কোনো সন্ত্রাসই কাম্য নয় by ইকতেদার আহমেদ
সন্ত্রাস
বলতে সাধারণভাবে আমরা বুঝি জননিরাপত্তা বিঘ্নিত করে এমন যেকোনো ধরনের কাজ।
শক্তি প্রদর্শন বা বল প্রয়োগের মাধ্যমে যেমন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত
হয়, অনুরূপ চোরাগোপ্তা হামলার মাধ্যমেও সন্ত্রাস করা হয়। হুমকি, বিভীষিকা,
ভীতি প্রদর্শন, উগ্রপন্থা, চরমপন্থা, ভয়ালতা, ভয়াচ্ছন্নতা, উৎত্রাস, ত্রাস
ইত্যাদি সন্ত্রাসের সমার্থক। সন্ত্রাসের মাধ্যমে জীবন ও সম্পদ উভয়ের
ক্ষতিসাধন করা হয়। আবার সন্ত্রাসের মাধ্যমে জীবনহানিও ঘটে। কোনো ব্যক্তি বা
প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বলপূর্বক চাঁদা আদায়; স্থলপথ, রেলপথ, জলপথ বা
আকাশপথে যান চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি; ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো যানবাহনের
ক্ষতিসাধন করা; ইচ্ছাকৃতভাবে সরকারি ও বেসরকারি স্থাবর বা অস্থাবর যেকোনো
ধরনের সম্পত্তি বিনষ্ট বা ভাংচুর; কোনো ব্যক্তির কাছ থেকে অর্থ, অলংকার,
মূল্যবান জিনিসপত্র বা যানবাহন ছিনতাইয়ের চেষ্টা করা অথবা ছিনতাই করা; একক
বা দলবদ্ধভাবে শক্তির মহড়ার মাধ্যমে ত্রাস সৃষ্টি করা- এসবের যেকোনো একটি
সম্পাদনে শারীরিক যেকোনো ধরনের জখমসহ মৃত্যু ঘটানো ইত্যাদি সন্ত্রাসের
অন্তর্ভুক্ত।
সন্ত্রাস আন্তর্জাতিকভাবে পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্র কর্তৃক বহিঃরাষ্ট্রে যেমন সংগঠিত হয়, অনুরূপ রাষ্ট্র কর্তৃক দেশের অভ্যন্তরে বিরোধী মতাবলম্বীদের দমনেও সংগঠিত হয়। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ব্যক্তি বা সংগঠন কর্তৃক সন্ত্রাস হয় না- বিশ্বে এমন রাষ্ট্র বিরল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী ইরাকের কাছে মানবসভ্যতা বিধ্বংসী জীবাণু অস্ত্র ও রাসায়নিক অস্ত্র আছে এ অভিযোগে ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাত করে সেখানে তাদের তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করে। বহুজাতিক বাহিনীর অভিযান-পরবর্তী ইরাকে কোনো মানবসভ্যতা বিধ্বংসী জীবাণু অস্ত্র ও রাসায়নিক অস্ত্রের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। মূলত সাদ্দাম হোসেনের শাসনামলে ইরাক সামরিক দিক থেকে যেভাবে শক্তিধর হয়ে উঠছিল, তা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য হানিকর বিবেচনায় মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করে ইরাকের বিরুদ্ধে আগ্রাসী অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। এ ধরনের আগ্রাসন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তো আন্তর্জাতিক মোড়ল। তাই তাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলবে কে? ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের পর সে দেশে যে সংঘাত-সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছে তা এখনও অব্যাহত আছে। এমন কোনো দিন নেই যেদিন সংঘাত-সহিংসতায় ইরাকে জীবনহানি ঘটছে না। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেয়, কেনইবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী ইরাকে অভিযান পরিচালনা করল আর কেনইবা দেশটির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হল? ইরাকের সাধারণ জনমানুষ বর্তমানে অসহনীয় অবস্থার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে। সেখানকার এ অসহনীয় অবস্থার জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুপ্রবেশকে প্রতিহত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা তালেবানদের অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করে। তালেবানদের কাছে আফগানিস্তানের সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থনপুষ্ট সরকার পরাভূত হলে সেখানে তালেবান ও আল কায়দার সমর্থন নিয়ে উগ্রপন্থীদের উত্থান হয়। তাদের এ উত্থানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অন্যান্য মুসলিম দেশে উগ্রপন্থীদের উত্থানের হুমকি হিসেবে দেখে। তাই আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনী বিতাড়নে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তালেবান ও আল কায়দাকে অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করেছিল, তাদের সৃষ্ট পরিস্থিতির ভিন্নতায় সে একই তালেবান ও আল কায়দাকে উৎখাতে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে। আজ আফগানিস্তান তথাকথিত তালেবান ও আল কায়দার সন্ত্রাস নির্মূলের অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের দখলাধীনে। তাদের এ দখলদারিত্বের হয়তো একদিন অবসান হবে। কিন্তু সোভিয়েত বাহিনী হঠানোর নামে স্থিতিশীল আফগানিস্তানকে তারা যেভাবে অস্থিতিশীল করে তুলেছে, এ অস্থিতিশীলতার কি আদৌ অবসান হবে?
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বর্তমানে বিশ্বে পরাশক্তি বলতে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝায়। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের বর্তমানে যে বিবাদ চলছে, এর পেছনে মূল ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা। রাশিয়া শক্তিধর রাষ্ট্র বিধায় তার সঙ্গে ইউক্রেনের বিবাদে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা হয়তো ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো সফলতা পাবে না। কিন্তু জাতিগত বিবেদের কারণে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে রুশ ভাষাভাষীদের সঙ্গে ইউক্রেনীয়দের যে বিবাদ চলছে তাতে যেকোনো পক্ষকে বহিঃশক্তির সমর্থন সন্ত্রাসকে উসকে দেবে।
রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনো দল বা ব্যক্তি যখন জননিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটিয়ে সম্পদ বা জীবনের ক্ষতি বা হানি ঘটায় তখন তা ব্যক্তি বা দলের সন্ত্রাস। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তি বা দল রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে সম্পদ বা জীবনের ক্ষতি বা হানি ঘটিয়েছে। ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়ে আওয়ামী লীগসহ আন্দোলনকারী দলগুলো দেশে অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। অনুরূপ বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলের ডাকে বর্তমানে অবরোধ ও হরতাল চলছে এবং এ অবরোধ ও হরতালে প্রাণহানিসহ জীবন ও সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। যদিও যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা মেরে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার মতো নৃশংস ঘটনার দায় এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর চাপাচ্ছে।
যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, কার ও অটোরিকশায় পেট্রলবোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে পুড়িয়ে মানুষ মারা এবং অগ্নিদগ্ধ করার ঘটনা দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক মহলে অসন্তোষ ও ঘৃণার সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায় অবরোধ ও হরতাল আহ্বানকারী দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ ধরনের নৃশংস ঘটনার সঙ্গে তাদের দল জড়িত নয় বরং বিরোধী দলকে দেশে ও বিদেশে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এসব করা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকার বলছে, অবরোধ-হরতাল আহ্বানকারীরাই এসব করছে। এভাবে এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর দোষ চাপানো বর্তমানে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এসব ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, সরকারের পক্ষ থেকে তা খুঁজে বের করার ব্যাপারে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়নি। আইনশৃংখলা রক্ষাসহ জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। সুতরাং এ ধরনের ঘটনা ঘটার পর সরকারের উচিত ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা, যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর না ঘটে।
রাজনৈতিক দল আহূত অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচির সময় বাস-ট্রাকে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যার মতো রাষ্ট্রের মদদে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও সন্ত্রাস। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শক্তিধর রাষ্ট্র কর্তৃক মিথ্যা অজুহাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের অভিপ্রায়ে দুর্বল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাও সন্ত্রাস। আমাদের দেশে বড় দুটি দল ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরও মৃত্যু হয়েছে। আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হলে তাদের জীবন রক্ষার জন্য কতটুকু শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে, তা আইনে বলে দেয়া আছে। ক্রসফায়ারের ঘটনায় আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা সন্ত্রাসীদের সহযোগীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কথা বলা হলেও এ পর্যন্ত আমাদের সামনে এমন নজির নেই যেখানে ক্রসফায়ারে আইনশৃংখলা বাহিনীর কোনো সদস্যের প্রাণহানি ঘটেছে। একজন ব্যক্তি যত বড় সন্ত্রাসীই হোক না কেন, বিনা বিচারে তার মৃত্যু আমাদের দেশের প্রচলিত আইন ও ধর্মীয় অনুশাসন অনুমোদন করে না। অপরাধী, নিরপরাধ নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তির বিচার পাওয়া একটি মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তিকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com
সন্ত্রাস আন্তর্জাতিকভাবে পৃথিবীর শক্তিধর রাষ্ট্র কর্তৃক বহিঃরাষ্ট্রে যেমন সংগঠিত হয়, অনুরূপ রাষ্ট্র কর্তৃক দেশের অভ্যন্তরে বিরোধী মতাবলম্বীদের দমনেও সংগঠিত হয়। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ব্যক্তি বা সংগঠন কর্তৃক সন্ত্রাস হয় না- বিশ্বে এমন রাষ্ট্র বিরল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী ইরাকের কাছে মানবসভ্যতা বিধ্বংসী জীবাণু অস্ত্র ও রাসায়নিক অস্ত্র আছে এ অভিযোগে ইরাক আক্রমণ করে সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বাধীন সরকারকে উৎখাত করে সেখানে তাদের তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করে। বহুজাতিক বাহিনীর অভিযান-পরবর্তী ইরাকে কোনো মানবসভ্যতা বিধ্বংসী জীবাণু অস্ত্র ও রাসায়নিক অস্ত্রের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। মূলত সাদ্দাম হোসেনের শাসনামলে ইরাক সামরিক দিক থেকে যেভাবে শক্তিধর হয়ে উঠছিল, তা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থের জন্য হানিকর বিবেচনায় মিথ্যাকে সত্য বলে প্রতিষ্ঠিত করে ইরাকের বিরুদ্ধে আগ্রাসী অভিযান পরিচালনা করা হয়েছিল। এ ধরনের আগ্রাসন আন্তর্জাতিক সন্ত্রাস। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তো আন্তর্জাতিক মোড়ল। তাই তাদের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কথা বলবে কে? ইরাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের পর সে দেশে যে সংঘাত-সহিংসতা সৃষ্টি হয়েছে তা এখনও অব্যাহত আছে। এমন কোনো দিন নেই যেদিন সংঘাত-সহিংসতায় ইরাকে জীবনহানি ঘটছে না। তাই স্বভাবতই প্রশ্ন দেখা দেয়, কেনইবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বহুজাতিক বাহিনী ইরাকে অভিযান পরিচালনা করল আর কেনইবা দেশটির স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে দিতে ব্যর্থ হল? ইরাকের সাধারণ জনমানুষ বর্তমানে অসহনীয় অবস্থার মধ্য দিয়ে দিনাতিপাত করছে। সেখানকার এ অসহনীয় অবস্থার জন্য সম্পূর্ণরূপে দায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড।
আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুপ্রবেশকে প্রতিহত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা তালেবানদের অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করে। তালেবানদের কাছে আফগানিস্তানের সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থনপুষ্ট সরকার পরাভূত হলে সেখানে তালেবান ও আল কায়দার সমর্থন নিয়ে উগ্রপন্থীদের উত্থান হয়। তাদের এ উত্থানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা অন্যান্য মুসলিম দেশে উগ্রপন্থীদের উত্থানের হুমকি হিসেবে দেখে। তাই আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত বাহিনী বিতাড়নে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা তালেবান ও আল কায়দাকে অস্ত্র, অর্থ ও প্রশিক্ষণ দিয়ে সাহায্য করেছিল, তাদের সৃষ্ট পরিস্থিতির ভিন্নতায় সে একই তালেবান ও আল কায়দাকে উৎখাতে তারা সর্বশক্তি নিয়োগ করে। আজ আফগানিস্তান তথাকথিত তালেবান ও আল কায়দার সন্ত্রাস নির্মূলের অজুহাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের দখলাধীনে। তাদের এ দখলদারিত্বের হয়তো একদিন অবসান হবে। কিন্তু সোভিয়েত বাহিনী হঠানোর নামে স্থিতিশীল আফগানিস্তানকে তারা যেভাবে অস্থিতিশীল করে তুলেছে, এ অস্থিতিশীলতার কি আদৌ অবসান হবে?
সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বর্তমানে বিশ্বে পরাশক্তি বলতে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বোঝায়। রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের বর্তমানে যে বিবাদ চলছে, এর পেছনে মূল ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্ররা। রাশিয়া শক্তিধর রাষ্ট্র বিধায় তার সঙ্গে ইউক্রেনের বিবাদে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা হয়তো ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো সফলতা পাবে না। কিন্তু জাতিগত বিবেদের কারণে ইউক্রেনের অভ্যন্তরে রুশ ভাষাভাষীদের সঙ্গে ইউক্রেনীয়দের যে বিবাদ চলছে তাতে যেকোনো পক্ষকে বহিঃশক্তির সমর্থন সন্ত্রাসকে উসকে দেবে।
রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনো দল বা ব্যক্তি যখন জননিরাপত্তার বিঘ্ন ঘটিয়ে সম্পদ বা জীবনের ক্ষতি বা হানি ঘটায় তখন তা ব্যক্তি বা দলের সন্ত্রাস। আমাদের দেশে বিভিন্ন সময়ে ব্যক্তি বা দল রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে সম্পদ বা জীবনের ক্ষতি বা হানি ঘটিয়েছে। ১৯৯৫ ও ১৯৯৬ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হরতাল-অবরোধের ডাক দিয়ে আওয়ামী লীগসহ আন্দোলনকারী দলগুলো দেশে অস্থিতিশীল ও নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। অনুরূপ বিএনপি-জামায়াতসহ ২০ দলের ডাকে বর্তমানে অবরোধ ও হরতাল চলছে এবং এ অবরোধ ও হরতালে প্রাণহানিসহ জীবন ও সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে। যদিও যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা মেরে আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারার মতো নৃশংস ঘটনার দায় এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর চাপাচ্ছে।
যাত্রীবাহী বাস, ট্রাক, কার ও অটোরিকশায় পেট্রলবোমা নিক্ষেপের মাধ্যমে পুড়িয়ে মানুষ মারা এবং অগ্নিদগ্ধ করার ঘটনা দেশের অভ্যন্তরে ও আন্তর্জাতিক মহলে অসন্তোষ ও ঘৃণার সৃষ্টি করেছে। এ অবস্থায় অবরোধ ও হরতাল আহ্বানকারী দলগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ ধরনের নৃশংস ঘটনার সঙ্গে তাদের দল জড়িত নয় বরং বিরোধী দলকে দেশে ও বিদেশে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে এসব করা হচ্ছে। অন্যদিকে সরকার বলছে, অবরোধ-হরতাল আহ্বানকারীরাই এসব করছে। এভাবে এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর দোষ চাপানো বর্তমানে আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, এসব ঘটনার সঙ্গে কারা জড়িত, সরকারের পক্ষ থেকে তা খুঁজে বের করার ব্যাপারে সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো হয়নি। আইনশৃংখলা রক্ষাসহ জনগণের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব সরকারের। সুতরাং এ ধরনের ঘটনা ঘটার পর সরকারের উচিত ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা, যাতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি আর না ঘটে।
রাজনৈতিক দল আহূত অবরোধ ও হরতাল কর্মসূচির সময় বাস-ট্রাকে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে মানুষ হত্যার মতো রাষ্ট্রের মদদে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও সন্ত্রাস। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে শক্তিধর রাষ্ট্র কর্তৃক মিথ্যা অজুহাতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থের অভিপ্রায়ে দুর্বল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনাও সন্ত্রাস। আমাদের দেশে বড় দুটি দল ক্ষমতাসীন থাকাবস্থায় ক্রসফায়ারের নামে অসংখ্য বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। এসব ঘটনায় চিহ্নিত সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরও মৃত্যু হয়েছে। আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা সন্ত্রাসীদের দ্বারা আক্রান্ত হলে তাদের জীবন রক্ষার জন্য কতটুকু শক্তি প্রয়োগ করতে পারবে, তা আইনে বলে দেয়া আছে। ক্রসফায়ারের ঘটনায় আইনশৃংখলা বাহিনীর সদস্যরা সন্ত্রাসীদের সহযোগীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কথা বলা হলেও এ পর্যন্ত আমাদের সামনে এমন নজির নেই যেখানে ক্রসফায়ারে আইনশৃংখলা বাহিনীর কোনো সদস্যের প্রাণহানি ঘটেছে। একজন ব্যক্তি যত বড় সন্ত্রাসীই হোক না কেন, বিনা বিচারে তার মৃত্যু আমাদের দেশের প্রচলিত আইন ও ধর্মীয় অনুশাসন অনুমোদন করে না। অপরাধী, নিরপরাধ নির্বিশেষে প্রতিটি ব্যক্তির বিচার পাওয়া একটি মৌলিক অধিকার। রাষ্ট্র কোনো ব্যক্তিকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।
ইকতেদার আহমেদ : সাবেক জজ; সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতি বিশ্লেষক
iktederahmed@yahoo.com
No comments