এ কথাই কি লেখা ছিল ভাগ্যে? by ড. মাহবুব উল্লাহ্
২২
ফেব্রুয়ারির প্রথম আলো প্রধান শিরোনামে সংবাদ দিয়েছে, ৬ জানুয়ারি থেকে
অবরোধ-হরতাল শুরু। তবে সহিংসতা শুরু হয়েছিল আগের দিন থেকে। সেই সময় থেকে ২১
ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা একশ ছাড়িয়ে গেছে। মোট নিহত হয়েছেন ১০১
জন। পেট্রলবোমা ও আগুনে নিহতের সংখ্যা ৫৬, এর মধ্যে পুরুষ ৪০ জন, নারী ৯ জন
এবং শিশু ৭ জন। ক্রসফায়ার বা তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০। এর
মধ্যে বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ৬ জন, জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের ৭ জন এবং
অন্যান্য ১৭ জন। এই অন্যান্য ১৭ জনের দলীয়/সাংগঠনিক পরিচয় নিশ্চিত হওয়া
যায়নি। নিহত ব্যক্তিদের পরিবারের দাবি আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর
সদস্যরা তাদের হত্যা করেছে। সংঘর্ষে মারা গেছেন ১৫ জন, ক্রসফায়ার বা
বন্দুকযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা ৩০ কিংবা তারও বেশি কিনা সে সম্পর্কে নিশ্চিত
করে কিছু বলা যায় না। প্রায় প্রতিদিনই এ ধরনের মৃত্যুর খবর সংবাদপত্রে
প্রকাশিত হয়। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বিগত সময়ের দৈনিক পত্রিকাগুলো থেকে
বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে তথাকথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রকৃত নিহতের সংখ্যা
নির্ণয় করবে। সে পর্যন্ত সঠিক সংখ্যাটি জানার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে
হবে। তবে এর পরেও যে সরকারের পক্ষ থেকে এই সংখ্যাকে ভিত্তিহীন বলা হবে না,
তার নিশ্চয়তা নেই। অতীতের ঘটনাবলী থেকে আমাদের এই অভিজ্ঞতা হয়েছে। দেশে যখন
সরকার ও বিরোধী পক্ষ যুদ্ধংদেহি অবস্থায় রয়েছে সেই সময়েও আমরা লক্ষ্য করছি
দেশের কোথাও কোথাও সরকারি দলের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী গ্র“পের মধ্যে সংঘর্ষের
ঘটনা ঘটেছে। সংঘর্ষের ঘটনা যাতে না ঘটতে পারে তার জন্য প্রশাসনের পক্ষ
থেকে ১৪৪ ধারা জারি করা হচ্ছে। সব মিলিয়ে এ কথাই বলা যায় যে, যা কিছু ঘটছে
তা মর্মান্তিক। মানুষের জীবন এখন লবণের চেয়েও সস্তা।
প্রয়াত কবি ও সাহিত্যিক আবু হেনা মোস্তফা কামাল এক আলাপচারিতায় আমাকে বলেছিলেন, রাষ্ট্র বিপর্যয় বড্ড ভয়াবহ। রাষ্ট্র বিপর্যয়ের কবলে পড়ে কত নিরীহ মানুষকে যে প্রাণ হারাতে হয়, ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ হতে হয় এবং সারা জীবনের সঞ্চয় হারিয়ে সর্বহারায় পরিণত হতে হয় তার ইয়ত্তা থাকে না। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশে তেমন ঘটনাই ঘটেছিল। বিপর্যয়কর পরিস্থিতি থেমে যাওয়ার পরও সমাজে এক ধরনের উইচ হান্টিং চলতে থাকে। মতলববাজ লোকরা শত্রুতা উদ্ধারে লিপ্ত হয়। এই প্রক্রিয়ায় তারা প্রতিপক্ষের বিষয়-সম্পত্তিও গ্রাস করে নেয়। আজ হোক, কাল হোক কিংবা বেশ কমাস বিলম্বে হোক দেশে চলমান সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা হয়তো থেমে যাবে। কিন্তু তার জের অব্যাহত থাকবে অনেক দিন। এর ফলে সমাজ দেহে যে ক্ষত সৃষ্টি হবে তা নিরাময় করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য সবকিছু নির্ভর করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর। এখন দেশে রাজনীতির যে কালবোশেখি চলছে তার অবসানের পর নতুন করে পত্রপুষ্প পল্লবিত হয়ে উঠবে। কিন্তু এই নবীন উদ্ভিদকে যতœ করে তরতাজা করে তোলা এবং কালক্রমে মহীরুহে পরিণত করার জন্য যে বিশাল হৃদয়ের নেতৃত্বের প্রয়োজন তা তো চোখে পড়ছে না। কবির কথায় বলতে হয়, হিংসার আগুনে জ্বলছে পৃথ্বী। যারা আমাদের দেশের কর্ণধার তাদের মধ্যে যে পরিমাণ অসহিষ্ণুতা লক্ষ্য করা যায়, তারা কীভাবে সমাজে সহনশীলতা ও সহমর্মিতা ফিরিয়ে আনবেন সে এক বিশাল দুর্ভাবনার বিষয়।
দেশে যে সহিংসতা চলছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকররূপে আবির্ভূত হয়েছে পেট্রলবোমার সন্ত্রাস। কোনো পক্ষই এর দায়িত্ব নিচ্ছে না। এর জন্য এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দায়ী করছে। এসব দুর্ঘটনার দায়িত্ব নিয়েও যে বিভ্রান্তি আছে সেটাও আমরা জানতে পারছি সংবাদপত্রের পাতা থেকে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম চৌদ্দগ্রামের পেট্রলবোমার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে তাতে মনে হয় এটি মিলিটারি দক্ষতা দিয়ে ঘটানো হয়েছে। জানি না, তার এই তথ্যের উৎস কোথায়? ঘটনার পর পুলিশ এলাকার বিরোধীপক্ষীয় অনেক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। এসব মামলার ফলে ন্যায়বিচার কতটা নিশ্চিত হবে সেটাও অনেকটাই অনিশ্চিত। মামলার ফলাফল নির্ভর করে সাক্ষ্য প্রমাণের ওপর। তবে এসব সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তি অবশ্যই সত্যতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আল্লাহতায়ালা মিথ্যাবাদীকে মোটেও পছন্দ করেন না। মিথ্যা বলার জন্য আমাদের ধর্মসহ সব ধর্মে পরকালে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। গত জুমার নামাজের সময় ইমাম সাহেব বয়ান করলেন, মিথ্যা বলা মহাপাপ, তার চেয়েও বড় গোনাহের কাজ হল মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। আইনজীবীরা জেরা করে অনেক সময় বের করে ফেলেন কেউ মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে কিনা। তারপরও সব সময় মিথ্যা সাক্ষ্যের ঘটনা উদঘাটন করা যায় না। কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে পড়েছি, কথিত এক অপরাধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। প্রায় ৫০ বছর পর জানা গেল লোকটি আসলে সে রকম কোনো অপরাধ করেননি। এখন কে তাকে তার হারানো জীবনটি ফেরত দেবে? শত সহস্র কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দেয়া হলেও তার পরিবার-পরিজন সত্যিকার অর্থে কোনো শান্তি খুঁজে পাবে না। শাহজাহানপুরে ওয়াসার পরিত্যক্ত উন্মুক্ত পাইপের মধ্যে পড়ে গিয়ে শিশু জিহাদ মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করে। প্রশাসনের লোকেরা বলেছিল, ওই পাইপের মধ্যে মানুষ কেন অন্য কোনো পোকামাকড়েরও অবস্থান নেই। পরে স্থানীয় একটি উদ্যমী গ্র“প নিজস্ব হিকমত প্রয়োগ করে পাইপের গভীর থেকে মৃত শিশুটির লাশ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। সম্প্রতি হাইকোর্ট জিহাদের পরিবারকে ত্রিশ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশনা দিয়েছেন। জিহাদের মা বলেছে, এই টাকা দিয়ে আমি কী করব? আমি তো আমার জিহাদকে ফিরে পাব না। মানুষের জীবনকে অমূল্য জ্ঞান করাই মানবাধিকারের প্রাথমিক শর্ত। বাংলাদেশে বহুভাবে এবং বহু পন্থায় মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা দলিলে তিনটি চেতনা ও মূল্যবোধের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হল- সাম্য, মানবিক মর্যাদা এং ন্যায়বিচার। বুকে বড় ব্যথা অনুভব করি যখন ভাবি, এই স্বাধীনতার জন্য যৌবনে অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেছিলাম। নিজের কথা ভাবতে গিয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি এই কারণে যে, আজও আমি বেঁচে আছি, বাংলাদেশের আলো-বাতাস ও পানি থেকে জীবনীশক্তি সংগ্রহ করে চলছি। কিন্তু বাংলাদেশে কোথায় আজ সাম্য? কোথায় আজ মানবিক মর্যাদা? এবং কোথায় আজ ন্যায়বিচার কিংবা ইনসাফ? প্রতিটি নাগরিককে আজ এই প্রশ্নটি উত্থাপন করতে হবে। অন্যথায় আমরা রাষ্ট্রের নাগরিকের মর্যাদা ভোগ করতে পারব না।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক উপ-কমিটির একটি প্রতিনিধি দল অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। সর্বশেষে রাজনৈতিক সংকটের সূচনালগ্নে মনে হয়েছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশকে তাদের হিসাবের খাতায় স্থান দিচ্ছে না। এর ফলে সংকট সমাধানে বিলম্ব অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে বলে অনেকেই ধারণা করেছিলেন। কিন্তু ইদানীং তাদের সক্রিয়তা লক্ষ্য করে বোঝা যাচ্ছে তারা নিশ্চুপ, নিরুদ্বিগ্ন নন। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার সংক্রান্ত উপ-কমিটি বাংলাদেশ ত্যাগ করার আগে প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য করেছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের বিনিময়ে হওয়া উচিত নয়। কারণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটি বহু মতভিত্তিক ও সক্রিয় গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি, ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন দূতাবাস ১৯ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে। দলটি সরকার ও বিরোধীপক্ষীয় নেতৃবৃন্দ এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। প্রতিনিধি দলের প্রধান ক্রিশ্চিয়ান ড্যান ক্রেদা বলেন, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ থাকায় আমরা এ সফরে এসেছি। বাংলাদেশকে আমরা শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে চাই। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা অপরিহার্য উপাদান। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের প্রস্তাব আবার উল্লেখ করে প্রতিনিধি দল গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে অব্যাহতভাবে উদ্বেগ জানিয়েছে। বিভিন্ন আলোচনায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। এক্ষেত্রে মৌলিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিনিময়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছে। সেই সঙ্গে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার উন্নয়নে নাগরিক সমাজের কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার লক্ষ্যে খসড়া বৈদেশিক সহযোগিতা আইন যাতে প্রয়োজনীয় সুযোগ নিশ্চিত করে, সে আশাও ব্যক্ত করা হয়েছে। কারণ, ইউরোপীয় অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য এটি জরুরি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শ্রম পরিস্থিতি, নারী ও শিশু অধিকার এবং সংখ্যালঘুসহ সামগ্রিকভাবে বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়ন করাই এ সফরের লক্ষ্য। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার সংক্রান্ত উপ-কমিটির বক্তব্যে কোনো অর্থদ্যোতকতা নেই। বাংলাদেশে শাসক গোষ্ঠী শান্তি ও স্থিতিশীলতা অব্যাহত রাখা বলতে তাদের শাসন ও শোষণকে অব্যাহত রাখাই বুঝিয়ে থাকে- এ রকমটি মনে করা অসঙ্গত নয়। এ রকম শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গিয়ে মানবাধিকার আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে না এমনটি মনে করা খুব যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ জনগণ প্রতিনিয়ত দেখছে কোথায় কী ঘটছে। গ্রেফতারের পর পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির পায়ে গুলি করার মতো ঘটনাও মিডিয়াতে এসেছে। একবার-দুবার নয় একাধিকবার এভাবে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গেলে যে শেষ পর্যন্ত কবরের শান্তি অবধারিত হয়ে উঠবে সে রকম আশংকা করা যায়। শাসকগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহানুভূতি আকর্ষণের জন্য প্রতিনিয়ত বলে চলেছে, বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস চলছে। এই জঙ্গিত্বকে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিত্বের সঙ্গে প্রায়শই তুলনা করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক স্টেট-ওয়ালারা ইসলামের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংশ্লেষহীন পন্থায় খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। এরা অমুসলিমদের শিরñেদ ঘটিয়েছে। নিঃসন্দেহে এদের লক্ষ্য গণতন্ত্র বা ওই ধরনের কিছু নয়। কিন্তু বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে রয়েছে ভোটারবিহীন নির্বাচন, গণতন্ত্রহীনতা এবং রাজনৈতিক অধিকারহীনতা। সুতরাং ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে কোনো লাভ নেই। এখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতার আবশ্যিক পূর্বশর্ত হল নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তা। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম মহান ব্রত ছিল গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে পারে এটাই আলাপ-আলোচনা করে নির্ধারণ করতে হবে। পৌঁছাতে হবে একটি ঐকমত্যে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দল পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গেও বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিরা কোনো প্রশ্ন উপস্থাপন করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিষয়টি বেমালুম অস্বীকার করেন। একটি ইংরেজি দৈনিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর জবাব দেখে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দল বিস্ময় প্রকাশ করেন। তারা জানান, মানবাধিকারের বিষয়টি ছিল তাদের আলোচনার এজেন্ডা। এভাবে বিদেশী প্রতিনিধি দল সম্পর্কে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জনমনে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলেন সেটা ছিল অপ্রত্যাশিত ও অনাকাক্সিক্ষত। বিদেশী বন্ধুদের সম্পর্কে এ রকম নির্জলা মিথ্যাচার করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হল সে ব্যাপারটি সপ্রতিভ তরুণ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ভাবা উচিত ছিল। তিনি কূটনীতির ভাষার মারপ্যাঁচ দিয়ে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করলেও পারতেন। কিন্তু সে বুদ্ধিমত্তাও তিনি ব্যবহার করলেন না। দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার কোন পর্যায়ে নেমেছে, তার একটি বড় উদাহরণ এবারের ২১ ফেব্র“য়ারিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করতে বিরোধী জোটের নেত্রী খালেদা জিয়া শহীদ মিনারে যেতে ভরসা পাননি। অথচ তিনি অতীতে কী ক্ষমতায় কিংবা ক্ষমতার বাইরে সব পরিস্থিতিতেই এই মহান কর্তব্যটি সর্বদাই পালন করেছেন। জানি না কবে এ দেশ থেকে রাজভয় নির্বাসিত হবে। মানুষ কবে মন খুলে কথা বলতে পারবে। ইচ্ছামতো দেশের ভেতরে যেখানে-সেখানে যেতে পারবে। শুধু প্রার্থনা করব, এ দেশ হতে হে, মঙ্গলময় দূর করে দাও সব ভয়/লোকভয়, রাজভয়, আরও ভয় যত। মনে হয় না খুব সহসা এই ভয় কেটে যাবে। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলকে আওয়ামী লীগ জানিয়েছে, নির্বাচন এলে সংলাপ হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কথামতো নির্বাচন তো আসবে ২০১৯ সালে। ততদিন পর্যন্ত ভয়, ভীতি, শংকা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুর্ভাবনা এবং দুঃস্বপ্ন নিয়েই আমাদের দিনমান কাটবে কি? বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে এ কথাই কি লেখা ছিল আমাদের ভাগ্যে?
ড. মাহবুব উল্লাহ : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
প্রয়াত কবি ও সাহিত্যিক আবু হেনা মোস্তফা কামাল এক আলাপচারিতায় আমাকে বলেছিলেন, রাষ্ট্র বিপর্যয় বড্ড ভয়াবহ। রাষ্ট্র বিপর্যয়ের কবলে পড়ে কত নিরীহ মানুষকে যে প্রাণ হারাতে হয়, ভিটামাটি থেকে উচ্ছেদ হতে হয় এবং সারা জীবনের সঞ্চয় হারিয়ে সর্বহারায় পরিণত হতে হয় তার ইয়ত্তা থাকে না। ১৯৭১ সালে আমাদের দেশে তেমন ঘটনাই ঘটেছিল। বিপর্যয়কর পরিস্থিতি থেমে যাওয়ার পরও সমাজে এক ধরনের উইচ হান্টিং চলতে থাকে। মতলববাজ লোকরা শত্রুতা উদ্ধারে লিপ্ত হয়। এই প্রক্রিয়ায় তারা প্রতিপক্ষের বিষয়-সম্পত্তিও গ্রাস করে নেয়। আজ হোক, কাল হোক কিংবা বেশ কমাস বিলম্বে হোক দেশে চলমান সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা হয়তো থেমে যাবে। কিন্তু তার জের অব্যাহত থাকবে অনেক দিন। এর ফলে সমাজ দেহে যে ক্ষত সৃষ্টি হবে তা নিরাময় করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠতে পারে। অবশ্য সবকিছু নির্ভর করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর। এখন দেশে রাজনীতির যে কালবোশেখি চলছে তার অবসানের পর নতুন করে পত্রপুষ্প পল্লবিত হয়ে উঠবে। কিন্তু এই নবীন উদ্ভিদকে যতœ করে তরতাজা করে তোলা এবং কালক্রমে মহীরুহে পরিণত করার জন্য যে বিশাল হৃদয়ের নেতৃত্বের প্রয়োজন তা তো চোখে পড়ছে না। কবির কথায় বলতে হয়, হিংসার আগুনে জ্বলছে পৃথ্বী। যারা আমাদের দেশের কর্ণধার তাদের মধ্যে যে পরিমাণ অসহিষ্ণুতা লক্ষ্য করা যায়, তারা কীভাবে সমাজে সহনশীলতা ও সহমর্মিতা ফিরিয়ে আনবেন সে এক বিশাল দুর্ভাবনার বিষয়।
দেশে যে সহিংসতা চলছে তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকররূপে আবির্ভূত হয়েছে পেট্রলবোমার সন্ত্রাস। কোনো পক্ষই এর দায়িত্ব নিচ্ছে না। এর জন্য এক পক্ষ অন্য পক্ষকে দায়ী করছে। এসব দুর্ঘটনার দায়িত্ব নিয়েও যে বিভ্রান্তি আছে সেটাও আমরা জানতে পারছি সংবাদপত্রের পাতা থেকে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচটি ইমাম চৌদ্দগ্রামের পেট্রলবোমার ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, ঘটনাটি যেভাবে ঘটেছে তাতে মনে হয় এটি মিলিটারি দক্ষতা দিয়ে ঘটানো হয়েছে। জানি না, তার এই তথ্যের উৎস কোথায়? ঘটনার পর পুলিশ এলাকার বিরোধীপক্ষীয় অনেক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দিয়েছে। এসব মামলার ফলে ন্যায়বিচার কতটা নিশ্চিত হবে সেটাও অনেকটাই অনিশ্চিত। মামলার ফলাফল নির্ভর করে সাক্ষ্য প্রমাণের ওপর। তবে এসব সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তি অবশ্যই সত্যতার ওপর প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। আল্লাহতায়ালা মিথ্যাবাদীকে মোটেও পছন্দ করেন না। মিথ্যা বলার জন্য আমাদের ধর্মসহ সব ধর্মে পরকালে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। গত জুমার নামাজের সময় ইমাম সাহেব বয়ান করলেন, মিথ্যা বলা মহাপাপ, তার চেয়েও বড় গোনাহের কাজ হল মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়া। আইনজীবীরা জেরা করে অনেক সময় বের করে ফেলেন কেউ মিথ্যা সাক্ষ্য দিচ্ছে কিনা। তারপরও সব সময় মিথ্যা সাক্ষ্যের ঘটনা উদঘাটন করা যায় না। কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে পড়েছি, কথিত এক অপরাধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একজনের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। প্রায় ৫০ বছর পর জানা গেল লোকটি আসলে সে রকম কোনো অপরাধ করেননি। এখন কে তাকে তার হারানো জীবনটি ফেরত দেবে? শত সহস্র কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দেয়া হলেও তার পরিবার-পরিজন সত্যিকার অর্থে কোনো শান্তি খুঁজে পাবে না। শাহজাহানপুরে ওয়াসার পরিত্যক্ত উন্মুক্ত পাইপের মধ্যে পড়ে গিয়ে শিশু জিহাদ মর্মান্তিক মৃত্যুবরণ করে। প্রশাসনের লোকেরা বলেছিল, ওই পাইপের মধ্যে মানুষ কেন অন্য কোনো পোকামাকড়েরও অবস্থান নেই। পরে স্থানীয় একটি উদ্যমী গ্র“প নিজস্ব হিকমত প্রয়োগ করে পাইপের গভীর থেকে মৃত শিশুটির লাশ উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। সম্প্রতি হাইকোর্ট জিহাদের পরিবারকে ত্রিশ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের নির্দেশনা দিয়েছেন। জিহাদের মা বলেছে, এই টাকা দিয়ে আমি কী করব? আমি তো আমার জিহাদকে ফিরে পাব না। মানুষের জীবনকে অমূল্য জ্ঞান করাই মানবাধিকারের প্রাথমিক শর্ত। বাংলাদেশে বহুভাবে এবং বহু পন্থায় মানবাধিকার লংঘিত হচ্ছে। আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা দলিলে তিনটি চেতনা ও মূল্যবোধের কথা বলা হয়েছে। এগুলো হল- সাম্য, মানবিক মর্যাদা এং ন্যায়বিচার। বুকে বড় ব্যথা অনুভব করি যখন ভাবি, এই স্বাধীনতার জন্য যৌবনে অনেক কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার করেছিলাম। নিজের কথা ভাবতে গিয়ে নিজেকে ভাগ্যবান মনে করি এই কারণে যে, আজও আমি বেঁচে আছি, বাংলাদেশের আলো-বাতাস ও পানি থেকে জীবনীশক্তি সংগ্রহ করে চলছি। কিন্তু বাংলাদেশে কোথায় আজ সাম্য? কোথায় আজ মানবিক মর্যাদা? এবং কোথায় আজ ন্যায়বিচার কিংবা ইনসাফ? প্রতিটি নাগরিককে আজ এই প্রশ্নটি উত্থাপন করতে হবে। অন্যথায় আমরা রাষ্ট্রের নাগরিকের মর্যাদা ভোগ করতে পারব না।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকারবিষয়ক উপ-কমিটির একটি প্রতিনিধি দল অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। সর্বশেষে রাজনৈতিক সংকটের সূচনালগ্নে মনে হয়েছিল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশকে তাদের হিসাবের খাতায় স্থান দিচ্ছে না। এর ফলে সংকট সমাধানে বিলম্ব অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়বে বলে অনেকেই ধারণা করেছিলেন। কিন্তু ইদানীং তাদের সক্রিয়তা লক্ষ্য করে বোঝা যাচ্ছে তারা নিশ্চুপ, নিরুদ্বিগ্ন নন। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার সংক্রান্ত উপ-কমিটি বাংলাদেশ ত্যাগ করার আগে প্রণিধানযোগ্য মন্তব্য করেছে। তারা বলেছে, বাংলাদেশে শান্তি এবং স্থিতিশীলতা নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের বিনিময়ে হওয়া উচিত নয়। কারণ, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটি বহু মতভিত্তিক ও সক্রিয় গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি, ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন দূতাবাস ১৯ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় এ বিজ্ঞপ্তি প্রচার করেছে। দলটি সরকার ও বিরোধীপক্ষীয় নেতৃবৃন্দ এবং জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গে মতবিনিময় করেছে। প্রতিনিধি দলের প্রধান ক্রিশ্চিয়ান ড্যান ক্রেদা বলেন, মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ থাকায় আমরা এ সফরে এসেছি। বাংলাদেশকে আমরা শক্তিশালী অংশীদার হিসেবে চাই। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে পুরোপুরি কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধা অপরিহার্য উপাদান। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরের প্রস্তাব আবার উল্লেখ করে প্রতিনিধি দল গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যা নিয়ে অব্যাহতভাবে উদ্বেগ জানিয়েছে। বিভিন্ন আলোচনায় মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। এক্ষেত্রে মৌলিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার বিনিময়ে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠিত হওয়া উচিত নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দল গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করার ওপর জোর দিয়েছে। সেই সঙ্গে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রার উন্নয়নে নাগরিক সমাজের কাজের ক্ষেত্র প্রস্তুত করার লক্ষ্যে খসড়া বৈদেশিক সহযোগিতা আইন যাতে প্রয়োজনীয় সুযোগ নিশ্চিত করে, সে আশাও ব্যক্ত করা হয়েছে। কারণ, ইউরোপীয় অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়নের জন্য এটি জরুরি। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, শ্রম পরিস্থিতি, নারী ও শিশু অধিকার এবং সংখ্যালঘুসহ সামগ্রিকভাবে বর্তমান মানবাধিকার পরিস্থিতি মূল্যায়ন করাই এ সফরের লক্ষ্য। ইউরোপীয় পার্লামেন্টের মানবাধিকার সংক্রান্ত উপ-কমিটির বক্তব্যে কোনো অর্থদ্যোতকতা নেই। বাংলাদেশে শাসক গোষ্ঠী শান্তি ও স্থিতিশীলতা অব্যাহত রাখা বলতে তাদের শাসন ও শোষণকে অব্যাহত রাখাই বুঝিয়ে থাকে- এ রকমটি মনে করা অসঙ্গত নয়। এ রকম শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গিয়ে মানবাধিকার আরও বিপর্যস্ত হয়ে পড়বে না এমনটি মনে করা খুব যুক্তিযুক্ত নয়। কারণ জনগণ প্রতিনিয়ত দেখছে কোথায় কী ঘটছে। গ্রেফতারের পর পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতারকৃত ব্যক্তির পায়ে গুলি করার মতো ঘটনাও মিডিয়াতে এসেছে। একবার-দুবার নয় একাধিকবার এভাবে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গেলে যে শেষ পর্যন্ত কবরের শান্তি অবধারিত হয়ে উঠবে সে রকম আশংকা করা যায়। শাসকগোষ্ঠী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন ও সহানুভূতি আকর্ষণের জন্য প্রতিনিয়ত বলে চলেছে, বাংলাদেশকে একটি জঙ্গি রাষ্ট্রে পরিণত করার প্রয়াস চলছে। এই জঙ্গিত্বকে ইসলামিক স্টেটের জঙ্গিত্বের সঙ্গে প্রায়শই তুলনা করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামিক স্টেট-ওয়ালারা ইসলামের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংশ্লেষহীন পন্থায় খেলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিয়েছে। এরা অমুসলিমদের শিরñেদ ঘটিয়েছে। নিঃসন্দেহে এদের লক্ষ্য গণতন্ত্র বা ওই ধরনের কিছু নয়। কিন্তু বাংলাদেশে যে রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে তার মূলে রয়েছে ভোটারবিহীন নির্বাচন, গণতন্ত্রহীনতা এবং রাজনৈতিক অধিকারহীনতা। সুতরাং ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে কোনো লাভ নেই। এখানে শান্তি ও স্থিতিশীলতার আবশ্যিক পূর্বশর্ত হল নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকারের নিশ্চয়তা। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অন্যতম মহান ব্রত ছিল গণতন্ত্র। এই গণতন্ত্র কীভাবে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে পারে এটাই আলাপ-আলোচনা করে নির্ধারণ করতে হবে। পৌঁছাতে হবে একটি ঐকমত্যে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দল পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গেও বৈঠক করেছে। ওই বৈঠকে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধিরা কোনো প্রশ্ন উপস্থাপন করেছিলেন কিনা সে বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বিষয়টি বেমালুম অস্বীকার করেন। একটি ইংরেজি দৈনিকে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর জবাব দেখে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দল বিস্ময় প্রকাশ করেন। তারা জানান, মানবাধিকারের বিষয়টি ছিল তাদের আলোচনার এজেন্ডা। এভাবে বিদেশী প্রতিনিধি দল সম্পর্কে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জনমনে যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করলেন সেটা ছিল অপ্রত্যাশিত ও অনাকাক্সিক্ষত। বিদেশী বন্ধুদের সম্পর্কে এ রকম নির্জলা মিথ্যাচার করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে কোন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হল সে ব্যাপারটি সপ্রতিভ তরুণ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ভাবা উচিত ছিল। তিনি কূটনীতির ভাষার মারপ্যাঁচ দিয়ে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করলেও পারতেন। কিন্তু সে বুদ্ধিমত্তাও তিনি ব্যবহার করলেন না। দেশে গণতান্ত্রিক অধিকার ও মানবাধিকার কোন পর্যায়ে নেমেছে, তার একটি বড় উদাহরণ এবারের ২১ ফেব্র“য়ারিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ করতে বিরোধী জোটের নেত্রী খালেদা জিয়া শহীদ মিনারে যেতে ভরসা পাননি। অথচ তিনি অতীতে কী ক্ষমতায় কিংবা ক্ষমতার বাইরে সব পরিস্থিতিতেই এই মহান কর্তব্যটি সর্বদাই পালন করেছেন। জানি না কবে এ দেশ থেকে রাজভয় নির্বাসিত হবে। মানুষ কবে মন খুলে কথা বলতে পারবে। ইচ্ছামতো দেশের ভেতরে যেখানে-সেখানে যেতে পারবে। শুধু প্রার্থনা করব, এ দেশ হতে হে, মঙ্গলময় দূর করে দাও সব ভয়/লোকভয়, রাজভয়, আরও ভয় যত। মনে হয় না খুব সহসা এই ভয় কেটে যাবে। কারণ ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি দলকে আওয়ামী লীগ জানিয়েছে, নির্বাচন এলে সংলাপ হবে। কিন্তু আওয়ামী লীগের কথামতো নির্বাচন তো আসবে ২০১৯ সালে। ততদিন পর্যন্ত ভয়, ভীতি, শংকা, উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, দুর্ভাবনা এবং দুঃস্বপ্ন নিয়েই আমাদের দিনমান কাটবে কি? বাংলাদেশের নাগরিক হয়ে এ কথাই কি লেখা ছিল আমাদের ভাগ্যে?
ড. মাহবুব উল্লাহ : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments