দুর্নীতি বেড়েছে বাংলাদেশে
বাংলাদেশে
গত বছরের তুলনায় দুর্নীতি বেড়েছে। বিশ্বের ১৭৫টি দেশের মধ্যে দুর্নীতির
দিক দিয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৪তম। আর দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে
দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বাংলাদেশ। বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি
ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) প্রকাশিত হয়
বুধবার। এ সূচক অনুসারে গত বছরের তুলনায়, বাংলাদেশের স্কোর ও অবস্থান উভয়
খাতেই অবনতি হয়েছে। পরপর পাঁচবার দুর্নীতির শীর্ষে থাকার পর ২০০৬ সাল থেকে
তা কমতে থাকে। ২০১৩ সাল পর্যন্ত ১৬তম অবস্থানে নেমে এলেও এক বছরের ব্যবধানে
আবারও দুই ধাপ বেড়েছে। জাতীয় সংসদসহ জবাবদিহিতামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর
অকার্যকারিতা ও দায়গ্রস্তদের বিচারহীনতার (দায়মুক্তি) সংস্কৃতি দুর্নীতিতে
উৎসাহিত করছে বলে জানান টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
টিআইবির চেয়ারম্যান সুলতানা কামাল বলেন, কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে
ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে রাষ্ট্র, যা উদ্বেগকজনক। রাজনৈতিক অঙ্গীকার অনুযায়ী
ব্যর্থতার এ দায় সরকারকেই নিতে হবে বলে মনে করেন তিনি। বিশ্বব্যাপী একযোগে
এ রিপোর্ট প্রকাশ উপলক্ষে বুধবার ঢাকায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ
সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এতে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরেন টিআইবির
নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এ বছর বাংলাদেশ ০-১০০ স্কেলে ২৫ স্কোর পেয়ে ১৭৫টি দেশের মধ্যে ঊর্ধ্বক্রম অনুসারে ১৪৫তম এবং নিুক্রম অনুসারে ১৪তম অবস্থানে রয়েছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬-তে। সে তুলনায় অবস্থানের নিুক্রমেও দুই ধাপ অবনতি হয়েছে। একই সঙ্গে গত বছরের স্কোর ২৭-এর চেয়ে এবার দুই স্কোর কম পেয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া উচ্চক্রমের দিক থেকেও বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় নয় ধাপ নিচে নেমে গেছে।
উল্লেখ্য, সূচক স্কেলের ০ স্কোরকে বেশি দুর্নীতি এবং ‘১০০’ স্কোরকে কম দুর্নীতির মাপকাঠি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ বছর দুর্নীতির সূচক তৈরির ক্ষেত্রে ২০১১ সালের ফেব্র“য়ারি থেকে ২০১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে ড. জামান বলেন, বিভিন্ন কারণে সিপিআই সূচকে এ বছর বাংলাদেশের ক্রমের অবনতি হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের ঘাটতি, কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দৃষ্টান্তের অভাব, দুদকের স্বাধীনতা খর্ব করার অপপ্রয়াস, পদ্মা সেতু প্রকল্প, রেলওয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য, শেয়ারবাজার, হলমার্ক ও ডেসটিনি এবং সোনালী ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে ব্যাপক অনিয়ম, রানা প্লাজার ঘটনার ব্যাপারে শৈথিল্য, ক্ষমতাবানদের বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন সম্পদের বৃদ্ধি, খেলাপি ঋণের দৌরাত্ম্য, সংসদসহ সংশ্লিষ্ট জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা, নিয়োগ-বাণিজ্যের রাজনীতিকীকরণ এবং ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় ভূমি ও নদী-জলাশয় দখলের মহোৎসব এবং ব্যবসার প্রসার। তিনি আরও বলেন, বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে দুদককে অনেক সময়ই সরকারের এক ধরনের বি-টিমের ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজামান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে আফগানিস্তান। এর পরের অবস্থানেই আছে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ দুই পয়েন্ট কম পেয়েছ। এতে দুর্নীতির বৈশ্বিক ধারণা সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে দুর্নীতিতে যে প্রকট আকার ধারণ করেছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি আরও বলেন, ২০১৪ সালের সিপিআই অনুযায়ী ৯২টি দেশের স্কোর বৃদ্ধি পেয়েছে, ৪৭টি দেশ আগের স্কোর ধরে রেখেছে। অন্যদিকে যে ৩৬টি দেশের স্কোরের অবনতি হয়েছে, দুঃখজনকভাবে সেই তালিকায় বাংলাদেশও আছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সঙ্গে একই স্কোর প্রাপ্ত অন্য চারটি দেশ হল- গিনি, লাওস, কেনিয়া ও পাপুয়া নিউগিনি।
জাতীয় সংসদের অকার্যকারিতাসহ জবাবদিহিতামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতাই দুর্নীতি বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, দুর্নীতি উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। দেশে আইনের শাসনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এই দুর্নীতি। বাংলাদেশে যে দুর্নীতি হয় তা বন্ধ করা গেলে প্রবৃদ্ধির হার আরও ৪ শতাংশ বাড়ত। তিনি বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের দুর্নীতি সাধারণ মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্রতম গোষ্ঠী।
তিনি বলেন, দুর্নীতির বিচারহীনতা একটি স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকারের মানসিকতা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতি বিষয়ে ‘রি-অ্যাক্ট করা হয়, রেসপন্স করা হয় না।’ তিনি বলেন, মন্ত্রী-এমপিরা অবৈধভাবে বিভিন্ন সুযোগ নিচ্ছেন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। যার প্রভাব পড়ছে দুর্নীতি সূচকে। উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতির সহায়ক শক্তির প্রভাব বাড়ছে ও দুর্নীতি বিরোধীদের কোনো প্রভাব থাকছে না। যারা দুর্নীতি ও অপরাধ করছে তাদের বিচারের আওতায় আনা যাচ্ছে না।
২০১৪ সালে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ডেনমার্ক, যার স্কোর ৯২। ৯১ স্কোর পেয়ে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ড এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে ফিনল্যান্ড, যার স্কোর ৮৯। ৮ স্কোর পেয়ে ২০১৪ সালে তালিকার সর্বনিুে অবস্থান করছে যৌথভাবে সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া। ১১ ও ১২ স্কোর পেয়ে তালিকার সর্বনিম্নের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দেশ হিসেবে রয়েছে যথাক্রমে সুদান ও আফগানিস্তান।
সংবাদ সম্মেলনে সুলতানা কামাল বলেন, দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যাপক বিস্তার এবং জবাবদিহিতার ঘাটতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের দরিদ্র জনগণ। আমরা সরকারের কাছ থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাইনি। সে কারণে রাজনৈতিক অঙ্গীকার অনুযায়ী কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় সরকারকেই নিতে হবে।
তিনি বলেন, দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে সুরক্ষার সংস্কৃতিই লক্ষ্য করা গেছে। অথচ যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন তাদের সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার বদলে উচ্চ পর্যায় থেকে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা যায়।
দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা উদ্বেগজনক জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের গড় স্কোর অনেক কম। দুর্নীতির বিষয়ে গত বছরের অবস্থানও ধরে রাখা যায়নি বরং সেখান থেকে অবনতি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আরও কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানান তিনি।
সিপিআই সম্পর্কে যথাযথ ধারণার অভাবে মনে করা হয় বাংলাদেশ বা তার অধিবাসীরা দুর্নীতিগ্রস্ত। এটা ঠিক নয় জানিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাস্তবে দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি ও তা প্রতিরোধে দেশের নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার কারণে দেশ বা জনগণকে কোনোভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যাবে না।
সিপিআই ২০১৪-এর জন্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সূত্র হিসেবে ৭টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য যথাক্রমে : বার্টেলসমান ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কর্র্তৃক পরিচালিত কান্ট্রি রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট, গ্লোবাল ইনসাইটের কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস্, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেসের ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক্সিউকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে এবং ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট পরিচালিত রুল অব ল ইনডেক্সের রিপোর্টগুলোর জরিপ ব্যবহৃত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবি কোনো ভূমিকা পালন করে না। এমনকি টিআইবির গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য বা বিশ্নেষণ সিপিআই-এ পাঠানো হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের মতোই টিআইবি দুর্নীতির ধারণা সূচক স্থানীয় পর্যায়ে প্রকাশ করে মাত্র।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান ও ড. এটিএম শামসুল হুদা এবং উপনির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের।
আবারও বৃদ্ধির দিকে দুর্নীতি : ২০০১ সাল থেকে পরবর্তী ৫ বছর বাংলাদেশ দুর্নীতির শীর্ষে ছিল। ২০০৬ সাল থেকে দুর্নীতির অবস্থার নিচে নামতে থাকে। ওই বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তিনে। এরপর ২০০৭ সালে ৭ম, ২০০৮ সালে ১০ম, পরের বছর আরও এক ধাপ উন্নতি করে। ২০১০ সালে ১২তম অবস্থানে আসে দুর্নীতির সূচক। ২০১১ ও ১২ সালে ১৩তম এবং ২০১৩ সালে ১৬তম অবস্থানে চলে আসে। কিন্তু এবার আবার ২ ধাপ অবনতি হয়ে ১৪-তে দাঁড়িয়েছে।
দুর্নীতিতে শীর্ষে সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া : দুর্নীতির ধারণা সূচকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া। সূচকের নিম্নক্রম অনুসারে ১৭৫টি দেশের মধ্যে এই দুই দেশের অবস্থান ১৭৪। ওই দুই দেশের স্কোর ৮। এরপর রয়েছে সুদান ১৭৩তম (স্কোর ১১), আফগানিস্তান ১৭২তম (স্কোর ১২), দক্ষিণ সুদান ১৭১ (স্কোর ১৫), ইরাক ১৭০তম (স্কোর-১৬) তুর্কিমেনিস্তান ১৬৯তম (স্কোর ১৭) ও উজবেকিস্তান, লিবিয়া এবং ইরিত্রিয়া ১৬৬তম (স্কোর ১৮)।
কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ডেনমার্ক : ২০১৪ সালে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে রয়েছে ডেনমার্ক। ১০০ স্কেলের মধ্যে দেশটির স্কোর ৯২। কম দুর্নীতিগ্রস্ত ১০টি দেশের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ড (স্কোর ৯১) ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ফিনল্যান্ড (স্কোর ৮৯)। এরপর চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে সুইডেন (স্কোর ৮৭), পঞ্চম নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড (স্কোর ৮৬), ষষ্ঠ সিঙ্গাপুর (স্কোর ৮৪), সপ্তম নেদারল্যান্ডস (স্কোর ৮৩), অষ্টম লুক্সেমবার্গ (স্কোর ৮২) এবং নবম অবস্থানে কানাডা (স্কোর ৮১)।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, এ বছর বাংলাদেশ ০-১০০ স্কেলে ২৫ স্কোর পেয়ে ১৭৫টি দেশের মধ্যে ঊর্ধ্বক্রম অনুসারে ১৪৫তম এবং নিুক্রম অনুসারে ১৪তম অবস্থানে রয়েছে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬-তে। সে তুলনায় অবস্থানের নিুক্রমেও দুই ধাপ অবনতি হয়েছে। একই সঙ্গে গত বছরের স্কোর ২৭-এর চেয়ে এবার দুই স্কোর কম পেয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া উচ্চক্রমের দিক থেকেও বাংলাদেশ গত বছরের তুলনায় নয় ধাপ নিচে নেমে গেছে।
উল্লেখ্য, সূচক স্কেলের ০ স্কোরকে বেশি দুর্নীতি এবং ‘১০০’ স্কোরকে কম দুর্নীতির মাপকাঠি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এ বছর দুর্নীতির সূচক তৈরির ক্ষেত্রে ২০১১ সালের ফেব্র“য়ারি থেকে ২০১৪ সালের আগস্ট পর্যন্ত তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে।
লিখিত বক্তব্যে ড. জামান বলেন, বিভিন্ন কারণে সিপিআই সূচকে এ বছর বাংলাদেশের ক্রমের অবনতি হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল : দুর্নীতিবিরোধী অঙ্গীকার অনুযায়ী যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের ঘাটতি, কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দৃষ্টান্তের অভাব, দুদকের স্বাধীনতা খর্ব করার অপপ্রয়াস, পদ্মা সেতু প্রকল্প, রেলওয়ে নিয়োগ-বাণিজ্য, শেয়ারবাজার, হলমার্ক ও ডেসটিনি এবং সোনালী ব্যাংকসহ আর্থিক খাতে ব্যাপক অনিয়ম, রানা প্লাজার ঘটনার ব্যাপারে শৈথিল্য, ক্ষমতাবানদের বৈধ আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন সম্পদের বৃদ্ধি, খেলাপি ঋণের দৌরাত্ম্য, সংসদসহ সংশ্লিষ্ট জবাবদিহিমূলক প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতা, নিয়োগ-বাণিজ্যের রাজনীতিকীকরণ এবং ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় ভূমি ও নদী-জলাশয় দখলের মহোৎসব এবং ব্যবসার প্রসার। তিনি আরও বলেন, বড় ধরনের দুর্নীতির অভিযোগকে কেন্দ্র করে দুদককে অনেক সময়ই সরকারের এক ধরনের বি-টিমের ভূমিকা পালন করতে দেখা গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজামান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে আফগানিস্তান। এর পরের অবস্থানেই আছে বাংলাদেশ। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ দুই পয়েন্ট কম পেয়েছ। এতে দুর্নীতির বৈশ্বিক ধারণা সূচকেও বাংলাদেশের অবস্থানের অবনতি হয়েছে। ফলে বাংলাদেশে দুর্নীতিতে যে প্রকট আকার ধারণ করেছে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। তিনি আরও বলেন, ২০১৪ সালের সিপিআই অনুযায়ী ৯২টি দেশের স্কোর বৃদ্ধি পেয়েছে, ৪৭টি দেশ আগের স্কোর ধরে রেখেছে। অন্যদিকে যে ৩৬টি দেশের স্কোরের অবনতি হয়েছে, দুঃখজনকভাবে সেই তালিকায় বাংলাদেশও আছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের সঙ্গে একই স্কোর প্রাপ্ত অন্য চারটি দেশ হল- গিনি, লাওস, কেনিয়া ও পাপুয়া নিউগিনি।
জাতীয় সংসদের অকার্যকারিতাসহ জবাবদিহিতামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর দুর্বলতাই দুর্নীতি বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, দুর্নীতি উন্নয়নের পথে প্রধান অন্তরায়। দেশে আইনের শাসনে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এই দুর্নীতি। বাংলাদেশে যে দুর্নীতি হয় তা বন্ধ করা গেলে প্রবৃদ্ধির হার আরও ৪ শতাংশ বাড়ত। তিনি বলেন, অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের দুর্নীতি সাধারণ মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্রতম গোষ্ঠী।
তিনি বলেন, দুর্নীতির বিচারহীনতা একটি স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতির অভিযোগ অস্বীকারের মানসিকতা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করছে। সরকারের পক্ষ থেকে দুর্নীতি বিষয়ে ‘রি-অ্যাক্ট করা হয়, রেসপন্স করা হয় না।’ তিনি বলেন, মন্ত্রী-এমপিরা অবৈধভাবে বিভিন্ন সুযোগ নিচ্ছেন ও ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। যার প্রভাব পড়ছে দুর্নীতি সূচকে। উচ্চ পর্যায়ে দুর্নীতির সহায়ক শক্তির প্রভাব বাড়ছে ও দুর্নীতি বিরোধীদের কোনো প্রভাব থাকছে না। যারা দুর্নীতি ও অপরাধ করছে তাদের বিচারের আওতায় আনা যাচ্ছে না।
২০১৪ সালে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত তালিকার শীর্ষে অবস্থান করছে ডেনমার্ক, যার স্কোর ৯২। ৯১ স্কোর পেয়ে তালিকার দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ড এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে ফিনল্যান্ড, যার স্কোর ৮৯। ৮ স্কোর পেয়ে ২০১৪ সালে তালিকার সর্বনিুে অবস্থান করছে যৌথভাবে সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া। ১১ ও ১২ স্কোর পেয়ে তালিকার সর্বনিম্নের দ্বিতীয় ও তৃতীয় দেশ হিসেবে রয়েছে যথাক্রমে সুদান ও আফগানিস্তান।
সংবাদ সম্মেলনে সুলতানা কামাল বলেন, দুর্নীতি ও অনিয়মের ব্যাপক বিস্তার এবং জবাবদিহিতার ঘাটতির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় দেশের দরিদ্র জনগণ। আমরা সরকারের কাছ থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধে কার্যকর ও দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখতে পাইনি। সে কারণে রাজনৈতিক অঙ্গীকার অনুযায়ী কার্যকরভাবে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতার দায় সরকারকেই নিতে হবে।
তিনি বলেন, দুর্নীতিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার পরিবর্তে সুরক্ষার সংস্কৃতিই লক্ষ্য করা গেছে। অথচ যারা দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলেন তাদের সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তার বদলে উচ্চ পর্যায় থেকে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে। সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান দুর্নীতির বিরুদ্ধে কাজ করে তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। এর মধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করা যায়।
দেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও গভীরতা উদ্বেগজনক জানিয়ে তিনি আরও বলেন, বৈশ্বিক সূচকে বাংলাদেশের গড় স্কোর অনেক কম। দুর্নীতির বিষয়ে গত বছরের অবস্থানও ধরে রাখা যায়নি বরং সেখান থেকে অবনতি হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়নে আরও কঠোর ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের প্রতি জোরালো আহ্বান জানান তিনি।
সিপিআই সম্পর্কে যথাযথ ধারণার অভাবে মনে করা হয় বাংলাদেশ বা তার অধিবাসীরা দুর্নীতিগ্রস্ত। এটা ঠিক নয় জানিয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাস্তবে দেশের আপামর জনগণ দুর্নীতিগ্রস্ত নয়। তারা দুর্নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভুক্তভোগী মাত্র। ক্ষমতাবানদের দুর্নীতি ও তা প্রতিরোধে দেশের নেতৃত্ব ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যর্থতার কারণে দেশ বা জনগণকে কোনোভাবেই দুর্নীতিগ্রস্ত বলা যাবে না।
সিপিআই ২০১৪-এর জন্য বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সূত্র হিসেবে ৭টি প্রতিষ্ঠানের তথ্য যথাক্রমে : বার্টেলসমান ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত ট্রান্সফরমেশন ইনডেক্স, ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট কর্র্তৃক পরিচালিত কান্ট্রি রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট, গ্লোবাল ইনসাইটের কান্ট্রি রিস্ক রেটিংস্, পলিটিক্যাল রিস্ক সার্ভিসেসের ইন্টারন্যাশনাল কান্ট্রি রিস্ক গাইড, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি পলিসি অ্যান্ড ইনস্টিটিউশনাল অ্যাসেসমেন্ট, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের এক্সিউকিউটিভ ওপিনিয়ন সার্ভে এবং ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট পরিচালিত রুল অব ল ইনডেক্সের রিপোর্টগুলোর জরিপ ব্যবহৃত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, সিপিআই নির্ণয়ে টিআইবি কোনো ভূমিকা পালন করে না। এমনকি টিআইবির গবেষণা থেকে প্রাপ্ত কোনো তথ্য বা বিশ্নেষণ সিপিআই-এ পাঠানো হয় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অন্যান্য দেশের টিআই চ্যাপ্টারের মতোই টিআইবি দুর্নীতির ধারণা সূচক স্থানীয় পর্যায়ে প্রকাশ করে মাত্র।
সংবাদ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন টিআইবি ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন অ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল। আরও উপস্থিত ছিলেন টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য এম হাফিজউদ্দিন খান ও ড. এটিএম শামসুল হুদা এবং উপনির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের।
আবারও বৃদ্ধির দিকে দুর্নীতি : ২০০১ সাল থেকে পরবর্তী ৫ বছর বাংলাদেশ দুর্নীতির শীর্ষে ছিল। ২০০৬ সাল থেকে দুর্নীতির অবস্থার নিচে নামতে থাকে। ওই বছর বাংলাদেশের অবস্থান ছিল তিনে। এরপর ২০০৭ সালে ৭ম, ২০০৮ সালে ১০ম, পরের বছর আরও এক ধাপ উন্নতি করে। ২০১০ সালে ১২তম অবস্থানে আসে দুর্নীতির সূচক। ২০১১ ও ১২ সালে ১৩তম এবং ২০১৩ সালে ১৬তম অবস্থানে চলে আসে। কিন্তু এবার আবার ২ ধাপ অবনতি হয়ে ১৪-তে দাঁড়িয়েছে।
দুর্নীতিতে শীর্ষে সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া : দুর্নীতির ধারণা সূচকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া ও উত্তর কোরিয়া। সূচকের নিম্নক্রম অনুসারে ১৭৫টি দেশের মধ্যে এই দুই দেশের অবস্থান ১৭৪। ওই দুই দেশের স্কোর ৮। এরপর রয়েছে সুদান ১৭৩তম (স্কোর ১১), আফগানিস্তান ১৭২তম (স্কোর ১২), দক্ষিণ সুদান ১৭১ (স্কোর ১৫), ইরাক ১৭০তম (স্কোর-১৬) তুর্কিমেনিস্তান ১৬৯তম (স্কোর ১৭) ও উজবেকিস্তান, লিবিয়া এবং ইরিত্রিয়া ১৬৬তম (স্কোর ১৮)।
কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ ডেনমার্ক : ২০১৪ সালে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকার শীর্ষে রয়েছে ডেনমার্ক। ১০০ স্কেলের মধ্যে দেশটির স্কোর ৯২। কম দুর্নীতিগ্রস্ত ১০টি দেশের তালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে নিউজিল্যান্ড (স্কোর ৯১) ও তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ফিনল্যান্ড (স্কোর ৮৯)। এরপর চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে সুইডেন (স্কোর ৮৭), পঞ্চম নরওয়ে ও সুইজারল্যান্ড (স্কোর ৮৬), ষষ্ঠ সিঙ্গাপুর (স্কোর ৮৪), সপ্তম নেদারল্যান্ডস (স্কোর ৮৩), অষ্টম লুক্সেমবার্গ (স্কোর ৮২) এবং নবম অবস্থানে কানাডা (স্কোর ৮১)।
No comments