বোঝাপড়া উন্নত করার সফর by হুমায়ুন কবির
পশ্চিমবঙ্গের
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তিন দিনের বাংলাদেশ সফরকে এক কথায়
বলা যায়_ বোঝাপড়া উন্নত করার সফর। তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে স্বদেশ ফিরে
বলেছেন, বাংলাদেশ সফর ইতিবাচক হয়েছে এবং আলোচনা হয়েছে ফলপ্রসূ। কিন্তু এটাও
মনে রাখা চাই যে, তিনি আমাদের একটি প্রতিবেশী দেশের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী
হিসেবে এবারের সফরে এসেছেন। এটা ছিল শুভেচ্ছা সফর। কোনো চুক্তি সম্পাদন
হওয়ার সুযোগ এতে ছিল না। কিন্তু সফরটি অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ। রাজনৈতিক
উত্থানপর্ব থেকেই তিনি বাংলাদেশের গণমাধ্যমের কল্যাণে একটি পরিচিত মুখ।
তিনি তৃণমূল পর্যায় থেকে একটি দলকে গড়ে তুলেছেন এবং নির্বাচনে বিপুল
সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জয়ী হয়ে বামফ্রন্টের সাড়ে তিন দশকের শাসনের অবসান
ঘটিয়েছেন। তার এ ভাবমূর্তি ইতিবাচক। বাংলাদেশে তিনি আরও একটি কারণে পরিচিত,
যাকে ঠিক একইভাবে দেখা চলে না। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সে সময়ের
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। তখন সীমান্ত ও
তিস্তা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি সম্পাদিত হবে, সেটা একরূপ নিশ্চিত ছিল। এ
বিষয়ে দুই দেশের বিভিন্ন পর্যায়ের আলোচনায় সমঝোতা চূড়ান্ত পর্যায়ে
পেঁৗছেছিল। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হয়েছিলেন বাংলাদেশের
সীমান্তবর্তী কয়েকটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ মুহূর্তে প্রতিনিধি দল থেকে সরে দাঁড়ান। সে সময়ে বাংলাদেশে এরূপ ধারণা
তৈরি হয় যে, তার বিরোধিতার কারণেই এ চুক্তি হতে পারেনি। অনেকেই মনে করতে
থাকেন, বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশী রাজ্যের এই নেত্রী আমাদের প্রতি
বন্ধুসুলভ আচরণ করেননি।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রতি তার মনোভাবে খানিকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যা ইতিবাচক। বিশেষ করে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি জোট ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে তিনি কিছুটা নমনীয় অবস্থান ব্যক্ত করতে থাকেন। তিনি এটা জানেন যে, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য লোকসভায় বিজেপি জোটের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এই জোট সীমান্ত চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নে আগ্রহী এবং সে অঙ্গীকার শীর্ষ পর্যায় থেকেই একাধিকবার ব্যক্ত হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকায় এসেও এ কথা জানিয়ে গেছেন। তৃণমূল কংগ্রেস এ ইস্যুতে বিরোধিতা করলেও চুক্তি আটকে রাখা যাবে না, সেটা এখন স্পষ্ট। তাই তিনি বিষয়টিতে বিঘ্ন ঘটানো অপ্রয়োজনীয় মনে করতে পারেন। লোকসভায় এ সংক্রান্ত বিলটি উত্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতাও শেষ পর্যায়ে। সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিলটি লোকসভায় উত্থাপনে সম্মতি দিয়েছে। বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই এটি সুখবর। চার দশক আগে এই ইস্যুতে দুটি দেশ ঐকমত্যে পেঁৗছেছিল। এতদিন যে এ চুক্তি চূড়ান্ত হতে পারেনি তার দায় একান্তভাবেই ভারতীয় পক্ষের।
বাংলাদেশ ইস্যুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থার পরিবর্তনের একটি রাজনৈতিক দিক রয়েছে। সম্প্রতি দেখা গেছে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির শক্তি বাড়ছে এবং তারা সিপিএমকে অনেক স্থানে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসছে। সামনে রয়েছে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন এবং তৃণমূল কংগ্রেসের শঙ্কা_ নরেন্দ্র মোদির দল তাদের জন্য শক্ত চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। এটা দেখা যাচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে যারা অভিবাসী হিসেবে গিয়েছেন তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ বিজেপির প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন, বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে উঠতে পারলে এবং বাংলাদেশে তার প্রতি যে খানিকটা নেতিবাচক ধারণা গড়ে উঠেছে সেটা কাটাতে পারলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তার সুবিধা হতে পারে। এ লক্ষ্য থেকে তিনি সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ সফরের সময়টিও বেছে নিয়েছেন ভেবেচিন্তে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-উৎসাহ তার জানা আছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। গোটা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী কোটি কোটি মানুষও একুশকে দেখে থাকেন একই মনোভাব নিয়ে। বাংলাদেশে নিজের ভাবমূর্তি বাড়ানোর জন্য এ সুযোগটি তিনি কাজে লাগাতে চেয়েছেন। বাংলার দুই অংশের সাংস্কৃতিক বন্ধনের শিকড় ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত। সঙ্গত কারণেই তিনি সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বাড়ানোর ইস্যুটি সামনে এনেছেন। দুই দেশের শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ূক, সেটাও তার একান্ত কাম্য। আমরাও মনে করি, এতে পারস্পরিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ভারতের সল্ট লেকে তথ্যপ্রযুক্তির যে অত্যাধুনিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে তার প্রতিও আমাদের মনোযোগ থাকা চাই। মনে রাখা চাই যে আমাদের একেবারে ঘরের কাছেই একটি অভাবনীয় সুযোগ তৈরি হচ্ছে। পর্যটনেও আমাদের সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এজন্য স্থল, নৌ ও আকাশপথে যোগাযোগের সম্ভাবনা প্রচুর। কিন্তু বলতে পারি, এ সম্ভাবনার এখন পর্যন্ত ব্যবহার সামান্যই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকায় অবস্থানকালে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার প্রায় ৩০ মিনিট একান্তে আলোচনা হয়েছে। তিনি কথা বলেছেন শিল্প-সংস্কৃতির জগতের অগ্রণী ব্যক্তিদের সঙ্গে। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের আড্ডায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা হাজির ছিলেন। তার সঙ্গে তোলা তিন দলের নেতাদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি। তিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও কথা বলেছেন এবং দুই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে একটি যৌথ কমিটি গঠনের প্রস্তাব রেখেছেন। তিনি বলেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। দুই অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের চিন্তাভাবনাও একই রকম বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগের ক্ষেত্রে এ অঞ্চল প্রবেশদ্বার হতে পারে বলেও তিনি মনে করেন। সীমান্ত এলাকায় ব্যবসার ক্ষেত্রে যেসব অবকাঠামো সমস্যা রয়েছে, সেসব দূর করায় তিনি আগ্রহ দেখিয়েছেন। এসবই ইতিবাচক বলে আমি মনে করি।
তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকায় অবস্থানকালে তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে প্রকাশ্যে যেভাবে বক্তব্য রেখেছেন তাতে আমরা ঠিক আশ্বস্ত হতে পারছি না। তিনি বলেছেন, এ ইস্যুতে তার ওপর আস্থা রাখতে। তিনি সীমান্ত চুক্তি লোকসভার এ অধিবেশনেই পাস হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও একাধিকবার জানিয়েছেন। কাজেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ঢাকায় নতুন কিছু বলেননি। তিনি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারতেন তিস্তা চুক্তি বিষয়ে, যাতে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে বলেই আমাদের মনে হবে। তিনি দুই দেশের স্বার্থ রক্ষা করে চুক্তি সম্পাদন করার কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা জানি যে, মনমোহন সিংয়ের সফরের আগেই এ বিষয়ে চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। তিনি যদি বলতেন, যে খসড়া চুক্তিতে দুই দেশ সমঝোতায় পেঁৗছেছে তা মেনে নিচ্ছেন, তাহলে সেটাই হতো সর্বোত্তম সমাধান। এখন তিনি পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ রক্ষার কথা বলছেন। খসড়া চুক্তি বিদ্যমান থাকার পর এর কী ব্যাখ্যা তিনি দেবেন, সেটা আমাদের জানা নেই। পানি বণ্টনের জন্য তিনি কি নতুন কোনো ফর্মুলা উপস্থাপন করতে চান? এটা হলে গোটা প্রক্রিয়াটি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। সামনে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন। তিনি কি এ ইস্যুটিকে ঝুলিয়ে রাখতে চাইছেন? তিনি মনে করতে পারেন যে, তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের ন্যায্য স্বার্থ রক্ষা করতে গেলে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে তার দলের ভোটের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে পারে।
তিনি বাংলাদেশ সফরকালে তার প্রতি দেখানো আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি শুভেচ্ছার বার্তা রেখে গেছেন। আবার আসবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আমরা জানি, দুই দেশের মধ্যে ধরলাসহ আরও কয়েকটি অভিন্ন নদী রয়েছে। তিনি সদিচ্ছার মনোভাব দেখালে দিলি্লর জন্য কাজটি অনেক সহজ হয়ে যেতে পারে। তার এ সফরের মধ্য দিয়ে সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা হয়তো অনেকে নিশ্চিত করে বলতে চাইবেন না। কিন্তু এ পথে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এখন আমরা চাইব, সম্পর্ক যেন যৌক্তিক পরিণতির পথে এগিয়ে যেতে পারে এবং যে কোনো বাধাবিঘ্ন যাতে আন্তরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়, সেজন্য উভয়পক্ষ সযত্নবান থাকবে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং কলকাতায় বাংলাদেশের সাবেক ডেপুটি হাইকমিশনার
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের প্রতি তার মনোভাবে খানিকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়, যা ইতিবাচক। বিশেষ করে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি জোট ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ইস্যুগুলোতে তিনি কিছুটা নমনীয় অবস্থান ব্যক্ত করতে থাকেন। তিনি এটা জানেন যে, সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য লোকসভায় বিজেপি জোটের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এই জোট সীমান্ত চুক্তি দ্রুত বাস্তবায়নে আগ্রহী এবং সে অঙ্গীকার শীর্ষ পর্যায় থেকেই একাধিকবার ব্যক্ত হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ ঢাকায় এসেও এ কথা জানিয়ে গেছেন। তৃণমূল কংগ্রেস এ ইস্যুতে বিরোধিতা করলেও চুক্তি আটকে রাখা যাবে না, সেটা এখন স্পষ্ট। তাই তিনি বিষয়টিতে বিঘ্ন ঘটানো অপ্রয়োজনীয় মনে করতে পারেন। লোকসভায় এ সংক্রান্ত বিলটি উত্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতাও শেষ পর্যায়ে। সংশ্লিষ্ট সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বিলটি লোকসভায় উত্থাপনে সম্মতি দিয়েছে। বাংলাদেশের জন্য অবশ্যই এটি সুখবর। চার দশক আগে এই ইস্যুতে দুটি দেশ ঐকমত্যে পেঁৗছেছিল। এতদিন যে এ চুক্তি চূড়ান্ত হতে পারেনি তার দায় একান্তভাবেই ভারতীয় পক্ষের।
বাংলাদেশ ইস্যুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবস্থার পরিবর্তনের একটি রাজনৈতিক দিক রয়েছে। সম্প্রতি দেখা গেছে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির শক্তি বাড়ছে এবং তারা সিপিএমকে অনেক স্থানে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসছে। সামনে রয়েছে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন এবং তৃণমূল কংগ্রেসের শঙ্কা_ নরেন্দ্র মোদির দল তাদের জন্য শক্ত চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠতে পারে। এটা দেখা যাচ্ছে যে, পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে যারা অভিবাসী হিসেবে গিয়েছেন তাদের উল্লেখযোগ্য অংশ বিজেপির প্রতি ঝুঁকে পড়ছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মনে করছেন, বাংলাদেশের প্রতি বন্ধুভাবাপন্ন হয়ে উঠতে পারলে এবং বাংলাদেশে তার প্রতি যে খানিকটা নেতিবাচক ধারণা গড়ে উঠেছে সেটা কাটাতে পারলে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে তার সুবিধা হতে পারে। এ লক্ষ্য থেকে তিনি সাংস্কৃতিক যোগাযোগের ওপরও গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশ সফরের সময়টিও বেছে নিয়েছেন ভেবেচিন্তে। মহান একুশে ফেব্রুয়ারি নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের আবেগ-উৎসাহ তার জানা আছে। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। গোটা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী কোটি কোটি মানুষও একুশকে দেখে থাকেন একই মনোভাব নিয়ে। বাংলাদেশে নিজের ভাবমূর্তি বাড়ানোর জন্য এ সুযোগটি তিনি কাজে লাগাতে চেয়েছেন। বাংলার দুই অংশের সাংস্কৃতিক বন্ধনের শিকড় ইতিহাসের গভীরে প্রোথিত। সঙ্গত কারণেই তিনি সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বাড়ানোর ইস্যুটি সামনে এনেছেন। দুই দেশের শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ূক, সেটাও তার একান্ত কাম্য। আমরাও মনে করি, এতে পারস্পরিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। ভারতের সল্ট লেকে তথ্যপ্রযুক্তির যে অত্যাধুনিক কেন্দ্র গড়ে উঠেছে তার প্রতিও আমাদের মনোযোগ থাকা চাই। মনে রাখা চাই যে আমাদের একেবারে ঘরের কাছেই একটি অভাবনীয় সুযোগ তৈরি হচ্ছে। পর্যটনেও আমাদের সহযোগিতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। এজন্য স্থল, নৌ ও আকাশপথে যোগাযোগের সম্ভাবনা প্রচুর। কিন্তু বলতে পারি, এ সম্ভাবনার এখন পর্যন্ত ব্যবহার সামান্যই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকায় অবস্থানকালে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার প্রায় ৩০ মিনিট একান্তে আলোচনা হয়েছে। তিনি কথা বলেছেন শিল্প-সংস্কৃতির জগতের অগ্রণী ব্যক্তিদের সঙ্গে। ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের আড্ডায় আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির গুরুত্বপূর্ণ নেতারা হাজির ছিলেন। তার সঙ্গে তোলা তিন দলের নেতাদের হাস্যোজ্জ্বল ছবি আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি। তিনি ব্যবসায়ীদের সঙ্গেও কথা বলেছেন এবং দুই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে একটি যৌথ কমিটি গঠনের প্রস্তাব রেখেছেন। তিনি বলেছেন, ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। দুই অঞ্চলের ব্যবসায়ীদের চিন্তাভাবনাও একই রকম বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। চীন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়াসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার যোগাযোগের ক্ষেত্রে এ অঞ্চল প্রবেশদ্বার হতে পারে বলেও তিনি মনে করেন। সীমান্ত এলাকায় ব্যবসার ক্ষেত্রে যেসব অবকাঠামো সমস্যা রয়েছে, সেসব দূর করায় তিনি আগ্রহ দেখিয়েছেন। এসবই ইতিবাচক বলে আমি মনে করি।
তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঢাকায় অবস্থানকালে তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে প্রকাশ্যে যেভাবে বক্তব্য রেখেছেন তাতে আমরা ঠিক আশ্বস্ত হতে পারছি না। তিনি বলেছেন, এ ইস্যুতে তার ওপর আস্থা রাখতে। তিনি সীমান্ত চুক্তি লোকসভার এ অধিবেশনেই পাস হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এটা ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও একাধিকবার জানিয়েছেন। কাজেই পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ঢাকায় নতুন কিছু বলেননি। তিনি স্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারতেন তিস্তা চুক্তি বিষয়ে, যাতে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে বলেই আমাদের মনে হবে। তিনি দুই দেশের স্বার্থ রক্ষা করে চুক্তি সম্পাদন করার কথা বলেছেন। কিন্তু আমরা জানি যে, মনমোহন সিংয়ের সফরের আগেই এ বিষয়ে চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। তিনি যদি বলতেন, যে খসড়া চুক্তিতে দুই দেশ সমঝোতায় পেঁৗছেছে তা মেনে নিচ্ছেন, তাহলে সেটাই হতো সর্বোত্তম সমাধান। এখন তিনি পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ রক্ষার কথা বলছেন। খসড়া চুক্তি বিদ্যমান থাকার পর এর কী ব্যাখ্যা তিনি দেবেন, সেটা আমাদের জানা নেই। পানি বণ্টনের জন্য তিনি কি নতুন কোনো ফর্মুলা উপস্থাপন করতে চান? এটা হলে গোটা প্রক্রিয়াটি অনিশ্চিত হয়ে পড়বে, তাতে সন্দেহ নেই। সামনে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন। তিনি কি এ ইস্যুটিকে ঝুলিয়ে রাখতে চাইছেন? তিনি মনে করতে পারেন যে, তিস্তা নিয়ে বাংলাদেশের ন্যায্য স্বার্থ রক্ষা করতে গেলে উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতে তার দলের ভোটের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হতে পারে।
তিনি বাংলাদেশ সফরকালে তার প্রতি দেখানো আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়েছেন। তিনি শুভেচ্ছার বার্তা রেখে গেছেন। আবার আসবেন বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। আমরা জানি, দুই দেশের মধ্যে ধরলাসহ আরও কয়েকটি অভিন্ন নদী রয়েছে। তিনি সদিচ্ছার মনোভাব দেখালে দিলি্লর জন্য কাজটি অনেক সহজ হয়ে যেতে পারে। তার এ সফরের মধ্য দিয়ে সমঝোতার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা হয়তো অনেকে নিশ্চিত করে বলতে চাইবেন না। কিন্তু এ পথে অবশ্যই উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এখন আমরা চাইব, সম্পর্ক যেন যৌক্তিক পরিণতির পথে এগিয়ে যেতে পারে এবং যে কোনো বাধাবিঘ্ন যাতে আন্তরিক আলোচনার মধ্য দিয়ে দ্রুত নিষ্পত্তি করা যায়, সেজন্য উভয়পক্ষ সযত্নবান থাকবে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এবং কলকাতায় বাংলাদেশের সাবেক ডেপুটি হাইকমিশনার
No comments