বাংলা একাডেমির বইমেলা প্রসঙ্গে by বদরুদ্দীন উমর

ভাবাবেগে গদগদ হওয়া বাঙালির এক পরিচিত অভ্যাস। এর সঙ্গে অতিশয়োক্তির নিবিড় সম্পর্ক। এ কারণে সামান্যকে অসামান্য করার প্রবণতা বাঙালির মধ্যে লক্ষণীয়। এখানেই শেষ নয়। যারা সামান্যকে অসামান্য করে, তাদের মধ্যে অসামান্যকে সামান্য করার উল্টো প্রবণতাও দেখা যায়। এটাই স্বাভাবিক, কারণ এ দুই প্রবণতাই পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এ ধরনের প্রবণতা বুদ্ধিবৃত্তি ও মেধাচর্চার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। বাঙালি মেধাহীন না হলেও এ কথা অবশ্যই বলা যায় যে, ভাবাবেগে সিক্ত কাব্যসাহিত্য, এমনকি ইতিহাসচর্চা এ দেশে যত দেখা যায়, সে তুলনায় মননশীলতার চর্চা সামান্য। তুচ্ছও বলা যায়। ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত বইমেলায় যে হাজার হাজার বই প্রকাশিত হয়, তার মধ্যে মননশীল বইয়ের সংখ্যা নগণ্য, প্রায় না থাকার মতোই। কাব্যসাহিত্য বিষয়ক বইয়ের ওপরও যে রিপোর্ট দেখা যায় তাতে তার মধ্যেও মননশীলতার নিদর্শন সামান্য। আবেগ ভালো জিনিস। কিন্তু সংস্কৃতিচর্চার ক্ষেত্রে মেধাহীন আবেগ সৃষ্টিশীলতার সহায়ক নয়। শুধু তাই নয়, এ ধরনের আবেগ থেকে নানা ধরনের বিকৃতির জন্ম হয়। এই বিকৃতির সর্বোচ্চ রূপ দেখা যায় ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে।
বিগত বেশ কয়েক বছরের মতো এ বছরও বাংলা একাডেমি আয়োজিত বইমেলায় হাজার হাজার নতুন বই এসেছে। সংবাদপত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু বইয়ের প্রচ্ছদ, বইয়ের বিবরণ এবং বইয়ের গুণগত মান সম্পর্কে নানা মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, এ বছর বইমেলার অবস্থা আগের থেকেও শোচনীয়। কোনো কোনো মন্তব্য থেকে দেখা যাচ্ছে যে, এ পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে পাঠযোগ্য পঞ্চাশটি বইও আছে কিনা সন্দেহ। যেভাবে ও যে উদ্দেশ্যে এভাবে বই বের হচ্ছে, তার মধ্যেই বাংলাদেশে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও বিদ্যাচর্চার দৈন্যদশার পরিচয় পাওয়া যায়। হজ করা, গরু কোরবানি দেওয়ার মতো বই প্রকাশও এখন বাংলাদেশে হয়ে দাঁড়িয়েছে সামাজিক মর্যাদার বিষয়। কাজেই কী বই প্রকাশ হলো তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, কার ক'টি বই প্রকাশ হলো। বইমেলা সামনে রেখে অনেক প্রতিষ্ঠিত ও পরিচিত লেখকও চেষ্টা করেন যত বেশি সম্ভব বই বের করতে। কাজেই বইমেলার সময় ক'টি বই প্রকাশ হয়েছে, এ প্রশ্নের সম্মুখীন অনেক লেখককেই হতে হয়। আমাকে এ প্রশ্ন কেউ করলে আমি বলি, আমি বইমেলার লেখক নই। তবে কোনো কোনো বই প্রকাশকরা মেলার সময় প্রকাশ করে থাকেন।
আসলে বইয়ের সংখ্যা দিয়ে কোনো লেখকের শক্তি ও প্রতিভার পরিমাপ হয় না, যেমন হয় না তার বইয়ের গুণগত মান নির্ণয়। কিন্তু বাংলাদেশে বইয়ের গুণগত মান সাধারণভাবে এতই নিম্ন যে, লেখকদেরও পরিচয় দাঁড়ায় বইয়ের সংখ্যার মাপকাঠিতে। এই পরিস্থিতিতে ক্রমবর্ধমান সংখ্যায় লেখক নামের অযোগ্য ব্যক্তিরা উৎসাহিত হয়ে অনেক ক্ষেত্রে নিজেদের অর্থায়নে প্রকাশকদের দিয়ে বই বের করেন। নীতিজ্ঞানহীন প্রকাশকরাও এই সুযোগে মুনাফার অঙ্ক বৃদ্ধি করেন। সমাজে সামগ্রিকভাবে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তার সঙ্গে এসব ব্যাপার সম্পর্কহীন নয়। বাংলাদেশে এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ও পৃষ্ঠপোষকতায় যেখানে পরীক্ষায় নম্বর পাওয়া ও পাসের হার দিয়ে শিক্ষার উৎকর্ষতা প্রমাণের চেষ্টা হয়, সেখানে বইয়ের গুণগত মানের পরিবর্তে কোন লেখকের ক'টি বই প্রকাশ হয়েছে সেটা দিয়ে যে নিজের মর্যাদা বৃদ্ধির চেষ্টা অনেকে করে থাকেন, এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে রাজনীতি এখন ব্যবসায়ীদের স্বার্থের অধীন। শাসক শ্রেণীর ক্ষমতাসীন দলের নেতা-নেত্রী, সংসদ সদস্য, মন্ত্রীবর্গ এবং ক্ষমতার বাইরে অবস্থিত দলগুলোর নেতা-নেত্রীদের কর্মকাণ্ড যেভাবে রাজনীতিকে ব্যবসায়ী স্বার্থের অধীন করেছে, সেই একই প্রক্রিয়ায় শিক্ষা এবং সংস্কৃতির প্রত্যেকটি প্রদেশ এখন ব্যবসায়ী স্বার্থচিন্তার অধীন। সাহিত্যচর্চা থেকে নিয়ে গান, নাচ, নাটক, সিনেমা ইত্যাদি সবকিছুই এখন চিন্তার এই বৃত্তে বন্দি।
আবেগের আতিশয্য যে, ইতিহাসচর্চা ক্ষেত্রে বিকৃতির জন্ম দেয়, এটা প্রথমেই বলা হয়েছে। আবেগের সঙ্গে স্বার্থচিন্তা যুক্ত হয়ে এই পরিস্থিতি বাংলাদেশে ভয়াবহ হয়েছে। ইতিহাসচর্চার দুটি প্রধান দিক হলো, তথ্য এবং ব্যাখ্যা বা মূল্যায়ন। সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ব্যাখ্যা বা মূল্যায়ন বলে কিছু হতে পারে না। এটা নির্ভর করে ইতিহাসবিদের নিজের সামাজিক অবস্থান ও সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত চিন্তাচেতনার ওপর। কাজেই এ ক্ষেত্রে পার্থক্য স্বাভাবিক, এর মধ্যে দোষের কিছু নেই। কিন্তু প্রত্যেক ইতিহাসবিদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে, তথ্য বিষয়ে সতর্ক থাকা, কোনো তথ্য ধামাচাপা না দেওয়া, কোনোভাবে তথ্যের বিকৃতি না ঘটানো। মিথ্যা তথ্য ব্যবহার এবং তথ্য বিকৃতি ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে এক মারাত্মক অমার্জনীয় অপরাধ। বাংলাদেশে এই অপরাধ এতই ব্যাপকভাবে চর্চিত হয় যে, এ নিয়ে কোনো আপত্তি অথবা এর বিরোধিতা বিপজ্জনক। ভাষা আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে যে তথ্য বিকৃতি দেখা যায়, এটা এক উদ্বেগজনক ব্যাপার। রাজনৈতিক সুবিধাবাদ, ব্যবসায়ী স্বার্থ এবং তার থেকে সৃষ্ট আবেগ এ ক্ষেত্রে এত শক্তিশালীভাবে নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে, যাতে বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চা দাঁড়িয়েছে এক সস্তা ও খেলো ব্যাপারে। এই পরিস্থিতিতে যথার্থ ইতিহাসবিদরা নয়, অর্ধশিক্ষিত রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী ও কর্মীরাই এখন বাংলাদেশে ঐতিহাসিকের স্থলাভিষিক্ত। শুধু তাই নয়, ইতিহাস বিকৃতির এই সুবিধাবাদী প্রক্রিয়ার দ্বারা লেখক, সাংবাদিক ও ইতিহাসবিদরাও অনেকে পরিচালিত। তথ্য বিকৃতির অমার্জনীয় অপরাধ করতে তাদের অসুবিধা নেই।
এই পরিস্থিতি যেখানে বিরাজ করছে, সেখানে ইতিহাসচর্চা যে সঠিকভাবে সম্ভব নয়, তা বলাই বাহুল্য। এদিক দিয়ে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই যে, বাংলাদেশে ইতিহাসচর্চা বলতে এখন ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছাড়া অন্য কিছুই নেই। সাধারণভাবে ইতিহাসচর্চা উঠিয়ে দিয়ে স্কুল পর্যায়ে ইতিহাসের পাঠ বন্ধ করা হয়েছে। ছাত্রদের কাছে ইতিহাস এখন এক অন্ধকারের দেশ। তার জায়গায় সমাজবিজ্ঞান বিষয়ক বইয়ে ইতিহাসের নামে যা ঢোকানো হয়েছে তা হলো, ঐতিহাসিক তথ্য বিকৃতির এক অভ্রান্ত নিদর্শন। এই অমার্জনীয় অপরাধ যারা করেছে তারা মতলববাজ ছাড়া আর কী? এই ইতিহাস এবং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর ওপর যেসব বই বাংলা একাডেমির মেলায় ক্রেতা ও পাঠকদের জন্য উপস্থিত করা হয়ে থাকে, এগুলোকে আবর্জনা ছাড়া অন্য কিছুই বলা যায় না। বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে যে পরিস্থিতি বিরাজ করছে, নৈরাজ্য মূল্যবোধকে যেভাবে ধরাশায়ী করেছে তার সঙ্গে বইমেলার এই দুরবস্থা অবিচ্ছিন্ন। বইমেলায় হাজার হাজার লোকের যে সমাগম হচ্ছে তার দ্বারা এর দৈন্যদশা আড়াল করা বা বইমেলা নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই।
২৩.২.২০১৫
সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.