সহিংসতা অর্থনীতির বিপর্যয় ডেকে এনেছে by এমএ খালেক
টানা অবরোধ-হরতালকে কেন্দ্র করে সহিংসতা
অব্যাহত আছে। আমরা লক্ষ্য করছি, রাজনৈতিক সহিংসতার বলি হচ্ছে নিরীহ মানুষ;
কিন্তু কেউই তার দায় নিচ্ছে না। সরকার বলছে, আন্দোলনকারীরা মানুষ হত্যা
করছে। আর আন্দোলনকারী রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, সরকার তার এজেন্টদের দিয়ে
নিরীহ মানুষ হত্যা করে তার দায়ভার বিরোধী দলের ওপর চাপাচ্ছে। আমরা সাধারণ
মানুষ বুঝতে অপারগ, আসলে কারা এ সহিংসতার জন্ম দিচ্ছে। বর্তমানে আন্দোলনের
নামে যে অবরোধ-হরতাল চলছে, তা আর কতদিন চলবে এটা কেউই নিশ্চিত করে বলতে
পারবে না।
অবরোধ-হরতাল ও সহিংসতায় এরই মধ্যে দেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করতে অনেকদিন সময় প্রয়োজন হবে। একদিন হয়তো ক্ষমতার পালাবদল হবে, এক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসীন হবে অন্যটি ক্ষমতার বাইরে থাকবে। কিন্তু যারা আন্দোলনকালে স্বজন হারিয়েছে তারা কী পাবেন? বর্তমানে আন্দোলনের নামে চলমান সহিংসতায় অনেকেই সামাজিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এ ক্ষতি পূরণ করা বেশ কঠিন হবে। অর্থনীতির ক্ষতির দিকটিও সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। এজন্য আমাদের প্রতিবছর ৯ থেকে ১০ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রয়োজন। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই প্রবৃদ্ধির হার ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশের ওপরে তুলতে পারছি না। চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে নিশ্চিত হয়ে গেছে, কোনোভাবেই এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বলেছে, বাংলাদেশ চলতি অর্থবছরে ৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। কিন্তু তারা এ প্রক্ষেপণ করেছে বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হওয়ার আগে। এখন তারা নিশ্চয়ই এ প্র্রক্ষেপণ কমিয়ে আনতে বাধ্য হবে। স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। বিশেষ করে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ নিশ্চিতভাবেই কমে যাবে। দুবছর আগেও যেখানে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের হার ছিল জিডিপির ২২ দশমিক ২৫ শতাংশ, গত বছর তা ২১ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল সাড়ে ১৬ শতাংশ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অর্জনের হার মাত্র ১১ দশমিক ৪ শতাংশ।
বর্তমানে দেশে আন্দোলনের নামে যে সহিংসতা চলছে, তা আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আগামীতে বিদেশী ক্রেতারা আমাদের দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছেন, বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ব্যবসায়-বাণিজ্য যেভাবে বিপন্ন হচ্ছে তা আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকলে নিশ্চিতভাবেই অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তারা দ্রুত এর সমাধান প্রত্যাশা করছেন। এফবিসিসিআই হরতাল-অবরোধে ক্ষতির একটি হিসাব দিয়েছে, যা তাৎক্ষণিক হিসাব। প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। তাদের হিসাব মতে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে এ বিপুল পরিমাণ অনাকাক্সিক্ষত ক্ষতি মেনে নেয়া সম্ভব নয়। রাজনীতিকরা দাবি করে থাকেন তারা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করেন। এই কি তার নমুনা?
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি বড় কৌশল হচ্ছে রফতানিমুখী প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন অর্জন। এ কৌশল কাজে লাগানোর জন্য দেশের উৎপাদন প্রক্রিয়া যাতে নিরবচ্ছিন্ন থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য উপযুক্ত উৎপাদনমুখী পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে। রাজনীতিকরা যত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবেন যে, দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করে কোনোভাবেই ক্ষমতায় যাওয়া অথবা টিকে থাকার চেষ্টা করা উচিত নয়, ততই জাতির জন্য মঙ্গল। সাধারণ মানুষ নিজেরা খেটে দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে চায়। তারা কোনোভাবেই স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন হোক তা চায় না। দেশের মালিক সাধারণ মানুষ। তারা কোনোভাবেই রাজনৈতিক দলের হাতের পুতুল হতে চায় না। কাজেই রাজনৈতিক নেতাদের গণআকাক্সক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। অনুধাবন করতে হবে তারা কী চায়। এখন সময় এসেছে আমাদের দেশের রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তনের বিষয় নিয়ে ভাবার। এমন অবস্থা দিনের পর দিন চলতে পারে না। ক্রমাগত রাজনৈতিক দলের কাছে মানুষ জিম্মি হতে থাকবে এটা চলতে পারে না। বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে যে, দেশের রাজনীতি দ্বারা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হবে, নাকি অর্থনীতিই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করবে। আমরা দেশ ও মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করব, নাকি মানুষ হত্যার রাজনীতি করব, এ ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
একটি রাজনৈতিক দল আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করবে, এতে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। এমনকি কোনো একক ব্যক্তিরও আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সেই আন্দোলন হতে হবে অবশ্যই শান্তিপূর্ণ। একটি রাজনৈতিক দলের যেমন আন্দোলনের ডাক দেয়ার অধিকার আছে, তেমনি সেই আন্দোলনে সমর্থন জ্ঞাপন করা অথবা উপেক্ষা করার অধিকারও সাধারণ মানুষের আছে। কিন্তু আমরা কী দেখছি? কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট আন্দোলনের ডাক দিয়ে সাধারণ মানুষকে তা পরিপালনে বাধ্য করছে। এটি কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রীতি হতে পারে না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা নেই বললেই চলে। তাই তারা যখন জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখতে চায়, প্রায়ই তাদের আচার-আচরণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব পরিলক্ষিত হয়।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসেছে, আমরা কি এভাবেই দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ ধ্বংস করব, নাকি সঠিক রাজনৈতিক আচরণের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার কাজে সহায়তা করব? রাজনৈতিক কর্মসূচি এমনভাবে সাজাতে হবে যেন কোনোভাবেই তা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত বা বিঘিœত না করে। রাজনীতিকদের যুগের চাহিদা অনুযায়ী আন্দোলনের কর্মসূচি ঢেলে সাজাতে হবে। আমরা পরাধীন দেশে যেভাবে আন্দোলন করেছি, একটি স্বাধীন দেশে সেরকম আন্দোলন কোনোভাবেই চলতে পারে না। ইরাক বা আফগানিস্তানে একটি রাজনৈতিক দল যেভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করে, নিশ্চয়ই বাংলাদেশে সেভাবে আন্দোলন চলতে পারে না। বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ মেরে ফেলা কোনোদিনই আন্দোলন হতে পারে না। এটি সন্ত্রাস। কোনোভাবেই এটা মেনে নেয়া যায় না। কারা এর পেছনে আছে, তা খুঁজে বের করতে হবে। জ্বালাও-পোড়াও ছাড়াও আন্দোলন হতে পারে।
হরতাল-ধর্মঘট একটি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। এমন অর্থনীতি বিধ্বংসী রাজনৈতিক কর্মসূচি মেনে নেয়া যায় না। অন্যভাবেও রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ধারণ ও পরিচালনা করা যেতে পারে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয় তারা যেন হরতাল (যাকে অনেকেই বলেন, ভয়তাল) ও ধর্মঘট বা এ ধরনের অর্থনীতি বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড ছাড়া প্রতিবাদের কোনো হাতিয়ার খুঁজে পান না। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। প্রসঙ্গত ভারতবিরোধী আন্দোলনের সময় মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক উদ্ভাবিত সত্যাগ্রহ আন্দোলনের কথা বলা যেতে পারে। ব্রিটিশ শাসক কর্তৃপক্ষ তখন স্থানীয়দের নানাভাবে অত্যাচার করত। মহাত্মা গান্ধী এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। এর মূল কথাই হচ্ছে, অত্যাচারী যতই অত্যাচার-নির্যাতন করুক, আমি কিছু বলব না। একদিন অত্যাচারীর মনে অনুশোচনা সৃষ্টি হবে এবং এমনিতেই অত্যাচার বন্ধ করবে। সত্যাগ্রহ আন্দোলন ব্রিটিশদের বেশ বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। এখন মহাত্মা গান্ধী নেই। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময়ও নেই। কিন্তু তাই বলে কি অন্যভাবে আন্দোলন করা যায় না? গণঅনশন, গণগ্রেফতার বরণ, অবস্থান কর্মসূচি ইত্যাদি নানাভাবে দাবি আদায়ের চেষ্টা করা যেতে পারে। সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের মাধ্যমে সরকারকে দাবি মেনে নিতে বাধ্য করাই যদি মূল উদ্দেশ্য হয়, তাহলে অনেক পদ্ধতি আছে। সেসব পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। এফবিসিসিআইসহ অনেক প্রতিষ্ঠানই আইন করে হরতাল বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু কোনো সরকারই মনে হয় এটি করবে না। কারণ ক্ষমতার বাইরে গেলে তারাও একই পদ্ধতিতে আন্দোলন করবেন। আমি মনে করি, আইন করে হরতাল বন্ধ করার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু এটি নিশ্চিত হলেই চলবে যে, কেউ আন্দোলনের ডাক দিয়ে জনসাধারণকে সেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য বল প্রয়োগ করবে না। তাহলেই দেখা যাবে আন্দোলনের ডাক দিলে কেমন জনসমর্থন পাওয়া যায়।
আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে- দেশ বাঁচলে আমরা বাঁচব। রাজনৈতিক দল বাঁচবে। দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে কোনোদিনই রাজনীতি চলতে পারে না। এ ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
অবরোধ-হরতাল ও সহিংসতায় এরই মধ্যে দেশের যে ক্ষতি হয়েছে, তা পূরণ করতে অনেকদিন সময় প্রয়োজন হবে। একদিন হয়তো ক্ষমতার পালাবদল হবে, এক রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় আসীন হবে অন্যটি ক্ষমতার বাইরে থাকবে। কিন্তু যারা আন্দোলনকালে স্বজন হারিয়েছে তারা কী পাবেন? বর্তমানে আন্দোলনের নামে চলমান সহিংসতায় অনেকেই সামাজিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতির শিকার হয়েছেন। এ ক্ষতি পূরণ করা বেশ কঠিন হবে। অর্থনীতির ক্ষতির দিকটিও সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। রাষ্ট্রীয়ভাবে ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার জন্য প্রতিশ্র“তিবদ্ধ। এজন্য আমাদের প্রতিবছর ৯ থেকে ১০ শতাংশ হারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন প্রয়োজন। কিন্তু আমরা কোনোভাবেই প্রবৃদ্ধির হার ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশের ওপরে তুলতে পারছি না। চলতি অর্থবছরে ৭ দশমিক ৩ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে নিশ্চিত হয়ে গেছে, কোনোভাবেই এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হচ্ছে না। কয়েকটি আন্তর্জাতিক সংস্থা বলেছে, বাংলাদেশ চলতি অর্থবছরে ৬ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারে। কিন্তু তারা এ প্রক্ষেপণ করেছে বর্তমান রাজনৈতিক সহিংসতা শুরু হওয়ার আগে। এখন তারা নিশ্চয়ই এ প্র্রক্ষেপণ কমিয়ে আনতে বাধ্য হবে। স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগ ব্যাপকভাবে কমে যাওয়ার আশংকা রয়েছে। বিশেষ করে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ নিশ্চিতভাবেই কমে যাবে। দুবছর আগেও যেখানে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগের হার ছিল জিডিপির ২২ দশমিক ২৫ শতাংশ, গত বছর তা ২১ দশমিক ৪ শতাংশে নেমে এসেছে। ব্যক্তি খাতে ব্যাংক ঋণের প্রবৃদ্ধি আশা করা হয়েছিল সাড়ে ১৬ শতাংশ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে অর্জনের হার মাত্র ১১ দশমিক ৪ শতাংশ।
বর্তমানে দেশে আন্দোলনের নামে যে সহিংসতা চলছে, তা আন্তর্জাতিক মহলে আমাদের ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আগামীতে বিদেশী ক্রেতারা আমাদের দেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে নিয়োজিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছেন, বর্তমানে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ব্যবসায়-বাণিজ্য যেভাবে বিপন্ন হচ্ছে তা আরও কিছুদিন অব্যাহত থাকলে নিশ্চিতভাবেই অর্থনীতি বিপর্যস্ত হবে। তারা দ্রুত এর সমাধান প্রত্যাশা করছেন। এফবিসিসিআই হরতাল-অবরোধে ক্ষতির একটি হিসাব দিয়েছে, যা তাৎক্ষণিক হিসাব। প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন। তাদের হিসাব মতে, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশের পক্ষে এ বিপুল পরিমাণ অনাকাক্সিক্ষত ক্ষতি মেনে নেয়া সম্ভব নয়। রাজনীতিকরা দাবি করে থাকেন তারা দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য রাজনীতি করেন। এই কি তার নমুনা?
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের একটি বড় কৌশল হচ্ছে রফতানিমুখী প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়ন অর্জন। এ কৌশল কাজে লাগানোর জন্য দেশের উৎপাদন প্রক্রিয়া যাতে নিরবচ্ছিন্ন থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য উপযুক্ত উৎপাদনমুখী পরিবেশ সৃষ্টি করে দিতে হবে। রাজনীতিকরা যত দ্রুত উপলব্ধি করতে পারবেন যে, দেশের অর্থনীতির ক্ষতি করে কোনোভাবেই ক্ষমতায় যাওয়া অথবা টিকে থাকার চেষ্টা করা উচিত নয়, ততই জাতির জন্য মঙ্গল। সাধারণ মানুষ নিজেরা খেটে দুবেলা দুমুঠো ভাত খেতে চায়। তারা কোনোভাবেই স্বাভাবিক জীবন বিপন্ন হোক তা চায় না। দেশের মালিক সাধারণ মানুষ। তারা কোনোভাবেই রাজনৈতিক দলের হাতের পুতুল হতে চায় না। কাজেই রাজনৈতিক নেতাদের গণআকাক্সক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। অনুধাবন করতে হবে তারা কী চায়। এখন সময় এসেছে আমাদের দেশের রাজনৈতিক কৌশল পরিবর্তনের বিষয় নিয়ে ভাবার। এমন অবস্থা দিনের পর দিন চলতে পারে না। ক্রমাগত রাজনৈতিক দলের কাছে মানুষ জিম্মি হতে থাকবে এটা চলতে পারে না। বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে যে, দেশের রাজনীতি দ্বারা অর্থনীতি নিয়ন্ত্রিত হবে, নাকি অর্থনীতিই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করবে। আমরা দেশ ও মানুষের কল্যাণে রাজনীতি করব, নাকি মানুষ হত্যার রাজনীতি করব, এ ব্যাপারে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
একটি রাজনৈতিক দল আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করবে, এতে কারও কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়। এমনকি কোনো একক ব্যক্তিরও আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করার অধিকার রয়েছে। কিন্তু সেই আন্দোলন হতে হবে অবশ্যই শান্তিপূর্ণ। একটি রাজনৈতিক দলের যেমন আন্দোলনের ডাক দেয়ার অধিকার আছে, তেমনি সেই আন্দোলনে সমর্থন জ্ঞাপন করা অথবা উপেক্ষা করার অধিকারও সাধারণ মানুষের আছে। কিন্তু আমরা কী দেখছি? কোনো রাজনৈতিক দল বা জোট আন্দোলনের ডাক দিয়ে সাধারণ মানুষকে তা পরিপালনে বাধ্য করছে। এটি কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক রীতি হতে পারে না। আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা নেই বললেই চলে। তাই তারা যখন জাতীয় রাজনীতিতে অবদান রাখতে চায়, প্রায়ই তাদের আচার-আচরণে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব পরিলক্ষিত হয়।
সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় এসেছে, আমরা কি এভাবেই দেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ ধ্বংস করব, নাকি সঠিক রাজনৈতিক আচরণের মাধ্যমে দেশের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল করার কাজে সহায়তা করব? রাজনৈতিক কর্মসূচি এমনভাবে সাজাতে হবে যেন কোনোভাবেই তা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত বা বিঘিœত না করে। রাজনীতিকদের যুগের চাহিদা অনুযায়ী আন্দোলনের কর্মসূচি ঢেলে সাজাতে হবে। আমরা পরাধীন দেশে যেভাবে আন্দোলন করেছি, একটি স্বাধীন দেশে সেরকম আন্দোলন কোনোভাবেই চলতে পারে না। ইরাক বা আফগানিস্তানে একটি রাজনৈতিক দল যেভাবে আন্দোলন-সংগ্রাম করে, নিশ্চয়ই বাংলাদেশে সেভাবে আন্দোলন চলতে পারে না। বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে মানুষ মেরে ফেলা কোনোদিনই আন্দোলন হতে পারে না। এটি সন্ত্রাস। কোনোভাবেই এটা মেনে নেয়া যায় না। কারা এর পেছনে আছে, তা খুঁজে বের করতে হবে। জ্বালাও-পোড়াও ছাড়াও আন্দোলন হতে পারে।
হরতাল-ধর্মঘট একটি দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়। এমন অর্থনীতি বিধ্বংসী রাজনৈতিক কর্মসূচি মেনে নেয়া যায় না। অন্যভাবেও রাজনৈতিক কর্মসূচি নির্ধারণ ও পরিচালনা করা যেতে পারে। আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ড দেখলে মনে হয় তারা যেন হরতাল (যাকে অনেকেই বলেন, ভয়তাল) ও ধর্মঘট বা এ ধরনের অর্থনীতি বিধ্বংসী কর্মকাণ্ড ছাড়া প্রতিবাদের কোনো হাতিয়ার খুঁজে পান না। এটা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না। প্রসঙ্গত ভারতবিরোধী আন্দোলনের সময় মহাত্মা গান্ধী কর্তৃক উদ্ভাবিত সত্যাগ্রহ আন্দোলনের কথা বলা যেতে পারে। ব্রিটিশ শাসক কর্তৃপক্ষ তখন স্থানীয়দের নানাভাবে অত্যাচার করত। মহাত্মা গান্ধী এ অত্যাচারের বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেন। এর মূল কথাই হচ্ছে, অত্যাচারী যতই অত্যাচার-নির্যাতন করুক, আমি কিছু বলব না। একদিন অত্যাচারীর মনে অনুশোচনা সৃষ্টি হবে এবং এমনিতেই অত্যাচার বন্ধ করবে। সত্যাগ্রহ আন্দোলন ব্রিটিশদের বেশ বিব্রতকর অবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছিল। এখন মহাত্মা গান্ধী নেই। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময়ও নেই। কিন্তু তাই বলে কি অন্যভাবে আন্দোলন করা যায় না? গণঅনশন, গণগ্রেফতার বরণ, অবস্থান কর্মসূচি ইত্যাদি নানাভাবে দাবি আদায়ের চেষ্টা করা যেতে পারে। সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের মাধ্যমে সরকারকে দাবি মেনে নিতে বাধ্য করাই যদি মূল উদ্দেশ্য হয়, তাহলে অনেক পদ্ধতি আছে। সেসব পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। এফবিসিসিআইসহ অনেক প্রতিষ্ঠানই আইন করে হরতাল বন্ধ করার দাবি জানিয়েছে। কিন্তু কোনো সরকারই মনে হয় এটি করবে না। কারণ ক্ষমতার বাইরে গেলে তারাও একই পদ্ধতিতে আন্দোলন করবেন। আমি মনে করি, আইন করে হরতাল বন্ধ করার কোনো প্রয়োজন নেই। শুধু এটি নিশ্চিত হলেই চলবে যে, কেউ আন্দোলনের ডাক দিয়ে জনসাধারণকে সেই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার জন্য বল প্রয়োগ করবে না। তাহলেই দেখা যাবে আন্দোলনের ডাক দিলে কেমন জনসমর্থন পাওয়া যায়।
আমাদের একটি বিষয় মনে রাখতে হবে- দেশ বাঁচলে আমরা বাঁচব। রাজনৈতিক দল বাঁচবে। দেশের অর্থনীতি ধ্বংস করে কোনোদিনই রাজনীতি চলতে পারে না। এ ব্যাপারে জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
No comments