে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। জ্ঞানচর্চার সহায়ক পরিবেশ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তরুণরা যাতে মানসম্মত বইয়ের প্রতি মনোযোগী হয়, এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে।
অ্যাডভোকেট সালমা ইসলাম এমপি : প্রকাশক, দৈনিক যুগান্তর
No comments