ভিরুঙ্গা ও বাংলাদেশ by হাসান ফেরদৌস
অরলান্ডো
ভন আইসিডেলের তথ্যচিত্র ভিরুঙ্গি দেখে আমার কেবলই বাংলাদেশের কথা মনে
হয়েছে। নিজের দেশ, তাকে সন্তানের মতো বুকে আগলে রাখার কথা। অথচ সেই
স্বদেশকেই খুবলে, আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করে একদম নিঃস্ব করে ফেলছি আমরাই। ঠিক
যেমন ঘটছে কঙ্গোতে। যাঁরা ভিরুঙ্গা ছবিটি দেখেননি, তাঁদের জন্য খুব
সংক্ষেপে এই তথ্যচিত্রের মূল বিষয়টি জানিয়ে দিই। গণপ্রজাতান্ত্রিক কঙ্গোর
উত্তর-পশ্চিমে ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্ক। এখানে বাস করে পৃথিবীর অবশিষ্ট
পাহাড়ি গরিলা। তাদের মোট সংখ্যা বড়জোর ৭০০। দেশটি গৃহযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত ২০
বছর ধরে। ফলে অগুনতি মানুষ হতাহত হয়েছে, গৃহহীন হয়েছে। আফ্রিকার সবচেয়ে ধনী
দেশ হওয়ার কথা যার, সে এখন প্রায় নিঃস্ব। মানুষ তো মরছেই, সঙ্গে সঙ্গে
মরছে এই গরিলাগুলো। ভিরুঙ্গা ন্যাশনাল পার্কে একদল নিবেদিতপ্রাণ রেঞ্জার
জান বাজি রেখে বুক দিয়ে আগলানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন পাহাড়ি গরিলার এই শেষ
চিহ্ন টিকিয়ে রাখতে।
সমস্যা বাধল যখন এই পার্কের সীমানার ভেতর লেক এডওয়ার্ডে আবিষ্কৃত হলো তেল। এই পার্কের ভেতর দিয়ে তেলের পাইপলাইন যাবে, ফলে পার্ক তো সাবাড় হবেই, নিশ্চিহ্ন হবে গরিলারা। দৌড়ে এল বিদেশি তেল কোম্পানি, হামলে পড়ল স্থানীয় মিলিশিয়া। সঙ্গে হাত মেলাল কেন্দ্রীয় সরকার। সবার এক লক্ষ্য, যেভাবে পারো লুটেপুটে খাও। বিদেশি কোম্পানি এই কাজ করছে ১০০ বছর ধরে। যেখানেই খনিজ সম্পদের দেখা মিলেছে, সবার আগে তারা মোটা টাকার গোছা ধরিয়ে দেয় সরকারি কর্তাদের হাতে। নিজের দেশের বারোটা বাজুক, নিজের আখের তো গোছানো গেল! কঙ্গোর তেলমন্ত্রী থেকে তাবৎ ক্ষমতাধর ব্যক্তি এককথায় বিদেশির পকেটে। স্থানীয় মিলিশিয়াও ভাবল, আমরাই বা পিছিয়ে থাকব কেন? তেল কোম্পানির সঙ্গে তাদের গোপন চুক্তি হয়ে গেল। ন্যাশনাল পার্ক জাহান্নামে যাক, লেক এডওয়ার্ড থেকে তেল উঠুক।
আপত্তি করলেন পার্কের দায়িত্বে থাকা শ চারেক রেঞ্জার। এখানে তেল খোঁড়া শুরু হলে শুধু যে পার্ক গোল্লায় যাবে তা নয়, মারা পড়বে এই অসহায় গরিলাগুলো। যে লেক এডওয়ার্ডের ওপর এই অঞ্চলের মৎস্যজীবী কয়েক হাজার মানুষের জীবিকা নির্ভর করে, তাদেরও পথে বসতে হবে। তাঁরা বললেন, না, জীবন দিয়ে হলেও আমরা বিদেশি তেল কোম্পানির নোংরা হাত আটকাব। এই পার্কের ক্ষতি করে তেল তুলতে দেব না। তেল কোম্পানি থেকে শুরু করে কেন্দ্রের মন্ত্রীরা লোক পাঠালেন, বাপের জন্মে যত টাকা দেখোনি, এই নাও সেই টাকা। মিলিশিয়া ধমক দিয়ে গেল, মানে মানে সরে না পড়লে খাবে গুলি। রেঞ্জারদের একজনও তাতে ভীত হলেন না। গোপন ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে কোম্পানি ও তার দোসরদের কথাবার্তা রেকর্ড করা শুরু করলেন তাঁরা। লক্ষ্য বিশ্বের মানুষের কাছে তাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেওয়া। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হলো প্রায়-কিশোরী এক ফরাসি সাংবাদিক।
বাকিটুকু আপনারা দেখে নেবেন। ছবিটা দেখা প্রয়োজন শুধু এ কথা জানার জন্য যে সর্বগ্রাসী প্রলোভন উপেক্ষা করে একদম সাধারণ মানুষ এখনো নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য জীবন বাজি রাখেন, এমন মানুষ এখনো আছেন। নেতা হয়তো নেই, অন্তত এই ছবিতে তাঁদের দেখি না।
এমন সাহস এসব সাধারণ মানুষ কোত্থেকে পায়? অর্থের প্রলোভন উপেক্ষা করে নিজ দায়িত্ব পালনের এমন কর্তব্যবোধ, তা-ই বা আসে কোত্থেকে? এর উত্তর আমি জানি না। সততার হয়তো কোনো নিজস্ব শক্তি আছে, নিজস্ব কোনো আলো, যা তাদের আঁধার থেকে সরিয়ে রাখে। অন্য শক্তি সম্ভবত দেশপ্রেম। মানুষ নিজের ব্যক্তিস্বার্থকে হিসাবে না রেখে দেশের কল্যাণের কথা ভাবে, এ খুব অবাক ব্যাপার নয়।
যে কঙ্গোর একখণ্ড ভূমির ওপর এই কাহিনির উন্মোচন, সেই দেশটি প্রায় দেড় শ বছর বিদেশির পদানত ছিল। অসম্ভব ধনী এই দেশটির খনিজ সম্পদের লোভে এসেছিল, যারা এই দেড় শ বছরের প্রতিটি দিন সে সম্পদের নির্মম লুটপাট করেছে। সন্দেহ নেই, কঙ্গোর মানুষ তাদের মদদ জুগিয়েছে, তাদের কেউ কেউ সে লুটের ভাগ পেয়েছে। কিন্তু প্রতিবাদীও মানুষ ছিলেন কঙ্গোতে। তাঁদের একজন প্যাট্রিসলুমুম্বা। বিদেশির নির্লজ্জ-নির্বিকার লুণ্ঠন ঠেকাতে চেয়েছিলেন তিনি। বিদেশি প্রভুর উৎকোচের প্যাকেট টেবিলের নিচ দিয়ে নিয়ে তা পকেটে ভরার কথা কখনো মাথায়ও আসেনি তাঁর। শেষ পর্যন্ত খুন হয়েছিলেন তিনি, বিদেশির দালাল একদল দেশি মানুষেরই হাতে।
দেশকে ভালোবেসে মৃত্যু আমাদের অপরিচিত নয়। বাংলা নামের দেশকে আমরা পেলামই তো তাঁদের জন্য, যাঁরা মৃত্যু উপেক্ষা করেছিলেন। কোনো পুরস্কারের জন্য নয়, কোনো মনু্যমেন্টের আশায় নয়, মাসিক কোনো ভাতার জন্য নয়। শুধুই দেশের জন্য।
কিন্তু সেসব মানুষ এখন কোথায়? আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে এই ভেবে বিস্মিত হতে হয়, এই দেশের মানুষ একদিন জান বাজি রেখে যুদ্ধে গিয়েছিল। এখন আমরা জান বাজি রেখে কর্মক্ষেত্রে যাই। আমাদের ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিতে যায়, সুস্থ ফিরে আসবে কি না জানি না। অসুস্থ মা-বাবাকে হাসপাতালে নেব, তার ভরসা হয় না। কারণ, যেকোনো সময় ধেয়ে আসতে পারে পেট্রলবোমা।
একজন রাজনীতিক আমাকে বলেছেন, বৃহত্তর স্বার্থে এই ক্ষতিটুকু স্বীকার করতেই হবে। তাঁর কথা শুনে থ হয়ে গেছি। বৃহত্তর স্বার্থ মানে তাঁর ক্ষমতায় যাওয়া। আর সে জন্য আমার শিশুপুত্রকে আগুনে পুড়তে হবে, হাত-পা হারাতে হবে আমার ভাইকে।
বন্য গরিলাকে বাঁচাতে জান বাজি রেখেছিলেন কঙ্গোর অতি সাধারণ একদল মানুষ। তাঁরা কোনো দিন মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হবেন না। এমনকি সাংসদও নন। যাঁরা বাংলাদেশে রাজনীতি করেন, তাঁদের কাছে অনুরোধ, প্লিজ, ভিরুঙ্গা ডকুমেন্টারিটি দেখবেন। নিজের সন্তানের মমতায় সেই পার্কের রেঞ্জাররা বন্য গরিলাদের আগলে রেখেছেন। যাঁরা ক্ষমতায়, তাঁরাও একধরনের রেঞ্জার। দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ আগলে রাখার কথা তাঁদের।
কই, আজকের বাংলাদেশে কোথায় সেই সব রেঞ্জার?
হাসান ফেরদৌস: নিউইয়র্কে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি
সমস্যা বাধল যখন এই পার্কের সীমানার ভেতর লেক এডওয়ার্ডে আবিষ্কৃত হলো তেল। এই পার্কের ভেতর দিয়ে তেলের পাইপলাইন যাবে, ফলে পার্ক তো সাবাড় হবেই, নিশ্চিহ্ন হবে গরিলারা। দৌড়ে এল বিদেশি তেল কোম্পানি, হামলে পড়ল স্থানীয় মিলিশিয়া। সঙ্গে হাত মেলাল কেন্দ্রীয় সরকার। সবার এক লক্ষ্য, যেভাবে পারো লুটেপুটে খাও। বিদেশি কোম্পানি এই কাজ করছে ১০০ বছর ধরে। যেখানেই খনিজ সম্পদের দেখা মিলেছে, সবার আগে তারা মোটা টাকার গোছা ধরিয়ে দেয় সরকারি কর্তাদের হাতে। নিজের দেশের বারোটা বাজুক, নিজের আখের তো গোছানো গেল! কঙ্গোর তেলমন্ত্রী থেকে তাবৎ ক্ষমতাধর ব্যক্তি এককথায় বিদেশির পকেটে। স্থানীয় মিলিশিয়াও ভাবল, আমরাই বা পিছিয়ে থাকব কেন? তেল কোম্পানির সঙ্গে তাদের গোপন চুক্তি হয়ে গেল। ন্যাশনাল পার্ক জাহান্নামে যাক, লেক এডওয়ার্ড থেকে তেল উঠুক।
আপত্তি করলেন পার্কের দায়িত্বে থাকা শ চারেক রেঞ্জার। এখানে তেল খোঁড়া শুরু হলে শুধু যে পার্ক গোল্লায় যাবে তা নয়, মারা পড়বে এই অসহায় গরিলাগুলো। যে লেক এডওয়ার্ডের ওপর এই অঞ্চলের মৎস্যজীবী কয়েক হাজার মানুষের জীবিকা নির্ভর করে, তাদেরও পথে বসতে হবে। তাঁরা বললেন, না, জীবন দিয়ে হলেও আমরা বিদেশি তেল কোম্পানির নোংরা হাত আটকাব। এই পার্কের ক্ষতি করে তেল তুলতে দেব না। তেল কোম্পানি থেকে শুরু করে কেন্দ্রের মন্ত্রীরা লোক পাঠালেন, বাপের জন্মে যত টাকা দেখোনি, এই নাও সেই টাকা। মিলিশিয়া ধমক দিয়ে গেল, মানে মানে সরে না পড়লে খাবে গুলি। রেঞ্জারদের একজনও তাতে ভীত হলেন না। গোপন ভিডিও ক্যামেরা দিয়ে কোম্পানি ও তার দোসরদের কথাবার্তা রেকর্ড করা শুরু করলেন তাঁরা। লক্ষ্য বিশ্বের মানুষের কাছে তাদের ষড়যন্ত্র ফাঁস করে দেওয়া। তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হলো প্রায়-কিশোরী এক ফরাসি সাংবাদিক।
বাকিটুকু আপনারা দেখে নেবেন। ছবিটা দেখা প্রয়োজন শুধু এ কথা জানার জন্য যে সর্বগ্রাসী প্রলোভন উপেক্ষা করে একদম সাধারণ মানুষ এখনো নিজ দায়িত্ব পালনের জন্য জীবন বাজি রাখেন, এমন মানুষ এখনো আছেন। নেতা হয়তো নেই, অন্তত এই ছবিতে তাঁদের দেখি না।
এমন সাহস এসব সাধারণ মানুষ কোত্থেকে পায়? অর্থের প্রলোভন উপেক্ষা করে নিজ দায়িত্ব পালনের এমন কর্তব্যবোধ, তা-ই বা আসে কোত্থেকে? এর উত্তর আমি জানি না। সততার হয়তো কোনো নিজস্ব শক্তি আছে, নিজস্ব কোনো আলো, যা তাদের আঁধার থেকে সরিয়ে রাখে। অন্য শক্তি সম্ভবত দেশপ্রেম। মানুষ নিজের ব্যক্তিস্বার্থকে হিসাবে না রেখে দেশের কল্যাণের কথা ভাবে, এ খুব অবাক ব্যাপার নয়।
যে কঙ্গোর একখণ্ড ভূমির ওপর এই কাহিনির উন্মোচন, সেই দেশটি প্রায় দেড় শ বছর বিদেশির পদানত ছিল। অসম্ভব ধনী এই দেশটির খনিজ সম্পদের লোভে এসেছিল, যারা এই দেড় শ বছরের প্রতিটি দিন সে সম্পদের নির্মম লুটপাট করেছে। সন্দেহ নেই, কঙ্গোর মানুষ তাদের মদদ জুগিয়েছে, তাদের কেউ কেউ সে লুটের ভাগ পেয়েছে। কিন্তু প্রতিবাদীও মানুষ ছিলেন কঙ্গোতে। তাঁদের একজন প্যাট্রিসলুমুম্বা। বিদেশির নির্লজ্জ-নির্বিকার লুণ্ঠন ঠেকাতে চেয়েছিলেন তিনি। বিদেশি প্রভুর উৎকোচের প্যাকেট টেবিলের নিচ দিয়ে নিয়ে তা পকেটে ভরার কথা কখনো মাথায়ও আসেনি তাঁর। শেষ পর্যন্ত খুন হয়েছিলেন তিনি, বিদেশির দালাল একদল দেশি মানুষেরই হাতে।
দেশকে ভালোবেসে মৃত্যু আমাদের অপরিচিত নয়। বাংলা নামের দেশকে আমরা পেলামই তো তাঁদের জন্য, যাঁরা মৃত্যু উপেক্ষা করেছিলেন। কোনো পুরস্কারের জন্য নয়, কোনো মনু্যমেন্টের আশায় নয়, মাসিক কোনো ভাতার জন্য নয়। শুধুই দেশের জন্য।
কিন্তু সেসব মানুষ এখন কোথায়? আজকের বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে এই ভেবে বিস্মিত হতে হয়, এই দেশের মানুষ একদিন জান বাজি রেখে যুদ্ধে গিয়েছিল। এখন আমরা জান বাজি রেখে কর্মক্ষেত্রে যাই। আমাদের ছেলেমেয়েরা পরীক্ষা দিতে যায়, সুস্থ ফিরে আসবে কি না জানি না। অসুস্থ মা-বাবাকে হাসপাতালে নেব, তার ভরসা হয় না। কারণ, যেকোনো সময় ধেয়ে আসতে পারে পেট্রলবোমা।
একজন রাজনীতিক আমাকে বলেছেন, বৃহত্তর স্বার্থে এই ক্ষতিটুকু স্বীকার করতেই হবে। তাঁর কথা শুনে থ হয়ে গেছি। বৃহত্তর স্বার্থ মানে তাঁর ক্ষমতায় যাওয়া। আর সে জন্য আমার শিশুপুত্রকে আগুনে পুড়তে হবে, হাত-পা হারাতে হবে আমার ভাইকে।
বন্য গরিলাকে বাঁচাতে জান বাজি রেখেছিলেন কঙ্গোর অতি সাধারণ একদল মানুষ। তাঁরা কোনো দিন মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রী হবেন না। এমনকি সাংসদও নন। যাঁরা বাংলাদেশে রাজনীতি করেন, তাঁদের কাছে অনুরোধ, প্লিজ, ভিরুঙ্গা ডকুমেন্টারিটি দেখবেন। নিজের সন্তানের মমতায় সেই পার্কের রেঞ্জাররা বন্য গরিলাদের আগলে রেখেছেন। যাঁরা ক্ষমতায়, তাঁরাও একধরনের রেঞ্জার। দেশ ও দেশের মানুষের স্বার্থ আগলে রাখার কথা তাঁদের।
কই, আজকের বাংলাদেশে কোথায় সেই সব রেঞ্জার?
হাসান ফেরদৌস: নিউইয়র্কে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি
No comments