মমতার ঢাকা সফর- শুধু কথায় চিড়ে ভিজে না by হাসান শাহরিয়ার
চার
বছর আগে ২০১১ সালে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনগণ প্রত্যাবর্তন নয়, পরিবর্তনকে
বেছে নিয়ে সাড়ে তিন দশকের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়েছিল। আর এই নীরব বিপ্লবের
ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার তৃণমূল কংগ্রেস। মমতা
বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন তার কলকাতার কালিঘাটের হরিশ চ্যাটার্জি লেনের বাড়ি
থেকে জনগণকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেছিলেন, এটি হলো 'দলতন্ত্রকে ছাপিয়ে
গণতন্ত্রের ঐতিহাসিক জয়। এই জয় জঙ্গলমহল থেকে মা, মাটি ও মানুষের জয়। ৩৫
বছর পরে বাংলার মাটিতে স্বাধীনতার জয়।' তখন দেশ_বিদেশে সবাই তার প্রশংসা
করেছিলেন। তারা ভেবেছিলেন, অত্যাচার-নির্যাতন ও সীমাহীন দুর্ভোগের পর
ক্ষমতায় এসে তিনি জনগণের সুখ-দুঃখের সাথী হবেন। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই
বোঝা গেল, মহাকরণে যাওয়ার পর ক্ষমতার ভারে বদলে গেছেন মমতা দেবী। তাকে
ঘোড়ারোগে পেয়ে বসল, অচিরেই তিনি অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন এবং সমালোচকদের শিক্ষা
দেওয়ার জন্য জেলে পাঠাতে শুরু করলেন। যে গণমাধ্যম তাকে সমর্থন দিয়ে ক্ষমতায়
নিয়ে এসেছিল সেই গণমাধ্যমই হয়ে উঠল তার চক্ষুশূল। প্রেস কাউন্সিল অব
ইন্ডিয়ার চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি মার্কন্ডেয় কাটজুর
ভাষায়, 'সংবিধান ও আইনকে মমতা তোয়াক্কাই করেন না। যা মুখে আসে তা-ই বলেন,
যা খুশি তা-ই করেন।' অনেকেই তখন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন : বিনা কারণে তার
ধৈর্যচ্যুতি ভবিষ্যতে তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে। আর তা_ই হয়েছে। তিনি
কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন দুর্বল কেন্দ্রীয় সরকারকে নাস্তানাবুদ করেছেন, চড়েছেন
মমতা উল্টোরথে। কিন্তু বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে বিজেপি ক্ষমতায়
আসার পর নতুন করে হিসাব_নিকাশ করে সোজাপথে হাঁটার চেষ্টা করছেন।
দেখতে দেখতে ক্ষমতায় চার বছর কাটিয়েছেন তিনি। এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়েছে আগামী বছরের বিধানসভার নির্বাচনের। বিজেপিও বসে নেই। এরই মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের কোনো কোনো নেতা বিজেপিতে ঠাঁই নিয়েছেন। সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি বীতশ্রদ্ধ পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের একটি অংশ বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বর্ধমানের অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনার পর অভিযোগ উঠেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনকে অর্থ সরবরাহ এবং আশ্রয় ও মদদ দিচ্ছে। জন্মসূত্রে বাংলাদেশিদের এক বিরাট অংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোটার। বাংলাদেশের প্রতি তার অবন্ধুসুলভ আচরণ তাদেরকে আহত করেছে। তিনি এখন এই ভোটব্যাংক রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
এই প্রেক্ষাপটেই তার বাংলাদেশ সফর। এই সফরের পেছনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইচ্ছাই কাজ করেছে। সীমান্ত স্থলচুক্তির প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার আপত্তি তুলে নিয়েছেন। তিনি জানেন, এবারও যদি তিনি বাদ সাধতে চান, তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার পরোয়া করবে না। অতএব, লেজ সোজা করেই গর্তে ঢুকতে হচ্ছে তাকে। যে যাই বলুক না কেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বাকপটু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাত করে দিয়ে গেলেন বাংলাদেশিদের। তিন দিনের সফরে কত কথা যে তিনি বললেন তার ইয়ত্তা নেই। সব অনুষ্ঠানেই কথার ফুলঝুরি। কিন্তু কাজের কথার বেলায় ফাঁকিঝুঁকি। তার সফরের আগে বলা হয়েছিল, তিনি চমক দেখাবেন। কংগ্রেস সরকারের দুর্বলতার কারণে যে তিস্তার পানিচুক্তি তিনি ইতিপূর্বে বিনা কারণে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন, সে প্রশ্নে তার কোনো স্পষ্ট জবাব নেই। ঢাকায় আসার পর বলেছিলেন, আস্থা রাখুন, শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে সমাধান মিলে যাবে। পরের দিন প্রতিশ্রুত কোনো চমক না দেখিয়ে বিষয়টি 'ভেবে দেখব' বলে মৌখিক আশ্বাস দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি বলেছেন, তড়িঘড়ি করে এই সমস্যার সমাধান তার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ কিছু 'বাধ্যবাধকতা' রয়েছে। তবে এ প্রশ্নে তিনি কোনো সমাধানের ইঙ্গিত না দেওয়ায় বাংলাদেশিরা মর্মাহত হয়েছে।
খরস্রোতা তিস্তা নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট দিয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে পড়েছে। শেখ হাসিনা ও মনমোহন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তিস্তার ৪৫০ কিউসেক পানি প্রবহমান রেখে অবশিষ্ট ৪৮ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৫২ শতাংশ ভারত। প্রথমে ১৫ বছর মেয়াদি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি হবে। পরে পানিপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে। মমতা বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের লোকেরা চাষাবাদের জন্য তিস্তার ওপর নির্ভরশীল। তার ধারণা, পানির হিসেবে ৩৫ হাজার কিউসেক যদি বাংলাদেশ পায়, তাহলে উত্তরবঙ্গের সেচ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, বিপন্ন হবে কৃষি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে তার আসল রূপটি বেরিয়ে আসে। 'আপনারা কি চান, আমি একবার এসেই সব সমস্যার সমাধান করে চলে যাই,' তাদের পাল্টা প্রশ্ন করে তিনি বলেন, 'তিস্তা নিয়েও তো ইতিবাচক পরিবেশের কথা শুরু হলো। আপনাদের জল চাই, সেটা আমি বুঝি। তিস্তার জল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গেও কিছু সমস্যা রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে উত্তরবঙ্গে জলই থাকে না। আর জলই যদি না থাকে, তাহলে সেটা দেওয়া যাবে কীভাবে?' মমতা নিশ্চয়ই জানেন যে, তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত না হওয়ার কারণে শুষ্ক মৌসুমে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে। ফলে তখন বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সেচের পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়।
আসলে এটি তার নেহাত একটি রাজনৈতিক চাল। পশ্চিমবঙ্গের যে এলাকা দিয়ে তিস্তা প্রবাহিত হয়েছে সে অঞ্চলটি সিপিএমের দখলে। তৃণমূলের কোনো ভিত নেই সেখানে। ওই অঞ্চলে পানি দেওয়ার আগে সেখানে তিনি তার দলের অবস্থান সুদৃঢ় করতে চান। বিষয়টি বিজেপির অজানা নয়। তাই দলের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঢাকা সফরকে 'আইওয়াশ' বলে অভিহিত করে বলেছেন, তিস্তার পানিচুক্তির প্রশ্নে কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেননি তিনি। এখন এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, স্থানীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতার কারণেই তিনি চুক্তিতে বাদ সাধছেন। বাংলাদেশকে এই পরিমাণ পানি দিলে পশ্চিমবঙ্গের কৃষির ক্ষতি হবে না, তা তিনি ভালো করেই জানেন। তিনি যে কমিশন গঠন করেছিলেন তা এসব দিক পর্যালোচনা না করে বিবেচনায় নিয়েছে পরিবেশ সংরক্ষণ।
শেখ হাসিনা ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। নব্বইয়ের দশকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা দিলি্লতে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অশোকা হোটেলে দিদির সঙ্গে রাত কাটিয়েছেন গল্প করে। চার বছর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল যখন নির্বাচনে জয়লাভ করে, তখন সব প্রটোকল ভেঙে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার মূল্যায়ন করেননি, বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তা মনে রাখেননি। উদারতার ঘাটতি দেখাননি। কোনো ব্যতিক্রম না ঘটিয়ে এবারও তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। প্রটোকল ভেঙে শহীদ মিনারে তার সঙ্গে কথা বলেছেন এবং বাড়িতে নিজে এসে গাড়িতে তুলে দিয়েছেন। তিনি আবার প্রমাণ করেছেন, বাংলাদেশিরা অতিথিপরায়ণ। তিস্তার পানি না দিলে কী হবে তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে ফিরে গেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার সফরসঙ্গীরা। খাওয়া-দাওয়ার বিষয়টি ছিল যেন এক এলাহি কাণ্ড। তালিকায় ছিল কালিজিরা চালের ভাত, সবজি-ডাল, ভাপা ইলিশ, ইলিশ ভাজা, শর্ষে ইলিশ, ইলিশের ডিমভাজি, ইলিশের তেল, চিতলের মুইঠ্যা, রূপচাঁদা ভাজা, রুই কালিয়া, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, খাসির রেজালা, মুরগি ভুনা এবং কুমিল্লার রসমালাই ও মিষ্টিদই। এই খাওয়া খেয়ে তার সফরসঙ্গীদের অনেকেই ঢেঁকুর তুলে বলেছেন, ইলিশের এত পদ জীবনেও কোনোদিন খাইনি। ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে (তখন মন্ত্রী) তো নিজে রেঁধে পাঁচ রকমের মাছ খাইয়েছিলেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তিস্তার বিষয়টি তিনি ভেবে দেখবেন। গত চার বছর ধরেই তো তিনি ভাবলেন। তার এই ভাবা কবে শেষ হবে, তা শুধু তিনিই বলতে পারেন। এখন এটি স্পষ্ট যে, তিস্তার পানি ভাগাভাগির সমাধান সহসা হচ্ছে না। তিনি তো অনেক কথাই বলে গেলেন। তবে সব কথার শেষ কথা হলো, শুধু কথায় চিড়ে ভিজে না। কথা কাজে পরিণত করতে হয়। ঢালঢোক পিটিয়ে মমতার সফরে কাজের কাজ কিছুই হলো না, মাঝখানে সমস্যা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল এবং সেই সঙ্গে ঝুলে রইল তিস্তা চুক্তি। চার বছর পর আবার তিস্তার পানি গড়াতে শুরু করবে। তবে কবে এর হিল্লে হবে তা ভবিতব্যই জানে।
প্রবীণ সাংবাদিক, ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমেরিটাস, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (সিজেএ)
দেখতে দেখতে ক্ষমতায় চার বছর কাটিয়েছেন তিনি। এখন থেকেই প্রস্তুতি শুরু হয়েছে আগামী বছরের বিধানসভার নির্বাচনের। বিজেপিও বসে নেই। এরই মধ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল কংগ্রেসের কোনো কোনো নেতা বিজেপিতে ঠাঁই নিয়েছেন। সীমান্তের ওপার থেকে পাওয়া খবরে জানা গেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি বীতশ্রদ্ধ পশ্চিমবঙ্গের ভোটারদের একটি অংশ বিজেপির দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বর্ধমানের অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনার পর অভিযোগ উঠেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল বাংলাদেশের জঙ্গি সংগঠনকে অর্থ সরবরাহ এবং আশ্রয় ও মদদ দিচ্ছে। জন্মসূত্রে বাংলাদেশিদের এক বিরাট অংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভোটার। বাংলাদেশের প্রতি তার অবন্ধুসুলভ আচরণ তাদেরকে আহত করেছে। তিনি এখন এই ভোটব্যাংক রক্ষা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
এই প্রেক্ষাপটেই তার বাংলাদেশ সফর। এই সফরের পেছনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ইচ্ছাই কাজ করেছে। সীমান্ত স্থলচুক্তির প্রশ্নে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার আপত্তি তুলে নিয়েছেন। তিনি জানেন, এবারও যদি তিনি বাদ সাধতে চান, তাহলে কেন্দ্রীয় সরকার পরোয়া করবে না। অতএব, লেজ সোজা করেই গর্তে ঢুকতে হচ্ছে তাকে। যে যাই বলুক না কেন, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বাকপটু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মাত করে দিয়ে গেলেন বাংলাদেশিদের। তিন দিনের সফরে কত কথা যে তিনি বললেন তার ইয়ত্তা নেই। সব অনুষ্ঠানেই কথার ফুলঝুরি। কিন্তু কাজের কথার বেলায় ফাঁকিঝুঁকি। তার সফরের আগে বলা হয়েছিল, তিনি চমক দেখাবেন। কংগ্রেস সরকারের দুর্বলতার কারণে যে তিস্তার পানিচুক্তি তিনি ইতিপূর্বে বিনা কারণে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন, সে প্রশ্নে তার কোনো স্পষ্ট জবাব নেই। ঢাকায় আসার পর বলেছিলেন, আস্থা রাখুন, শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে সমাধান মিলে যাবে। পরের দিন প্রতিশ্রুত কোনো চমক না দেখিয়ে বিষয়টি 'ভেবে দেখব' বলে মৌখিক আশ্বাস দিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে। তিনি বলেছেন, তড়িঘড়ি করে এই সমস্যার সমাধান তার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ কিছু 'বাধ্যবাধকতা' রয়েছে। তবে এ প্রশ্নে তিনি কোনো সমাধানের ইঙ্গিত না দেওয়ায় বাংলাদেশিরা মর্মাহত হয়েছে।
খরস্রোতা তিস্তা নদী ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং-জলপাইগুড়ি হয়ে বাংলাদেশের লালমনিরহাট দিয়ে কুড়িগ্রামের চিলমারীতে প্রবেশ করে ব্রহ্মপুত্রে গিয়ে পড়েছে। শেখ হাসিনা ও মনমোহন সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তিস্তার ৪৫০ কিউসেক পানি প্রবহমান রেখে অবশিষ্ট ৪৮ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৫২ শতাংশ ভারত। প্রথমে ১৫ বছর মেয়াদি অন্তর্বর্তীকালীন চুক্তি হবে। পরে পানিপ্রবাহ পর্যবেক্ষণ করে একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করা হবে। মমতা বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলের লোকেরা চাষাবাদের জন্য তিস্তার ওপর নির্ভরশীল। তার ধারণা, পানির হিসেবে ৩৫ হাজার কিউসেক যদি বাংলাদেশ পায়, তাহলে উত্তরবঙ্গের সেচ ব্যবস্থা ভেঙে পড়বে, বিপন্ন হবে কৃষি। ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে তার আসল রূপটি বেরিয়ে আসে। 'আপনারা কি চান, আমি একবার এসেই সব সমস্যার সমাধান করে চলে যাই,' তাদের পাল্টা প্রশ্ন করে তিনি বলেন, 'তিস্তা নিয়েও তো ইতিবাচক পরিবেশের কথা শুরু হলো। আপনাদের জল চাই, সেটা আমি বুঝি। তিস্তার জল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গেও কিছু সমস্যা রয়েছে। শুষ্ক মৌসুমে উত্তরবঙ্গে জলই থাকে না। আর জলই যদি না থাকে, তাহলে সেটা দেওয়া যাবে কীভাবে?' মমতা নিশ্চয়ই জানেন যে, তিস্তা চুক্তি সম্পাদিত না হওয়ার কারণে শুষ্ক মৌসুমে ভারত একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহার করে। ফলে তখন বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে সেচের পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়।
আসলে এটি তার নেহাত একটি রাজনৈতিক চাল। পশ্চিমবঙ্গের যে এলাকা দিয়ে তিস্তা প্রবাহিত হয়েছে সে অঞ্চলটি সিপিএমের দখলে। তৃণমূলের কোনো ভিত নেই সেখানে। ওই অঞ্চলে পানি দেওয়ার আগে সেখানে তিনি তার দলের অবস্থান সুদৃঢ় করতে চান। বিষয়টি বিজেপির অজানা নয়। তাই দলের পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সভাপতি রাহুল সিনহা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঢাকা সফরকে 'আইওয়াশ' বলে অভিহিত করে বলেছেন, তিস্তার পানিচুক্তির প্রশ্নে কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেননি তিনি। এখন এটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে, স্থানীয় রাজনীতির বাধ্যবাধকতার কারণেই তিনি চুক্তিতে বাদ সাধছেন। বাংলাদেশকে এই পরিমাণ পানি দিলে পশ্চিমবঙ্গের কৃষির ক্ষতি হবে না, তা তিনি ভালো করেই জানেন। তিনি যে কমিশন গঠন করেছিলেন তা এসব দিক পর্যালোচনা না করে বিবেচনায় নিয়েছে পরিবেশ সংরক্ষণ।
শেখ হাসিনা ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মধ্যে বন্ধুত্ব দীর্ঘদিনের। নব্বইয়ের দশকে বিরোধী দলের নেতা হিসেবে শেখ হাসিনা দিলি্লতে গেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অশোকা হোটেলে দিদির সঙ্গে রাত কাটিয়েছেন গল্প করে। চার বছর আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল যখন নির্বাচনে জয়লাভ করে, তখন সব প্রটোকল ভেঙে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তার মূল্যায়ন করেননি, বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশের বিরোধিতা করেছেন। কিন্তু শেখ হাসিনা তা মনে রাখেননি। উদারতার ঘাটতি দেখাননি। কোনো ব্যতিক্রম না ঘটিয়ে এবারও তিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন। প্রটোকল ভেঙে শহীদ মিনারে তার সঙ্গে কথা বলেছেন এবং বাড়িতে নিজে এসে গাড়িতে তুলে দিয়েছেন। তিনি আবার প্রমাণ করেছেন, বাংলাদেশিরা অতিথিপরায়ণ। তিস্তার পানি না দিলে কী হবে তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হয়ে ফিরে গেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার সফরসঙ্গীরা। খাওয়া-দাওয়ার বিষয়টি ছিল যেন এক এলাহি কাণ্ড। তালিকায় ছিল কালিজিরা চালের ভাত, সবজি-ডাল, ভাপা ইলিশ, ইলিশ ভাজা, শর্ষে ইলিশ, ইলিশের ডিমভাজি, ইলিশের তেল, চিতলের মুইঠ্যা, রূপচাঁদা ভাজা, রুই কালিয়া, গলদা চিংড়ির মালাইকারি, খাসির রেজালা, মুরগি ভুনা এবং কুমিল্লার রসমালাই ও মিষ্টিদই। এই খাওয়া খেয়ে তার সফরসঙ্গীদের অনেকেই ঢেঁকুর তুলে বলেছেন, ইলিশের এত পদ জীবনেও কোনোদিন খাইনি। ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জিকে (তখন মন্ত্রী) তো নিজে রেঁধে পাঁচ রকমের মাছ খাইয়েছিলেন।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, তিস্তার বিষয়টি তিনি ভেবে দেখবেন। গত চার বছর ধরেই তো তিনি ভাবলেন। তার এই ভাবা কবে শেষ হবে, তা শুধু তিনিই বলতে পারেন। এখন এটি স্পষ্ট যে, তিস্তার পানি ভাগাভাগির সমাধান সহসা হচ্ছে না। তিনি তো অনেক কথাই বলে গেলেন। তবে সব কথার শেষ কথা হলো, শুধু কথায় চিড়ে ভিজে না। কথা কাজে পরিণত করতে হয়। ঢালঢোক পিটিয়ে মমতার সফরে কাজের কাজ কিছুই হলো না, মাঝখানে সমস্যা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই রয়ে গেল এবং সেই সঙ্গে ঝুলে রইল তিস্তা চুক্তি। চার বছর পর আবার তিস্তার পানি গড়াতে শুরু করবে। তবে কবে এর হিল্লে হবে তা ভবিতব্যই জানে।
প্রবীণ সাংবাদিক, ইন্টারন্যাশনাল প্রেসিডেন্ট ইমেরিটাস, কমনওয়েলথ জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন (সিজেএ)
No comments