রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনই আমাদের অগ্রাধিকার by সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম
একজন প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে
আমার বয়স সাত বছর পূর্ণ হল আজ ৪ ডিসেম্বর ২০১৪। ২০০৭ সালের ১১ অক্টোবর দেশে
সংবিধান এবং বন্দুকের নল উভয়ের মিলিত শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। বাংলাদেশ
সেনাবাহিনীর তৎকালীন প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল মইন ইউ আহমেদ দেশে জরুরি
অবস্থা জারি এবং নিজেদের পছন্দের একটি দীর্ঘমেয়াদি তত্ত্বাবধায়ক সরকার
কায়েম করেছিলেন। ওয়ান-ইলেভেন যে অনেক বড় একটি স্থানীয় রাজনৈতিক, সামরিক এবং
আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ফসল ছিল সেটা ওই সময় বুঝিনি।
ওয়ান-ইলেভেনের এক বছরের মাথায় সেটা বুঝে গিয়েছিলাম। যা হোক, ওই ওয়ান-ইলেভেন
নামক ঘটনার আগে থেকেই অনেকদিন যাবৎ আমি রাজনৈতিকভাবে সচেতন থেকে কলাম
লিখতাম, টেলিভিশন টকশো ও বিভিন্ন আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখতাম। এ
প্রেক্ষাপটে আমি ক্রমান্বয়ে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আকৃষ্ট হচ্ছিলাম।
যাদের স্মৃতিতে ২০০৭ সালের কথা এখনও মনে আছে তারা নিশ্চয় জানেন, ওয়ান-ইলেভেন কর্তৃপক্ষ একটি বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। তারা প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিকদের হয় জেলখানায় পাঠিয়েছিলেন অথবা দেশ ছেড়ে চলে যেতে পরোক্ষভাবে বাধ্য করেছিল। এ প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের অনেক মানুষ, মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই, অনেক সাবেক সৈনিক, সুশীল সমাজের অনেক শুভাকাক্সক্ষী আমাকে উৎসাহিত করেন এই মর্মে যে, ‘আপনি জেনারেল ইবরাহিম, অনেক ভালো ভালো কথা বলছেন, লিখছেন; এখন করে দেখানোর সময় এসেছে। রাজনীতিতে নামুন।’ আমি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলাম ১৯৬২ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত ছয় বছর। আমাদের কলেজের মটো ছিল ‘ডিডস, নট ওয়ার্ডস’ যার বাংলা অর্থ ‘কথা নয়, কাজ’। যারা আমার ক্যাডেট কলেজের পরিচয়টি জানত, তারা এ কথা বলেই আমাকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল করে ফেলত। এক কথা, দুই কথা, প্রেরণা-উৎসাহ, আবার পিছুটান, আবার প্রেরণা-উৎসাহ- এরকম করতে করতেই একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নামব। ৪ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে প্রায় ১২০০ লোকের তথা সচেতন রাজনীতিমনস্ক নাগরিকের কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সম্মেলন থেকেই নতুন রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি’র যাত্রা শুরু। চেয়েছিলাম স্বাধীনভাবে তথা দুই বড়’র মাঝখানে থেকে রাজনৈতিক দল নিয়ে সামনে এগিয়ে যাব। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ২০০৯-এর জানুয়ারির পর ক্ষমতাসীন দল যেদিকে হাঁটছিল, সেটা অনেক উদ্বেগের কারণ ঘটিয়েছিল। পার্লামেন্টারি মেজরিটি ব্যবহার করে সংবিধানকে নিজের মতো করে সাজানো হচ্ছিল। আমার মূল্যায়নে, পরিচিত গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা এবং বাহ্যিক অভিব্যক্তিগুলো সরকারের রোষানলে পড়েছিল। তাই পরিস্থিতির উন্নয়ন তথা অবনতি রোধ করার লক্ষ্যে ২০১১ সালের রমজান মাসের পরপরই নীতিগতভাবে বিএনপির সঙ্গে (তথা তৎকালীন চারদলীয় জোটের সঙ্গে) পথ চলা শুরু করি। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ১৮ দলীয় জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেই থেকে জোটে আছি। জোটের পরিধি বড় হয়েছে। জোট অনেক সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দু-একটি ভুল সিদ্ধান্তও সম্ভবত নিয়েছে। সঠিক হোক আর ভুল হোক, তার দায়িত্ব জোটের সব শরিকের ওপরই বর্তায়। আর এটাই স্বাভাবিক।
এ মুহূর্তে আমরা দুটি রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত। একটি সংগ্রাম অতি সহজেই দেখা যাচ্ছে, আরেকটি সংগ্রাম অত সহজে দেখা যাচ্ছে না বা সহজে অনুভব হচ্ছে না। সহজেই দেখা যাচ্ছে এমন সংগ্রামটি হচ্ছে : গণতন্ত্রের চর্চা নিশ্চিত করতে তথা সর্বদলীয় অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধানে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। আর সহজে দেখা যাচ্ছে না বা অনুভূত হচ্ছে না এমন সংগ্রাম হচ্ছে- রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার সংগ্রাম। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের প্রার্থনা করেন লাখ
লাখ মানুষ। কিন্তু এ দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তির সংখ্যা অপ্রতুল। প্রত্যেক দেশেই পরিবর্তনের জন্য কেউ না কেউ আহ্বান জানান। তাই আমি একই সঙ্গে দুটি উদাহরণ দেব, অতঃপর আমার মূল্যায়নে পরিবর্তনের আকাক্সক্ষার কথা বলব।
২০০৭-০৮ সালে বারাক ওবামা এবং ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা উভয়েই পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে বা পরিবর্তন আনার জন্য নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের দল ছিল, রাজনৈতিক দলগত কাঠামো ছিল, দলের আর্থিক শক্তি ছিল। তাদের দলের প্রতি শুভাকাক্সক্ষী মিডিয়া ছিল এবং তাদের দলের শুভাকাক্সক্ষীদের মেধাশক্তি ছিল। সবকিছু ব্যবহার করেই যথাক্রমে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট এবং শেখ হাসিনা সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ২০০৭ সালের ৪ ডিসেম্বর পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েই বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নামক একটি নতুন রাজনৈতিক দল যাত্রা শুরু করেছিলে। জন্মদিবস থেকেই তাদের নীতিবাক্য (বা ‘মটো’) ছিল ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’ বা ‘পলিটিক্স ফর চেঞ্জ’। পরিবর্তন অনেক আঙ্গিকেই কাম্য ছিল এবং এখনও আছে। প্রথম ও প্রধান প্রত্যাশা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন আনা। কিন্তু বারাক ওবামার দলের মতো বা মাননীয় শেখ হাসিনার দলের মতো এ নতুন দলটির ঐতিহ্য ছিল না, মেধাশক্তি , অর্থশক্তিও ছিল অতি নগণ্য। তাই সামনে এগোবার পথটিও ছিল বন্ধুর। এই নতুন দলটি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ৩৬টি আসনে অংশগ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশের বিদ্যমান প্রথা ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের বিকল্প হিসেবে ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’ স্লোগান নিয়ে আমরা চেষ্টা করেছিলাম; কিন্তু পারিনি। নির্বাচনে জিততে পারিনি তার মানে এই নয় যে, পরিবর্তনের জন্য মনের আকাক্সক্ষা স্তিমিত হয়েছে। আকাক্সক্ষা এখনও জাগ্রত এবং প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে কর্মপন্থা কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন চাই। বিদ্যমান বহুদলীয় রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্য থেকেই এ পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমরা চাই সৎ, মেধাবী, সাহসী ব্যক্তিরা রাজনীতিতে জড়িত হোক। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই জনগণের খেদমত করার সুযোগ পাক। আমরা চাই, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এমন হোক যেখানে সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিরা নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন, জনগণের সামনে নিজেদের উপস্থাপন করতে পারেন এবং জনগণকে আশ্বস্ত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেতে পারেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৎ, মেধাবী, সাহসী ব্যক্তি যদি সংসদ সদস্য নির্বাচিত
হতে পারেন, তাহলে সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটি গুণগত পরিবর্তন সূচিত হবে। সে জন্য দেশে সাহসী ভোটার প্রয়োজন, যারা সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন। সাহসী মিডিয়া প্রয়োজন, যারা সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিদের উৎসাহিত করবে এবং প্রচারণায় পৃষ্ঠপোষকতা দেবে।
রাজনীতিতে কাক্সিক্ষত গুণগত পরিবর্তনের আরও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধের ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনা সম্মিলিতভাবে বা
যুগপৎ বিদ্যমান থাকবে। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় নেতারা, মুক্তিযুদ্ধের নেতারা এবং জাতীয় নেতারা জাতীয় ঐক্যের প্রেরণা হবেন, জাতীয় বিভক্তির কারণ হবেন না। তৃতীয়ত, সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
চতুর্থত, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস শুরু হবে। পঞ্চমত, প্রতিহিংসা নয়, পারস্পরিক প্রতিযোগিতাই হবে উন্নয়ন ও অবদানের কাঠামো। ষষ্ঠত, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, সততা ও প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সপ্তমত, রাজনীতি ও ব্যবসায় তরুণ সমাজকে উৎসাহিত করতে হবে এবং তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। অষ্টমত, বাংলাদেশের সার্বিক কল্যাণ এবং নাগরিকদের উপকার কোন কোন পন্থায় করা যায় এ বিষয়ে পরিকল্পিতভাবে সচেতনতা সৃষ্টির কর্মসূচি চালু করতে হবে।
দেশে এ মুহূর্তে যে অবস্থা বিদ্যমান, তা থেকে পরিত্রাণের পূর্ণশক্তি তথা কাঠামোগত শক্তি দেশের রাজনীতিতে নেই, এমনকি আমলাতন্ত্রেরও নেই। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। দেশে এরূপ পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিনের অশুভ পৃষ্ঠপোষকতায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অতএব এ থেকে পরিত্রাণও একদিনে পাওয়া যাবে না। পরিত্রাণ পেতে হলে অবশ্যই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন চাই।
মানুষকে, বিশেষত তরুণ সমাজকে রাজনীতিবিমুখ করা চলবে না। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে যে নিয়মে মানুষ রাজনীতিতে প্রবেশ করত এবং যে নিয়মে রাজনীতিতে বিচরণ করত, হুবহু সেই নিয়ম এখানে প্রযোজ্য হবে না। কারণ সবকিছুই পরিবর্তনশীল। তবে এ পরিবর্তনের জন্য সবকিছুকে বাদ দিলে চলবে না। যেখানে যেখানে সমস্যা রয়েছে, শুধু সেখানেই আমাদের কাজ করে যেতে হবে। আমাদের মহান ধর্ম ইসলামেরও শিক্ষা- পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়। পাপীকে সঠিক পথে ফেরত আনতে চেষ্টা করতে হবে। একই কথা রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাজনীতির অসুস্থতা দূর করে রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফেরাতে হবে। দেশের সবাই রাজনীতি করবে না। কিন্তু রাজনীতিই দেশের চালিকাশক্তি তথা রাজনীতিকরাই দেশকে চালাবেন। অতএব, অসুস্থতার চিকিৎসা যদি করতে হয়, তাহলে রাজনীতির চিকিৎসা করতে হবে। দেশে এখন রাজনীতিক-চিকিৎসক প্রয়োজন। আমার চিন্তা-চেতনার সঙ্গে সবাই একমত হবেন, এমনটি আমি আশা করি না। কিন্তু রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন দরকার, এটা বোধ করি সবাই স্বীকার করবেন। আমরা সেই প্রত্যাশায় রইলাম।
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
যাদের স্মৃতিতে ২০০৭ সালের কথা এখনও মনে আছে তারা নিশ্চয় জানেন, ওয়ান-ইলেভেন কর্তৃপক্ষ একটি বিরাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া শুরু করেছিল। তারা প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিকদের হয় জেলখানায় পাঠিয়েছিলেন অথবা দেশ ছেড়ে চলে যেতে পরোক্ষভাবে বাধ্য করেছিল। এ প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রামের অনেক মানুষ, মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই, অনেক সাবেক সৈনিক, সুশীল সমাজের অনেক শুভাকাক্সক্ষী আমাকে উৎসাহিত করেন এই মর্মে যে, ‘আপনি জেনারেল ইবরাহিম, অনেক ভালো ভালো কথা বলছেন, লিখছেন; এখন করে দেখানোর সময় এসেছে। রাজনীতিতে নামুন।’ আমি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের ছাত্র ছিলাম ১৯৬২ থেকে ১৯৬৮ পর্যন্ত ছয় বছর। আমাদের কলেজের মটো ছিল ‘ডিডস, নট ওয়ার্ডস’ যার বাংলা অর্থ ‘কথা নয়, কাজ’। যারা আমার ক্যাডেট কলেজের পরিচয়টি জানত, তারা এ কথা বলেই আমাকে মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল করে ফেলত। এক কথা, দুই কথা, প্রেরণা-উৎসাহ, আবার পিছুটান, আবার প্রেরণা-উৎসাহ- এরকম করতে করতেই একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে নামব। ৪ ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে প্রায় ১২০০ লোকের তথা সচেতন রাজনীতিমনস্ক নাগরিকের কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সম্মেলন থেকেই নতুন রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি’র যাত্রা শুরু। চেয়েছিলাম স্বাধীনভাবে তথা দুই বড়’র মাঝখানে থেকে রাজনৈতিক দল নিয়ে সামনে এগিয়ে যাব। কিন্তু সেটা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ২০০৯-এর জানুয়ারির পর ক্ষমতাসীন দল যেদিকে হাঁটছিল, সেটা অনেক উদ্বেগের কারণ ঘটিয়েছিল। পার্লামেন্টারি মেজরিটি ব্যবহার করে সংবিধানকে নিজের মতো করে সাজানো হচ্ছিল। আমার মূল্যায়নে, পরিচিত গণতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা এবং বাহ্যিক অভিব্যক্তিগুলো সরকারের রোষানলে পড়েছিল। তাই পরিস্থিতির উন্নয়ন তথা অবনতি রোধ করার লক্ষ্যে ২০১১ সালের রমজান মাসের পরপরই নীতিগতভাবে বিএনপির সঙ্গে (তথা তৎকালীন চারদলীয় জোটের সঙ্গে) পথ চলা শুরু করি। ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল ১৮ দলীয় জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সেই থেকে জোটে আছি। জোটের পরিধি বড় হয়েছে। জোট অনেক সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দু-একটি ভুল সিদ্ধান্তও সম্ভবত নিয়েছে। সঠিক হোক আর ভুল হোক, তার দায়িত্ব জোটের সব শরিকের ওপরই বর্তায়। আর এটাই স্বাভাবিক।
এ মুহূর্তে আমরা দুটি রাজনৈতিক সংগ্রামে লিপ্ত। একটি সংগ্রাম অতি সহজেই দেখা যাচ্ছে, আরেকটি সংগ্রাম অত সহজে দেখা যাচ্ছে না বা সহজে অনুভব হচ্ছে না। সহজেই দেখা যাচ্ছে এমন সংগ্রামটি হচ্ছে : গণতন্ত্রের চর্চা নিশ্চিত করতে তথা সর্বদলীয় অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধানে সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। আর সহজে দেখা যাচ্ছে না বা অনুভূত হচ্ছে না এমন সংগ্রাম হচ্ছে- রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার সংগ্রাম। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের প্রার্থনা করেন লাখ
লাখ মানুষ। কিন্তু এ দাবিতে সোচ্চার ব্যক্তির সংখ্যা অপ্রতুল। প্রত্যেক দেশেই পরিবর্তনের জন্য কেউ না কেউ আহ্বান জানান। তাই আমি একই সঙ্গে দুটি উদাহরণ দেব, অতঃপর আমার মূল্যায়নে পরিবর্তনের আকাক্সক্ষার কথা বলব।
২০০৭-০৮ সালে বারাক ওবামা এবং ২০০৮ সালে শেখ হাসিনা উভয়েই পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে বা পরিবর্তন আনার জন্য নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন। তাদের দল ছিল, রাজনৈতিক দলগত কাঠামো ছিল, দলের আর্থিক শক্তি ছিল। তাদের দলের প্রতি শুভাকাক্সক্ষী মিডিয়া ছিল এবং তাদের দলের শুভাকাক্সক্ষীদের মেধাশক্তি ছিল। সবকিছু ব্যবহার করেই যথাক্রমে বারাক ওবামা প্রেসিডেন্ট এবং শেখ হাসিনা সংসদ নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। ২০০৭ সালের ৪ ডিসেম্বর পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েই বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি নামক একটি নতুন রাজনৈতিক দল যাত্রা শুরু করেছিলে। জন্মদিবস থেকেই তাদের নীতিবাক্য (বা ‘মটো’) ছিল ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’ বা ‘পলিটিক্স ফর চেঞ্জ’। পরিবর্তন অনেক আঙ্গিকেই কাম্য ছিল এবং এখনও আছে। প্রথম ও প্রধান প্রত্যাশা হচ্ছে, বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন আনা। কিন্তু বারাক ওবামার দলের মতো বা মাননীয় শেখ হাসিনার দলের মতো এ নতুন দলটির ঐতিহ্য ছিল না, মেধাশক্তি , অর্থশক্তিও ছিল অতি নগণ্য। তাই সামনে এগোবার পথটিও ছিল বন্ধুর। এই নতুন দলটি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে ৩৬টি আসনে অংশগ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশের বিদ্যমান প্রথা ও রাজনৈতিক ঐতিহ্যের বিকল্প হিসেবে ‘পরিবর্তনের জন্য রাজনীতি’ স্লোগান নিয়ে আমরা চেষ্টা করেছিলাম; কিন্তু পারিনি। নির্বাচনে জিততে পারিনি তার মানে এই নয় যে, পরিবর্তনের জন্য মনের আকাক্সক্ষা স্তিমিত হয়েছে। আকাক্সক্ষা এখনও জাগ্রত এবং প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তবে কর্মপন্থা কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত হয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে গুণগত পরিবর্তন চাই। বিদ্যমান বহুদলীয় রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্য থেকেই এ পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আমরা চাই সৎ, মেধাবী, সাহসী ব্যক্তিরা রাজনীতিতে জড়িত হোক। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই জনগণের খেদমত করার সুযোগ পাক। আমরা চাই, দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ এমন হোক যেখানে সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিরা নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন, জনগণের সামনে নিজেদের উপস্থাপন করতে পারেন এবং জনগণকে আশ্বস্ত করে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পেতে পারেন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সৎ, মেধাবী, সাহসী ব্যক্তি যদি সংসদ সদস্য নির্বাচিত
হতে পারেন, তাহলে সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটি গুণগত পরিবর্তন সূচিত হবে। সে জন্য দেশে সাহসী ভোটার প্রয়োজন, যারা সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিদের ভোট দিয়ে নির্বাচিত করবেন। সাহসী মিডিয়া প্রয়োজন, যারা সৎ, সাহসী, মেধাবী ব্যক্তিদের উৎসাহিত করবে এবং প্রচারণায় পৃষ্ঠপোষকতা দেবে।
রাজনীতিতে কাক্সিক্ষত গুণগত পরিবর্তনের আরও কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- মুক্তিযুদ্ধের ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চেতনা সম্মিলিতভাবে বা
যুগপৎ বিদ্যমান থাকবে। দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় নেতারা, মুক্তিযুদ্ধের নেতারা এবং জাতীয় নেতারা জাতীয় ঐক্যের প্রেরণা হবেন, জাতীয় বিভক্তির কারণ হবেন না। তৃতীয়ত, সমাজে ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে।
চতুর্থত, জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রয়াস শুরু হবে। পঞ্চমত, প্রতিহিংসা নয়, পারস্পরিক প্রতিযোগিতাই হবে উন্নয়ন ও অবদানের কাঠামো। ষষ্ঠত, আর্থিক ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা, সততা ও প্রতিযোগিতা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সপ্তমত, রাজনীতি ও ব্যবসায় তরুণ সমাজকে উৎসাহিত করতে হবে এবং তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। অষ্টমত, বাংলাদেশের সার্বিক কল্যাণ এবং নাগরিকদের উপকার কোন কোন পন্থায় করা যায় এ বিষয়ে পরিকল্পিতভাবে সচেতনতা সৃষ্টির কর্মসূচি চালু করতে হবে।
দেশে এ মুহূর্তে যে অবস্থা বিদ্যমান, তা থেকে পরিত্রাণের পূর্ণশক্তি তথা কাঠামোগত শক্তি দেশের রাজনীতিতে নেই, এমনকি আমলাতন্ত্রেরও নেই। এ অবস্থা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। দেশে এরূপ পরিস্থিতি একদিনে সৃষ্টি হয়নি। দীর্ঘদিনের অশুভ পৃষ্ঠপোষকতায় এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। অতএব এ থেকে পরিত্রাণও একদিনে পাওয়া যাবে না। পরিত্রাণ পেতে হলে অবশ্যই রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন চাই।
মানুষকে, বিশেষত তরুণ সমাজকে রাজনীতিবিমুখ করা চলবে না। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে যে নিয়মে মানুষ রাজনীতিতে প্রবেশ করত এবং যে নিয়মে রাজনীতিতে বিচরণ করত, হুবহু সেই নিয়ম এখানে প্রযোজ্য হবে না। কারণ সবকিছুই পরিবর্তনশীল। তবে এ পরিবর্তনের জন্য সবকিছুকে বাদ দিলে চলবে না। যেখানে যেখানে সমস্যা রয়েছে, শুধু সেখানেই আমাদের কাজ করে যেতে হবে। আমাদের মহান ধর্ম ইসলামেরও শিক্ষা- পাপকে ঘৃণা কর, পাপীকে নয়। পাপীকে সঠিক পথে ফেরত আনতে চেষ্টা করতে হবে। একই কথা রাজনীতির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। রাজনীতির অসুস্থতা দূর করে রাজনীতিকে সুস্থ ধারায় ফেরাতে হবে। দেশের সবাই রাজনীতি করবে না। কিন্তু রাজনীতিই দেশের চালিকাশক্তি তথা রাজনীতিকরাই দেশকে চালাবেন। অতএব, অসুস্থতার চিকিৎসা যদি করতে হয়, তাহলে রাজনীতির চিকিৎসা করতে হবে। দেশে এখন রাজনীতিক-চিকিৎসক প্রয়োজন। আমার চিন্তা-চেতনার সঙ্গে সবাই একমত হবেন, এমনটি আমি আশা করি না। কিন্তু রাজনীতিতে যে গুণগত পরিবর্তন দরকার, এটা বোধ করি সবাই স্বীকার করবেন। আমরা সেই প্রত্যাশায় রইলাম।
মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম, বীর প্রতীক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
No comments