অভিবাসী প্রশ্নে ওবামার নির্বাহী আদেশের ব্যবচ্ছেদ by তারেক শামসুর রেহমান
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা
অভিবাসীদের বৈধতা নিয়ে যে নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন, তা ইতিমধ্যেই নানা
প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। আমি অনেক বাংলাদেশী-আমেরিকানের সঙ্গে কথা বলে
দেখেছি, তারা আদৌ খুশি নন। এমনকি ওবামার এ আদেশ পুরো জাতিকেই দুভাগে ভাগ
করে দিয়েছে। রিপাবলিকানরা এতে আদৌ খুশি নন। ওবামা এ নির্বাহী আদেশ জারি
করলেন এমন এক সময় যখন মার্কিন কংগ্রেসে তার পূর্ণ সমর্থন নেই। মধ্যবর্তী
নির্বাচনে তার দল ডেমোক্রেটিক পার্টি হেরে গেছে। অর্থাৎ কংগ্রেস এবং হাউস
অব রিপ্রেজেনটেটিভে (প্রতিনিধি পরিষদ) ডেমোক্রেটিক পার্টির কোনো
সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। এর অর্থ হচ্ছে, প্রেসিডেন্ট ওবামা চাইলেও কোনো আইন
কংগ্রেসে পাস করাতে পারবেন না। রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস এর বিরোধিতা
করবে। তবু ওবামা রিপাবলিকানদের চ্যালেঞ্জ করে এ নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন।
রিপাবলিকানরা খুব সহজে এটা মেনে নেবে এমনটি কেউই মনে করছেন না। ফলে এ
অভিবাসী প্রশ্নেই প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কংগ্রেসের দ্বন্দ্ব শুরু হতে পারে।
মার্কিন সমাজের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অভিবাসন। অভিবাসীরা বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন এবং নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেন। আপনি যদি নিউইয়র্কের সাবওয়েতে (মেট্রো রেল) ভ্রমণ করেন, তাহলে দেখবেন বিভিন্ন জাতির মানুষ। এরা সবাই শ্বেতাঙ্গ বটে, কিন্তু বিভিন্ন দেশ থেকে এসে বংশপরম্পরায় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। এদের সন্তানরা নতুন আমেরিকার জন্ম দিয়েছে। আদি আমেরিকান বলতে কেউ নেই। আদি আমেরিকান, অর্থাৎ রেড ইন্ডিয়ানরা এখন নির্দিষ্ট এলাকায়, অত্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করেন। কয়েক বছর আগে নিউমেক্সিকো রাজ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সৌজন্যে রেড ইন্ডিয়ানদের একটি গ্রাম দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। এরা সংখ্যায় কম। মূলধারায় বিচরণ করেন না। উচ্চশিক্ষাও তেমন নেন না। এদের মধ্য থেকে অতীতে কখনও কেউ সিনেট বা প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হননি। তবে এদের গ্রামের একজন গভর্নর আছেন। তাদের প্রশাসন তারা নিজেরাই চালান। সরকার তাদের আর্থিক সহযোগিতা করে। এর বাইরে আইরিশ, স্কটিশ, পোলিশ, রাশিয়ান, মেক্সিকান, ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যা বেশি। তারা কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করছেন।
নিউইয়র্কে সম্ভবত প্রায় ১০০ দেশের অভিবাসী বসবাস করছেন। এ নগরীরও তাদের প্রয়োজন রয়েছে। এদের ছাড়া নিউইয়র্ক শহর চলবে না। এরা সস্তায় শ্রম দেন। আমি ম্যানহাটনে একজনকে পেয়েছিলাম, যিনি ভালো ইংরেজি বলতে পারেন না। রাস্তায় নির্মাণ কাজ করেন। শ্বেতাঙ্গ। কিন্তু গ্রিনকার্ড হোল্ডার। এ ধরনের কাজ অভিবাসী শ্বেতাঙ্গদের সন্তানরা করবে না। ম্যানহাটনে যে হাসপাতালে আমি চিকিৎসা নিয়েছি, সেখানে একজন পরিচ্ছন্ন কর্মী আলিয়া মন্টেনেগরো থেকে এসেছিলেন ৪০ বছর আগে। এখন পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি মুসলমান। স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের ভাড়া বাড়িতে থাকেন। কেননা শহরে থাকার সামর্থ্য তার নেই। এ নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটনে শত শত সুউচ্চ ভবন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখায় তিনি অবদান রাখছেন। এদের ছাড়া বড় বড় শহর অচল। এখন রিপাবলিকানরা যতই বিরোধিতা করুক না কেন, এদের প্রয়োজন আছে।
এ অভিবাসী কর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখছেন। ফরচুন ম্যাগাজিনের ১৬ জুন সংখ্যায় (২০১৪) জেনিফার আলসেভারের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে (ইমিগ্রেন্টস : অ্যামেরিকাস জব ক্রিয়েটার)। তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ৫০০টি কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব থাকবে না অভিবাসীদের অংশগ্রহণ ছাড়া। তিনি ওই প্রবন্ধে বেশকিছু পরিসংখ্যানও দিয়েছেন। পরিসংখ্যানে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা অনেকটা এরকম : ১. অভিবাসীরা যেসব কোম্পানি পরিচালনা করছেন, তার মূলধনের পরিমাণ বছরে ৭৭৫ বিলিয়ন ডলার। আর আয় করেন ১০০ বিলিয়ন ডলার; ২. প্রতি ১০ জন কর্মীর মাঝে একজন অভিবাসী; ৩. প্রতিবছর স্থায়ীভাবে এ দেশে থাকার অধিকার পান ৩ লাখ ৭৬ হাজার অভিবাসী; ৪. ২০১৩ সালে গ্রিনকার্ড দেয়া হয়েছে ৪৩ লাখ অভিবাসীকে। ২০০৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৫ লাখ; ৫. ২০০৮ সালে যেখানে ৫০ হাজার চীনা ছাত্র দেশে ফিরে গেছে, সেখানে ২০১১ সালে ফিরে গেছে ১ লাখ ৮০ হাজার জন; ৬. ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা ২৮ ভাগ ব্যবসা শুরু করেছে অভিবাসীরা, অথচ তারা জনসংখ্যার মাত্র ১২ দশমিক ৯ ভাগ; ৭. শীর্ষ ৫০০ বড় কোম্পানির মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগ প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী বা তাদের সন্তানরা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে AT&T, Procter & Gamble, Goldman Sachs, Pfizer, eBay, Google, Intel, Kraft, Cigna, Kohl ইত্যাদি। চিন্তা করা যায়, বিশ্বব্যাপী নামকরা এসব কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীরা। শুধু তাই নয়, পরিসংখ্যান আরও বলছে বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির একটা বড় অংশ এসব অভিবাসীর নিয়ন্ত্রণে। যেমন বলা যেতে পারে সিমেন্সের কথা। ফরচুন ম্যাগাজিনের গবেষণায় দেখা গেছে, এ কোম্পানির ৬৩ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে অভিবাসীরা। Merck-এর ক্ষেত্রে ৬৫ ভাগ, CISCO-এর ৬০ ভাগ, General Electric-এর ৬৪ ভাগ, Qualcom-এর ৭২ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে অভিবাসীরা।
সুতরাং বারাক ওবামা যখন অভিবাসীদের বৈধতা দেয়ার কথা ঘোষণা করেছেন, তখন এর পেছনে একটা যুক্তি অবশ্যই আছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে নানা কারণে। প্রায় ৫ লাখ নাগরিকের, যাদের একটা বড় অংশ মেক্সিকো ও লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের অধিবাসী এবং স্পেনিশ ভাষাভাষী, তারা এ সুযোগ পাবেন। তাদের কাজ করার অনুমতি দেয়া হবে। কিন্তু গ্রিনকার্ড দেয়া হবে না। অর্থাৎ স্থায়ী থাকার অধিকার তারা পাবেন না। ফলে এসব অবৈধ বসবাসকারীকে আর তাদের স্ব স্ব দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না। বেশি সুযোগ পাবে তারা, যারা এ দেশে জন্মগ্রহণ করেছে; কিন্তু বাবা-মা অবৈধ থাকায় তারাও অবৈধ হয়ে গেছে। অনেকে আছেন, যাদের ১০ বছর থাকার পরও গ্রিনকার্ড হয়নি। ওবামার এ ঘোষণা তাদের কাজ করার অনুমতি দেবে। কিন্তু স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি আপাতত দেবে না। দুই ক্যাটাগরিতে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক. কৃষি শ্রমিক। এরা কাজ করার বৈধ অনুমতি পাবে। নিউইয়র্কের আপার স্টেটে বাংলাদেশীদের বেশ কটি কৃষি ফার্ম রয়েছে। এখানে বাংলাদেশীরাই কাজ করেন। তারা নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশীদের সবজির জোগান দেন। এখানে কিছু অবৈধ বাংলাদেশী কাজ করেন। তারা কাজ করার অনুমতি পাবেন। তবে বেশি সুযোগ পাবে মেক্সিকানরা। তারা প্রচুর সংখ্যায় এ দেশে আছেন। কৃষি শ্রমিক থেকে শুরু করে নির্মাণ শ্রমে তাদের অংশগ্রহণ বেশি। কোনো আমেরিকান বেকার থাকলেও সাধারণত এসব কাজ তারা করেন না। ফলে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ও কৃষি সেক্টরে এদের প্রয়োজন আছেই। তবে বৈধতা পাওয়ায় অনেক সমস্যার জন্ম হবে। এক. অভিবাসীদের সন্তানরা তখন স্কুলে যাবে এবং তাদের স্কুলের খরচ রাজ্যগুলোকে বহন করতে হবে। রিপাবলিকানরা এতে আপত্তি তুলবে এবং তাতে সমস্যা হবে। দুই. সরকারি হাসপাতালগুলোকে তাদের চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। এতে খরচ বাড়বে। ফেডারেল সরকারকে এ খরচ দিতে হবে। রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস এ বাজেট বরাদ্দ দেবে না। তিন. অভিবাসীদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় আর্থিক সহায়তার প্রশ্নটিও আসবে। এখানে সবাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে রাষ্ট্র থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে। পরে চাকরি করে তারা তা পরিশোধ করেও দেয়। এখন যে অভিবাসীর সন্তান, সে তার বাবার ওয়ার্ক পারমিটের সুযোগে এখানে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষায় সহযোগিতা চাইবে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলশিক্ষা ফ্রি হলেও কলেজ শিক্ষা ফ্রি নয়। এখন রাষ্ট্র যদি তা না দেয়, তাহলে সংবিধানের দোহাই তুলে মামলা-মোকদ্দমা হতে পারে। অভিবাসনবিরোধীরা এ প্রশ্ন তুলতে পারে। এমনকি ডেমোক্রেট আইন প্রণেতাদেরও কেউ কেউ এটি চাইবেন না। কারণ ভোটের জন্য তাদের স্থানীয় জনগণের কাছে যেতে হয়। স্থানীয় জনগণ এটা চাইবে না। এমনকি কৃষ্ণাঙ্গরাও এটা পছন্দ করবে না। সুতরাং ওবামার এ ঘোষণা যে খুব জনপ্রিয় হয়েছে, এটা বলা যাবে না।
ডিসেম্বরে বাজেট পাস হতে হবে। ওবামা তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করবেন। কিন্তু রিপাবলিকানরা তা অনুমোদন করবে না। ফলে এ ডিসেম্বরেই নতুন করেই দ্বন্দ্ব শুরু হবে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কংগ্রেসের। শাটডাউনের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে আবার। কংগ্রেস বাজেট পাস না করলে অনেক ফেডারেল বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যাবে গতবারের মতো। এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তাই একটা শংকা থেকেই গেল। ইতিমধ্যে অনেক রিপাবলিকান নেতার কথায় এ বক্তব্যই প্রতিফলিত হয়েছে যে, তারা খুব সহজে ওবামার এ আদেশটি মেনে নেবেন না।
ওবামার এ আদেশে বাংলাদেশীরা কতটুকু সুবিধা পাবেন, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। যেখানে ভারতীয় অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা ৫ লাখ বলা হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা কত, এর কোনো সুস্পষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী আছেন। তারা মূলত বড় বড় শহরে বসবাস করেন। তাদের অনেকে এ আদেশের আওতায় নাও আসতে পারেন। কেননা তাদের অনেকের বাবা-মা এ দেশে থাকেন না। ফলে এ আদেশ তাদের জন্য কার্যকর হবে না। তবে একটা আশংকা থেকেই গেল যে, তারা অবৈধ থেকে যেতে পারেন। তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা কার্যকর নাও হতে পারে। তবে অনেক ভারতীয় আছেন, যাদের সন্তানরা আইটি সেক্টরে পড়াশোনা করে। তাদের জন্য একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। গেল বছর যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী ৭২ হাজার অভিবাসীকে ডিপোর্ট করা হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ওই সব বাবা-মার প্রায় ৫ হাজার সন্তান এখন ফস্টার হোমে বসবাস করছে। সেখানকার টিভিতে Orange Is the New Black নামে একটি সিরিয়াল সম্প্রচারিত হয়। এতে অভিনয় করছেন মিস ডায়ানে গুয়েয়ারআরো। তিনি একজন অভিবাসীর সন্তান। তিনি ফস্টার হোমে বড় হয়েছেন। সিরিয়ালটি অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে। মিস ডায়ানের অভিনয় সবাইকে ছুঁয়ে যায়। ১৪ বছর বয়সে তার বাবা-মাকে স্বদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। একা একা বড় হওয়া ডায়ানে এখন দক্ষ অভিনেত্রী। এ ধরনের ডায়ানের সংখ্যা এখন অনেক।
ওবামার নির্বাহী আদেশ অবৈধ অভিবাসীদের জন্য একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও তা অভিবাসীদের কতটুকু স্বস্তি দেবে, তা নিশ্চিত করে এখনই বলা যাচ্ছে না। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে যখন কংগ্রেসের অধিবেশন বসবে, তখনই বোঝা যাবে কংগ্রেস সদস্যরা প্রেসিডেন্টের এ আদেশকে কিভাবে দেখবেন। তবে বিষয়টি খুব সহজেই সমাধান হয়ে যাবে, এটা বলা যাবে না। কংগ্রেসকে একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে। কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের প্রতি কতটুকু সম্মান দেখাবে- এ প্রশ্ন থাকলই।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মার্কিন সমাজের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অভিবাসন। অভিবাসীরা বিভিন্ন দেশ থেকে এসেছেন এবং নতুন এক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছেন। আপনি যদি নিউইয়র্কের সাবওয়েতে (মেট্রো রেল) ভ্রমণ করেন, তাহলে দেখবেন বিভিন্ন জাতির মানুষ। এরা সবাই শ্বেতাঙ্গ বটে, কিন্তু বিভিন্ন দেশ থেকে এসে বংশপরম্পরায় যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। এদের সন্তানরা নতুন আমেরিকার জন্ম দিয়েছে। আদি আমেরিকান বলতে কেউ নেই। আদি আমেরিকান, অর্থাৎ রেড ইন্ডিয়ানরা এখন নির্দিষ্ট এলাকায়, অত্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলে বসবাস করেন। কয়েক বছর আগে নিউমেক্সিকো রাজ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সৌজন্যে রেড ইন্ডিয়ানদের একটি গ্রাম দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। এরা সংখ্যায় কম। মূলধারায় বিচরণ করেন না। উচ্চশিক্ষাও তেমন নেন না। এদের মধ্য থেকে অতীতে কখনও কেউ সিনেট বা প্রতিনিধি পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হননি। তবে এদের গ্রামের একজন গভর্নর আছেন। তাদের প্রশাসন তারা নিজেরাই চালান। সরকার তাদের আর্থিক সহযোগিতা করে। এর বাইরে আইরিশ, স্কটিশ, পোলিশ, রাশিয়ান, মেক্সিকান, ভারতীয় অভিবাসীর সংখ্যা বেশি। তারা কয়েক প্রজন্ম ধরে বসবাস করছেন।
নিউইয়র্কে সম্ভবত প্রায় ১০০ দেশের অভিবাসী বসবাস করছেন। এ নগরীরও তাদের প্রয়োজন রয়েছে। এদের ছাড়া নিউইয়র্ক শহর চলবে না। এরা সস্তায় শ্রম দেন। আমি ম্যানহাটনে একজনকে পেয়েছিলাম, যিনি ভালো ইংরেজি বলতে পারেন না। রাস্তায় নির্মাণ কাজ করেন। শ্বেতাঙ্গ। কিন্তু গ্রিনকার্ড হোল্ডার। এ ধরনের কাজ অভিবাসী শ্বেতাঙ্গদের সন্তানরা করবে না। ম্যানহাটনে যে হাসপাতালে আমি চিকিৎসা নিয়েছি, সেখানে একজন পরিচ্ছন্ন কর্মী আলিয়া মন্টেনেগরো থেকে এসেছিলেন ৪০ বছর আগে। এখন পরিচ্ছন্ন কর্মী হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি মুসলমান। স্ট্যাটেন আইল্যান্ডের ভাড়া বাড়িতে থাকেন। কেননা শহরে থাকার সামর্থ্য তার নেই। এ নিউইয়র্ক শহরের ম্যানহাটনে শত শত সুউচ্চ ভবন পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখায় তিনি অবদান রাখছেন। এদের ছাড়া বড় বড় শহর অচল। এখন রিপাবলিকানরা যতই বিরোধিতা করুক না কেন, এদের প্রয়োজন আছে।
এ অভিবাসী কর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতেও বড় অবদান রাখছেন। ফরচুন ম্যাগাজিনের ১৬ জুন সংখ্যায় (২০১৪) জেনিফার আলসেভারের একটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে (ইমিগ্রেন্টস : অ্যামেরিকাস জব ক্রিয়েটার)। তাতে তিনি উল্লেখ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ ৫০০টি কোম্পানির কোনো অস্তিত্ব থাকবে না অভিবাসীদের অংশগ্রহণ ছাড়া। তিনি ওই প্রবন্ধে বেশকিছু পরিসংখ্যানও দিয়েছেন। পরিসংখ্যানে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে, তা অনেকটা এরকম : ১. অভিবাসীরা যেসব কোম্পানি পরিচালনা করছেন, তার মূলধনের পরিমাণ বছরে ৭৭৫ বিলিয়ন ডলার। আর আয় করেন ১০০ বিলিয়ন ডলার; ২. প্রতি ১০ জন কর্মীর মাঝে একজন অভিবাসী; ৩. প্রতিবছর স্থায়ীভাবে এ দেশে থাকার অধিকার পান ৩ লাখ ৭৬ হাজার অভিবাসী; ৪. ২০১৩ সালে গ্রিনকার্ড দেয়া হয়েছে ৪৩ লাখ অভিবাসীকে। ২০০৯ সালে এ সংখ্যা ছিল ৩৫ লাখ; ৫. ২০০৮ সালে যেখানে ৫০ হাজার চীনা ছাত্র দেশে ফিরে গেছে, সেখানে ২০১১ সালে ফিরে গেছে ১ লাখ ৮০ হাজার জন; ৬. ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে শতকরা ২৮ ভাগ ব্যবসা শুরু করেছে অভিবাসীরা, অথচ তারা জনসংখ্যার মাত্র ১২ দশমিক ৯ ভাগ; ৭. শীর্ষ ৫০০ বড় কোম্পানির মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগ প্রথম প্রজন্মের অভিবাসী বা তাদের সন্তানরা প্রতিষ্ঠা করেছেন। এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে AT&T, Procter & Gamble, Goldman Sachs, Pfizer, eBay, Google, Intel, Kraft, Cigna, Kohl ইত্যাদি। চিন্তা করা যায়, বিশ্বব্যাপী নামকরা এসব কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসীরা। শুধু তাই নয়, পরিসংখ্যান আরও বলছে বড় বড় মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির একটা বড় অংশ এসব অভিবাসীর নিয়ন্ত্রণে। যেমন বলা যেতে পারে সিমেন্সের কথা। ফরচুন ম্যাগাজিনের গবেষণায় দেখা গেছে, এ কোম্পানির ৬৩ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে অভিবাসীরা। Merck-এর ক্ষেত্রে ৬৫ ভাগ, CISCO-এর ৬০ ভাগ, General Electric-এর ৬৪ ভাগ, Qualcom-এর ৭২ ভাগ নিয়ন্ত্রণ করে অভিবাসীরা।
সুতরাং বারাক ওবামা যখন অভিবাসীদের বৈধতা দেয়ার কথা ঘোষণা করেছেন, তখন এর পেছনে একটা যুক্তি অবশ্যই আছে। তবে প্রশ্ন উঠেছে নানা কারণে। প্রায় ৫ লাখ নাগরিকের, যাদের একটা বড় অংশ মেক্সিকো ও লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশের অধিবাসী এবং স্পেনিশ ভাষাভাষী, তারা এ সুযোগ পাবেন। তাদের কাজ করার অনুমতি দেয়া হবে। কিন্তু গ্রিনকার্ড দেয়া হবে না। অর্থাৎ স্থায়ী থাকার অধিকার তারা পাবেন না। ফলে এসব অবৈধ বসবাসকারীকে আর তাদের স্ব স্ব দেশে ফেরত পাঠানো যাবে না। বেশি সুযোগ পাবে তারা, যারা এ দেশে জন্মগ্রহণ করেছে; কিন্তু বাবা-মা অবৈধ থাকায় তারাও অবৈধ হয়ে গেছে। অনেকে আছেন, যাদের ১০ বছর থাকার পরও গ্রিনকার্ড হয়নি। ওবামার এ ঘোষণা তাদের কাজ করার অনুমতি দেবে। কিন্তু স্থায়ীভাবে থাকার অনুমতি আপাতত দেবে না। দুই ক্যাটাগরিতে এ নিয়ম প্রযোজ্য হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এক. কৃষি শ্রমিক। এরা কাজ করার বৈধ অনুমতি পাবে। নিউইয়র্কের আপার স্টেটে বাংলাদেশীদের বেশ কটি কৃষি ফার্ম রয়েছে। এখানে বাংলাদেশীরাই কাজ করেন। তারা নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশীদের সবজির জোগান দেন। এখানে কিছু অবৈধ বাংলাদেশী কাজ করেন। তারা কাজ করার অনুমতি পাবেন। তবে বেশি সুযোগ পাবে মেক্সিকানরা। তারা প্রচুর সংখ্যায় এ দেশে আছেন। কৃষি শ্রমিক থেকে শুরু করে নির্মাণ শ্রমে তাদের অংশগ্রহণ বেশি। কোনো আমেরিকান বেকার থাকলেও সাধারণত এসব কাজ তারা করেন না। ফলে নির্মাণ প্রতিষ্ঠান ও কৃষি সেক্টরে এদের প্রয়োজন আছেই। তবে বৈধতা পাওয়ায় অনেক সমস্যার জন্ম হবে। এক. অভিবাসীদের সন্তানরা তখন স্কুলে যাবে এবং তাদের স্কুলের খরচ রাজ্যগুলোকে বহন করতে হবে। রিপাবলিকানরা এতে আপত্তি তুলবে এবং তাতে সমস্যা হবে। দুই. সরকারি হাসপাতালগুলোকে তাদের চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। এতে খরচ বাড়বে। ফেডারেল সরকারকে এ খরচ দিতে হবে। রিপাবলিকান নিয়ন্ত্রিত কংগ্রেস এ বাজেট বরাদ্দ দেবে না। তিন. অভিবাসীদের সন্তানদের উচ্চশিক্ষায় আর্থিক সহায়তার প্রশ্নটিও আসবে। এখানে সবাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে রাষ্ট্র থেকে আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে। পরে চাকরি করে তারা তা পরিশোধ করেও দেয়। এখন যে অভিবাসীর সন্তান, সে তার বাবার ওয়ার্ক পারমিটের সুযোগে এখানে পড়াশোনা করে উচ্চশিক্ষায় সহযোগিতা চাইবে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রে স্কুলশিক্ষা ফ্রি হলেও কলেজ শিক্ষা ফ্রি নয়। এখন রাষ্ট্র যদি তা না দেয়, তাহলে সংবিধানের দোহাই তুলে মামলা-মোকদ্দমা হতে পারে। অভিবাসনবিরোধীরা এ প্রশ্ন তুলতে পারে। এমনকি ডেমোক্রেট আইন প্রণেতাদেরও কেউ কেউ এটি চাইবেন না। কারণ ভোটের জন্য তাদের স্থানীয় জনগণের কাছে যেতে হয়। স্থানীয় জনগণ এটা চাইবে না। এমনকি কৃষ্ণাঙ্গরাও এটা পছন্দ করবে না। সুতরাং ওবামার এ ঘোষণা যে খুব জনপ্রিয় হয়েছে, এটা বলা যাবে না।
ডিসেম্বরে বাজেট পাস হতে হবে। ওবামা তার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর প্রস্তাব করবেন। কিন্তু রিপাবলিকানরা তা অনুমোদন করবে না। ফলে এ ডিসেম্বরেই নতুন করেই দ্বন্দ্ব শুরু হবে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কংগ্রেসের। শাটডাউনের মতো পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে আবার। কংগ্রেস বাজেট পাস না করলে অনেক ফেডারেল বরাদ্দ বন্ধ হয়ে যাবে গতবারের মতো। এবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে। তাই একটা শংকা থেকেই গেল। ইতিমধ্যে অনেক রিপাবলিকান নেতার কথায় এ বক্তব্যই প্রতিফলিত হয়েছে যে, তারা খুব সহজে ওবামার এ আদেশটি মেনে নেবেন না।
ওবামার এ আদেশে বাংলাদেশীরা কতটুকু সুবিধা পাবেন, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। যেখানে ভারতীয় অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা ৫ লাখ বলা হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশী অভিবাসীর সংখ্যা কত, এর কোনো সুস্পষ্ট পরিসংখ্যান নেই। তবে অবৈধ বাংলাদেশী অভিবাসী আছেন। তারা মূলত বড় বড় শহরে বসবাস করেন। তাদের অনেকে এ আদেশের আওতায় নাও আসতে পারেন। কেননা তাদের অনেকের বাবা-মা এ দেশে থাকেন না। ফলে এ আদেশ তাদের জন্য কার্যকর হবে না। তবে একটা আশংকা থেকেই গেল যে, তারা অবৈধ থেকে যেতে পারেন। তাদের জন্য সাধারণ ক্ষমা কার্যকর নাও হতে পারে। তবে অনেক ভারতীয় আছেন, যাদের সন্তানরা আইটি সেক্টরে পড়াশোনা করে। তাদের জন্য একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। গেল বছর যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী ৭২ হাজার অভিবাসীকে ডিপোর্ট করা হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ওই সব বাবা-মার প্রায় ৫ হাজার সন্তান এখন ফস্টার হোমে বসবাস করছে। সেখানকার টিভিতে Orange Is the New Black নামে একটি সিরিয়াল সম্প্রচারিত হয়। এতে অভিনয় করছেন মিস ডায়ানে গুয়েয়ারআরো। তিনি একজন অভিবাসীর সন্তান। তিনি ফস্টার হোমে বড় হয়েছেন। সিরিয়ালটি অবৈধ অভিবাসীদের নিয়ে। মিস ডায়ানের অভিনয় সবাইকে ছুঁয়ে যায়। ১৪ বছর বয়সে তার বাবা-মাকে স্বদেশে পাঠিয়ে দেয়া হয়। একা একা বড় হওয়া ডায়ানে এখন দক্ষ অভিনেত্রী। এ ধরনের ডায়ানের সংখ্যা এখন অনেক।
ওবামার নির্বাহী আদেশ অবৈধ অভিবাসীদের জন্য একটা সম্ভাবনা সৃষ্টি করলেও তা অভিবাসীদের কতটুকু স্বস্তি দেবে, তা নিশ্চিত করে এখনই বলা যাচ্ছে না। ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে যখন কংগ্রেসের অধিবেশন বসবে, তখনই বোঝা যাবে কংগ্রেস সদস্যরা প্রেসিডেন্টের এ আদেশকে কিভাবে দেখবেন। তবে বিষয়টি খুব সহজেই সমাধান হয়ে যাবে, এটা বলা যাবে না। কংগ্রেসকে একটি আইন প্রণয়ন করতে হবে। কংগ্রেস প্রেসিডেন্টের প্রতি কতটুকু সম্মান দেখাবে- এ প্রশ্ন থাকলই।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
No comments