মমতার সফরে কী পেল বাংলাদেশ? by আলী ইমাম মজুমদার

তিন দিনের সফরে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সফরকালে তাঁর মধ্যে লক্ষ করা গেছে আবেগ আর উচ্ছ্বাস। পাশাপাশি প্রত্যাশা। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব বিষয় অমীমাংসিত রয়েছে, তার মধ্যে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি আর ছিটমহল বিনিময় গুরুত্বপূর্ণ। ছিটমহল বিনিময়সংক্রান্ত চুক্তিটিতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আর তিস্তা চুক্তিতে সংশ্লিষ্ট মূলত পশ্চিমবঙ্গ। এ দুটি অনিষ্পন্ন বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ভূমিকা তাৎপর্যপূর্ণ। এর পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সফর ও তাঁর বক্তব্যকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হয়।
উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক, ভারত আমাদের নিকট প্রতিবেশী। স্বাধীনতাসংগ্রামের প্রধান মিত্র। আর পশ্চিমবঙ্গ ওই স্বাধীনতাসংগ্রামের সময় আমাদের ৮০ লাখ শরণার্থীকে সাদরে আশ্রয় দিয়েছিল। ভাগাভাগি করে নিয়েছিল আমাদের সুখ-দুঃখ।
২০১১ সালে ভারতের তখনকার প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরকালে এ দুটি চুক্তি চূড়ান্ত হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোতে মালামাল পরিবহনসংক্রান্ত একটি ট্রানজিট চুক্তিও সম্পন্ন হবে। তাঁর সফরসঙ্গী হওয়ার কথা পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীরা। ভারত সরকারের ‘হোমওয়ার্কের’ ঘাটতি কিংবা বাংলাদেশ সরকারের কূটনৈতিক অক্ষমতা যেটাই হোক, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী আসেননি। তদুপরি তিনি তিস্তার পানি বণ্টন এবং ছিটমহল বিনিময়সংক্রান্ত চুক্তিরও বিরোধিতা করতে থাকেন। ফলে পানি বণ্টন ও ট্রানজিট চুক্তি হয়নি। ছিটমহল বিনিময়সংক্রান্ত একটি সমঝোতা স্মারক সই হয়। তখনকার ভারত সরকার ছিটমহল বিনিময় চুক্তিটি কার্যকর করার জন্য ভারতীয় সংবিধানে একটি সংশোধনী আনতে রাজ্যসভায় শুধু একটি বিল উপস্থাপন করে।
উল্লেখ্য, এতদবিষয়ক মূল চুক্তিটি ১৯৭৪ সালে দুই দেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। বাংলাদেশ সে বছরই এ বিষয়ে সংবিধান সংশোধন করে নিয়েছে। ভারতে আজও বিষয়টি অপেক্ষমাণ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সফরে এসে জানান, সংসদের আসন্ন বাজেট অধিবেশনে তা পাস হবে। এই বিলের প্রশ্নে তাঁর ইতিবাচক ভূমিকা সম্পর্কেও তিনি বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করতে সচেষ্ট ছিলেন। এ বিষয়ে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকেও ইতিবাচক মনে হচ্ছে। অন্য দেশের সীমারেখার মাঝে কতগুলো অপ্রবেশ্য ছিটমহল নামকাওয়াস্তে মালিকানায় রেখে আমরা সেখানকার বসবাসকারীদের দুর্ভোগই দীর্ঘায়িত করছি। ছিটমহল প্রশ্নে তাঁর আগের ভূমিকা পরিবর্তনের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ধন্যবাদ জানাতে হয়।
এরপর আসছে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়টি। দেশের খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনাকালে তিনি এ বিষয়ে বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন। সবাইকে অনুরোধ জানিয়েছেন তাঁর প্রতি আস্থা রাখতে। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালেও তিনি জানিয়েছেন, উভয় দেশের স্বার্থরক্ষা করে তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিটিও শিগগিরই স্বাক্ষরিত হবে। তিনি তাঁকে নিরুদ্বেগ থাকার জন্যও পরামর্শ দিয়েছেন।
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে তিনি তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তির বিষয়ে ছিলেন অনমনীয়। এবার তাঁর বক্তব্য ভিন্নরূপ। স্মরণে রাখা দরকার, বাংলাদেশের চতুর্থ বৃহত্তম নদী তিস্তা পানির অভাবে শুকিয়ে যাচ্ছে। এখানে লক্ষ করার বিষয়, যেদিন তিনি এ দেশে আসেন, সেদিন তিস্তার পানিপ্রবাহ ছিল ১৬৫ কিউসেক। স্মরণকালের মধ্যে সর্বনিম্ন। নৌকাও চলে না। গত কয়েক বছর এই সময়ে ৩০০ থেকে ৪০০ কিউসেক পানি পাওয়া যেত। অথচ সেচসহ অন্য সব কাজের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজন সাড়ে তিন হাজার কিউসেক। বাংলাদেশ সফরকালে যদি কিছুটা বাড়তি পানি ছাড়তে তিনি নির্দেশ দিয়ে আসতেন, সেটা তাঁর আশ্বাসকে আরও অর্থবহ করত। তাঁকে বিশ্বাস করার আবেদনও হতো আরও জোরদার। পানি ছাড়তে তো আর চুক্তি লাগে না।
নদীমাতৃক দেশটির অর্থনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতিতে নদীর ভূমিকা ব্যাপক। ঠিক তেমনি তিস্তারও। অবশ্য এ ভূমিকা বাংলাদেশ ও ভারত উভয় দেশের। ভারতের সিকিম রাজ্যের হিমালয় পর্বতমালার এক হিমবাহ এর উৎস। দুই দেশ মিলিয়ে তিস্তার দৈর্ঘ্য ৩০৯ কিলোমিটার। বাংলাদেশে বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এটি ব্রহ্মপুত্রে মিলেছে। গোটা দেশটির ১৪ শতাংশ ফসলি জমি এর পলিবাহিত। প্রায় এক কোটি লোক নদীটির ওপর সরাসরি নির্ভরশীল। দেশের শতকরা ৭ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষের জীবন-জীবিকা নির্ভর করছে তিস্তার ওপর। ১৯৮৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের গজলডোবায় বাঁধ নির্মাণের আগ পর্যন্ত ফেব্রুয়ারির প্রথম দিকে এর প্রবাহ থাকত পাঁচ হাজার কিউসেকের অধিক। আর এখন? ইতিমধ্যে আলোচনা করা হয়েছে। বর্ষায় বাঁধ খুলে দেওয়া হয়। বন্যা আর নদীভাঙনের পুরো তোড় সামলাতে হয় বাংলাদেশের তিস্তাপারের মানুষকে।
একটি আন্তর্জাতিক নদীর পানির ওপর অধিকার এর অববাহিকার সব দেশের। আবার এর পানিপ্রবাহের ন্যূনতম ২০ শতাংশ নদীতেই রাখতে হয় চূড়ান্ত গতিপথ পর্যন্ত। নাব্যতা, নদীতে বসবাসরত প্রাণী ও তৃণতলার জীবনধারণের জন্য এই পানি দরকার। এটাকে বাদ দিয়েই নদীর পানি ভাগ করতে হয়। শুষ্ক মৌসুমে নেমে আসা পানি ধরে রেখে বিভিন্ন সংযোগ খালের মাধ্যমে সেচ দেওয়ার বিশাল একটি কার্যক্রম নিয়েছিল বাংলাদেশ। এর সুফলও মিলেছে। কিন্তু গত দু-তিন বছরে এক-চতুর্থাংশ জমিতেও সেচের পানি দেওয়া যায়নি। যেটুকু দেওয়া গেছে তা-ও অনিয়মিত। আর নদীর ভাগে কিছুই থাকেনি। এভাবে তিস্তা আর তিস্তাপারের মানুষ আজ বিপন্ন। তারা নদীর পানির ওপর তাদের ন্যায্য হিস্যা চায়।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এত দিন বলে এসেছিলেন যে তাঁর রাজ্যের উত্তরাঞ্চলে সেচের জন্য তিস্তার পানি দরকার। সেই প্রয়োজন মিটিয়ে ভাগাভাগির প্রশ্ন আসবে। পানি তাদের যতই দরকার হোক, আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়নীতির ভিত্তিতে ভাগাভাগি করে নিতে হবে। এখন তিনি বলছেন তাঁর ওপর আস্থা রাখতে। বলছেন, উভয় দেশের স্বার্থ রক্ষা করে পানি বণ্টন চুক্তি হবে।
এই বক্তব্যকে আমরা স্বাগত জানাই। তবে এখনকার বক্তব্য তাঁর আগের অবস্থান থেকে কতটা দূরে, তা ধরে নেওয়া খুব কঠিন। তাঁর রয়েছে একটি নির্বাচকমণ্ডলী। তিস্তার পানি নিয়ে গত কয়েক বছর তাদের মধ্যে তিনি আশাবাদ জাগিয়ে তুলেছেন। গজলডোবায় প্রাপ্ত প্রায় সব পানি এখন ব্যবহৃত হচ্ছে সেই অঞ্চলের সেচকাজে। সেখানে পানিপ্রবাহ বাড়াতে হলে সিকিম সরকার এবং কার্যত ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের শক্ত ভূমিকা দরকার। সিকিমে অনেকগুলো পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রের পানি ধরে রাখার পরিমাণকে নিয়ন্ত্রিত ও সীমিত করার আবশ্যকতা রয়েছে। সিকিম একটি জনবিরল রাজ্য। বিদ্যুতের চাহিদাও সেই রাজ্যে খুবই কম। উৎপাদিত হচ্ছে অন্য রাজ্যের প্রয়োজনে। সেখানে আন্তদেশীয় ন্যায়নীতির খাতিরে এমন কিছু একটা করা সংগত বলে বিবেচিত হবে।
আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক যে ২০০৯-এ মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে ভারতকে একতরফা বেশ কিছু সুবিধা দিয়েছে। সেগুলো যৌক্তিক। এমনকি কোনো স্থায়ী চুক্তি ছাড়াই ত্রিপুরায় মালামাল যাচ্ছে বাংলাদেশের মধ্য দিয়েই। নৌ প্রটোকলের মাধ্যমে যাচ্ছে আসামে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এসেছেন। আমরা অতীত ভুলে তাঁকে আপন করে সাদর সংবর্ধনা দিয়েছি। তবে ২০১১ সালে তাঁর জন্য যা সহজ ছিল, এখন তা কতটা সহজ হবে বোঝা মুশকিল। তখন বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গে সরকার গঠন করেছিলেন। ন্যায়নীতির ভিত্তিতে একটি সমঝোতায় তাঁর রাজ্যবাসীকে মানিয়ে নেওয়া অনেক সহজ ছিল বলে অনেকে মনে করেন।
২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। সেই নির্বাচন সামনে রেখে এখন তিনি কতটা করতে পারবেন, সে বিষয়ে সংশয়বাদী কেউ কেউ। তিনি তাঁর ওপর আস্থা রাখতে বলেছেন। আমরা না হয় রাখলাম। তবে বিষয়টি জরুরি। যুগ যুগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার নয়। সেই আস্থার ভিত জোরদার করতে একটি নদী ও নদীপারের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখাতে তাঁর প্রচেষ্টার দিকে সবার দৃষ্টি।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব।
majumder234@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.