পিলখানার শহীদগণের প্রতি শ্রদ্ধা by সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বীর প্রতীক
১৩
এপ্রিল ১৬৯৯ হচ্ছে শিখ ধর্মের অন্যতম পবিত্র ব্যক্তিত্ব গুরু গেবিন্দ সিং
কর্তৃক খালসা-পান্থ প্রতিষ্ঠার দিন। একই ১৩ এপ্রিল, প্রতি বছর
পাঞ্জাবি-নববর্ষ উপলক্ষে পবিত্র বৈশাখী ছুটির দিন হিসেবে শিখ ধর্মাবলম্বীরা
পালন করতেন। ওই ধারাবাহিকতায় ১৯১৯ সালের ১৩ এপ্রিল তারিখেও সাধারণ মানুষের
একটি মিলন মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। স্থান আনুমানিক ২২৫ মিটার দীর্ঘ ও ১৮০
মিটার প্রস্থ একটি দেয়ালঘেরা শূন্য বাগান যার নাম ছিল জালিয়ানওয়ালাবাগ,
অমৃতসর নগরী, পাঞ্জাব রাজ্য, ব্রিটিশ ভারত। ওই দিন শত শত নিরস্ত্র নিরপরাধ
মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। হত্যা করা হয়েছিল ব্রিগেডিয়ার আর ই এইচ ডায়ারের
(ভিন্ন পরিচিতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রেগিনাল্ড ডায়ার) হুকুমে। ১৯৫১ সালে
ভারত সরকার একটি আইন পাস করে এবং ওই আইনের অনুসরণে ওই জালিয়ানওয়ালাবাগে
একটি স্মৃতিসৌধ বা মনুমেন্ট নির্মাণ করা হয়েছিল ১৯১৯ সালের নিহতদের স্মরণে।
ওই আমলের সরকারি ইনকোয়ারি মোতাবেক নিহতের সংখ্যা ছিল ৩৭৯; নাগরিকদের
ইনকোয়ারি মোতাবেক নিহত ছিল এক হাজারের অধিক। ব্রিগেডিয়ার ডায়ার কোনো দিন
অনুতপ্ত হননি। তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে এইরূপ গল্প ফেঁদেছিলেন : ওই পার্কে
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মিটিং হচ্ছে দেখে তিনি আন্দোলনকারীদের দমন করার
জন্য অস্ত্র থেকে গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
এই কলামটি শুরু করেছি একটি লোমহর্ষক নির্দয় ঘটনার বিবরণ দিয়ে। ২৫ ফেব্রয়ারি ২০০৯ তারিখে ঢাকা মহানগরীর পিলখানায় অনুরূপ একটি লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার সাথে মিল এবং অমিল দুইটাই আছে। ওই সময় বিডিআর-সপ্তাহ চলছিল। এ উপলে একাধিক অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবগুলোতে থাকেননি। বিডিআর সপ্তাহ উপলে সারা দেশ থেকে বিডিআরের সব জ্যেষ্ঠ অফিসার একত্র হয়েছিলেন সপরিবারে। ২৫ ফেব্র“য়ারি সকালবেলা, পিলখানায় অবস্থিত বিডিআরের বিখ্যাত দরবার হলে ডাইরেক্টর জেনারেল মহোদয়ের দরবার অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। অর্থাৎ সব অফিসার এবং জেসিও আর সৈনিক একখানে সম্মিলিত থাকবে। অর্থাৎ রূপক অর্থে : একটি খাঁচার মধ্যেই সব মুরগি অথবা একটি মাটির হাঁড়ির মধ্যেই সব ডিম। অতএব ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য একটি মোম সময়। পিলখানায় নিহতদের (অর্থাৎ শহীদদের) সংখ্যা সঠিকভাবে আবিষ্কার হয়েছে কিন্তু হত্যাকারীর নাম-ধাম সুস্পষ্টভাবে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপিত হয়নি। তাই ধোঁয়াশা বিদ্যমান। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালেও পিলখানায় একটি বিদ্রোহ হয়েছিল। ৭২-এর বিদ্রোহ এত লোমহর্ষক ছিল না। তাই কিছুটা প্রেক্ষাপট বর্ণনাসহ পিলখানার ২০০৯ সালের ঘটনার স্মরণ করছি। সর্বাগ্রে সামরিক ও বেসামরিক তথা সব শহীদ অফিসার, জেসিও, সৈনিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাচ্ছি। ওই দিনের ঘটনাবলি সম্বন্ধে, বিবিধ প্রকারের সংপ্তি রচনা, শহীদদের নামের তালিকা, মূল্যায়নমূলক রচনা, ছবি, শোকবার্তা ইত্যাদি অনেক জায়গায় লিপিবদ্ধ বা সংরক্ষিত আছে। একটি তাৎক্ষণিক রেফারেন্স বা লিংক এখানে দিলাম আগ্রহীদের জন্য। http://www.goodnewsbd.com/bdr এই লিংকের বক্তব্যগুলো নভেম্বর ২০১৩-এর পরে আপডেট বা যোগ-বিয়োগ করা হয়নি। করা না হলেও মূল বক্তব্য বা তথ্যের চেতনা একই।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বহুলাংশেই যুগপৎ বর্তমান ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বর্তমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামোর আদলে গঠিত। এই মুহূর্তে পৃথিবীর যেসব দেশ কোনো-না-কোনো কালে যুক্তরাজ্য বা ব্রিটেন বা ইংল্যান্ডের উপনিবেশ ছিল, তাদের সবার সম্মিলিত আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সংগঠনের নাম ব্রিটিশ কমনওয়েলথ অব নেশনস। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের ১৪ ও ১৫ তারিখ পাকিস্তান ও ভারতকে ইংল্যান্ডের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা দেয়া হয়। ওই দু’টি দিনের আগে ভারতীয় উপমহাদেশে তথা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় যেই সেনাবাহিনী ছিল সেটি ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি। সেই ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির জনবল এবং স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যথাসম্ভব পরিকল্পিতভাবে ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম ও অগোছালো ব্যবস্থাপনা ল করা গেলেও সামগ্রিকভাবে ওই সম্পদ বণ্টন নিয়ে কোনো যুদ্ধ হয়নি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তানি বাহিনীর পরিত্যক্ত স্থাবর ও অস্থাবর সব সম্পদ নিয়েই যাত্রা শুরু।
নবীন বাংলাদেশের নবীন সেনাবাহিনী নিজের নিয়মে এগিয়ে যায়। পাকিস্তান আমল থেকে প্রচলিত অনেক রেওয়াজ ও ঘটনার ধারাবাহিকতা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ধারণ করতে শুরু করে। এ রকম অন্যতম একটি রেওয়াজ ছিল সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর (অথবা অপর ভাষায় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী) কমান্ড এবং কন্ট্রোল তথা নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাবাহিনীর অফিসারদের ব্যবহার করা। প্রতিরা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসাররাকে ডেপুটেশন বা প্রেষণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিডিআরে কর্তব্য পালনের জন্য পাঠানো হতো। পাকিস্তান আমলে যেমন, বাংলাদেশ আমলেও, দেশের ভৌগোলিক নিরাপত্তার জন্য প্রতিরার প্রথম ধাপ ছিল বিডিআর। সেই বিডিআর যেন সেনাবাহিনীর সাথে মিলেমিশে একই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অবদান রাখতে পারে, তার জন্যই অপরিহার্য ছিল যে, বিডিআরের কমান্ড সেনাবাহিনীর কমিশনড অফিসারদের ওপর ন্যস্ত থাকবে। আজকাল মোবাইল ফোনের যুগ, নেটওয়ার্ক ও ফ্রিকোয়েন্সি নামক শব্দ দুটি মোটামুটিভাবে শিক্ষিত সবার কাছে অতি পরিচিত। এটি শুধু টেলিযোগ বা বেতার যন্ত্রের যোগাযোগের জন্য প্রযোজ্য নয়, মনের চিন্তাশক্তি ও সেই চিন্তা প্রকাশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিডিআরের কমান্ড যদি এমন কোনো প্রকৃতির অফিসারের ওপর ন্যস্ত হয় যাদের লেখাপড়া বা প্রশিণ এবং পেশাগত চিন্তা সেনাবাহিনী থেকে ভিন্ন, তাহলে বাংলাদেশের বৃহত্তর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক ও ফ্রিকোয়েন্সি মিলবে না। এটা বাস্তবতা হলেও এর বিরুদ্ধে একটি মহল সব সময় দুশ্চিন্তায় থেকেছে।
১৯৭২-৭৩ সালে একাধিকবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বিডিআরকে সীমান্তে চোরাচালান রোধ এবং অনুরূপ কর্মে নিয়োজিত করা হয়। সেই সময়ের ঘটনাবলি ইতিহাস সাী দেয় যে, কর্তব্যে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর অফিসার ও বিডিআরের সেনা অফিসাররা অসুবিধায় পড়তেন তখনকার আমলের সরকারি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে। বাগে আনতে না পেরে একাধিক সেনা অফিসারকে সেই সময় বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছিল। অতঃপর তৎকালীন সরকার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনাটি ছিল যে, বিডিআরের জন্য আলাদা একটি ক্যাডার সৃষ্টি করা হবে। এই মর্মে অফিসারও গ্রহণ করা হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রক্রিয়াও এগিয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ের বাংলাদেশের ইতিহাস যদি পাঠক, (যদি পাঠকের বয়সে কুলায়) নিজের স্মৃতিতে আনেন তাহলে খেয়াল করবেন যে, জাতীয় রক্ষীবাহিনী নামক একটি নতুন আধা সরকারি বাহিনীও সরকারের পূর্ণাঙ্গ পৃষ্ঠপোষকতায় অতি দ্রুত কলেবরে বৃদ্ধি হচ্ছিল। অফিসিয়ালি নয়, কিন্তু মানসিকভাবে এবং চিন্তা-চেতনায়, রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর প্রতিযোগী এবং ভবিষ্যতের বিকল্প মনে করা হতো। রক্ষীবাহিনীতে সর্বোচ্চপর্যায়ে শুধু চারজন সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন, বাকি ১০০-এর বেশি অফিসারই ছিলেন রক্ষীবাহিনীর নিজস্ব ক্যাডার। অর্থাৎ ওই আমলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব ও সংহতি বহুমুখী আক্রমণের শিকার হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে অনেক নিবিড় প্রচেষ্টার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারকে কোনোমতে বোঝানো সম্ভব হয়েছিল যে, বিডিআরের জন্য নিজস্ব অফিসার-ক্যাডার সৃষ্টি করা একটি মারাত্মক ক্ষতিকারক তথা আত্মঘাতী পদপে ছিল।
২৫-২৬ ফেব্র“য়ারি ২০০৯ সাল পিলখানা বিডিআর সদর দফতরের নারকীয় ঘটনাটি পুরো জাতির জন্য এক শোকাবহ দিন। কারণ ছয় বছর আগে ফেব্র“য়ারিতে পিলখানায় বাংলাদেশের ইতিহাসের তথা পৃথিবীর সামরিক ইতিহাসে একটি অন্যতম জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের ফলে নৃশংসভাবে নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অত্যন্ত মেধাবী তরুণ বা মধ্যবয়সী ৫৭ জন কর্মকর্তা। ঘটনাটি এ দেশের মানুষের চোখের সামনে এখনো ভেসে আছে। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত ছিল ওই আমলের বিডিআরের কিছু সংখ্যক ষড়যন্ত্রকারী জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ সৈনিক। দেশের ভেতরের বা বাইরের প্ররোচনাদাতা বা উৎসাহদাতা অবশ্যই ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি, কিন্তু তাদের পরিচয় আজো উন্মোচিত হয়নি। ওই ষড়যন্ত্রের রহস্য ও নেপথ্য কাহিনী উদঘাটন হওয়া এবং জাতির সামনে উপস্থাপিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
এই ন্যক্কারজনক ঘটনাটির ধারাবাহিকতায় আরো অনেকবার চেষ্টা করা হয়েছে, অফিসারদের বিরুদ্ধে কিছু করার তথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করার। কুচক্রীরা সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে তেমন কিছু করতে না পারলেও ২০০৯ সালে এসে বিডিআরে সেই ঘটনাটি ঘটাতে সম হয়। বিডিআরের সাধারণ সৈনিকদের কেউ-না-কেউ মন্দ উদ্দেশ্যে প্ররোচিত ও উৎসাহিত করেছে যে, সেনাবাহিনীর অফিসারদের মারতে হবে। যারা তখন বিডিআরের কিছু সদস্যকে এই অপকর্মে অনুপ্রাণিত করেছে, তারা দেশী শক্তি নাকি বিদেশী শক্তি, তা নিশ্চিত করে বলার মতো প্রমাণ এখনো আমাদের হাতে আসেনি। কিন্তু তাই বলে এটা প্রমাণিত হয় না যে, কোনো অপশক্তি এর পেছনে ছিল না। বাংলাদেশের নিরাপত্তার স্বার্থে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত করার স্বার্থে, সামরিক বাহিনীর মনোবল ও ইজ্জত রক্ষার স্বার্থে এ ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করতেই হবে।
একই সাথে এই হত্যাকাণ্ডটিকে জাতীয়ভাবে উপযুক্ত মূল্যায়ন করা দরকার। এমন শোকের দিন এই জাতির সামনে খুব কমই এসেছে। এ জন্য আমাদের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব, একটি আহ্বান, একটি দাবি হচ্ছে দিবসটিকে জাতীয়ভাবে শোকদিবস পালনের ঘোষণা করা হোক। যেহেতু এই দিন জাতির গর্বিত সন্তান সেনাবাহিনীর ৫৭ জন অফিসারকে হারিয়েছি, তাই সেই দিনটিকে আমরা মনে রাখতে চাই। তার জন্যই এই দিনটিকে জাতীয় শোকদিবস ঘোষণা করে, জাতীয়ভাবে পতাকা অর্ধনমিত রাখার আবেদন করছি; এর জন্য সরকারি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে জাতীয়ভাবে সরকারি ভাষ্য দেয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে; এ বিষয়টি গুরুত্বসহ তুলে ধরার জন্য গণমাধ্যমের প্রতিও আহ্বান জানাই। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং সব পত্রপত্রিকায় এ প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনারও আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা যদি বারবার স্মরণ করি, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারি, তাহলে অতীতের ভুলভ্রান্তিগুলো ধরা পড়বে এবং এতে আগামী প্রজন্ম এ ধরনের বিপর্যয় এড়াতে পারবে। আমাদের উদ্দেশ্য শোককে শক্তিতে পরিণত করা।
এমন কিছু কাজ আছে যেখানে সব দলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হয় দেশের কথা ভেবে। পিলখানা বিডিআর হত্যাকাণ্ড তেমনই একটা বিষয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ঘটনার প্রথম দিক থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে কিছু দায়িত্বহীন কথাবার্তা বের হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও জাতীয় সংসদের ভাষণে বলেছিলেন, সেনাবাহিনীকে নিয়ে ‘খেলনেওয়ালারাই’ নাকি পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এই খেলনেওয়ালারাই বলতে তিনি কোন দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন সেই কথাটিরই ব্যাখ্যা কোনো দিন পাওয়া যায়নি। জঙ্গি তৎপরতার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণের কথাও লাগাতারভাবে এবং জোরেশোরেই বলেছিলেন তৎকালীন বাণিজ্য মন্ত্রী। এই সরকার যদি এ প্রসঙ্গে নিজেদের অবস্থান বা বক্তব্য পরিষ্কার না করে তাহলে আগামীতে কেউ-না-কেউ করবেই।
বিডিআরের নাম বদলে রাখা হয়েছে বিজিবি। শুধু নাম বদলালেই কি কলঙ্ক মুছে যাবে? স্মৃতি মুছে যাবে? কষ্ট মুছে যাবে? প্রকৃত সত্য সারা জীবন চেপে রাখা যায় না, সুতরাং প্রকৃত রহস্য উন্মোচন হওয়া জরুরি কোনো ব্যক্তির স্বার্থে নয়, দেশের স্বার্থে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে, সেনাবাহিনীর সদস্যদের মনোবল বাড়ার স্বার্থে। কাজটি যত দ্রুত হবে ততই মঙ্গল।
এই ঘটনা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর জন্য বা এমনকি আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর জন্য একাধিক কঠিন প্রশ্নের উদ্রেককারী একটি ইতিহাসের মাইলফলক। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ৩০ বা ৩১ তারিখ পিলখানার ময়দানে বিদ্রোহ হয়েছিল যেটাকে চূড়ান্ত শান্তিপূর্ণ পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজে পিলখানায় গিয়েছিলেন। আজ থেকে ১২/১৩ বছর আগে বাংলাদেশ আনসার বাহিনী বিদ্রোহ করেছিল। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু কিছু ক্ষুদ্র অংশ বিদ্রোহ করেছিল বগুড়া এবং ঢাকায় আর তাদের সশস্ত্রভাবে দমন করা হয়েছিল। ১৯৮১ সালের মে মাসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অংশ তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মনজুর বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে; এই বিদ্রোহ দমনের জন্য সশস্ত্র পদক্ষেপের ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হলেও, নেয়ার আগেই বিদ্রোহ দমিত হয়। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল সেটি হচ্ছে, বিদ্রোহ দমনের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা কী? জান, মাল ও সম্মানের মধ্যে কোনটি কতটুকু ত্যাগ করে সমস্যার সমাধান করতে হবে?
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশ সরকার যেই নিয়মে বিষয়টিকে নাড়া-চাড়া করেছেন বা ব্যবস্থাপনা করেছেন, সেটা সম্বন্ধে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। ওই আমলের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানরা কোথায় ছিলেন, কতক্ষণ ছিলেন, কী কী নির্দেশ পেয়েছিলেন, কী কী নির্দেশ প্রদান করেছিলেন ইত্যাদি বিষয় স্পষ্ট হওয়া জাতির জন্য ভালো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের প্রতিনিধির সাথে আলোচনায় বসেছিলেন এটা যেমন সত্য, তেমনই এটাও বাস্তবতা যে, ওই আলোচনার প্রেক্ষাপট, কর্মপদ্ধতি, ফলাফল ইত্যাদি শতভাগ স্পষ্ট নয়। যা হোক না কেন, ওই দিনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে কোনো কার্পণ্য, এই জাতি করেনি এবং ইনশাল্লাহ করবেও না।
লেখক : গবেষক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান
এই কলামটি শুরু করেছি একটি লোমহর্ষক নির্দয় ঘটনার বিবরণ দিয়ে। ২৫ ফেব্রয়ারি ২০০৯ তারিখে ঢাকা মহানগরীর পিলখানায় অনুরূপ একটি লোমহর্ষক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিল। জালিয়ানওয়ালাবাগের ঘটনার সাথে মিল এবং অমিল দুইটাই আছে। ওই সময় বিডিআর-সপ্তাহ চলছিল। এ উপলে একাধিক অনুষ্ঠানে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সবগুলোতে থাকেননি। বিডিআর সপ্তাহ উপলে সারা দেশ থেকে বিডিআরের সব জ্যেষ্ঠ অফিসার একত্র হয়েছিলেন সপরিবারে। ২৫ ফেব্র“য়ারি সকালবেলা, পিলখানায় অবস্থিত বিডিআরের বিখ্যাত দরবার হলে ডাইরেক্টর জেনারেল মহোদয়ের দরবার অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। অর্থাৎ সব অফিসার এবং জেসিও আর সৈনিক একখানে সম্মিলিত থাকবে। অর্থাৎ রূপক অর্থে : একটি খাঁচার মধ্যেই সব মুরগি অথবা একটি মাটির হাঁড়ির মধ্যেই সব ডিম। অতএব ষড়যন্ত্রকারীদের জন্য একটি মোম সময়। পিলখানায় নিহতদের (অর্থাৎ শহীদদের) সংখ্যা সঠিকভাবে আবিষ্কার হয়েছে কিন্তু হত্যাকারীর নাম-ধাম সুস্পষ্টভাবে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপিত হয়নি। তাই ধোঁয়াশা বিদ্যমান। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালেও পিলখানায় একটি বিদ্রোহ হয়েছিল। ৭২-এর বিদ্রোহ এত লোমহর্ষক ছিল না। তাই কিছুটা প্রেক্ষাপট বর্ণনাসহ পিলখানার ২০০৯ সালের ঘটনার স্মরণ করছি। সর্বাগ্রে সামরিক ও বেসামরিক তথা সব শহীদ অফিসার, জেসিও, সৈনিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্মৃতির প্রতি সম্মান জানাচ্ছি। ওই দিনের ঘটনাবলি সম্বন্ধে, বিবিধ প্রকারের সংপ্তি রচনা, শহীদদের নামের তালিকা, মূল্যায়নমূলক রচনা, ছবি, শোকবার্তা ইত্যাদি অনেক জায়গায় লিপিবদ্ধ বা সংরক্ষিত আছে। একটি তাৎক্ষণিক রেফারেন্স বা লিংক এখানে দিলাম আগ্রহীদের জন্য। http://www.goodnewsbd.com/bdr এই লিংকের বক্তব্যগুলো নভেম্বর ২০১৩-এর পরে আপডেট বা যোগ-বিয়োগ করা হয়নি। করা না হলেও মূল বক্তব্য বা তথ্যের চেতনা একই।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বহুলাংশেই যুগপৎ বর্তমান ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং বর্তমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাংগঠনিক কাঠামোর আদলে গঠিত। এই মুহূর্তে পৃথিবীর যেসব দেশ কোনো-না-কোনো কালে যুক্তরাজ্য বা ব্রিটেন বা ইংল্যান্ডের উপনিবেশ ছিল, তাদের সবার সম্মিলিত আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সংগঠনের নাম ব্রিটিশ কমনওয়েলথ অব নেশনস। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসের ১৪ ও ১৫ তারিখ পাকিস্তান ও ভারতকে ইংল্যান্ডের পক্ষ থেকে স্বাধীনতা দেয়া হয়। ওই দু’টি দিনের আগে ভারতীয় উপমহাদেশে তথা ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় যেই সেনাবাহিনী ছিল সেটি ছিল ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মি। সেই ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির জনবল এবং স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যথাসম্ভব পরিকল্পিতভাবে ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছিল। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনিয়ম ও অগোছালো ব্যবস্থাপনা ল করা গেলেও সামগ্রিকভাবে ওই সম্পদ বণ্টন নিয়ে কোনো যুদ্ধ হয়নি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জন্ম যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে পাকিস্তানি বাহিনীর পরিত্যক্ত স্থাবর ও অস্থাবর সব সম্পদ নিয়েই যাত্রা শুরু।
নবীন বাংলাদেশের নবীন সেনাবাহিনী নিজের নিয়মে এগিয়ে যায়। পাকিস্তান আমল থেকে প্রচলিত অনেক রেওয়াজ ও ঘটনার ধারাবাহিকতা বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ধারণ করতে শুরু করে। এ রকম অন্যতম একটি রেওয়াজ ছিল সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর (অথবা অপর ভাষায় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী) কমান্ড এবং কন্ট্রোল তথা নির্দেশনা ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সেনাবাহিনীর অফিসারদের ব্যবহার করা। প্রতিরা মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অফিসাররাকে ডেপুটেশন বা প্রেষণে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ বিডিআরে কর্তব্য পালনের জন্য পাঠানো হতো। পাকিস্তান আমলে যেমন, বাংলাদেশ আমলেও, দেশের ভৌগোলিক নিরাপত্তার জন্য প্রতিরার প্রথম ধাপ ছিল বিডিআর। সেই বিডিআর যেন সেনাবাহিনীর সাথে মিলেমিশে একই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অবদান রাখতে পারে, তার জন্যই অপরিহার্য ছিল যে, বিডিআরের কমান্ড সেনাবাহিনীর কমিশনড অফিসারদের ওপর ন্যস্ত থাকবে। আজকাল মোবাইল ফোনের যুগ, নেটওয়ার্ক ও ফ্রিকোয়েন্সি নামক শব্দ দুটি মোটামুটিভাবে শিক্ষিত সবার কাছে অতি পরিচিত। এটি শুধু টেলিযোগ বা বেতার যন্ত্রের যোগাযোগের জন্য প্রযোজ্য নয়, মনের চিন্তাশক্তি ও সেই চিন্তা প্রকাশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। বিডিআরের কমান্ড যদি এমন কোনো প্রকৃতির অফিসারের ওপর ন্যস্ত হয় যাদের লেখাপড়া বা প্রশিণ এবং পেশাগত চিন্তা সেনাবাহিনী থেকে ভিন্ন, তাহলে বাংলাদেশের বৃহত্তর প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক ও ফ্রিকোয়েন্সি মিলবে না। এটা বাস্তবতা হলেও এর বিরুদ্ধে একটি মহল সব সময় দুশ্চিন্তায় থেকেছে।
১৯৭২-৭৩ সালে একাধিকবার বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বিডিআরকে সীমান্তে চোরাচালান রোধ এবং অনুরূপ কর্মে নিয়োজিত করা হয়। সেই সময়ের ঘটনাবলি ইতিহাস সাী দেয় যে, কর্তব্যে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর অফিসার ও বিডিআরের সেনা অফিসাররা অসুবিধায় পড়তেন তখনকার আমলের সরকারি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে। বাগে আনতে না পেরে একাধিক সেনা অফিসারকে সেই সময় বাধ্যতামূলক অবসর দেয়া হয়েছিল। অতঃপর তৎকালীন সরকার একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করে। পরিকল্পনাটি ছিল যে, বিডিআরের জন্য আলাদা একটি ক্যাডার সৃষ্টি করা হবে। এই মর্মে অফিসারও গ্রহণ করা হয়ে গিয়েছিল এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রক্রিয়াও এগিয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ের বাংলাদেশের ইতিহাস যদি পাঠক, (যদি পাঠকের বয়সে কুলায়) নিজের স্মৃতিতে আনেন তাহলে খেয়াল করবেন যে, জাতীয় রক্ষীবাহিনী নামক একটি নতুন আধা সরকারি বাহিনীও সরকারের পূর্ণাঙ্গ পৃষ্ঠপোষকতায় অতি দ্রুত কলেবরে বৃদ্ধি হচ্ছিল। অফিসিয়ালি নয়, কিন্তু মানসিকভাবে এবং চিন্তা-চেতনায়, রক্ষীবাহিনীকে সেনাবাহিনীর প্রতিযোগী এবং ভবিষ্যতের বিকল্প মনে করা হতো। রক্ষীবাহিনীতে সর্বোচ্চপর্যায়ে শুধু চারজন সেনাবাহিনীর অফিসার ছিলেন, বাকি ১০০-এর বেশি অফিসারই ছিলেন রক্ষীবাহিনীর নিজস্ব ক্যাডার। অর্থাৎ ওই আমলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অস্তিত্ব ও সংহতি বহুমুখী আক্রমণের শিকার হয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে অনেক নিবিড় প্রচেষ্টার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ও তার সরকারকে কোনোমতে বোঝানো সম্ভব হয়েছিল যে, বিডিআরের জন্য নিজস্ব অফিসার-ক্যাডার সৃষ্টি করা একটি মারাত্মক ক্ষতিকারক তথা আত্মঘাতী পদপে ছিল।
২৫-২৬ ফেব্র“য়ারি ২০০৯ সাল পিলখানা বিডিআর সদর দফতরের নারকীয় ঘটনাটি পুরো জাতির জন্য এক শোকাবহ দিন। কারণ ছয় বছর আগে ফেব্র“য়ারিতে পিলখানায় বাংলাদেশের ইতিহাসের তথা পৃথিবীর সামরিক ইতিহাসে একটি অন্যতম জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের ফলে নৃশংসভাবে নিহত হন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অত্যন্ত মেধাবী তরুণ বা মধ্যবয়সী ৫৭ জন কর্মকর্তা। ঘটনাটি এ দেশের মানুষের চোখের সামনে এখনো ভেসে আছে। এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের সাথে সম্পৃক্ত ছিল ওই আমলের বিডিআরের কিছু সংখ্যক ষড়যন্ত্রকারী জ্যেষ্ঠ ও কনিষ্ঠ সৈনিক। দেশের ভেতরের বা বাইরের প্ররোচনাদাতা বা উৎসাহদাতা অবশ্যই ছিল বলে আমি বিশ্বাস করি, কিন্তু তাদের পরিচয় আজো উন্মোচিত হয়নি। ওই ষড়যন্ত্রের রহস্য ও নেপথ্য কাহিনী উদঘাটন হওয়া এবং জাতির সামনে উপস্থাপিত হওয়া অত্যন্ত জরুরি।
এই ন্যক্কারজনক ঘটনাটির ধারাবাহিকতায় আরো অনেকবার চেষ্টা করা হয়েছে, অফিসারদের বিরুদ্ধে কিছু করার তথা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করার। কুচক্রীরা সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে তেমন কিছু করতে না পারলেও ২০০৯ সালে এসে বিডিআরে সেই ঘটনাটি ঘটাতে সম হয়। বিডিআরের সাধারণ সৈনিকদের কেউ-না-কেউ মন্দ উদ্দেশ্যে প্ররোচিত ও উৎসাহিত করেছে যে, সেনাবাহিনীর অফিসারদের মারতে হবে। যারা তখন বিডিআরের কিছু সদস্যকে এই অপকর্মে অনুপ্রাণিত করেছে, তারা দেশী শক্তি নাকি বিদেশী শক্তি, তা নিশ্চিত করে বলার মতো প্রমাণ এখনো আমাদের হাতে আসেনি। কিন্তু তাই বলে এটা প্রমাণিত হয় না যে, কোনো অপশক্তি এর পেছনে ছিল না। বাংলাদেশের নিরাপত্তার স্বার্থে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষিত করার স্বার্থে, সামরিক বাহিনীর মনোবল ও ইজ্জত রক্ষার স্বার্থে এ ষড়যন্ত্রের মুখোশ উন্মোচন করতেই হবে।
একই সাথে এই হত্যাকাণ্ডটিকে জাতীয়ভাবে উপযুক্ত মূল্যায়ন করা দরকার। এমন শোকের দিন এই জাতির সামনে খুব কমই এসেছে। এ জন্য আমাদের পক্ষ থেকে একটি প্রস্তাব, একটি আহ্বান, একটি দাবি হচ্ছে দিবসটিকে জাতীয়ভাবে শোকদিবস পালনের ঘোষণা করা হোক। যেহেতু এই দিন জাতির গর্বিত সন্তান সেনাবাহিনীর ৫৭ জন অফিসারকে হারিয়েছি, তাই সেই দিনটিকে আমরা মনে রাখতে চাই। তার জন্যই এই দিনটিকে জাতীয় শোকদিবস ঘোষণা করে, জাতীয়ভাবে পতাকা অর্ধনমিত রাখার আবেদন করছি; এর জন্য সরকারি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে জাতীয়ভাবে সরকারি ভাষ্য দেয়ার প্রয়োজনীয়তা আছে; এ বিষয়টি গুরুত্বসহ তুলে ধরার জন্য গণমাধ্যমের প্রতিও আহ্বান জানাই। বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এবং সব পত্রপত্রিকায় এ প্রসঙ্গে আলাপ-আলোচনারও আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা যদি বারবার স্মরণ করি, বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারি, তাহলে অতীতের ভুলভ্রান্তিগুলো ধরা পড়বে এবং এতে আগামী প্রজন্ম এ ধরনের বিপর্যয় এড়াতে পারবে। আমাদের উদ্দেশ্য শোককে শক্তিতে পরিণত করা।
এমন কিছু কাজ আছে যেখানে সব দলকে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হয় দেশের কথা ভেবে। পিলখানা বিডিআর হত্যাকাণ্ড তেমনই একটা বিষয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ঘটনার প্রথম দিক থেকেই সরকারের পক্ষ থেকে কিছু দায়িত্বহীন কথাবার্তা বের হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজেও জাতীয় সংসদের ভাষণে বলেছিলেন, সেনাবাহিনীকে নিয়ে ‘খেলনেওয়ালারাই’ নাকি পিলখানা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এই খেলনেওয়ালারাই বলতে তিনি কোন দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন সেই কথাটিরই ব্যাখ্যা কোনো দিন পাওয়া যায়নি। জঙ্গি তৎপরতার সংশ্লিষ্টতার প্রমাণের কথাও লাগাতারভাবে এবং জোরেশোরেই বলেছিলেন তৎকালীন বাণিজ্য মন্ত্রী। এই সরকার যদি এ প্রসঙ্গে নিজেদের অবস্থান বা বক্তব্য পরিষ্কার না করে তাহলে আগামীতে কেউ-না-কেউ করবেই।
বিডিআরের নাম বদলে রাখা হয়েছে বিজিবি। শুধু নাম বদলালেই কি কলঙ্ক মুছে যাবে? স্মৃতি মুছে যাবে? কষ্ট মুছে যাবে? প্রকৃত সত্য সারা জীবন চেপে রাখা যায় না, সুতরাং প্রকৃত রহস্য উন্মোচন হওয়া জরুরি কোনো ব্যক্তির স্বার্থে নয়, দেশের স্বার্থে, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে, সেনাবাহিনীর সদস্যদের মনোবল বাড়ার স্বার্থে। কাজটি যত দ্রুত হবে ততই মঙ্গল।
এই ঘটনা বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর জন্য বা এমনকি আইনশৃঙ্খলা রাকারী বাহিনীর জন্য একাধিক কঠিন প্রশ্নের উদ্রেককারী একটি ইতিহাসের মাইলফলক। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ৩০ বা ৩১ তারিখ পিলখানার ময়দানে বিদ্রোহ হয়েছিল যেটাকে চূড়ান্ত শান্তিপূর্ণ পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধু নিজে পিলখানায় গিয়েছিলেন। আজ থেকে ১২/১৩ বছর আগে বাংলাদেশ আনসার বাহিনী বিদ্রোহ করেছিল। ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কিছু কিছু ক্ষুদ্র অংশ বিদ্রোহ করেছিল বগুড়া এবং ঢাকায় আর তাদের সশস্ত্রভাবে দমন করা হয়েছিল। ১৯৮১ সালের মে মাসে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম অংশ তৎকালীন জিওসি মেজর জেনারেল আবুল মনজুর বীর উত্তম-এর নেতৃত্বে; এই বিদ্রোহ দমনের জন্য সশস্ত্র পদক্ষেপের ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হলেও, নেয়ার আগেই বিদ্রোহ দমিত হয়। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে যে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছিল সেটি হচ্ছে, বিদ্রোহ দমনের সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা কী? জান, মাল ও সম্মানের মধ্যে কোনটি কতটুকু ত্যাগ করে সমস্যার সমাধান করতে হবে?
২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ তারিখে বাংলাদেশ সরকার যেই নিয়মে বিষয়টিকে নাড়া-চাড়া করেছেন বা ব্যবস্থাপনা করেছেন, সেটা সম্বন্ধে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। ওই আমলের সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর প্রধানরা কোথায় ছিলেন, কতক্ষণ ছিলেন, কী কী নির্দেশ পেয়েছিলেন, কী কী নির্দেশ প্রদান করেছিলেন ইত্যাদি বিষয় স্পষ্ট হওয়া জাতির জন্য ভালো। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিদ্রোহীদের প্রতিনিধির সাথে আলোচনায় বসেছিলেন এটা যেমন সত্য, তেমনই এটাও বাস্তবতা যে, ওই আলোচনার প্রেক্ষাপট, কর্মপদ্ধতি, ফলাফল ইত্যাদি শতভাগ স্পষ্ট নয়। যা হোক না কেন, ওই দিনের শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনে কোনো কার্পণ্য, এই জাতি করেনি এবং ইনশাল্লাহ করবেও না।
লেখক : গবেষক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান
No comments