২১ ঘণ্টা পর মান্নাকে ডিবিতে হস্তান্তর
দিনভর
নাটকীয়তার পর রাতে নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে গোয়েন্দা
পুলিশের কাছে হস্তান্তর করেছে র্যাব। রাতে গুলশান থানায় তার বিরুদ্ধে
রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়েছে। ১৩১ ধারায় দায়ের করা মামলায় সেনা উস্কানির
অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলাটি দায়ের করেন গুলশান থানার অপারেশন অফিসার সোহেল
রানা। এদিকে রাতে মান্নাকে পুলিশের কাছে হস্তান্তরের কথা বলা হলেও তার
সাক্ষাৎ পাননি স্বজনরা। এমনকি গণমাধ্যমের কর্মীরাও তাকে দেখতে পাননি। সূত্র
জানায়, থানায় হস্তান্তরের কথা বলা হলেও তাকে সরাসরি গোয়েন্দা কার্যালয়ে
নেয়া হয়। তাকে কখন কোথা থেকে আটক করা হয়েছে এ বিষয়ে র্যাব বা পুলিশের পক্ষ
থেকে স্পষ্ট কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি। রাত দুইটা পর্যন্ত গোয়েন্দা
কার্যালয়ের ফটকে মান্নার স্ত্রী মেহের নিগার ও মেয়ে অবস্থান করছিলেন। মেহের
নিগার জানান, গণমাধ্যমে খবর দেখে প্রথমে থানায় গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে
জানতে পারি ডিবি কার্যালয়ে নেয়া হয়েছে। এখানে এসে যোগাযোগ করেছিলাম। কেউ
কিছু বলতে পারেনি। পরে তারা আবার গুলশান থানায় যান। রাত আড়াইটা পর্যন্ত
তারা সেখানে অবস্থান করেন। এদিকে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, মান্নাকে আজ
আদালতে হাজির করে রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করা হবে।
সোমবার গভীর রাতে ডিবি পরিচয়ে রাজধানীর বনানীর এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তুলে নেয়া হয় মাহমুদুর রহমান মান্নাকে। গতকাল মধ্যরাত পর্যন্ত তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মান্নাকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও। আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মান্নার সন্ধান চেয়ে বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন তার ভাইয়ের স্ত্রী। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও মান্না নিখোঁজ বলে খবর প্রকাশ হয়। মান্নার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, রাতে ভাতিজির বাসা থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য পরিচয় দিয়ে একটি সাদা রঙের গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, মান্নাকে পুলিশ আটক করেনি। তাকে অন্য কোন সংস্থা আটক করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিএনপির এক নেতা ও অজ্ঞাত এক ব্যক্তির সঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্নার ফোনালাপের রেকর্ড প্রচারের পর থেকে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া আসে। অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে অন্তত ৩০টি জিডি করা হয়। তাকে গণধোলাই দেয়ার হুমকি দেয় ছাত্রলীগ। এছাড়া মান্নাকে গ্রেপ্তারের দাবি উঠে সংসদ ও মন্ত্রিসভায়। ফোনালাপের বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে সংবাদ সম্মেলন করার ঘোষণা দিলেও তার আগেই তাকে বাসা থেকে তুলে নেয়া হয়।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল বেলা সাড়ে ১২টার দিকে থানায় এ ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং ১০৮১) করতে যান মাহমুদুর রহমান মান্নার মেজো ভাই মোবায়েদুর রহমানের স্ত্রী বেগম সুলতানা। সঙ্গে মান্নার ভাতিজি শাহনামা শারমিনও ছিলেন। জিডির অভিযোগে বেগম সুলতানা বলেন, রাত ১১টার দিকে মান্না তার মেয়ে শাহনামা শারমিনের বনানীর ১৭/এ রোডের ১২ নম্বর বাসায় আসেন। রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টার দিকে অজ্ঞাতনামা কয়েক ব্যক্তি নিজেদের সাদা পোশাকের পুলিশ পরিচয় দিয়ে দরজায় নক করে এবং দরজা খুলতে বলে। তারা দাবি করেন, বাসায় মাহমুদুর রহমান মান্না আছেন এবং তাকে বের হয়ে আসতে বলেন। তখন আমার মেয়ের জামাই মোহাম্মদ আলী রুমি তাদের সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু ডিবি পরিচয়ধারীরা সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন না বলে জানান। প্রয়োজনে তারা দরজা ভেঙ্গে প্রবেশ করার হুমকি দিলে রুমি দরজা খুলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে ৪-৫ জন লোক ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। মান্না বেডরুম থেকে বের হয়ে এলে ঘরে প্রবেশকারীরা মান্নাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলেন। এরপর মান্না তাদের সঙ্গে সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে উঠেন। মাইক্রোবাসটি পশ্চিমে বনানী মসজিদের দিকে চলে যায়। বেগম সুলতানা আরও বলেন, ভোর রাত পৌনে ৫টার দিকে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের স্ক্রল দেখে আমরা নিশ্চিত হই যে মান্না ডিবি পুলিশের হেফাজতে আছেন। কিন্তু সকাল ৯টার দিকে টিভি চ্যানেলের স্ক্রলের মাধ্যমে জানতে পারি মান্নার আটকের বিষয়টি ডিবি পুলিশ অস্বীকার করেছে। এরপর আমরা বিভিন্ন জায়গায় তার সন্ধানে যাই। দ্রুত তার প্রকৃত অবস্থান জানতে ও উদ্ধারের জন্য আমরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি লিপিবদ্ধ করি।
মান্নার বড় ভাইয়ের মেয়ে শাহনামা শারমিন জানান, সোমবার রাত ১১টার দিকে মাহমুদুর রহমান মান্না তার বাসায় যান। রাতে তার সঙ্গে তেমন কোন কথা হয়নি। কিছুক্ষণ টেলিভিশন দেখে ও চা খেয়ে তিনি ঘুমিয়ে যান। রাত সাড়ে ৩টার দিকে সাদা পোশাকধারী পুলিশ পরিচয়ে তাকে আটক করতে আসে। কিন্তু ওই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তাদের নাম বলেনি। তার স্বামী রুমি মান্নার সঙ্গে যেতে চাইলে ডিবি পুলিশ পরিচয়দানকারীরা অস্বীকৃতি জানায়। তারা বলে, মান্নার সঙ্গে কেউ গেলে তার সমস্যা হবে।
মান্নার স্ত্রী মেহের নিগার বলেন, সিভিল ড্রেসে আসা লোকজন তাকে (মান্নাকে) জোর করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। তিনি কোথায় আছেন আমরা জানতে চাই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে আটক করলে আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় যাব। তিনি বলেন, মান্নাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় ডিবি পরিচয়ধারীরা কোন পরোয়ানা দেখাতে পারেনি। মান্নার ভাই মোবায়দুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বনানীর মতো একটি এলাকা থেকে মান্নার মতো একজনকে কীভাবে নিয়ে যাওয়া হলো, এটা বিস্ময়ের ব্যাপার।’ তিনি বলেন, প্রথমে তারা ভেবেছিলেন মান্নাকে ডিবি পুলিশ নিয়ে গেছে। তারা একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে। তাই তাদের শঙ্কা ছিল না। কিন্তু যখন তারা সকালে টেলিভিশনে দেখতে পেলেন পুলিশ বলছে, ডিবি মান্নাকে নেয়নি। তখন সতর্ক হয়ে থানায় জিডি করেছেন বলে তিনি জানান।
‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করেছে’: এদিকে সকাল ১১টার দিকে মাহমুদুর রহমান মান্নার বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ ও তার সন্ধানের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে নাগরিক ঐক্য। মান্নাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই আটক করেছে বলে দাবি করেন নাগরিক ঐক্যের নেতারা। এজন্য দলটির পক্ষ থেকে অতি শিগগিরই আইনের আশ্রয় নেয়া হবে বলে জানানো হয়। গতকাল দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের তৃতীয় তলায় নাগরিক ঐক্যের পক্ষে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইফতেখার আহমেদ বাবু। বাবু বলেন, মান্নাকে আটক ও পরে অস্বীকার করার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। উনি রাষ্ট্রদ্রোহী কিছু করে থাকলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হোক। কিন্তু এভাবে আটক ও পরে অস্বীকারের ঘটনায় আমরা চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। তিনি আরও বলেন, টেলিফোনে কি কথোপকথন হয়েছে তা আমরা সবাই জানি। মান্না নিজেও অস্বীকার করেননি। এই বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যমে উনার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নষ্ট করা হয়েছে। যার যার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মান্নার বক্তব্য বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইফতেখার আহমেদ বলেন, আমরা খুব খুশি হতাম যদি সরকার উনাকে আটক না করে তার বক্তব্য খণ্ডনের সুযোগ করে দিত। কিন্তু সরকার তা না করে আরও ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছে। একজন নাগরিক সেনাবাহিনীর সঙ্গে রাষ্ট্র নিয়ে কথা বলতে পারে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে বাবু বলেন, সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্যদের সঙ্গে তো আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রতিদিনই কথা বলছে। রাজনীতির প্রয়োজনে সবার সঙ্গে কথা বলা দরকার। এখানে উনি রাষ্ট্রদ্রোহী কিছু বলেননি। এর সঙ্গে এক-এগারোর বা অন্য কোন ষড়যন্ত্রের আবিষ্কার দূরভিসন্ধিমূলক। বাবু আরও বলেন, উনি অন্যায় করলে আপনাদের সামনে প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দিতেন না। উনার মধ্যে সৎ সাহস ছিল বলেই, উনি প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করতে চেয়েছিলেন। উনি একজন বিশিষ্ট নাগরিক। উনাকে কেন অন্ধকারে রাখা হচ্ছে। উনার পরিবারসহ আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। তিনি আরও বলেন, আমরা সবসময় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে। এ লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। এ সময় কারও চরিত্র হননের উদ্দেশ্য সঙ্কটকে ঘনীভূত করা। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জিন্নুর রহমান চৌধুরী দিপু, আতিকুর রহমান আতিক, আবু বকর সিদ্দিক, গাজী শফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
মান্নাকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি বিএনপির
মাহমুদুর রহমান মান্নাকে অবিলম্বে তার পরিবারের কাছে ফেরত দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ এ দাবি জানান। বিবৃতিতে তিনি বলেন, দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, বরেণ্য নাগরিক, ডাকসু’র সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সোমবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে সাদা পোশাকধারী সরকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়নি মর্মে বক্তব্য দেয়ায় আমরা বিস্মিত হয়েছি। যে প্রক্রিয়ায় দেশের এই পর্যায়ের একজন নাগরিককে তুলে নেয়া হলো তাতে রাষ্ট্রের কোন নাগরিকের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার এবং বেঁচে থাকার অধিকারের কোন গ্যারান্টি অবশিষ্ট রইল না। আমরা সাংবিধানিক, মৌলিক ও মানবাধিকারকে চূড়ান্ত লঙ্ঘন করে সরকারি বাহিনীর এহেন ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। অবিলম্বে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে তার পরিবারের কাছে ফেরত দেয়া ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানাচ্ছি। ভবিষ্যতে সরকারকে এ জাতীয় ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার জন্যও আহবান জানাচ্ছি।
সোমবার গভীর রাতে ডিবি পরিচয়ে রাজধানীর বনানীর এক আত্মীয়ের বাসা থেকে তুলে নেয়া হয় মাহমুদুর রহমান মান্নাকে। গতকাল মধ্যরাত পর্যন্ত তার কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মান্নাকে আটকের বিষয়টি অস্বীকার করায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা। এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও। আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মান্নার সন্ধান চেয়ে বনানী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন তার ভাইয়ের স্ত্রী। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও মান্না নিখোঁজ বলে খবর প্রকাশ হয়। মান্নার পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছেন, রাতে ভাতিজির বাসা থেকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য পরিচয় দিয়ে একটি সাদা রঙের গাড়িতে করে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সকালে ঢাকা মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ও ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, মান্নাকে পুলিশ আটক করেনি। তাকে অন্য কোন সংস্থা আটক করেছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিএনপির এক নেতা ও অজ্ঞাত এক ব্যক্তির সঙ্গে মাহমুদুর রহমান মান্নার ফোনালাপের রেকর্ড প্রচারের পর থেকে সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া আসে। অল্প সময়ের ব্যবধানে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে অন্তত ৩০টি জিডি করা হয়। তাকে গণধোলাই দেয়ার হুমকি দেয় ছাত্রলীগ। এছাড়া মান্নাকে গ্রেপ্তারের দাবি উঠে সংসদ ও মন্ত্রিসভায়। ফোনালাপের বিষয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করতে সংবাদ সম্মেলন করার ঘোষণা দিলেও তার আগেই তাকে বাসা থেকে তুলে নেয়া হয়।
পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গতকাল বেলা সাড়ে ১২টার দিকে থানায় এ ঘটনায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং ১০৮১) করতে যান মাহমুদুর রহমান মান্নার মেজো ভাই মোবায়েদুর রহমানের স্ত্রী বেগম সুলতানা। সঙ্গে মান্নার ভাতিজি শাহনামা শারমিনও ছিলেন। জিডির অভিযোগে বেগম সুলতানা বলেন, রাত ১১টার দিকে মান্না তার মেয়ে শাহনামা শারমিনের বনানীর ১৭/এ রোডের ১২ নম্বর বাসায় আসেন। রাত আনুমানিক সাড়ে ৩টার দিকে অজ্ঞাতনামা কয়েক ব্যক্তি নিজেদের সাদা পোশাকের পুলিশ পরিচয় দিয়ে দরজায় নক করে এবং দরজা খুলতে বলে। তারা দাবি করেন, বাসায় মাহমুদুর রহমান মান্না আছেন এবং তাকে বের হয়ে আসতে বলেন। তখন আমার মেয়ের জামাই মোহাম্মদ আলী রুমি তাদের সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলেন। কিন্তু ডিবি পরিচয়ধারীরা সকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন না বলে জানান। প্রয়োজনে তারা দরজা ভেঙ্গে প্রবেশ করার হুমকি দিলে রুমি দরজা খুলে দেন। সঙ্গে সঙ্গে ৪-৫ জন লোক ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে। মান্না বেডরুম থেকে বের হয়ে এলে ঘরে প্রবেশকারীরা মান্নাকে তাদের সঙ্গে যেতে বলেন। এরপর মান্না তাদের সঙ্গে সাদা রঙের একটি মাইক্রোবাসে উঠেন। মাইক্রোবাসটি পশ্চিমে বনানী মসজিদের দিকে চলে যায়। বেগম সুলতানা আরও বলেন, ভোর রাত পৌনে ৫টার দিকে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের স্ক্রল দেখে আমরা নিশ্চিত হই যে মান্না ডিবি পুলিশের হেফাজতে আছেন। কিন্তু সকাল ৯টার দিকে টিভি চ্যানেলের স্ক্রলের মাধ্যমে জানতে পারি মান্নার আটকের বিষয়টি ডিবি পুলিশ অস্বীকার করেছে। এরপর আমরা বিভিন্ন জায়গায় তার সন্ধানে যাই। দ্রুত তার প্রকৃত অবস্থান জানতে ও উদ্ধারের জন্য আমরা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি লিপিবদ্ধ করি।
মান্নার বড় ভাইয়ের মেয়ে শাহনামা শারমিন জানান, সোমবার রাত ১১টার দিকে মাহমুদুর রহমান মান্না তার বাসায় যান। রাতে তার সঙ্গে তেমন কোন কথা হয়নি। কিছুক্ষণ টেলিভিশন দেখে ও চা খেয়ে তিনি ঘুমিয়ে যান। রাত সাড়ে ৩টার দিকে সাদা পোশাকধারী পুলিশ পরিচয়ে তাকে আটক করতে আসে। কিন্তু ওই অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিরা তাদের নাম বলেনি। তার স্বামী রুমি মান্নার সঙ্গে যেতে চাইলে ডিবি পুলিশ পরিচয়দানকারীরা অস্বীকৃতি জানায়। তারা বলে, মান্নার সঙ্গে কেউ গেলে তার সমস্যা হবে।
মান্নার স্ত্রী মেহের নিগার বলেন, সিভিল ড্রেসে আসা লোকজন তাকে (মান্নাকে) জোর করে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যায়। তিনি কোথায় আছেন আমরা জানতে চাই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাকে আটক করলে আমরা আইনি প্রক্রিয়ায় যাব। তিনি বলেন, মান্নাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় ডিবি পরিচয়ধারীরা কোন পরোয়ানা দেখাতে পারেনি। মান্নার ভাই মোবায়দুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘বনানীর মতো একটি এলাকা থেকে মান্নার মতো একজনকে কীভাবে নিয়ে যাওয়া হলো, এটা বিস্ময়ের ব্যাপার।’ তিনি বলেন, প্রথমে তারা ভেবেছিলেন মান্নাকে ডিবি পুলিশ নিয়ে গেছে। তারা একটি প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে। তাই তাদের শঙ্কা ছিল না। কিন্তু যখন তারা সকালে টেলিভিশনে দেখতে পেলেন পুলিশ বলছে, ডিবি মান্নাকে নেয়নি। তখন সতর্ক হয়ে থানায় জিডি করেছেন বলে তিনি জানান।
‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আটক করেছে’: এদিকে সকাল ১১টার দিকে মাহমুদুর রহমান মান্নার বিরুদ্ধে অপপ্রচার বন্ধ ও তার সন্ধানের দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে নাগরিক ঐক্য। মান্নাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীই আটক করেছে বলে দাবি করেন নাগরিক ঐক্যের নেতারা। এজন্য দলটির পক্ষ থেকে অতি শিগগিরই আইনের আশ্রয় নেয়া হবে বলে জানানো হয়। গতকাল দুপুরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের তৃতীয় তলায় নাগরিক ঐক্যের পক্ষে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ইফতেখার আহমেদ বাবু। বাবু বলেন, মান্নাকে আটক ও পরে অস্বীকার করার ঘটনায় আমরা উদ্বিগ্ন। উনি রাষ্ট্রদ্রোহী কিছু করে থাকলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনা হোক। কিন্তু এভাবে আটক ও পরে অস্বীকারের ঘটনায় আমরা চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। তিনি আরও বলেন, টেলিফোনে কি কথোপকথন হয়েছে তা আমরা সবাই জানি। মান্না নিজেও অস্বীকার করেননি। এই বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যমে উনার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা নষ্ট করা হয়েছে। যার যার উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মান্নার বক্তব্য বিকৃতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। ইফতেখার আহমেদ বলেন, আমরা খুব খুশি হতাম যদি সরকার উনাকে আটক না করে তার বক্তব্য খণ্ডনের সুযোগ করে দিত। কিন্তু সরকার তা না করে আরও ধূম্রজাল সৃষ্টি করেছে। একজন নাগরিক সেনাবাহিনীর সঙ্গে রাষ্ট্র নিয়ে কথা বলতে পারে কি না এমন প্রশ্নের উত্তরে বাবু বলেন, সেনাবাহিনীর সাবেক সদস্যদের সঙ্গে তো আওয়ামী লীগ-বিএনপি প্রতিদিনই কথা বলছে। রাজনীতির প্রয়োজনে সবার সঙ্গে কথা বলা দরকার। এখানে উনি রাষ্ট্রদ্রোহী কিছু বলেননি। এর সঙ্গে এক-এগারোর বা অন্য কোন ষড়যন্ত্রের আবিষ্কার দূরভিসন্ধিমূলক। বাবু আরও বলেন, উনি অন্যায় করলে আপনাদের সামনে প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের ঘোষণা দিতেন না। উনার মধ্যে সৎ সাহস ছিল বলেই, উনি প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করতে চেয়েছিলেন। উনি একজন বিশিষ্ট নাগরিক। উনাকে কেন অন্ধকারে রাখা হচ্ছে। উনার পরিবারসহ আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। তিনি আরও বলেন, আমরা সবসময় গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষে। এ লক্ষ্যেই আমরা কাজ করছি। এ সময় কারও চরিত্র হননের উদ্দেশ্য সঙ্কটকে ঘনীভূত করা। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য জিন্নুর রহমান চৌধুরী দিপু, আতিকুর রহমান আতিক, আবু বকর সিদ্দিক, গাজী শফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
মান্নাকে ফিরিয়ে দেয়ার দাবি বিএনপির
মাহমুদুর রহমান মান্নাকে অবিলম্বে তার পরিবারের কাছে ফেরত দেয়ার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। গতকাল গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে দলের যুগ্ম মহাসচিব সালাহউদ্দিন আহমেদ এ দাবি জানান। বিবৃতিতে তিনি বলেন, দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ, বরেণ্য নাগরিক, ডাকসু’র সাবেক ভিপি ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্নাকে সোমবার রাত সাড়ে ৩টার দিকে সাদা পোশাকধারী সরকারি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই তুলে নিয়ে যায়। কিন্তু পুলিশের পক্ষ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়নি মর্মে বক্তব্য দেয়ায় আমরা বিস্মিত হয়েছি। যে প্রক্রিয়ায় দেশের এই পর্যায়ের একজন নাগরিককে তুলে নেয়া হলো তাতে রাষ্ট্রের কোন নাগরিকের মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার এবং বেঁচে থাকার অধিকারের কোন গ্যারান্টি অবশিষ্ট রইল না। আমরা সাংবিধানিক, মৌলিক ও মানবাধিকারকে চূড়ান্ত লঙ্ঘন করে সরকারি বাহিনীর এহেন ঘৃণ্য কর্মকাণ্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। অবিলম্বে মাহমুদুর রহমান মান্নাকে তার পরিবারের কাছে ফেরত দেয়া ও দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেয়ার দাবি জানাচ্ছি। ভবিষ্যতে সরকারকে এ জাতীয় ঘৃণ্য কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকার জন্যও আহবান জানাচ্ছি।
No comments