‘ধরে নিয়ে পুলিশের গুলি’ পঙ্গুতে নুরুজ্জামানের আহাজারি by উৎপল রায়
ব্যথায়
চিৎকার করে কাঁদছেন নুরুজ্জামান। পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে পায়ে গুলি করে। শুধু
তাই নয়, অপর পা বুট দিয়ে থেঁতলে দেয়া হয়েছে। রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতালে
চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনি। পায়ের ব্যান্ডেজ চুইয়ে রক্ত ঝরছে। প্রহরা দিয়ে
রেখেছে পুলিশ। কিভাবে এমন হয়েছে? নুরুজ্জামান বলেন, কিছুই জানি না আমি।
শুধু জানি আমি বিএনপির রাজনীতি করি। মিছিল মিটিংয়ে যাই। আর এ অপরাধে পুলিশ
আমাকে ধরে নিয়ে চোখ বেঁধে রাস্তায় ফেলে পায়ে গুলি করেছে। নুরুজ্জামান
ময়মনসিংহ সদর স্বেচ্ছাসেবক দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক। নুরুজ্জামান ও তার
পরিবারের অভিযোগ ২১শে ফেব্রুয়ারি রাতে ময়মনসিংহ পণ্ডিতপাড়া এলাকায় অবস্থিত
বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের বাসভবন সুন্দর মহলে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায়
জড়িত অভিযোগে পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে যায়। ময়মনসিংহ গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) ও
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে চোখ বেঁধে পণ্ডিতপাড়া এলাকায় রাস্তায় নিয়ে তার
ডান পায়ের উরুর নিচে গুলি করে পুলিশ। শুধু তাই নয়, বুট দিয়ে তার বাঁ পায়ের
গোড়ালি ও সবগুলো আঙ্গুল থেঁতলে দেয়া হয়েছে। পঙ্গু হাসপাতালের আই-জে
ওয়ার্ডের জি-২৫ নম্বর বেডে পুলিশি প্রহরায় চিকিৎসা চলছে নুরুজ্জামানের।
তীব্র ব্যথায় কাতরাচ্ছেন তিনি। ডান পায়ে ব্যান্ডেজ। তাতে ফিক্সেটর বাঁধা।
ক্ষতস্থান চুইয়ে রক্ত ঝরছে। রক্তে গজ, বিছানা মাখামাখি। বাম পায়ের গোড়ালি
থেকে নিচ পর্যন্ত পুরোটাই ব্যান্ডেজ। ব্যথায় বার বার চিৎকার করে উঠছেন
নুরুজ্জামান। স্ত্রী ঝরনা বেগম ব্যথা প্রশমনের জন্য পিঠে, বুকে হাত বুলিয়ে
দিচ্ছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ২১শে ফেব্রুয়ারি রাত দশটায়
বাণিজ্যমেলা থেকে আকুয়া চুকাইতলার বাসায় ফিরছিলেন নুরুজ্জামান, স্ত্রী ঝরনা
বেগম ও তাদের দুই সন্তান। পথিমধ্যে নুরুজ্জামান স্ত্রী-সন্তানদের বাসায়
পাঠিয়ে ব্যক্তিগত কাজের কথা বলে থেকে যান। একপর্যায়ে কাচারিঘাট জিরোপয়েন্ট
এলাকায় আসামাত্র তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় ডিবি
অফিসে। সেখানে তার চোখ বেঁধে ফেলা হয়। এসময় কখনও চুলের মুঠি ধরে, কখনও কিল,
ঘুষি ও লাথি মেরে জিজ্ঞাসাবাদের নামে চলে শারীরিক নির্যাতন। সুন্দর মহলে
ককটেল বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করা হয়।
কিছুক্ষণ পর অন্তত ১৫ থেকে ২০ জন পুলিশ চোখবাঁধা অবস্থায় তাকে নিয়ে যায়
পণ্ডিতপাড়া এলাকায়। সেখানে একটি নির্জন জায়গায় নুরুজ্জামানকে মারতে মারতে
রাস্তায় ফেলে দেয়া হয়। নুরুজ্জামানের ভাষ্য, এসময় পুলিশ সদস্যরা হামলে পড়ে
তার ওপর। চলে চরম শারীরিক নির্যাতন। কয়েকজন পুলিশ সদস্য বুট দিয়ে
নুরুজ্জামানের বাঁ পায়ের গোড়ালি ও আঙ্গুল থেঁতলে দেয়। চুলের মুঠি ধরে
কিল-ঘুষি মারতে থাকে আরও কয়েকজন। একপর্যায়ে ডান পায়ে ঊরুর নিচে অস্ত্র
ঠেকিয়ে গুলি করে পুলিশ। গল গল করে রক্ত বের হতে থাকে ক্ষতস্থান থেকে। এভাবে
রাস্তায় পড়ে থাকার কিছুক্ষণ পর টহলরত কয়েকজন পুলিশ সদস্য তাকে নিয়ে যায়
ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। রোববার তার অবস্থার অবনতি হলে
চিকিৎসকরা তাকে ঢাকায় পাঠানোর পরামর্শ দেন। ওই দিনই নুরুজ্জামানকে নিয়ে আসা
হয় জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ভাসকুলার বিভাগে।
সেখানে চিকিৎসা শেষে তাকে পাঠিয়ে দেয়া হয় আগারগাঁওয়ের পঙ্গু হাসপাতালে।
রোববার সন্ধ্যায় তার দু’পায়ে অস্ত্রোপচার করেন কর্তব্যরত চিকিৎসকরা।
চিকিৎসকরা বলছেন, গুলিতে নুরুজ্জামানের ঊরুর নিচের হাড় ভেঙে গেছে।
ক্ষতস্থান থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েক ব্যাগ রক্ত দিতে
হয়েছে তার শরীরে। বুট দিয়ে আঘাত করায় তার বাঁ পায়ের আঙ্গুলের হাড় ভেঙে
গেছে। আঙ্গুলগুলো থেঁতলে গেছে। নুরুজ্জামানের সুস্থ এবং স্বাভাবিক জীবনে
ফিরতে অনেক সময় লাগতে পারে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সুন্দর মহলে ককটেল
বিস্ফোরণের ঘটনায় ময়মনসিংহ থানায় ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে নুরুজ্জামান
ও ছাত্রদল-যুবদলের কয়েকজন নেতাকর্মীর নামে মামলা করেছে পুলিশ। পঙ্গু
হাসপাতালে নুরুজ্জামান বলেন, পেশায় তিনি কাপড় ব্যবসায়ী। স্ত্রী ঝরনা বেগম,
কন্যা লামিশা জাহান নুহা, পুত্র নাইমুজ্জামান নির্জনকে নিয়ে তার সংসার।
তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ময়মনসিংহ জেলা সদর স্বেচ্ছাসেবক দলের
সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক তিনি। কিন্তু এই পরিচয়ই তার জন্য কাল হয়েছে বলে
জানান নুরুজ্জামান। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হওয়ার পর থেকেই তিনি
পুলিশের টার্গেটে ছিলেন তিনি। নুরুজ্জামান বলেন, রাজনীতি করার অধিকার সবারই
আছে। আমিও করি। আমি যদি কোন অন্যায় করে থাকি, সে জন্য আইন, আদালত আছে।
সেখানে আমার বিচার করা হোক। আমার শাস্তি হোক। কিন্তু মিথ্যা অভিযোগে আমাকে
ধরে নিয়ে গিয়ে পায়ে গুলি করে আমাকে পঙ্গু করার চেষ্টা করা হয়েছে। বুট দিয়ে
পা থেঁতলে দেয়া হয়েছে। এত অবিচার আমার প্রতি কেন করা হলো? তিনি বলেন, আমি
পুলিশের এই অন্যায় কাজের প্রতিবাদও করতে পারছি না। নুরুজ্জামানের স্ত্রী
ঝরনা বেগম বলেন, শুধু রাজনীতি করার কারণে আমার স্বামীর ওপর এমন নির্মম
নির্যাতন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে চিকিৎসায় অনেক টাকা খরচ হয়ে গেছে।
স্বামীর আয়ে সংসার চলে। এখন তিনি যদি পঙ্গু হয়ে বসে থাকেন তাহলে সংসার
চলবে কেমন করে? পঙ্গু হাসপাতালে নুরুজ্জামানের চাচাতো ভাই মামুন বলেন, ভাই
রাজনীতি করে এটাই তার অপরাধ। এজন্যই তাকে ধরে নিয়ে গুলি করা হয়েছে। তিনি
যদি কোন অপরাধ করে থাকেন সেজন্য আইন, আদালত আছে। কিন্তু এভাবে তাকে ধরে
নিয়ে চোখ বেঁধে কেন গুলি করা হলো?
No comments