কেন নিভৃতে এই বীর? by মুজতবা আহমেদ মুরশেদ
স্বাধীনতার আন্দোলনকে বেগবান এবং সুশৃংখল
করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুযায়ী ৪ মার্চ ১৯৭১ সালে অ্যাডভোকেট
মো. আজিজুর রহমান, এমএনএ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে বৃহত্তর দিনাজপুর
জেলার সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। আবার সশস্ত্র
সংগ্রাম শুরু হলে তিনি ১৩ এপ্রিল ১৯৭১ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা
মুক্তিসংগ্রাম সমন্বয় পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পান (সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের
দলিলপত্র)।
প্রবাসী সরকার সুনিয়ন্ত্রিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকালে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো সম্পন্ন হলে, মুজিবনগর সরকার অ্যাডভোকেট মো. আজিজুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ৭নং সেক্টর এবং ৬নং সেক্টরের অর্ধেক অঞ্চলের জন্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার পদে দায়িত্ব প্রদান করে (তথ্যসূত্র : ৩০ আগস্ট, ১৯৭১ সালে জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত গোপন পরিপত্র নং : ০০০৯জি/২)। লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার হিসেবে তার সদর দফতর ছিল ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত তরঙ্গপুরে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার।
সেই গোপন পরিপত্র অনুয়ায়ী ওই সেক্টরের সামরিক কমান্ডার এবং অধীনস্থ সবার জন্য তার নির্দেশ মানাটা ছিল বাধ্যতামূলক। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য বিষয়েও পরামর্শ দেয়ার এখতিয়ার তার ছিল। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তার সামরিক বিষয়ে প্রদত্ত পরামর্শ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে সেক্টর কমান্ডারকে জানানোর নির্দেশ ছিল। ওই সেক্টরের সব মুক্তিযোদ্ধার রিক্রুটিং সংক্রান্ত সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার। আজিজুর রহমান পশ্চিমাঞ্চল ক-এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবেও নিয়োগ পেয়েছিলেন। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই পদমর্যাদায় মোট ১০ জন নিযুক্ত ছিলেন এবং সবাই ছিলেন এমএনএ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য)।
মোঃ আজিজুর রহমান ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার মোহাম্মদপুর গ্রামে ১৯২০ সালের ১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তার বিপ্লবী পিতা মাওলানা আকিমুদ্দিন সরকারের হাত ধরে তিনি স্কুল জীবনে ১৯৩৭ সালে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন।
১৯৪৮ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের (বর্তমান ছাত্রলীগ) সভাপতি দবিরুল ইসলাম দিনাজপুরে রাজনৈতিক সভা থেকে গ্রেফতার হলে মো. আজিজুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই উজ্জ্বল নেতার রাজনৈতিক পদযাত্রায় দেখা যায়, তিনি ১৯৪২ সালে অবিভক্ত বাংলা মুসলিম ছাত্র সংঘের সাংগঠনিক সম্পাদক। এরপর ১৯৪৪ সালে ডিস্টিংশনসসহ (সব বিষয়ে ৮৫ শতাংশ নম্বর) তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন।
বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, তিনি ১৯৬০ থেকে জুন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। কিন্তু ১৯৬৬ সালের জুন মাসে ৬ দফা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল আইয়ুব খানের জেল-জুলুমের ভয়ে রাজপথ থেকে বেশিরভাগ নেতাই সরে দাঁড়ালে মো. আজিজুর রহমান মাথায় গ্রেফতারের হুলিয়া নিয়েও জনতার অকুতোভয় সৈনিকের মতো গুটিকয় নেতাকর্মী নিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি (দৃশ্যত কার্যকর সভাপতি) হিসেবে রুখে দাঁড়ান।
অ্যাডভোকেট মো. আজিজুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকায় দেখা যায়, তিনি ১৯৭০ সালে বৃহত্তর দিনাজপুরের আসন থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিলে প্রতিবাদী জনতা নেমে আসে রাজপথে। শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম। প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হলে তিনি দিনাজপুর আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি হিসেবে সব দলের নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনতাকে দৃপ্তভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করেন।
যুদ্ধের শেষ ধাপে দিনাজপুর এবং ঠাকুরগাঁও শহরে চূড়ান্ত আঘাত হানার পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য শিলিগুড়ির ভারতীয় ক্যান্টনমেন্টে তিনি জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সঙ্গে মিলিত হন। ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অকুতোভয় নেতা মিত্রবাহিনীর অগ্রগামী দলের সঙ্গে ৪ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলার গৌরবের পতাকা উড়িয়ে দেন।
স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়নেও রয়েছে তার ভূমিকা। এই কর্মবীর ৪ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে ঘাসিপাড়ার ভাড়াবাড়িতে নিভৃতে ইন্তেকাল করেন।
মুজতবা আহমেদ মুরশেদ : কবি ও রাজনীতি বিশ্লেষক
প্রবাসী সরকার সুনিয়ন্ত্রিতভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকালে ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো সম্পন্ন হলে, মুজিবনগর সরকার অ্যাডভোকেট মো. আজিজুর রহমানকে মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র ৭নং সেক্টর এবং ৬নং সেক্টরের অর্ধেক অঞ্চলের জন্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার পদে দায়িত্ব প্রদান করে (তথ্যসূত্র : ৩০ আগস্ট, ১৯৭১ সালে জেনারেল ওসমানী স্বাক্ষরিত মুজিবনগর সরকারের জারিকৃত গোপন পরিপত্র নং : ০০০৯জি/২)। লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার হিসেবে তার সদর দফতর ছিল ভারতের পশ্চিম দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ থানার অন্তর্ভুক্ত তরঙ্গপুরে অবস্থিত মুক্তিযুদ্ধের ৭নং সেক্টরের হেডকোয়ার্টার।
সেই গোপন পরিপত্র অনুয়ায়ী ওই সেক্টরের সামরিক কমান্ডার এবং অধীনস্থ সবার জন্য তার নির্দেশ মানাটা ছিল বাধ্যতামূলক। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য বিষয়েও পরামর্শ দেয়ার এখতিয়ার তার ছিল। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে তার সামরিক বিষয়ে প্রদত্ত পরামর্শ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে তাৎক্ষণিকভাবে সেক্টর কমান্ডারকে জানানোর নির্দেশ ছিল। ওই সেক্টরের সব মুক্তিযোদ্ধার রিক্রুটিং সংক্রান্ত সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ ছিল লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদমর্যাদায় সিভিল অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজার। আজিজুর রহমান পশ্চিমাঞ্চল ক-এর প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবেও নিয়োগ পেয়েছিলেন। উল্লেখ্য, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এই পদমর্যাদায় মোট ১০ জন নিযুক্ত ছিলেন এবং সবাই ছিলেন এমএনএ (পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য)।
মোঃ আজিজুর রহমান ব্রিটিশ আমলে তৎকালীন ঠাকুরগাঁও মহকুমার মোহাম্মদপুর গ্রামে ১৯২০ সালের ১ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ব্রিটিশবিরোধী স্বদেশী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত তার বিপ্লবী পিতা মাওলানা আকিমুদ্দিন সরকারের হাত ধরে তিনি স্কুল জীবনে ১৯৩৭ সালে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেন।
১৯৪৮ সালে বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের (বর্তমান ছাত্রলীগ) সভাপতি দবিরুল ইসলাম দিনাজপুরে রাজনৈতিক সভা থেকে গ্রেফতার হলে মো. আজিজুর রহমান ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের এই উজ্জ্বল নেতার রাজনৈতিক পদযাত্রায় দেখা যায়, তিনি ১৯৪২ সালে অবিভক্ত বাংলা মুসলিম ছাত্র সংঘের সাংগঠনিক সম্পাদক। এরপর ১৯৪৪ সালে ডিস্টিংশনসসহ (সব বিষয়ে ৮৫ শতাংশ নম্বর) তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় তৃতীয় স্থান অধিকার করেন।
বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার রাজনৈতিক ইতিহাসে দেখা যায়, তিনি ১৯৬০ থেকে জুন ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর দিনাজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ছিলেন। কিন্তু ১৯৬৬ সালের জুন মাসে ৬ দফা ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে জেনারেল আইয়ুব খানের জেল-জুলুমের ভয়ে রাজপথ থেকে বেশিরভাগ নেতাই সরে দাঁড়ালে মো. আজিজুর রহমান মাথায় গ্রেফতারের হুলিয়া নিয়েও জনতার অকুতোভয় সৈনিকের মতো গুটিকয় নেতাকর্মী নিয়ে ভারপ্রাপ্ত সভাপতি (দৃশ্যত কার্যকর সভাপতি) হিসেবে রুখে দাঁড়ান।
অ্যাডভোকেট মো. আজিজুর রহমানের মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকায় দেখা যায়, তিনি ১৯৭০ সালে বৃহত্তর দিনাজপুরের আসন থেকে এমএনএ নির্বাচিত হন। এরপর ১৯৭১ সালের ১ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় সংসদ অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করে দিলে প্রতিবাদী জনতা নেমে আসে রাজপথে। শুরু হয় প্রতিরোধ সংগ্রাম। প্রতিরোধ সংগ্রাম শুরু হলে তিনি দিনাজপুর আওয়ামী লীগের জেলা সভাপতি হিসেবে সব দলের নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জনতাকে দৃপ্তভাবে ঐক্যবদ্ধ করতে শুরু করেন।
যুদ্ধের শেষ ধাপে দিনাজপুর এবং ঠাকুরগাঁও শহরে চূড়ান্ত আঘাত হানার পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য শিলিগুড়ির ভারতীয় ক্যান্টনমেন্টে তিনি জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সঙ্গে মিলিত হন। ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের এই অকুতোভয় নেতা মিত্রবাহিনীর অগ্রগামী দলের সঙ্গে ৪ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও প্রবেশ করে স্বাধীন বাংলার গৌরবের পতাকা উড়িয়ে দেন।
স্বাধীন দেশের সংবিধান প্রণয়নেও রয়েছে তার ভূমিকা। এই কর্মবীর ৪ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে ঘাসিপাড়ার ভাড়াবাড়িতে নিভৃতে ইন্তেকাল করেন।
মুজতবা আহমেদ মুরশেদ : কবি ও রাজনীতি বিশ্লেষক
No comments