লঞ্চডুবি- নৌপথের আহাজারি থামবে না?
মানিকগঞ্জের
পাটুরিয়া পয়েন্টের পদ্মায় রোববার দুপুরে সারবাহী কার্গোর ধাক্কায়
যাত্রীবাহী লঞ্চ এমভি মোস্তফা ডুবে নারী-শিশুসহ অন্তত ৭০ জনের মর্মান্তিক
মৃত্যুতে আমরা যেমন শোকাহত, তেমনই ক্ষুব্ধ। সোমবার সমকালে প্রকাশিত শীর্ষ
প্রতিবেদনে যথার্থই বলা হয়েছে_ চলমান অবরোধ-হরতাল ঘিরে বার্ন ইউনিটে
পেট্রোল বোমায় দগ্ধ মানুষের আহাজারির মধ্যে পদ্মাপাড় থেকে হঠাৎ এলো ভয়ঙ্কর
দুঃসংবাদ। আমরা নিহত ও নিখোঁজ লঞ্চযাত্রীদের পরিবার ও স্বজনের প্রতি গভীর
সমবেদনা জ্ঞাপন করছি। বস্তুত এই দুর্ঘটনার পর রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী,
সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা ও সংসদের বাইরে থাকা প্রধান বিরোধী দলের
চেয়ারপারসনের শোকবার্তার মধ্য দিয়ে গোটা জাতির মনোবেদনাই প্রকাশিত হয়েছে।
কিন্তু এই বেদনার মধ্যেও এতগুলো প্রাণের সলিলসমাধিতে আমাদের ক্ষোভ ঢাকা পড়ে
না। আমরা জানি, বাংলাদেশের বিস্তৃত নৌপথে প্রাকৃতিক কারণে জলযান
দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু নেহাত কম নয়। রোববার পদ্মায় যেভাবে লঞ্চটি ডুবে
গেছে, তা নিছক কার্গোচালক এবং এক অর্থে লঞ্চচালকেরও ঔদাসীন্যের ফল ছাড়া
কিছু নয়। সামান্য সতর্কতার সঙ্গে তারা যদি কার্গো ও লঞ্চটি চালাতেন, তাহলে
এভাবে পদ্মার তীরে স্বজন হারানো মানুষের আহাজারি আমাদের দেখতে হতো না।
আমাদের প্রশ্ন, নৌপথের যাত্রীরা এভাবে প্রাণ দিতেই থাকবে? আর কতদিন এভাবে
নদীপথে চলাচলকারী মানুষের হাহাকারে বাতাস ভারি হয়ে থাকবে? মৃতের সংখ্যা
বৃদ্ধির একটি কারণ, লঞ্চটিতে অতিরিক্ত যাত্রী। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম সূত্রে
জানা যাচ্ছে, লঞ্চটির ধারণক্ষমতা ১৪০ জন হলেও সেখানে দুই শতাধিক যাত্রী
ছিল। ছোট্ট লঞ্চে এত যাত্রী স্বভাবতই ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। এর ওপর
কার্গোর ধাক্কা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটিয়েছে। চালক দু'জন ও তাদের সহকারীরা
কি প্রশিক্ষিত ছিলেন? আমরা জানতে চাইব। যদি তদন্তে লঞ্চটির ফিটনেস না
থাকার অভিযোগ প্রমাণিত হয়, তা হবে আরও দুর্ভাগ্যজনক। এবার যেভাবে নৌ
মন্ত্রণালয়, অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তরের
পক্ষে তিনটি পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, তা নতুন নয়। আমাদের প্রশ্ন
হচ্ছে, এ ধরনের তদন্ত কমিটি এর আগে দুর্ঘটনার কারণ চিহ্নিত করে যেসব
সুপারিশ করেছে, সেগুলো কতটা বাস্তবায়িত হয়েছে? মন্দের ভালো হিসেবে আমরা আশা
করি, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা দেওয়ার জন্য সাত থেকে পনের দিনের যে
সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়েছে, আগের নজির অনুসরণ করে তা আর বাড়ানো হবে না।
তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন জমা না দেওয়া বা না প্রকাশের বিষয়টিও আরও
অগ্রহণযোগ্য। একই সঙ্গে তদন্ত কমিটির দেওয়া সুপারিশ বাস্তবায়নেরও সময়সীমা
বেঁধে দেওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। এক একটি লঞ্চ দুর্ঘটনার পর প্রশাসনের
কর্তা ব্যক্তিরা যেভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে সংবাদমাধ্যমের কাছে তদন্ত
কমিটি গঠনের ঘোষণা দেন, একইভাবে ওইসব তদন্ত কমিটির করা সুপারিশ বাস্তবায়নের
খবরও যদি আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদমাধ্যমকে জানাতে পারেন, তা হবে যথার্থ
দায়িত্বশীলতা। অবশ্য প্রায় সব তদন্ত কমিটির কাছ থেকে আমরা অভিন্ন কিছু
সুপারিশ পেয়ে থাকি_ ধারণক্ষমতার বেশি যাত্রী পরিবহন, ফিটনেস সনদ না থাকা,
চালকের অদক্ষতা ইত্যাদি। এসব বিষয়ে নজরদারি থাকলেই লঞ্চ দুর্ঘটনা অনেকাংশে
এড়ানো যায় বলে বিশেষজ্ঞরা বারবার বলে আসছেন। কিন্তু সংশ্লিষ্টরা এ ব্যাপারে
ব্যবস্থা নিচ্ছেন না কেন? বর্তমান সরকার যখন নৌপথ ব্যবস্থাপনার দিকে নতুন
করে দৃষ্টি দিয়েছে, তখন নিরাপত্তার প্রশ্নটি সর্বাগ্রে বিবেচনা করতে হবে।
সে ক্ষেত্রে পাটুরিয়ার লঞ্চ দুর্ঘটনাটিই নৌপথের বেদনার শেষ অধ্যায় হোক,
আমরা প্রত্যাশা করি।
No comments