শোকাবহ পিলখানা হত্যা দিবস আজ by আবু সালেহ আকন
আজ
২৫ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের ইতিহাসে এক শোকাবহ দিন। বিডিআর বিদ্রোহ নামে
২০০৯ সালের এই দিনে রাজধানীর পিলখানায় সেনাবাহিনীর ৫৭ জন অফিসারকে হত্যা
করা হয়, যাদের মধ্যে বিডিআরের (বর্তমান বিজিবি) তৎকালীন ডিজি মেজর জেনারেল
শাকিল আহমেদও ছিলেন। উচ্ছৃঙ্খল কিছু জওয়ান তৎকালীন ডিজির স্ত্রীসহ
সামরিক-বেসামরিক আরো ১৭ জন মানুষকে হত্যা করে ওই দিন। ইতোমধ্যে সেই
হত্যাকাণ্ডের বিচার সম্পন্ন হয়েছে। শেষ হয়েছে বিদ্রোহের বিচারও। বিস্ফোরক
দ্রব্য আইনে দায়ের করা মামলার বিচারপ্রক্রিয়াও এগোচ্ছে। কিন্তু সেদিনের
ক্ষত শুকায়নি এখনো। ভয়াল সেই তাণ্ডবের কথা মনে উঠতেই আজো আঁতকে ওঠেন মানুষ।
ভারী অস্ত্রের গুলির শব্দে সেদিন যেভাবে প্রকম্পিত হয়েছিল পিলখানা; সেই
কথা মনে উঠতেই মানুষের অন্তরাত্মা আজো কাঁপে।
বিডিআর বিদ্রোহের বিচার হয়েছে। বিচার হয়েছে ওই দিনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের। কিন্তু মানুষ সেই দিনের নির্মমতা ভুলতে পারছেন না। সেই বীভৎসদৃশ্য, মাটিচাপা লাশ, দেশপ্রেমিক সেনাকর্মকর্তাদের ক্ষতবিক্ষত দেহÑ চোখে ভেসে উঠতেই আঁতকে ওঠে মানুষ। এখনো বাতাসে ভাসছে স্বজনহারাদের আহাজারি। শুধু হত্যা করেই নরপশুরা খান্ত হয়নি। অফিসারদের স্ত্রী-সন্তান এবং বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনকে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালায় তারা। তাদের বাড়ি-গাড়ি, আসবাবপত্র ও অন্যান্য সম্পদ আগুনে পুড়ে ফেলে বিপথগামী জওয়ানরা। সেনাকর্মকর্তাদের শুধু হত্যা করেই খান্ত হয়নি ঘাতকরা। আলামত নষ্ট করতে প্রথমে তাদের লাশগুলো পুড়ে ফেলার চেষ্টা করে তারা। ব্যর্থ হয়ে লাশগুলো মাটিচাপা দেয় এবং ম্যানহোলের মধ্যে ফেলে দেয় তারা। উচ্ছৃঙ্খল জওয়ানরা অস্ত্রাগার লুট করে তাই দিয়ে সেনা অফিসারদের হত্যা করে।
নির্মম ওই হত্যাকাণ্ডের পর ছয় বছর হচ্ছে আজ। নৃশংস সেই ঘটনার পর বিডিআর আইনে মোট ৫৭টি মামলা দায়ের হয়। বিদ্রোহের এই মামলার রায় শেষ হয়েছে। অভিযুক্তদের অনেকে ইতোমধ্যে সাজাভোগ করে বের হয়েও গেছেন। নি¤œ আদালতে হত্যাকাণ্ডেরও বিচার সম্পন্ন হয়েছে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। সাজাপ্রাপ্তরা উচচ আদালতে আপিল করেছেন। অপর দিকে, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়েরকৃত মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
যা ঘটেছিল সেদিন : ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকর্তা ও জওয়ানরা বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সপ্তাহ উপলক্ষে এসেছিলেন ঢাকার পিলখানায়। আগের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিলখানায় বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজে অংশ নেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত সদস্যদের মধ্যে ভালো কাজের জন্য পদক প্রদানের কথা ছিল। দরবার হলের সেই অনুষ্ঠানে প্রায় আড়াই হাজার বিডিআর সদস্য উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত শেষে বাংলা অনুবাদ যখন শেষ হয় ঠিক তখনই সিপাহি মইন দরবার হলের রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে মেজর জেনারেল শাকিলের দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। তবে অতিরিক্ত ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারিসহ অন্যান্য কর্মকর্তা মইনকে আটক করেন। মইনকে আটকের সাথে সাথে ‘জাগো’ বলে বিডিআর জওয়ানরা দরবার হল ত্যাগ শুরু করে। ডিজি তখন তাদের উদ্দেশে বলেন, তাদের দাবি দাওয়া শুনবেন তিনি। কিন্তু মুহূর্তেই দরবার হল শূন্য হয়ে যায়। এক পর্যায়ে জওয়ানদের সবাই যখন দরবার হল ত্যাগ করে তখন বাইরে থেকে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু হয়। কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। অনেকে ভেতরেই কোথাও গোপন স্থানে অবস্থান নেন। সেসব স্থান থেকে তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করে জওয়ানরা হত্যা করে। বিডিআর ঢাকা সেক্টরের তৎকালীন কমান্ডার কর্নেল মজিবুল হককে ৩৬ রাইফেল ব্যাটালিয়নের চারতলার এক কক্ষে হত্যা করে তার লাশ ফেলে দেয় নিচে। এভাবে একে একে হত্যা করা হয় সেনাকর্মকর্তাদের। লুটপাট অগ্নিসংযোগসহ নানা অপকর্মে মেতে ওঠে উচ্ছৃঙ্খল বিডিআর জওয়ানরা। এসবই তারা করেছে অস্ত্রাগার থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করে। শুরুতেই তারা কোত ভেঙে অস্ত্র এবং ম্যাগজিন ভেঙে গুলি তাদের দখলে নিয়ে নেয়। ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। আতঙ্কে আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের বাসিন্দারা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনসহ অনেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সামরিক-বেসমারিক বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তারা ঘটনাস্থলে যান। কিন্তু ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে তারা ছিলেন পুরোপুরি অসহায়। বিদ্রোহীদের তাণ্ডবে প্রাণের ভয়ে পিলখানার আশপাশেও কেউ যেতে পারেননি। বিকেলে দূর থেকে হ্যান্ড মাইকে বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন তৎকালীন এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। মাইকে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করবেন। তিনি সবাইকে অস্ত্রসমর্পণ করতে বলেন। সন্ধ্যার দিকে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিডিআরের ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবনে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক শেষে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা ও তাদের দাবি দাওয়া পূরণের আশ্বাস নিয়ে তারা পিলখানায় ফিরে যান। এরপরও তারা অস্ত্রসমর্পণ ও বন্দীদের মুক্তি দেয়নি। মধ্যরাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সাথে বৈঠক করে বিদ্রোহীরা অস্ত্রসমর্পণ শুরু করে। কিন্তু পরদিনও থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা যায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, পরিস্থিতি শান্ত, সবাই অস্ত্রসমর্পণ করেছে।
এ দিকে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় লাশ উদ্ধার। একের পর এক উদ্ধার হতে থাকে সেনাকর্মকর্তাদের লাশ। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত উদ্ধার হয় ১৫টি লাশ। এভাবে উদ্ধার হয় ৫৭ সেনাকর্মকর্তা ও সামরিক-বেসামরিকসহ মোট ৭৪ জনের লাশ।
বিচার সম্পন্ন : বিদ্রোহের বিচার ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। নি¤œ আদালতে হত্যা মামলারও বিচার শেষ হয়েছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ওই বছরের ৬ এপ্রিল নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা মামলায় ২০১১ সালের ১২ ও ২৭ জুলাই বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন পিন্টুসহ ৮২৪ জনকে অভিযুক্ত করে হত্যাকাণ্ড ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে পৃথক দু’টি চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। তাদের মধ্যে বিডিআরের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত বেসামরিক আসামি ছিলেন ৪০ জন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি এ দু’টি চার্জশিট আদালত আমলে নেন। ৩ ফেব্রুয়ারি মামলার চার্জ গঠনের দিন ধার্য ছিল। ওই দিন সরকারপক্ষের আইনজীবীরা আদালতে মামলার অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন। আদালত তাদের আবেদন মঞ্জুর করে ৩ মার্চ পরবর্তী দিন ধার্য করেন এবং এর মধ্যে অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পরে ২১ মার্চ এই মামলায় আরো ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এই মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন হয় বকশিবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠের বিশেষ আদালতে। এতে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ২৬২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। আর খালাস দেয়া হয় ২৭১ জনকে। ৮৫০ জন আসামির মধ্যে চারজন বিচার শেষ হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন সাজাপ্রাপ্তরা। উচ্চ আদালতে ওই মামলা এখন বিচারাধীন। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এ পর্যন্ত ২৭ জন ওই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিদ্রোহের পর বিডিআর আইনে মোট ৫৭টি মামলা হয়। ৫৭টি মামলায় মোট আসামি ছয় হাজার ৪১ জন। ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর সদর ব্যাটালিয়নের বিচারকার্যের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের বিচার শেষ হয়। আসামিদের মধ্যে মোট পাঁচ হাজার ৯২৫ জনের শাস্তি হয়েছে। খালাস পেয়েছেন ১১৫ জন। অব্যাহতি পেয়েছেন পাঁচজন। অব্যাহতিপ্রাপ্তরা বিচার চলাকালে মারা গেছেন। মোট ১১টি আদালতে বিদ্রোহের বিচার চলে। ঢাকায় ছিল মোট ১১টি মামলা। ঢাকায় আসামি সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৮৯। এর মধ্যে সাজা হয়েছে ৪ হাজার ৩৩ জনের।
মামলাগুলোর মধ্যে ২০০৯ সালে ২৪ অক্টোবর প্রথম বিচার শুরু হয় রাঙ্গামাটির ১২ রাইফেলস ব্যাটালিয়ন রাজনগরের ৯ জনের বিরুদ্ধে। ২০১০ সালের ২ মে এই মামলার প্রত্যেক আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। বিদ্রোহের মামলার প্রথম রায় হয় পঞ্চগড়ের ২৫ রাইফেলস ব্যাটালিয়নে বিদ্রোহের ঘটনায়।
রক্তাক্ত বিদ্রোহের পর সীমান্ত রাবাহিনীর নাম বদলে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বদল করা হয় তাদের পোশাকও।
হত্যার বিচার, বিদ্রোহের বিচার সবই হয়েছে। কিন্তু সেই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের কাহিনী কেউ ভুলতে পারছেন না। এখনো মানুষ আঁতকে ওঠেন সেই নৃশংস ঘটনার কথা মনে করে। যারা স্বজন হারিয়েছেন তাদের আর্তনাদ এখনো থামেনি। আজ সেই বীভৎস হত্যাকাণ্ডের দিন। এই দিন উপলক্ষে হাতে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি।
বিডিআর বিদ্রোহের বিচার হয়েছে। বিচার হয়েছে ওই দিনের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের। কিন্তু মানুষ সেই দিনের নির্মমতা ভুলতে পারছেন না। সেই বীভৎসদৃশ্য, মাটিচাপা লাশ, দেশপ্রেমিক সেনাকর্মকর্তাদের ক্ষতবিক্ষত দেহÑ চোখে ভেসে উঠতেই আঁতকে ওঠে মানুষ। এখনো বাতাসে ভাসছে স্বজনহারাদের আহাজারি। শুধু হত্যা করেই নরপশুরা খান্ত হয়নি। অফিসারদের স্ত্রী-সন্তান এবং বাবা-মা ও আত্মীয়স্বজনকে আটকে রেখে নির্মম নির্যাতন চালায় তারা। তাদের বাড়ি-গাড়ি, আসবাবপত্র ও অন্যান্য সম্পদ আগুনে পুড়ে ফেলে বিপথগামী জওয়ানরা। সেনাকর্মকর্তাদের শুধু হত্যা করেই খান্ত হয়নি ঘাতকরা। আলামত নষ্ট করতে প্রথমে তাদের লাশগুলো পুড়ে ফেলার চেষ্টা করে তারা। ব্যর্থ হয়ে লাশগুলো মাটিচাপা দেয় এবং ম্যানহোলের মধ্যে ফেলে দেয় তারা। উচ্ছৃঙ্খল জওয়ানরা অস্ত্রাগার লুট করে তাই দিয়ে সেনা অফিসারদের হত্যা করে।
নির্মম ওই হত্যাকাণ্ডের পর ছয় বছর হচ্ছে আজ। নৃশংস সেই ঘটনার পর বিডিআর আইনে মোট ৫৭টি মামলা দায়ের হয়। বিদ্রোহের এই মামলার রায় শেষ হয়েছে। অভিযুক্তদের অনেকে ইতোমধ্যে সাজাভোগ করে বের হয়েও গেছেন। নি¤œ আদালতে হত্যাকাণ্ডেরও বিচার সম্পন্ন হয়েছে ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর। সাজাপ্রাপ্তরা উচচ আদালতে আপিল করেছেন। অপর দিকে, বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়েরকৃত মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে।
যা ঘটেছিল সেদিন : ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। বিভিন্ন সেক্টরের কর্মকর্তা ও জওয়ানরা বিডিআর (বর্তমান বিজিবি) সপ্তাহ উপলক্ষে এসেছিলেন ঢাকার পিলখানায়। আগের দিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পিলখানায় বিডিআর সপ্তাহ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত কুচকাওয়াজে অংশ নেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি বিভিন্ন সেক্টরে কর্মরত সদস্যদের মধ্যে ভালো কাজের জন্য পদক প্রদানের কথা ছিল। দরবার হলের সেই অনুষ্ঠানে প্রায় আড়াই হাজার বিডিআর সদস্য উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানের শুরুতে পবিত্র কুরআন তেলাওয়াত শেষে বাংলা অনুবাদ যখন শেষ হয় ঠিক তখনই সিপাহি মইন দরবার হলের রান্নাঘরের পাশ দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে মেজর জেনারেল শাকিলের দিকে আগ্নেয়াস্ত্র তাক করে। তবে অতিরিক্ত ডিজি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বারিসহ অন্যান্য কর্মকর্তা মইনকে আটক করেন। মইনকে আটকের সাথে সাথে ‘জাগো’ বলে বিডিআর জওয়ানরা দরবার হল ত্যাগ শুরু করে। ডিজি তখন তাদের উদ্দেশে বলেন, তাদের দাবি দাওয়া শুনবেন তিনি। কিন্তু মুহূর্তেই দরবার হল শূন্য হয়ে যায়। এক পর্যায়ে জওয়ানদের সবাই যখন দরবার হল ত্যাগ করে তখন বাইরে থেকে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু হয়। কর্মকর্তারা বিভিন্নভাবে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন। অনেকে ভেতরেই কোথাও গোপন স্থানে অবস্থান নেন। সেসব স্থান থেকে তাদেরকে খুঁজে খুঁজে বের করে জওয়ানরা হত্যা করে। বিডিআর ঢাকা সেক্টরের তৎকালীন কমান্ডার কর্নেল মজিবুল হককে ৩৬ রাইফেল ব্যাটালিয়নের চারতলার এক কক্ষে হত্যা করে তার লাশ ফেলে দেয় নিচে। এভাবে একে একে হত্যা করা হয় সেনাকর্মকর্তাদের। লুটপাট অগ্নিসংযোগসহ নানা অপকর্মে মেতে ওঠে উচ্ছৃঙ্খল বিডিআর জওয়ানরা। এসবই তারা করেছে অস্ত্রাগার থেকে লুণ্ঠিত অস্ত্র ও গোলাবারুদ ব্যবহার করে। শুরুতেই তারা কোত ভেঙে অস্ত্র এবং ম্যাগজিন ভেঙে গুলি তাদের দখলে নিয়ে নেয়। ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের গুলিতে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। আতঙ্কে আশপাশের কয়েক কিলোমিটারের বাসিন্দারা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নেন।
তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনসহ অনেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, সামরিক-বেসমারিক বিভিন্ন সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্তারা ঘটনাস্থলে যান। কিন্তু ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে তারা ছিলেন পুরোপুরি অসহায়। বিদ্রোহীদের তাণ্ডবে প্রাণের ভয়ে পিলখানার আশপাশেও কেউ যেতে পারেননি। বিকেলে দূর থেকে হ্যান্ড মাইকে বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা দেন তৎকালীন এলজিআরডি প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক। মাইকে তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করবেন। তিনি সবাইকে অস্ত্রসমর্পণ করতে বলেন। সন্ধ্যার দিকে ডিএডি তৌহিদের নেতৃত্বে বিডিআরের ১৪ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবনে গিয়ে তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক শেষে সাধারণ ক্ষমার ঘোষণা ও তাদের দাবি দাওয়া পূরণের আশ্বাস নিয়ে তারা পিলখানায় ফিরে যান। এরপরও তারা অস্ত্রসমর্পণ ও বন্দীদের মুক্তি দেয়নি। মধ্যরাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুনের সাথে বৈঠক করে বিদ্রোহীরা অস্ত্রসমর্পণ শুরু করে। কিন্তু পরদিনও থেমে থেমে গুলির শব্দ শোনা যায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেন, পরিস্থিতি শান্ত, সবাই অস্ত্রসমর্পণ করেছে।
এ দিকে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে শুরু হয় লাশ উদ্ধার। একের পর এক উদ্ধার হতে থাকে সেনাকর্মকর্তাদের লাশ। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা পর্যন্ত উদ্ধার হয় ১৫টি লাশ। এভাবে উদ্ধার হয় ৫৭ সেনাকর্মকর্তা ও সামরিক-বেসামরিকসহ মোট ৭৪ জনের লাশ।
বিচার সম্পন্ন : বিদ্রোহের বিচার ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। নি¤œ আদালতে হত্যা মামলারও বিচার শেষ হয়েছে। পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ওই বছরের ৬ এপ্রিল নিউমার্কেট থানায় দায়ের করা মামলায় ২০১১ সালের ১২ ও ২৭ জুলাই বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসিরউদ্দিন পিন্টুসহ ৮২৪ জনকে অভিযুক্ত করে হত্যাকাণ্ড ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে পৃথক দু’টি চার্জশিট দাখিল করে সিআইডি। তাদের মধ্যে বিডিআরের বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত বেসামরিক আসামি ছিলেন ৪০ জন। ২০১২ সালের ৫ জানুয়ারি এ দু’টি চার্জশিট আদালত আমলে নেন। ৩ ফেব্রুয়ারি মামলার চার্জ গঠনের দিন ধার্য ছিল। ওই দিন সরকারপক্ষের আইনজীবীরা আদালতে মামলার অধিকতর তদন্তের আবেদন করেন। আদালত তাদের আবেদন মঞ্জুর করে ৩ মার্চ পরবর্তী দিন ধার্য করেন এবং এর মধ্যে অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। পরে ২১ মার্চ এই মামলায় আরো ২৬ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়। ২০১৩ সালের ৫ নভেম্বর এই মামলার বিচারকার্য সম্পন্ন হয় বকশিবাজার আলিয়া মাদরাসা মাঠের বিশেষ আদালতে। এতে ১৫২ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৬১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ২৬২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়েছে। আর খালাস দেয়া হয় ২৭১ জনকে। ৮৫০ জন আসামির মধ্যে চারজন বিচার শেষ হওয়ার আগেই মৃত্যুবরণ করেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন সাজাপ্রাপ্তরা। উচ্চ আদালতে ওই মামলা এখন বিচারাধীন। বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের করা মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। এ পর্যন্ত ২৭ জন ওই মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
বিদ্রোহের পর বিডিআর আইনে মোট ৫৭টি মামলা হয়। ৫৭টি মামলায় মোট আসামি ছয় হাজার ৪১ জন। ২০১২ সালের ২০ অক্টোবর সদর ব্যাটালিয়নের বিচারকার্যের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহের বিচার শেষ হয়। আসামিদের মধ্যে মোট পাঁচ হাজার ৯২৫ জনের শাস্তি হয়েছে। খালাস পেয়েছেন ১১৫ জন। অব্যাহতি পেয়েছেন পাঁচজন। অব্যাহতিপ্রাপ্তরা বিচার চলাকালে মারা গেছেন। মোট ১১টি আদালতে বিদ্রোহের বিচার চলে। ঢাকায় ছিল মোট ১১টি মামলা। ঢাকায় আসামি সংখ্যা ছিল ৪ হাজার ৮৯। এর মধ্যে সাজা হয়েছে ৪ হাজার ৩৩ জনের।
মামলাগুলোর মধ্যে ২০০৯ সালে ২৪ অক্টোবর প্রথম বিচার শুরু হয় রাঙ্গামাটির ১২ রাইফেলস ব্যাটালিয়ন রাজনগরের ৯ জনের বিরুদ্ধে। ২০১০ সালের ২ মে এই মামলার প্রত্যেক আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। বিদ্রোহের মামলার প্রথম রায় হয় পঞ্চগড়ের ২৫ রাইফেলস ব্যাটালিয়নে বিদ্রোহের ঘটনায়।
রক্তাক্ত বিদ্রোহের পর সীমান্ত রাবাহিনীর নাম বদলে রাখা হয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বদল করা হয় তাদের পোশাকও।
হত্যার বিচার, বিদ্রোহের বিচার সবই হয়েছে। কিন্তু সেই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের কাহিনী কেউ ভুলতে পারছেন না। এখনো মানুষ আঁতকে ওঠেন সেই নৃশংস ঘটনার কথা মনে করে। যারা স্বজন হারিয়েছেন তাদের আর্তনাদ এখনো থামেনি। আজ সেই বীভৎস হত্যাকাণ্ডের দিন। এই দিন উপলক্ষে হাতে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচি।
No comments