মুক্তিযুদ্ধের এক অনালোচিত অধ্যায় by বিমল সরকার
মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনে এক বিশাল
ঘটনা। পাকিস্তানি শাসনামলে পাহাড়সম বৈষম্য, অন্যায় শাসন-শোষণ,
অত্যাচার-নির্যাতন, স্বার্থপরতা আর বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালি জাতির
আন্দোলন-সংগ্রাম ও প্রতিরোধসহ শত রকমের কর্মতৎপরতার সফল পরিণতি নয় মাসের
আমাদের গৌরবময় মহান মুক্তিযুদ্ধ। এই অনন্য ঘটনায় এ দেশের ত্রিশ লাখ মানুষ
জীবনদান করেছেন। দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হয়েছে। জানমালের ক্ষয়ক্ষতি,
যুদ্ধের স্থায়িত্ব, ত্যাগ-তিতিক্ষা, দুর্ভোগ-বিড়ম্বনা এবং ধ্বংসযজ্ঞ ও
অত্যাচার-নির্যাতনের মাত্রা বিবেচনায় এরূপ ঘটনা ইতিহাসে বিরল। এই
মহাকর্মযজ্ঞ বা গৌরবের কত কী যে আজও অনালোচিত রয়ে গেছে, এর খবরইবা আমরা
ক’জন রাখি?
যার কথা বলছি তাকে সামনে থেকে দেখা এবং তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ আমার অনেকবার হয়েছে। কিছুটা হলেও জানতে পেরেছি একজন হার না-মানা সৈনিকের মতো তার এগিয়ে যাওয়ার কাহিনী ও সুবিশাল কর্মকাণ্ড। উপমহাদেশের সুপরিচিত আদমজী, বাওয়ানি আর ইস্পাহানিদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে শিল্প ও কলকারখানা স্থাপন করে চলেছেন। পাকিস্তানি জামানায় ওইসব স্বনামখ্যাত শিল্পপতি ও ধনকুবেরদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে কোনো বাঙালি ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তার এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, মাঠে টিকে থাকাটাই ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু না, শুধু টিকেই থাকেননি; অনেক দূর এগিয়ে যেতেও সক্ষম হলেন তিনি। একই সঙ্গে গোটা জাতিকেও এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিলেন তার সাধ্য অনুযায়ী। দেশপ্রেম, দেশের মানুষের প্রতি দরদ এবং কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায়, কর্মনিষ্ঠা ও একাগ্রতা থাকলেই কেবল তা সম্ভব। আর এসব গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য যে তার মাঝে ছিল, এর প্রমাণ তিনি জীবনে অনেকবারই দিয়েছেন। আমি জহুরুল ইসলামের কথা বলছি। শিল্পপতি মরহুম জহুরুল ইসলাম। ইসলাম গ্র“প অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম চেয়ারম্যান আলহাজ জহুরুল ইসলাম। বাঙালি শিল্পপতি ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে তাকে বলা হয় পথিকৃৎ। পরাধীনতার সময় থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে চার-পাঁচ দশকে ক্রমান্বয়ে শিল্প ও বাণিজ্য জগতে জহুরুল ইসলাম কী বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তা সবারই জানা। কেবল শিল্প ও কলকারখানা স্থাপন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যেই নয়, ঢাকা এবং তার নিজ জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠাসহ জনহিতকর বিভিন্ন কাজে তিনি উদার হস্তে অর্থ ব্যয় করেছেন। তার সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য কীর্তি নিজ গ্রাম ভাগলপুরে অবস্থিত জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জহুরুল ইসলাম নার্সেস ট্রেনিং ইন্সটিটিউট।
কীর্তিমান জহুরুল ইসলামের অর্থপ্রাচুর্যের বেশ বড় একটা অংশই ব্যয়িত হয়েছে এবং আজও হচ্ছে দুস্থ, অনাথ-আর্ত-আঁতুড়ের সেবায়। সেবাধর্ম ও দেশপ্রেমের কঠিন পরীক্ষায় বেশ সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ জহুরুল ইসলামের নামটি স্বর্ণখচিত হয়ে রয়েছে আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও। আত্মপ্রচারবিমুখ জহুরুল ইসলাম ১৯৭১ সালে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনে ‘সুবিদ আলি’ ছদ্মনামে নিয়মিত অর্থ দান করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছেন। সবার কাছেই বলতে গেলে অজানাই রয়ে গেছে যে, একাত্তরে বাঙালি জাতির কঠিন অগ্নিপরীক্ষার দিনগুলোতে জুলাই অথবা আগস্ট থেকে চালু হওয়া লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসের বাড়ি ভাড়া ও কর্মীদের বেতনাদিসহ আর্থিক যাবতীয় ব্যয়ভার ডিসেম্বরে বিজয় লাভ পর্যন্ত জহুরুল ইসলাম একাই বহন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ এবং একইসঙ্গে জহুরুল ইসলামের জীবনের সে এক কৌতূহলোদ্দীপক ও অনালোচিত অধ্যায়। আত্মপ্রচারবিমুখ জহুরুল ইসলামকে এক্ষেত্রে চেনা যায় ভিন্ন রূপে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে জহুরুল ইসলাম দেশেই ছিলেন। একসময় তাকে ঢাকার রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে (পরে গণভবন) ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। তাকে দেয়ালের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করার ভয় দেখানো হয়। এমন সময় তার এক পাঞ্জাবি বন্ধু অনেক অনুনয়-বিনয় করে তাকে সেদিনের মতো মুক্ত করে আনেন। ওই বন্ধুরই সহযোগিতায় তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাওয়ার অনুমতি পান। যথারীতি তিনি লন্ডনে যান। ‘অসুস্থতার ভান করে’ ওখানকার লুইসহ্যাম হাসপাতালে ভর্তি হন। ইতিমধ্যে মুজিবনগর সরকার, বিশেষ করে প্রবাসী ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে তিনি অর্থ সাহায্যের আহ্বান পান। জহুরুল ইসলাম নিজেও মুক্তিযুদ্ধে আর্থিক সাহায্য প্রদানের জন্য ছিলেন উন্মুখ। এমন পরিস্থিতিতে জহুরুল ইসলাম জনৈক মোশাররফ হোসেন জোয়ারদারের মাধ্যমে বিদেশে প্রবাসী সরকারের কূটনৈতিক দায়িত্বপালনকারী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর (পরে রাষ্ট্রপতি) সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। বিচারপতি চৌধুরী হাসপাতালে গিয়ে জহুরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন। উভয়ের মধ্যে আলোচনা হয়। লন্ডনে ইতিমধ্যেই ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে একটি ফান্ড করা হয়। এ ফান্ডের অর্থ দিয়ে মূলত অস্ত্র কিনে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ ও স্টিয়ারিং কমিটির খরচ চালানো হতো। আবু সাঈদ চৌধুরীর ভাষায়, “... সেই ফান্ড থেকে অন্য কোনো খরচ করা বাঙালিদের বা আমার ব্যক্তিগত মতো নয়। কিন্তু আমাদের দূতাবাস করার প্রয়োজন রয়েছে। তাকে আরও বলি যে, দেখা গেছে বেতন এবং অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতি মাসে দু’থেকে আড়াই হাজার পাউন্ডের মতো লাগবে। পরে আরও কূটনীতিক যোগ দিলে বেশি লাগতে পারে। এই দূতাবাসের খরচ যদি তিনি চালিয়ে নেন তাহলে আমি নিশ্চিন্ত মনে কূটনৈতিক কাজ সুচারুরূপে করতে পারি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমার এস্টিমেট অনুযায়ী তিনি যদি দু-তিন বছরের টাকা একসঙ্গে দিয়ে দেন তাতে আমি সন্তুষ্ট হব কিনা। আমি উত্তর দিলাম যে, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি যদি আমাদের দূতাবাসের মাসিক খরচ প্রতি মাসে দেন তাহলেই ভালো হয়। তিনি এক কথায় রাজি হয়ে বললেন যে, প্রতি মাসে তিনি মোশাররফ হোসেন জোয়ারদারের মাধ্যমে তার দেয় অর্থ পাঠিয়ে দেবেন। তবে সেটা অন্য কারও নামে জমা করে নিতে হবে। অন্যথায় পাকিস্তানিরা কোনোভাবে এ খবর পেলে ঢাকায় অবস্থানরত তার স্ত্রী ও সন্তানদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। তখনই আমরা তিনজনে মিলে একটি নাম ঠিক করলাম। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার সুবিদ আলি নামে একজন রোগীর পক্ষ থেকে দূতাবাসের খরচ বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়ে আসবেন। যতদূর মনে পড়ে মাসিক আড়াই হাজার পাউন্ড দেয়ার কথা ধার্য হয়। এর মাত্র কয়েক মাস পরই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। তারপর আর তাকে দিতে হয়নি। অথচ তিনি দু’-তিন বছরের খরচ একসঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন। একেই বলে ভাগ্য।
... জহুরুল ইসলাম সেদিন এক পর্যায়ে নিজে থেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন , ‘স্যার, আপনার খরচ চলে কী করে?’ ... ‘আমি আপনার জন্য জোয়ারদারের মাধ্যমে এককালীন তিন হাজার পাউন্ড পাঠিয়ে দেব।’ আমি বললাম, ‘অশেষ ধন্যবাদ। আমি সেই অর্থ গ্রহণ করব এই শর্তে যে দেশ স্বাধীন হলে সরকারি বিনিময় হার অনুসারে আমি এই টাকা পরিশোধ করব, আর আপনি গ্রহণ করবেন। আর যদি দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত বেঁচে না থাকি আপনি কোনো দাবি রাখবেন না। তবে যখনই সম্ভব হবে আমার পরিবার এটা শোধ করে দেবে।’ এই তিন হাজার পাউন্ড শেষ হওয়ার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জহুরুল ইসলামকে তখনকার বিনিময় হারে তিন হাজার পাউন্ডের সমপরিমাণ বাংলাদেশী টাকা সোনালী ব্যাংকের মারফত আমার নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে চেক দ্বারা পরিশোধ করেছি। এই ঋণ গ্রহণের কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে জানিয়েছিলাম এবং তার জ্ঞাতসারেই পরিশোধ করেছি।
এভাবে স্থান এবং খরচের ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ায় সাতাশে আগস্ট ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেন্স-এ বাংলাদেশ দূতাবাস উদ্বোধন করা হয়। ভারত ছাড়া এটিই বিশ্বে বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস। মুজিবনগর সরকার এই বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব প্রদান করেন...।” (প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, আবু সাঈদ চৌধুরী )।
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
যার কথা বলছি তাকে সামনে থেকে দেখা এবং তার সঙ্গে কথা বলার সুযোগ আমার অনেকবার হয়েছে। কিছুটা হলেও জানতে পেরেছি একজন হার না-মানা সৈনিকের মতো তার এগিয়ে যাওয়ার কাহিনী ও সুবিশাল কর্মকাণ্ড। উপমহাদেশের সুপরিচিত আদমজী, বাওয়ানি আর ইস্পাহানিদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন স্থানে শিল্প ও কলকারখানা স্থাপন করে চলেছেন। পাকিস্তানি জামানায় ওইসব স্বনামখ্যাত শিল্পপতি ও ধনকুবেরদের সঙ্গে টেক্কা দিয়ে কোনো বাঙালি ব্যবসায়ী বা উদ্যোক্তার এগিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, মাঠে টিকে থাকাটাই ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু না, শুধু টিকেই থাকেননি; অনেক দূর এগিয়ে যেতেও সক্ষম হলেন তিনি। একই সঙ্গে গোটা জাতিকেও এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করে দিলেন তার সাধ্য অনুযায়ী। দেশপ্রেম, দেশের মানুষের প্রতি দরদ এবং কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায়, কর্মনিষ্ঠা ও একাগ্রতা থাকলেই কেবল তা সম্ভব। আর এসব গুণাবলী ও বৈশিষ্ট্য যে তার মাঝে ছিল, এর প্রমাণ তিনি জীবনে অনেকবারই দিয়েছেন। আমি জহুরুল ইসলামের কথা বলছি। শিল্পপতি মরহুম জহুরুল ইসলাম। ইসলাম গ্র“প অব ইন্ডাস্ট্রিজের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম চেয়ারম্যান আলহাজ জহুরুল ইসলাম। বাঙালি শিল্পপতি ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে তাকে বলা হয় পথিকৃৎ। পরাধীনতার সময় থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশে চার-পাঁচ দশকে ক্রমান্বয়ে শিল্প ও বাণিজ্য জগতে জহুরুল ইসলাম কী বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে গেছেন তা সবারই জানা। কেবল শিল্প ও কলকারখানা স্থাপন এবং ব্যবসা-বাণিজ্যেই নয়, ঢাকা এবং তার নিজ জন্মস্থান কিশোরগঞ্জের বাজিতপুরে বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মসজিদ ও এতিমখানা প্রতিষ্ঠাসহ জনহিতকর বিভিন্ন কাজে তিনি উদার হস্তে অর্থ ব্যয় করেছেন। তার সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য কীর্তি নিজ গ্রাম ভাগলপুরে অবস্থিত জহুরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও জহুরুল ইসলাম নার্সেস ট্রেনিং ইন্সটিটিউট।
কীর্তিমান জহুরুল ইসলামের অর্থপ্রাচুর্যের বেশ বড় একটা অংশই ব্যয়িত হয়েছে এবং আজও হচ্ছে দুস্থ, অনাথ-আর্ত-আঁতুড়ের সেবায়। সেবাধর্ম ও দেশপ্রেমের কঠিন পরীক্ষায় বেশ সাফল্যের সঙ্গে উত্তীর্ণ জহুরুল ইসলামের নামটি স্বর্ণখচিত হয়ে রয়েছে আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও। আত্মপ্রচারবিমুখ জহুরুল ইসলাম ১৯৭১ সালে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনে ‘সুবিদ আলি’ ছদ্মনামে নিয়মিত অর্থ দান করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় ভূমিকা পালন করেছেন। সবার কাছেই বলতে গেলে অজানাই রয়ে গেছে যে, একাত্তরে বাঙালি জাতির কঠিন অগ্নিপরীক্ষার দিনগুলোতে জুলাই অথবা আগস্ট থেকে চালু হওয়া লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাসের বাড়ি ভাড়া ও কর্মীদের বেতনাদিসহ আর্থিক যাবতীয় ব্যয়ভার ডিসেম্বরে বিজয় লাভ পর্যন্ত জহুরুল ইসলাম একাই বহন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ এবং একইসঙ্গে জহুরুল ইসলামের জীবনের সে এক কৌতূহলোদ্দীপক ও অনালোচিত অধ্যায়। আত্মপ্রচারবিমুখ জহুরুল ইসলামকে এক্ষেত্রে চেনা যায় ভিন্ন রূপে।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে জহুরুল ইসলাম দেশেই ছিলেন। একসময় তাকে ঢাকার রমনার প্রেসিডেন্ট ভবনে (পরে গণভবন) ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। তাকে দেয়ালের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলি করার ভয় দেখানো হয়। এমন সময় তার এক পাঞ্জাবি বন্ধু অনেক অনুনয়-বিনয় করে তাকে সেদিনের মতো মুক্ত করে আনেন। ওই বন্ধুরই সহযোগিতায় তিনি চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাওয়ার অনুমতি পান। যথারীতি তিনি লন্ডনে যান। ‘অসুস্থতার ভান করে’ ওখানকার লুইসহ্যাম হাসপাতালে ভর্তি হন। ইতিমধ্যে মুজিবনগর সরকার, বিশেষ করে প্রবাসী ওই সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে তিনি অর্থ সাহায্যের আহ্বান পান। জহুরুল ইসলাম নিজেও মুক্তিযুদ্ধে আর্থিক সাহায্য প্রদানের জন্য ছিলেন উন্মুখ। এমন পরিস্থিতিতে জহুরুল ইসলাম জনৈক মোশাররফ হোসেন জোয়ারদারের মাধ্যমে বিদেশে প্রবাসী সরকারের কূটনৈতিক দায়িত্বপালনকারী বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর (পরে রাষ্ট্রপতি) সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম হন। বিচারপতি চৌধুরী হাসপাতালে গিয়ে জহুরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করেন। উভয়ের মধ্যে আলোচনা হয়। লন্ডনে ইতিমধ্যেই ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে একটি ফান্ড করা হয়। এ ফান্ডের অর্থ দিয়ে মূলত অস্ত্র কিনে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রেরণ ও স্টিয়ারিং কমিটির খরচ চালানো হতো। আবু সাঈদ চৌধুরীর ভাষায়, “... সেই ফান্ড থেকে অন্য কোনো খরচ করা বাঙালিদের বা আমার ব্যক্তিগত মতো নয়। কিন্তু আমাদের দূতাবাস করার প্রয়োজন রয়েছে। তাকে আরও বলি যে, দেখা গেছে বেতন এবং অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতি মাসে দু’থেকে আড়াই হাজার পাউন্ডের মতো লাগবে। পরে আরও কূটনীতিক যোগ দিলে বেশি লাগতে পারে। এই দূতাবাসের খরচ যদি তিনি চালিয়ে নেন তাহলে আমি নিশ্চিন্ত মনে কূটনৈতিক কাজ সুচারুরূপে করতে পারি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমার এস্টিমেট অনুযায়ী তিনি যদি দু-তিন বছরের টাকা একসঙ্গে দিয়ে দেন তাতে আমি সন্তুষ্ট হব কিনা। আমি উত্তর দিলাম যে, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি যদি আমাদের দূতাবাসের মাসিক খরচ প্রতি মাসে দেন তাহলেই ভালো হয়। তিনি এক কথায় রাজি হয়ে বললেন যে, প্রতি মাসে তিনি মোশাররফ হোসেন জোয়ারদারের মাধ্যমে তার দেয় অর্থ পাঠিয়ে দেবেন। তবে সেটা অন্য কারও নামে জমা করে নিতে হবে। অন্যথায় পাকিস্তানিরা কোনোভাবে এ খবর পেলে ঢাকায় অবস্থানরত তার স্ত্রী ও সন্তানদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। তখনই আমরা তিনজনে মিলে একটি নাম ঠিক করলাম। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার সুবিদ আলি নামে একজন রোগীর পক্ষ থেকে দূতাবাসের খরচ বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়ে আসবেন। যতদূর মনে পড়ে মাসিক আড়াই হাজার পাউন্ড দেয়ার কথা ধার্য হয়। এর মাত্র কয়েক মাস পরই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। তারপর আর তাকে দিতে হয়নি। অথচ তিনি দু’-তিন বছরের খরচ একসঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন। একেই বলে ভাগ্য।
... জহুরুল ইসলাম সেদিন এক পর্যায়ে নিজে থেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন , ‘স্যার, আপনার খরচ চলে কী করে?’ ... ‘আমি আপনার জন্য জোয়ারদারের মাধ্যমে এককালীন তিন হাজার পাউন্ড পাঠিয়ে দেব।’ আমি বললাম, ‘অশেষ ধন্যবাদ। আমি সেই অর্থ গ্রহণ করব এই শর্তে যে দেশ স্বাধীন হলে সরকারি বিনিময় হার অনুসারে আমি এই টাকা পরিশোধ করব, আর আপনি গ্রহণ করবেন। আর যদি দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত বেঁচে না থাকি আপনি কোনো দাবি রাখবেন না। তবে যখনই সম্ভব হবে আমার পরিবার এটা শোধ করে দেবে।’ এই তিন হাজার পাউন্ড শেষ হওয়ার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জহুরুল ইসলামকে তখনকার বিনিময় হারে তিন হাজার পাউন্ডের সমপরিমাণ বাংলাদেশী টাকা সোনালী ব্যাংকের মারফত আমার নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে চেক দ্বারা পরিশোধ করেছি। এই ঋণ গ্রহণের কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে জানিয়েছিলাম এবং তার জ্ঞাতসারেই পরিশোধ করেছি।
এভাবে স্থান এবং খরচের ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ায় সাতাশে আগস্ট ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেন্স-এ বাংলাদেশ দূতাবাস উদ্বোধন করা হয়। ভারত ছাড়া এটিই বিশ্বে বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস। মুজিবনগর সরকার এই বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব প্রদান করেন...।” (প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি, আবু সাঈদ চৌধুরী )।
বিমল সরকার : কলেজ শিক্ষক
No comments