নেটিজেনদের সদর দরজা, কিন্তু ... by সান্ত্বন চট্টোপাধ্যায়
সোস্যাল
মিডিয়া এখন নেটিজেনদের সদর দরজার মতো। চারপাশের শুধু নয়, গোটা পৃথিবীর
ঘটমানতার দিকে নেটিজেনরা তাকাচ্ছে অনেকাংশেই এখন সোস্যাল মিডিয়ার মধ্য
দিয়ে। সোস্যাল মিডিয়ার ধারণাটিও খুব পুরনো, এমন নয়। ডেরিল বেরি ১৯৯৪ সালে
প্রথম এখনকার অর্থে এই শব্দবন্ধের প্রয়োগ করেন। ১৯৯৫ সালে তিনি ‘সোস্যাল
মিডিয়া স্পেশেস’ নামে একটি গবেষণাপত্রেও ইন্টারনেট ব্যবহার করে তথ্য
আদান-প্রদানের কথা বলেন। তবে এই দু’দশক সময়ে সোস্যাল মিডিয়া বহুগুণে
বেড়েছে। তার প্রভাব সমাজে অন্যতম নির্ধারকরূপে পরিগণিত হচ্ছে - এটা
মোটামুটি সকলেরই জানা। আসলে সোস্যাল মিডিয়া ইন্টারনেটের উত্তরসূরি।
ইন্টারনেট চালিত মিডিয়া অন-লাইন মিডিয়া নামে পরিচিত। সোস্যাল মিডিয়াও তাই।
কিন্তু সব অন-লাইন মিডিয়াই সোস্যাল মিডিয়া নয়। আসলে সোস্যাল মিডিয়া
ব্যবহারকারীকে প্রচারযোগ্য তথ্য তৈরি ও বিনিময় করতে দেয়। যাকে আমরা বলি
‘ইউসার জেনারেটেড কনটেন্ট’। এই মিডিয়ায় অংশগ্রহণ করার জন্য ব্যবহারকারীকে
কোনো অর্থ খরচ করতে হয় না, চাই শুধু ইন্টারনেট সংযোগ। আর বিষয়টি সম্পর্কে
জ্ঞান - তাহলে নিখরচায় অ্যাকাউন্ট খুলে এই বিপুল সমুদ্রে অবগাহন।
প্রযুক্তির হাত ধরে এই পরিসরে ব্যবহারকারীরা কেবল নিজেদের পূর্ব-পরিচিত
মহলেই সংযোগ রক্ষা করতে পারে না, খুঁজে পেতে পারে নতুন বন্ধুও। পরস্পর
যুক্ত জালের মতো ছড়িয়ে পড়ে এই সংযোগ। ইন্টারনেটের মাধ্যমে এটি কার্যত একটি
নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা। যদিও সোস্যাল নেটওয়ার্ক শব্দটি ১৯৫০ সালে প্রথম
ব্যবহৃত হয় সমমনোভাবাপন্ন মানুষের জমায়েত বোঝাতে, কিন্তু সোস্যাল মিডিয়া
উত্তর পৃথিবীতে এই শব্দবন্ধের অর্থ এখন সোস্যাল মিডিয়া পরিসরে জনসমাবেশ।
ঠিক যেমন কমিউনিটি শব্দের অর্থ ভৌগোলিক সীমারেখার সীমাবদ্ধতা ভেঙে দিয়েছে।
কমিউনিটি এখন আর একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের জনসমষ্টি নয়, ভুবনগ্রামের যে কোন
প্রান্তের সমমনস্ক মানুষ এখন সোস্যাল মিডিয়াতে কমিউনিটি তৈরি করেন।
সোস্যাল মিডিয়ার মূল বৈশিষ্ট্য সামাজিকীকরণ বা সোসালাইজেশন। এই পরিসরকে দেখলে মনে হয়, এটি বাহ্যিক কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণযুক্ত (একটি মুক্ত পরিসর)। যেমন ফেসবুক বা ট্যুইটারে একজন ব্যবহারকারীর ব্যক্তি-পরিচয় তথা ব্যক্তিমত প্রকাশিত হয়। ব্যক্তির স্বাধীন পরিসর হিসেবেই ব্যবহারকারীর কাছে এর গুরুত্ব সর্বাধিক। কিন্তু ব্যবহারকারীরা কেউই সোস্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলির মালিক নন। এগুলি আসলে এক-একটি বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থা। বরং এই ব্যবহারকারীরাই সংস্থার সম্পদ। ব্যবহারকারীদের সমস্ত তথ্যভাণ্ডার রক্ষিত হয় সংস্থাগুলির কাছে। সে এক বিশাল বাজার। এই বাজারে পণ্য বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপনের পসরা সাজিয়ে হাজির হয় অন্যান্য কোম্পানি। সুতরাং ব্যবহারকারীদের সমন্বয়ে তৈরি বাজার আসলে সোস্যাল মিডিয়া সংস্থার মালিকের রাজস্বের মূল সূত্র। সোস্যাল মিডিয়া এখন বিজ্ঞাপন তথা প্রোমোশনের আকর্ষণীয় মাধ্যম। এর জনপ্রিয়তার সঙ্গে এর মালিকের মুনাফা অর্জনের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত- বিষয়টি অনেক সময়েই চোখ এড়িয়ে যায়। তবে এই পরিসর ব্যবহারে দূরত্ব কমেছে তা বলাই বাহুল্য; এবং তা কমেছে দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ উভয়েরই। এই পরিসর ব্যবহারের ফল কয়েকটি মূল সূত্রে দেখা যেতে পারে। প্রথমত, এর মাধ্যমে ব্যক্তি তথা ইনডিভিজুয়ালের পরিচয় প্রাথমিকভাবে জানা যায়। সাধারণত সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষের পরিচয়ই জনপরিসরে পরিচিতি থাকে। সেখানে এই পরিসরে ব্যক্তি পরিচয় জানানো এবং জানা নিঃসন্দেহে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রবণতা। পরের পর্যায়ে এই পরিসর ব্যবহার করে ‘কথাবার্তা’ বলা। আজকের প্রজন্ম তো কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোনের কি-বোর্ডের মাধ্যমে কত কথাই না বলে চলে পরস্পরের সঙ্গে। এর থেকেই আসে তথ্য বা মতামত আদান-প্রদান বা বিনিময়ের সুযোগ। এই সবকটি মিলিয়ে তৈরি হয় এক সামাজিক উপস্থিতি। সেই উপস্থিতি পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরিতেও সহায়ক হয়। এই সম্পর্ক তৈরির বিষয়টি অবশ্য দীর্ঘমেয়াদী এক চলমান প্রক্রিয়া। সামাজিক ভাবমূর্তিও তৈরি হয় এই পরম্পরায়। শুধুমাত্র ব্যক্তি পরিচয় নয়, তার বাইরেও ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ-বিশ্বাস সবটা মিলিয়ে তৈরি হয় ভাবমূর্তি। সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা প্রাথমিকভাবে এই মিডিয়া ব্যবহার করেন ব্যক্তি হিসেবে। সেখানে ব্যক্তির ছবি, মতামত, শেয়ার সবকিছু মিলিয়ে ওই পরিসরে নির্মিত হয় তার ভাবমূর্তি। কিন্তু মূলত ব্যক্তিগত এই পরিসরে যাদের ভাবমূর্তি ভাল লাগে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে চান আরো মানুষ। আসলে আদান-প্রদানের সুযোগ থাকায় অচেনা মানুষকেও খানিক দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ থাকে এই পরিসরে। আর এই পছন্দ যখন সমমনস্কতার রূপান্তরিত হয় তখন অনেক মানুষ নির্দিষ্ট বিষদে গ্রুপ বা কমিউনিটি তৈরি করেন। আগেই বলেছি এই কমিউনিটির অস্তিত্ব বিশ্বজোড়া। এইভাবে তথ্যপ্রবাহে বহুমুখী প্রবণতা যুক্ত হচ্ছে। বহুত্ববাদের দৃষ্টিতে বিষয়টি অবশ্যই উৎসাহব্যঞ্জক। অন্যদিকে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ফলে তথ্যপ্রবাহে নমনীয়তা ও তাৎক্ষণিকতার গুরুত্ব বেড়ে গেছে বেশ খানিক। ঘটনা ঘটাকালীনই উপস্থিত ব্যক্তিরা সোস্যাল মিডিয়ায় ঘটনার আপডেট তুলে দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই সেটি তথ্যের প্রথম উৎসরূপে গৃহীত হচ্ছে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরাও এই সুযোগে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে নিজেদের কাজকর্মের হাতে গরম ছবি দিচ্ছেন। বহু ক্ষেত্রেই সংবাদপত্র, টেলিভিশনের মতো প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমকেও সেই সূত্র স্বীকার করতে হচ্ছে।
অংশগ্রহণকারীর তৈরি করা বার্তা বা ‘ইউসার জেনারেটেড কনটেন্ট’ চরিত্রগতভাবে খবরের কাগজ, রেডিও, টিভি’র দর্শকদের থেকে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের পৃথক করে। ওখানে যারা গ্রহীতার ভূমিকায়, এখানে তারা নির্মাতা। সোস্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট আপনার। আপনি কনটেন্টের মালিক। এখানে সংবাদপত্র, টিভি, রেডিওর মতো কোন আরোপিত সম্পাদকীয় নীতি নেই। ফলত স্বাধীনতা ও বহুত্বের উপাদান এই পরিসরে পর্যাপ্ত। এক ধরনের ক্ষমতায়নের সম্ভাবনাও এই পরিসরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। এই পরিসরের ব্যবহারকারীদের কাছে নিজের মত প্রকাশ করা, তার পক্ষে বিতর্ক করা, বিপক্ষ যুক্তি খণ্ডন করা ছাড়া অন্য কোনো দায় নেই। বাংলার মূলস্রোতের মিডিয়াগুলির রাজনৈতিক পক্ষপাত যেভাবে হাওয়া মোরগের মতো পরিবর্তনশীল সেখানে খবর বা সংবাদ জানানোর চেয়ে খবর তৈরির গপ্পোই বেশি চালু। মালিকের তথা সম্পাদকীয় নীতির নাগপাশে সেখানে তথ্য বাঁধা পড়ে। সোস্যাল মিডিয়ায় খবর বা মতামত দেওয়ার প্রশ্নে ব্যবহারকারী স্বাধীন। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আমার কথা অনেক মানুষকে জানানোর জন্য গণমাধ্যমের প্রতি নির্ভরতা হ্রাস। যেখানে পাঠক বা দর্শকের বক্তব্য খণ্ডাংশ আকারেই প্রচারিত হতে পারে গণমাধ্যমে এবং তার প্রকাশও নির্ভর করে সেই গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতির ওপর সেখানে কম প্রভাবশালী মানুষ তার নিজের কথা সপাটে বলে অনেককে জানিয়ে দিতে পারছেন - ক্ষমতায়নের প্রেক্ষিতে এর গুরুত্বও কিছু কম নয়। এতো গেল এই পরিসরের সুবিধা। কিন্তু মার্শাল ম্যাকলুহান যেমন বলেছিলেন, ‘মিডিয়াম ইস দ্য মেসেজ’ অর্থাৎ মাধ্যমই বার্তা তাতে মনে হতে পারে প্রযুক্তিই নিয়ামক। একথা সত্যি হলে তো মালিকানার প্রকৃতি, সম্পাদকীয় নীতি, রাজনীতি, পুঁজির নিয়ন্ত্রণ, শ্রেণী-লিঙ্গবৈষম্য সবই অপ্রাসঙ্গিক। অর্থাৎ সোস্যাল মিডিয়া প্রযুক্তিগতভাবে যথেষ্ট সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করলেও, তার বাস্তবায়ন অনেকগুলি আনুষঙ্গিক বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু খবরের কাগজ, টেলিভিশন থেকেও তথ্য সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আদান-প্রদান হয়, সুতরাং সেখানে আধিপত্য বজায় থাকলে তার প্রভাব সোস্যাল মিডিয়াতেও পড়ে। এছাড়া কোনটা তথ্য আর কোনটা তথ্য নয়, তার ধারণাটাও মোটেই প্রযুক্তি তৈরি করে না। অর্থের মাধ্যমেও সোস্যাল মিডিয়ায় ক্যামোফ্লেজ করা যায় -মানুষকে ভুল বোঝানো যায়। অর্থের বিনিময়ে ‘লাইক’ পাওয়া যায় ফেসবুকে। সাধারণ ব্যবহারকারীদের কাছে বিষয়টা খুব সহজে বোধগম্য হয় না।ভারতের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক নেতাদের ফেসবুক পেজে ‘লাইকের’ আকাশছোঁয়া সংখ্যা বাস্তবকে সঠিকভাবে উপস্থাপিত করে না। লক্ষ-লক্ষ ‘লাইকের’ মাধ্যমে জনপ্রিয়তার যে ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয় তা আসলে পয়সার বিনিময়ে ‘লাইক’ কেনা। ফেলো কড়ি, মাখো তেল। এর সঙ্গে চেতনা বা মতাদর্শগত সমর্থনের আদপেই কোনো সম্পর্ক নেই। এভাবেও অনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতিও কনটেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করে।
সোস্যাল মিডিয়া তার ব্যবহারকারীকে যে স্বাধীন পরিসর দিচ্ছে, তা সবক্ষেত্রেই যে বিকল্প ভাবনার জন্ম দেবে, তা ঠিক নয়। এই পরিসর একদিকে যেমন প্রসারণের জন্য বৈপ্লবিক, অন্যদিকে এরই মধ্যে আছে সঙ্কোচনের হরেক উপাদান। একদিকে এই পরিসরে জন্ম দেয় আত্মকেন্দ্রিকতার। এখানে রিয়েল আর ভার্চুয়াল একাকার। ফেসবুকের বন্ধু কি আদতে বন্ধু? শক্তি চট্টোপাধ্যায় যেমন লিখেছিলেন ‘বাগান কী তার প্রতিটি গাছ চেনে’? এও তেমন। এখানেই জন্ম নেয় অজস্র মরীচিকা। তথ্য কী সে প্রশ্নেও তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ধাঁধা। এই পরিসরে তথ্যের বন্যা বইছে। কিন্তু এর অধিকাংশই পরস্পর সম্পর্কহীন, পারম্পর্যবর্জিত, অনেক ক্ষেত্রেই অনু মন্তব্যের কোলাজ। হতভাগ্য মেয়েদের লাশের ছবির পরেই হয়তো বেড়ালের জন্মদিন পালনের ছবি। দৃশ্য ও তথ্যের এই ভয়ানক বি-সমতা অনেক ক্ষেত্রেই ভাবনায় লঘুতা আনে। আর মাদকসদৃশ প্রভাব বা নারকোটাইজেশন তো আছেই। সোস্যাল মিডিয়ায় আছে এক আত্মসমর্পণকারী আশক্তি। প্রযুক্তির অগ্রগতি কনভারজেন্স বা সমকেন্দ্রিকতার ফলে বহু গণমাধ্যমকে একই যন্ত্রের মাধ্যমে মানুষ করায়ত্ত করেছে। কম্পিউটার যেমন। এখানে খবরের কাগজ পড়া যায়, টেলিভিশন-ফিল্ম দেখা যায়, রেডিও শোনা যায়। সবই অবশ্য ইন্টারনেটের দৌলতে। এখন মোবাইল ফোনের প্রযুক্তিগত বিপ্লবের পর হাতের মুঠোতেই বিশ্ব। অর্থাৎ চলতে চলতেও তথ্য সংগ্রহ, সোস্যাল মিডিয়ার মতামত দেওয়ার সুযোগ। প্রায়ই দেখতে পাবেন দু’জন মানুষ পাশাপাশি, অথচ তারা মগ্ন মোবাইলের স্ক্রিনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সোস্যাল মিডিয়ায় আলাপচারী তারা। এখানেই এক মস্ত দ্বন্দ্ব। যে সোস্যাল মিডিয়ার মূল চরিত্র সামাজিকীকরণ, তার মধ্যেই নিহিত সমাজ-বিচ্ছিন্নতার বীজ।
ব্যবহারকারীদের একটা বড় অংশ এই পরিসরে সকলের কাছে দৃশ্যমান হওয়া, গুরুত্ব পাওয়া, নিজেদের সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিবেশন করার জন্য সদাসচেষ্ট। ফেসবুকের ‘লাইক’ যেন তাদের জিয়নকাঠি। এখানেই জন্ম নিচ্ছে নারসিসিজম — তাদের আত্মপ্রসাদের মরীচিকা। অর্থাৎ সোস্যাল মিডিয়ার জনমত গঠনের সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনই সেটি খুব সহজ পদ্ধতি, তা মোটেই নয়। মাধ্যমের চারিত্রিক আকর্ষণে মুগ্ধ থাকলে আদতে এই পরিসরের গণতান্ত্রিক ব্যবহার সম্ভব নয়। বহু দেশেই আইনি বিধিও আছে এই পরিসরকে সঙ্কুচিত করার জন্য। সেই আইনি বিধিগুলি বহুক্ষেত্রেই কণ্ঠরোধের জন্য শাসকের অস্ত্র হয়ে ওঠে। সেই সম্পর্কে সচেতনতা এবং জরুরি আলোচনাও সমাজে প্রয়োজন।
একদিকে আলোর গতিতে তথ্য ছড়িয়ে দেবার সম্ভাবনা, অন্যদিকে পরিসরটির সঙ্কোচনের হরেক উপাদান এবং অবশ্যই এই মাধ্যম ব্যবহারের কার্য-কারণ সম্পর্ক বিষয়ে ব্যবহারকারীর প্রয়োজনীয় বোধ। এই বিষয়গুলি সম্পর্কে সম্যক ধারণাই একমাত্র সোস্যাল মিডিয়ার আরো সফল ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে। নচেৎ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষাতেই হয়তো বলতে হবে।
‘সেই থেকে, ভেবেছি যা প্রাপণীয়,
তা তোমার উন্মুক্ত বন্ধন
রচনার, আষ্টেপৃষ্ঠে সে বন্দীত্ব নিজ হাতে গড়া।’
সান্ত্বন চট্টোপাধ্যায়: ভারতীয়
সোস্যাল মিডিয়ার মূল বৈশিষ্ট্য সামাজিকীকরণ বা সোসালাইজেশন। এই পরিসরকে দেখলে মনে হয়, এটি বাহ্যিক কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণযুক্ত (একটি মুক্ত পরিসর)। যেমন ফেসবুক বা ট্যুইটারে একজন ব্যবহারকারীর ব্যক্তি-পরিচয় তথা ব্যক্তিমত প্রকাশিত হয়। ব্যক্তির স্বাধীন পরিসর হিসেবেই ব্যবহারকারীর কাছে এর গুরুত্ব সর্বাধিক। কিন্তু ব্যবহারকারীরা কেউই সোস্যাল মিডিয়া সংস্থাগুলির মালিক নন। এগুলি আসলে এক-একটি বৃহৎ বহুজাতিক সংস্থা। বরং এই ব্যবহারকারীরাই সংস্থার সম্পদ। ব্যবহারকারীদের সমস্ত তথ্যভাণ্ডার রক্ষিত হয় সংস্থাগুলির কাছে। সে এক বিশাল বাজার। এই বাজারে পণ্য বিক্রির জন্য বিজ্ঞাপনের পসরা সাজিয়ে হাজির হয় অন্যান্য কোম্পানি। সুতরাং ব্যবহারকারীদের সমন্বয়ে তৈরি বাজার আসলে সোস্যাল মিডিয়া সংস্থার মালিকের রাজস্বের মূল সূত্র। সোস্যাল মিডিয়া এখন বিজ্ঞাপন তথা প্রোমোশনের আকর্ষণীয় মাধ্যম। এর জনপ্রিয়তার সঙ্গে এর মালিকের মুনাফা অর্জনের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত- বিষয়টি অনেক সময়েই চোখ এড়িয়ে যায়। তবে এই পরিসর ব্যবহারে দূরত্ব কমেছে তা বলাই বাহুল্য; এবং তা কমেছে দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ উভয়েরই। এই পরিসর ব্যবহারের ফল কয়েকটি মূল সূত্রে দেখা যেতে পারে। প্রথমত, এর মাধ্যমে ব্যক্তি তথা ইনডিভিজুয়ালের পরিচয় প্রাথমিকভাবে জানা যায়। সাধারণত সমাজে প্রতিষ্ঠিত মানুষের পরিচয়ই জনপরিসরে পরিচিতি থাকে। সেখানে এই পরিসরে ব্যক্তি পরিচয় জানানো এবং জানা নিঃসন্দেহে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারের প্রথম গণতান্ত্রিক প্রবণতা। পরের পর্যায়ে এই পরিসর ব্যবহার করে ‘কথাবার্তা’ বলা। আজকের প্রজন্ম তো কম্পিউটার বা স্মার্ট ফোনের কি-বোর্ডের মাধ্যমে কত কথাই না বলে চলে পরস্পরের সঙ্গে। এর থেকেই আসে তথ্য বা মতামত আদান-প্রদান বা বিনিময়ের সুযোগ। এই সবকটি মিলিয়ে তৈরি হয় এক সামাজিক উপস্থিতি। সেই উপস্থিতি পারস্পরিক সম্পর্ক তৈরিতেও সহায়ক হয়। এই সম্পর্ক তৈরির বিষয়টি অবশ্য দীর্ঘমেয়াদী এক চলমান প্রক্রিয়া। সামাজিক ভাবমূর্তিও তৈরি হয় এই পরম্পরায়। শুধুমাত্র ব্যক্তি পরিচয় নয়, তার বাইরেও ব্যক্তির পছন্দ-অপছন্দ-বিশ্বাস সবটা মিলিয়ে তৈরি হয় ভাবমূর্তি। সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীরা প্রাথমিকভাবে এই মিডিয়া ব্যবহার করেন ব্যক্তি হিসেবে। সেখানে ব্যক্তির ছবি, মতামত, শেয়ার সবকিছু মিলিয়ে ওই পরিসরে নির্মিত হয় তার ভাবমূর্তি। কিন্তু মূলত ব্যক্তিগত এই পরিসরে যাদের ভাবমূর্তি ভাল লাগে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করতে চান আরো মানুষ। আসলে আদান-প্রদানের সুযোগ থাকায় অচেনা মানুষকেও খানিক দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ থাকে এই পরিসরে। আর এই পছন্দ যখন সমমনস্কতার রূপান্তরিত হয় তখন অনেক মানুষ নির্দিষ্ট বিষদে গ্রুপ বা কমিউনিটি তৈরি করেন। আগেই বলেছি এই কমিউনিটির অস্তিত্ব বিশ্বজোড়া। এইভাবে তথ্যপ্রবাহে বহুমুখী প্রবণতা যুক্ত হচ্ছে। বহুত্ববাদের দৃষ্টিতে বিষয়টি অবশ্যই উৎসাহব্যঞ্জক। অন্যদিকে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ফলে তথ্যপ্রবাহে নমনীয়তা ও তাৎক্ষণিকতার গুরুত্ব বেড়ে গেছে বেশ খানিক। ঘটনা ঘটাকালীনই উপস্থিত ব্যক্তিরা সোস্যাল মিডিয়ায় ঘটনার আপডেট তুলে দিচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই সেটি তথ্যের প্রথম উৎসরূপে গৃহীত হচ্ছে। সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিরাও এই সুযোগে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহার করে নিজেদের কাজকর্মের হাতে গরম ছবি দিচ্ছেন। বহু ক্ষেত্রেই সংবাদপত্র, টেলিভিশনের মতো প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমকেও সেই সূত্র স্বীকার করতে হচ্ছে।
অংশগ্রহণকারীর তৈরি করা বার্তা বা ‘ইউসার জেনারেটেড কনটেন্ট’ চরিত্রগতভাবে খবরের কাগজ, রেডিও, টিভি’র দর্শকদের থেকে সোস্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের পৃথক করে। ওখানে যারা গ্রহীতার ভূমিকায়, এখানে তারা নির্মাতা। সোস্যাল মিডিয়ার অ্যাকাউন্ট আপনার। আপনি কনটেন্টের মালিক। এখানে সংবাদপত্র, টিভি, রেডিওর মতো কোন আরোপিত সম্পাদকীয় নীতি নেই। ফলত স্বাধীনতা ও বহুত্বের উপাদান এই পরিসরে পর্যাপ্ত। এক ধরনের ক্ষমতায়নের সম্ভাবনাও এই পরিসরের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। এই পরিসরের ব্যবহারকারীদের কাছে নিজের মত প্রকাশ করা, তার পক্ষে বিতর্ক করা, বিপক্ষ যুক্তি খণ্ডন করা ছাড়া অন্য কোনো দায় নেই। বাংলার মূলস্রোতের মিডিয়াগুলির রাজনৈতিক পক্ষপাত যেভাবে হাওয়া মোরগের মতো পরিবর্তনশীল সেখানে খবর বা সংবাদ জানানোর চেয়ে খবর তৈরির গপ্পোই বেশি চালু। মালিকের তথা সম্পাদকীয় নীতির নাগপাশে সেখানে তথ্য বাঁধা পড়ে। সোস্যাল মিডিয়ায় খবর বা মতামত দেওয়ার প্রশ্নে ব্যবহারকারী স্বাধীন। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আমার কথা অনেক মানুষকে জানানোর জন্য গণমাধ্যমের প্রতি নির্ভরতা হ্রাস। যেখানে পাঠক বা দর্শকের বক্তব্য খণ্ডাংশ আকারেই প্রচারিত হতে পারে গণমাধ্যমে এবং তার প্রকাশও নির্ভর করে সেই গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতির ওপর সেখানে কম প্রভাবশালী মানুষ তার নিজের কথা সপাটে বলে অনেককে জানিয়ে দিতে পারছেন - ক্ষমতায়নের প্রেক্ষিতে এর গুরুত্বও কিছু কম নয়। এতো গেল এই পরিসরের সুবিধা। কিন্তু মার্শাল ম্যাকলুহান যেমন বলেছিলেন, ‘মিডিয়াম ইস দ্য মেসেজ’ অর্থাৎ মাধ্যমই বার্তা তাতে মনে হতে পারে প্রযুক্তিই নিয়ামক। একথা সত্যি হলে তো মালিকানার প্রকৃতি, সম্পাদকীয় নীতি, রাজনীতি, পুঁজির নিয়ন্ত্রণ, শ্রেণী-লিঙ্গবৈষম্য সবই অপ্রাসঙ্গিক। অর্থাৎ সোস্যাল মিডিয়া প্রযুক্তিগতভাবে যথেষ্ট সম্ভাবনার ইঙ্গিত বহন করলেও, তার বাস্তবায়ন অনেকগুলি আনুষঙ্গিক বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু খবরের কাগজ, টেলিভিশন থেকেও তথ্য সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আদান-প্রদান হয়, সুতরাং সেখানে আধিপত্য বজায় থাকলে তার প্রভাব সোস্যাল মিডিয়াতেও পড়ে। এছাড়া কোনটা তথ্য আর কোনটা তথ্য নয়, তার ধারণাটাও মোটেই প্রযুক্তি তৈরি করে না। অর্থের মাধ্যমেও সোস্যাল মিডিয়ায় ক্যামোফ্লেজ করা যায় -মানুষকে ভুল বোঝানো যায়। অর্থের বিনিময়ে ‘লাইক’ পাওয়া যায় ফেসবুকে। সাধারণ ব্যবহারকারীদের কাছে বিষয়টা খুব সহজে বোধগম্য হয় না।ভারতের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক নেতাদের ফেসবুক পেজে ‘লাইকের’ আকাশছোঁয়া সংখ্যা বাস্তবকে সঠিকভাবে উপস্থাপিত করে না। লক্ষ-লক্ষ ‘লাইকের’ মাধ্যমে জনপ্রিয়তার যে ছবি তুলে ধরার চেষ্টা করা হয় তা আসলে পয়সার বিনিময়ে ‘লাইক’ কেনা। ফেলো কড়ি, মাখো তেল। এর সঙ্গে চেতনা বা মতাদর্শগত সমর্থনের আদপেই কোনো সম্পর্ক নেই। এভাবেও অনৈতিক প্রভাব খাটানো হয়। পারিপার্শ্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতিও কনটেন্টকে নিয়ন্ত্রণ করে।
সোস্যাল মিডিয়া তার ব্যবহারকারীকে যে স্বাধীন পরিসর দিচ্ছে, তা সবক্ষেত্রেই যে বিকল্প ভাবনার জন্ম দেবে, তা ঠিক নয়। এই পরিসর একদিকে যেমন প্রসারণের জন্য বৈপ্লবিক, অন্যদিকে এরই মধ্যে আছে সঙ্কোচনের হরেক উপাদান। একদিকে এই পরিসরে জন্ম দেয় আত্মকেন্দ্রিকতার। এখানে রিয়েল আর ভার্চুয়াল একাকার। ফেসবুকের বন্ধু কি আদতে বন্ধু? শক্তি চট্টোপাধ্যায় যেমন লিখেছিলেন ‘বাগান কী তার প্রতিটি গাছ চেনে’? এও তেমন। এখানেই জন্ম নেয় অজস্র মরীচিকা। তথ্য কী সে প্রশ্নেও তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন ধাঁধা। এই পরিসরে তথ্যের বন্যা বইছে। কিন্তু এর অধিকাংশই পরস্পর সম্পর্কহীন, পারম্পর্যবর্জিত, অনেক ক্ষেত্রেই অনু মন্তব্যের কোলাজ। হতভাগ্য মেয়েদের লাশের ছবির পরেই হয়তো বেড়ালের জন্মদিন পালনের ছবি। দৃশ্য ও তথ্যের এই ভয়ানক বি-সমতা অনেক ক্ষেত্রেই ভাবনায় লঘুতা আনে। আর মাদকসদৃশ প্রভাব বা নারকোটাইজেশন তো আছেই। সোস্যাল মিডিয়ায় আছে এক আত্মসমর্পণকারী আশক্তি। প্রযুক্তির অগ্রগতি কনভারজেন্স বা সমকেন্দ্রিকতার ফলে বহু গণমাধ্যমকে একই যন্ত্রের মাধ্যমে মানুষ করায়ত্ত করেছে। কম্পিউটার যেমন। এখানে খবরের কাগজ পড়া যায়, টেলিভিশন-ফিল্ম দেখা যায়, রেডিও শোনা যায়। সবই অবশ্য ইন্টারনেটের দৌলতে। এখন মোবাইল ফোনের প্রযুক্তিগত বিপ্লবের পর হাতের মুঠোতেই বিশ্ব। অর্থাৎ চলতে চলতেও তথ্য সংগ্রহ, সোস্যাল মিডিয়ার মতামত দেওয়ার সুযোগ। প্রায়ই দেখতে পাবেন দু’জন মানুষ পাশাপাশি, অথচ তারা মগ্ন মোবাইলের স্ক্রিনে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সোস্যাল মিডিয়ায় আলাপচারী তারা। এখানেই এক মস্ত দ্বন্দ্ব। যে সোস্যাল মিডিয়ার মূল চরিত্র সামাজিকীকরণ, তার মধ্যেই নিহিত সমাজ-বিচ্ছিন্নতার বীজ।
ব্যবহারকারীদের একটা বড় অংশ এই পরিসরে সকলের কাছে দৃশ্যমান হওয়া, গুরুত্ব পাওয়া, নিজেদের সাজিয়ে-গুছিয়ে পরিবেশন করার জন্য সদাসচেষ্ট। ফেসবুকের ‘লাইক’ যেন তাদের জিয়নকাঠি। এখানেই জন্ম নিচ্ছে নারসিসিজম — তাদের আত্মপ্রসাদের মরীচিকা। অর্থাৎ সোস্যাল মিডিয়ার জনমত গঠনের সম্ভাবনা যেমন আছে, তেমনই সেটি খুব সহজ পদ্ধতি, তা মোটেই নয়। মাধ্যমের চারিত্রিক আকর্ষণে মুগ্ধ থাকলে আদতে এই পরিসরের গণতান্ত্রিক ব্যবহার সম্ভব নয়। বহু দেশেই আইনি বিধিও আছে এই পরিসরকে সঙ্কুচিত করার জন্য। সেই আইনি বিধিগুলি বহুক্ষেত্রেই কণ্ঠরোধের জন্য শাসকের অস্ত্র হয়ে ওঠে। সেই সম্পর্কে সচেতনতা এবং জরুরি আলোচনাও সমাজে প্রয়োজন।
একদিকে আলোর গতিতে তথ্য ছড়িয়ে দেবার সম্ভাবনা, অন্যদিকে পরিসরটির সঙ্কোচনের হরেক উপাদান এবং অবশ্যই এই মাধ্যম ব্যবহারের কার্য-কারণ সম্পর্ক বিষয়ে ব্যবহারকারীর প্রয়োজনীয় বোধ। এই বিষয়গুলি সম্পর্কে সম্যক ধারণাই একমাত্র সোস্যাল মিডিয়ার আরো সফল ব্যবহারের বিষয়টি নিশ্চিত করতে পারে। নচেৎ শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ভাষাতেই হয়তো বলতে হবে।
‘সেই থেকে, ভেবেছি যা প্রাপণীয়,
তা তোমার উন্মুক্ত বন্ধন
রচনার, আষ্টেপৃষ্ঠে সে বন্দীত্ব নিজ হাতে গড়া।’
সান্ত্বন চট্টোপাধ্যায়: ভারতীয়
No comments