সোনা অস্ত্র মাদকের চালান ট্রেনে
চোরাচালানিদের
কাছে নিরাপদ বাহনে পরিণত হয়েছে ট্রেন। ফলে রেলপথে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে
চোরাচালান। চোরাই পণ্যের তালিকায় নানা ধরনের মাদকের সঙ্গে যোগ হয়েছে
আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ এবং সোনা। পর্যাপ্ত নজরদারির অভাবে মাদক, অস্ত্র ও
সোনাসহ বিভিন্ন ধরনের চোরাই পণ্যের ৬০ ভাগ চালানই ট্রেনে আনা-নেয়া হচ্ছে।
পর্যাপ্ত জনবলের অভাবে এ পথে চোরাইপণ্য পরিবহন বন্ধ করা যাচ্ছে না। নারী,
শিশু, কিশোর, প্রতিবন্ধীদের চোরাই পণ্য বহনে ব্যবহার করা হচ্ছে। দীর্ঘ সময়
ধরে শরীরের সঙ্গে চোরাই পণ্য বেঁধে রাখায় ক্যান্সারসহ নানা ধরনের রোগে
আক্রান্ত হচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। সীমান্ত ঘেঁষা রেলপথে দিনাজপুর, হিলি,
ফুলবাড়ী, পাঁচবিবি, বিরামপুর, জয়পুরহাট, শান্তাহার রেলওয়ে স্টেশন এলাকায়
তিন দিন ঘুরে দেখা যায়, ঢাকামুখী প্রতিটি আন্তঃনগর, লোকাল ও মেইল ট্রেনে
প্রকাশ্যে চোরাচালান হচ্ছে। এসব রুটের আন্তঃনগর, মেইল ও লোকাল ট্রেনের যেমন
বিভিন্ন নাম দিয়েছে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ, তেমনি স্থানীয়ভাবেও নামকরণ করা
হয়েছে ট্রেনগুলোর। যেমন বাংলা ট্রেন, মশলা ট্রেন, ফেন্সি ট্রেন, বিচি ও
লাকড়ির ট্রেন। এসব নাম রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ দেয়নি, এ নামগুলো মুখে মুখে চালু
করেছে চোরাকারবারি, প্রতিরোধকারী সংস্থার সদস্য, ট্রেনযাত্রী ও স্টেশন
ঘেঁষা বসবাসরত সাধারণ লোকজন।
দিনাজপুর ও ঢাকা রুটে চলাচলকারী আন্তঃনগর একতা, দ্রুতযান ও নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোকে সাধারণ যাত্রীসহ চোরাকারবারিরা ফেন্সি, বিচি, লাকড়ি ট্রেন বলে ডাকে। স্থানীয় ভাষায় বিচিকে গুলি আর লাকড়িকে অস্ত্র বলে থাকে। মাদকদ্রব্যের পাশাপাশি এসব ট্রেনে গুলি ও অস্ত্রের চালান আসছে রাজধানীতে। একইভাবে ঢাকা থেকে সোনার চালান যাচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে। সেখান থেকে নিরাপদে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এছাড়া কাঞ্চন কমিউটার, উত্তরবঙ্গ মেইল, দিনাজপুর কমিউটার কিংবা দোলনচাঁপা এক্সপ্রেসে প্রায় প্রকাশ্যেই চোরাচালান হচ্ছে। ট্রেনগুলোর সময়সূচি এলোমেলো হলেও সমস্যা নেই চোরাকারবারিদের। তাদের মতে, ট্রেন এলেই হল, সে যখনই আসুক। ট্রেন থামার সঙ্গে সঙ্গে ওঁৎ পেতে থাকা শত শত চোরাকারবারি চোরাই পণ্য নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়েন। ভারতীয় জিরা, চিনি, নানা ধরনের মশলা সামগ্রী, গাঁজা, ফেনসিডিল, কসমেটিক, বিস্কুট-চকলেটসহ খাদ্যসামগ্রী, বস্তায় বস্তায় ট্রেনে তোলা হয়। খুব সাধারণ চোরাই মালের বস্তায় দেয়া হয় আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি, বিস্ফোরক এবং অনেক সময় সোনার চালানও যায় এভাবে।
দিনাজপুরের বিবিবন্দর, হিলি, পুলবাড়ী, পাঁচবিবি, বিরামপুর, শান্তাহার ও জয়পুরহাটসহ সীমান্তবর্তী রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, পুরুষ চোরাকারবারিদের পাশাপাশি নানা বয়সী নারী-শিশু, হিজড়া, প্রতিবন্ধীদের অনেকেই ব্যাগ অথবা বস্তাভর্তি ভারতীয় চোরাই পণ্য নিয়ে রেলওয়ে স্টেশন ট্রেনের অপেক্ষা করছে। হিলি রেলওয়ে স্টেশন এলাকা ঘেঁষেই রয়েছে ভারতীয় সীমানা। স্টেশন চত্বরে চোরাকারবারিরা ভারতীয় পণ্য নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বিজিবি, রেলওয়ে জিআরপি পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের নামকাওয়াস্তে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। তাদের সামনেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শুধু ‘লাইনম্যান’রা। যাদের সংখ্যা ১০-১২ জন। প্রতিরোধকারী সংস্থার হয়ে তারা চোরাকারবারিদের কাছ থেকে টাকা তুলছিল। অবৈধ পণ্যের পরিমাণভেদে ৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ২শ’ টাকা, ৫শ’ টাকা থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত তুলছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দু’জন লাইনম্যান জানান, দেখতে তাদের ক্ষমতাবান মনে হলেও সত্যিকার অর্থে তারাও দিনমজুরের কাজ করছেন। স্থানীয় চোরাচালান গডফাদারদের হয়ে শুধু টাকা তুলছেন। উচ্চস্বরে বললেন, ‘দুনিয়ার এমন কোনো শক্তি নেই, হিলি স্টেশনে চোরাচালান বন্ধ করতে পারে।’ প্রতিদিন প্রায় ৩শ’ নারী-পুরুষ, শিশু ও প্রতিবন্ধীরা ভারতীয় অবৈধ মালামাল নিয়ে নানামুখী ট্রেনে ওঠে। চোরাকারবারিদের তুলনায় বিজিবি তথা প্রতিরোধকারী সংস্থার সদস্য খুবই কম। হিলিতে কর্তব্যরত দু’জন বিজিবি সদস্য নাম গোপন রেখে বলেন, তারা চোরাচালান বন্ধ করতে পারছেন না। ট্রেন আসতেই শত শত চোরাকারবারি মৌমাছির মতো ট্রেন ঘিরে ধরছে। তাদের মালামাল নিয়ে ট্রেন উঠছে। নারীদের আটকানোও সম্ভব হচ্ছে না। আটকাতে চাইলেই মহিলা, শিশু ও হিজড়া চোরাকারবারিরা তাদেও গায়ের জামা-কাপড় ছিঁড়তে থাকেন। কখনও কখনও ব্লেড দিয়ে শরীর কাটতে শুরু করে। হিজড়ারা একেবারেই নগ্ন হয়ে পড়ে। তারপরও যথাসম্ভব মালামাল উদ্ধারের চেষ্টা করেন তারা।
স্টেশনে কর্তব্যরত রেলওয়ের দুই কর্মচারী জানান, চোরাকারবারিদের মধ্যে মেয়ে, মা, নানি কিংবা দাদি একসঙ্গে নেমেছে এ ব্যবসায়। সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় চোরাচালান চক্রের গডফাদাররা। এ অঞ্চলের চোরাকারবারিদের একমাত্র ভরসাই হচ্ছে ট্রেন। ট্রেনে করেই সব মালামাল রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় পাচার করা হয়।
চোরাকারবারি কহিনূর আক্তার (৪২) জানালেন, প্রায় ৬ বছর ধরে এ (হিলি) সীমান্তে মাদক থেকে শুরু করে নানা অবৈধ পণ্য ট্রেনে করে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে পাচার করে আসছেন। সঙ্গে ২ ছেলে ও ১ মেয়ে এ কাজে জড়িত। রয়েছে তার ননদ পারভীন আক্তারও। পারভীনের স্বামী ৪ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এরপর থেকেই সে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। জিরা, চিনি কিংবা মশলা জাতীয় প্যাকেট-বস্তার ভেতর অস্ত্র কিংবা গুলি পাচার হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে কহিনূর বললেন, সাধারণত একজন চোরাকারবারি জিরা, চিনি কিংবা মশলা সামগ্রীর বস্তা-প্যাকেট ট্রেনে করে ঢাকা বা রাজশাহীতে পৌঁছে দিলে ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা পেয়ে থাকে। অন্যদিকে কিছু কিছু বস্তা কিংবা প্যাকেট পৌঁছে দিলে তারা ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকে। আর ওইসব বস্তা কিংবা প্যাকেটের ভেতরই অস্ত্র, গুলি ও নানা বিস্ফোরকদ্রব্য পাচার হয়। এ কাজে শিশু ও উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের বেশি ব্যবহার করা হয়।
দিনাজপুর, শান্তাহার ও কমলাপুর রেলওয়ে থানা এবং জয়পুরহাট ৩ বিজিবি ব্যাটালিয়ন সূত্রে জানা গেছে, জব্দকৃত চিনি ও জিরার প্যাকেট কিংবা বস্তা থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। শান্তাহার রেলওয়ে থানার ওসি মো. সাঈদ ইকবাল জানান, ঢাকাগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস থেকে মার্চ মাসে ২টি অস্ত্র পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। অস্ত্রগুলো জিরার প্যাকেটের ভেতর ছিল। দিনাজপুর রেলওয়ে থানার ওসি মো. সামসুল আলম জানান, দিনাজপুর রেলওয়ে সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় নারী-শিশুরা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত সবচেয়ে বেশি। দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. মোশায়ের-উল ইসলাম জানান, সীমান্ত এলাকায় নারী-শিশুরা শরীরে বেঁধে মাদকসহ বিভিন্ন মালামাল বহন করায় নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভারি বস্তু রশি দিয়ে কোমর, পেট কিংবা বুকে বাঁধা থাকায় তাদের কিডনি নষ্টসহ ক্যান্সারও হতে পারে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও বিজিবি সদস্যরা আরও তৎপরতা হলেই এমন অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
হাকিমপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজাহারুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, সীমান্তবর্তী রেলওয়ে স্টেশন তথা সীমান্তকে কেন্দ্র করে নারী-শিশু তথা হিজড়া ও প্রতিবন্ধীরা ট্রেনে চোরাই পণ্য পরিবহনের সঙ্গে জড়িত। ট্রেনে অস্ত্র ও গুলি পাচারের বিষয়ে তিনি বলেন, এলাকার চিহ্নিত অস্ত্র ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীরসহ ৩-৪ জনের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা রয়েছে। তারা জামিনে রয়েছে। জিরা, চিনি ও নানা মশলা সামগ্রী চোরাচালানের অন্তরালে অস্ত্র ও গুলির ব্যবসা হতেও পারে। তিনি বলেন, কিছু এলাকা রয়েছে, সীমানা পিলার না দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই যে, কোনটা বাংলাদেশ আর কোনটা ভারত। ফলে চোরাকারবারিরা কোনো মতে ভারতীয় পণ্য নিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখতে পারলেই বিভিন্ন ট্রেনে করে তা গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে টাকা আয় করছে।
জয়পুরহাট ৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক (অপারেশন অফিসার) মেজর নাসির উদ্দিন রুমি যুগান্তরকে জানান, হিলিসহ সীমান্ত এলাকায় বিজিবি সদস্যরা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। মানবতা ও মানবাধিকার বিষয়টির কথা চিন্তা করে নারী-শিশু তথা হিজড়া ও প্রতিবন্ধী চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। মহিলা বিজিবি সদস্য না থাকায় তাদের পর্যাপ্ত আটক কিংবা তল্লাশিও করা যাচ্ছে না। চলতি বছরে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ভারতীয় মাদকদ্রব্যসহ নানা অবৈধ পণ্য আটক করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, একই সময়ে ৩টি অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়েছে। অস্ত্রগুলো জিরা ও চিনির বস্তা তল্লাশি করে পাওয়া যায়।
এদিকে ঢাকার রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রতিদিন গড়ে ৮৬টি যাত্রীবাহী ট্রেন রাজধানী হয়ে চলাচল করে। এ পথে চলাচলরত আন্তঃনগর, লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেনগুলোতে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ যাত্রী যাতায়াত করে। টঙ্গী, বনানী, বিমানবন্দর, ক্যান্টনমেন্ট, তেজগাঁও ও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন হয়ে বিনা তল্লাশিতেই যাত্রীরা রাজধানীতে প্রবেশ করছে। এদের মধ্যে অনেকেই বহন করছে মাদক, আগ্নেয়াস্ত্র, না হয় সোনা। ঢাকা রেলওয়ে জিআরপি থানা সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ করে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোতে চোরাকারবারিরা যাত্রীবেশে ভারতীয় মাদকদ্রব্যসহ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ে ঢাকায় নামছে।
যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোতে মাদকদ্রব্যের পাশাপাশি অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরকদ্রব্য পরিবহনের কথা স্বীকার করেন কমলাপুর জিআরপি থানার ওসি মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, টঙ্গী থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ৬টি স্টেশন হয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ যাত্রী বিনা তল্লাশিতে রাজধানীতে প্রবেশ করছে। যাত্রীবেশে চোরাকারবারি অস্ত্র, গুলি, বিস্ফোরক ও নানা মাদকদ্রব্য নিয়ে ট্রেনে ঢাকায় এসে নামছে। এদের সবাইকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, চলতি বছর ১৩টি অস্ত্র উদ্ধারসহ ৬ জন অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অস্ত্রগুলো অভিনব কায়দায় ভারতীয় চিনি, জিরা ও নানা মশলা সামগ্রী প্যাকেটের ভেতর ট্রেনযোগে রাজধানীতে আনা হচ্ছিল। ট্রেন থেকে চলতি বছরে প্রায় অর্ধকোটি টাকার মাদকদ্রব্যসহ নানা অবৈধপণ্য আটক করা হয়েছে। চোরাই ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত বলে জানান জিআরপির এই কর্মকর্তা।
রেলওয়ে উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মল্লিক ফখরুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, রেলপথে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা রোধে তার সদস্যরা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে এলেও যথাযথ সফলতা আসছে না। প্রতিদিন কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন হয়ে প্রায় আড়াই লাখ যাত্রী চলাচল করে। প্রায় ৯৫ শতাংশ যাত্রীই তল্লাশির বাইরে থেকে যায়। লোকবল স্বল্পতা তথা নানা সীমাবদ্ধতা থাকায় যাত্রীদের তল্লাশি করা যাচ্ছে না। তবে যাত্রীসাধারণ সচেতন হলে রেলপথে চোরাচালান অনেকাংশই কমে আসবে। কারণ যাত্রীবেশেই চোরাকারবারিরা ট্রেনে ভ্রমণ করছেন।
দিনাজপুর ও ঢাকা রুটে চলাচলকারী আন্তঃনগর একতা, দ্রুতযান ও নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনগুলোকে সাধারণ যাত্রীসহ চোরাকারবারিরা ফেন্সি, বিচি, লাকড়ি ট্রেন বলে ডাকে। স্থানীয় ভাষায় বিচিকে গুলি আর লাকড়িকে অস্ত্র বলে থাকে। মাদকদ্রব্যের পাশাপাশি এসব ট্রেনে গুলি ও অস্ত্রের চালান আসছে রাজধানীতে। একইভাবে ঢাকা থেকে সোনার চালান যাচ্ছে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোতে। সেখান থেকে নিরাপদে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। এছাড়া কাঞ্চন কমিউটার, উত্তরবঙ্গ মেইল, দিনাজপুর কমিউটার কিংবা দোলনচাঁপা এক্সপ্রেসে প্রায় প্রকাশ্যেই চোরাচালান হচ্ছে। ট্রেনগুলোর সময়সূচি এলোমেলো হলেও সমস্যা নেই চোরাকারবারিদের। তাদের মতে, ট্রেন এলেই হল, সে যখনই আসুক। ট্রেন থামার সঙ্গে সঙ্গে ওঁৎ পেতে থাকা শত শত চোরাকারবারি চোরাই পণ্য নিয়ে ট্রেনে উঠে পড়েন। ভারতীয় জিরা, চিনি, নানা ধরনের মশলা সামগ্রী, গাঁজা, ফেনসিডিল, কসমেটিক, বিস্কুট-চকলেটসহ খাদ্যসামগ্রী, বস্তায় বস্তায় ট্রেনে তোলা হয়। খুব সাধারণ চোরাই মালের বস্তায় দেয়া হয় আগ্নেয়াস্ত্র, গুলি, বিস্ফোরক এবং অনেক সময় সোনার চালানও যায় এভাবে।
দিনাজপুরের বিবিবন্দর, হিলি, পুলবাড়ী, পাঁচবিবি, বিরামপুর, শান্তাহার ও জয়পুরহাটসহ সীমান্তবর্তী রেলওয়ে স্টেশন ঘুরে দেখা যায়, পুরুষ চোরাকারবারিদের পাশাপাশি নানা বয়সী নারী-শিশু, হিজড়া, প্রতিবন্ধীদের অনেকেই ব্যাগ অথবা বস্তাভর্তি ভারতীয় চোরাই পণ্য নিয়ে রেলওয়ে স্টেশন ট্রেনের অপেক্ষা করছে। হিলি রেলওয়ে স্টেশন এলাকা ঘেঁষেই রয়েছে ভারতীয় সীমানা। স্টেশন চত্বরে চোরাকারবারিরা ভারতীয় পণ্য নিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। বিজিবি, রেলওয়ে জিআরপি পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্যদের নামকাওয়াস্তে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। তাদের সামনেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শুধু ‘লাইনম্যান’রা। যাদের সংখ্যা ১০-১২ জন। প্রতিরোধকারী সংস্থার হয়ে তারা চোরাকারবারিদের কাছ থেকে টাকা তুলছিল। অবৈধ পণ্যের পরিমাণভেদে ৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ২শ’ টাকা, ৫শ’ টাকা থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত তুলছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দু’জন লাইনম্যান জানান, দেখতে তাদের ক্ষমতাবান মনে হলেও সত্যিকার অর্থে তারাও দিনমজুরের কাজ করছেন। স্থানীয় চোরাচালান গডফাদারদের হয়ে শুধু টাকা তুলছেন। উচ্চস্বরে বললেন, ‘দুনিয়ার এমন কোনো শক্তি নেই, হিলি স্টেশনে চোরাচালান বন্ধ করতে পারে।’ প্রতিদিন প্রায় ৩শ’ নারী-পুরুষ, শিশু ও প্রতিবন্ধীরা ভারতীয় অবৈধ মালামাল নিয়ে নানামুখী ট্রেনে ওঠে। চোরাকারবারিদের তুলনায় বিজিবি তথা প্রতিরোধকারী সংস্থার সদস্য খুবই কম। হিলিতে কর্তব্যরত দু’জন বিজিবি সদস্য নাম গোপন রেখে বলেন, তারা চোরাচালান বন্ধ করতে পারছেন না। ট্রেন আসতেই শত শত চোরাকারবারি মৌমাছির মতো ট্রেন ঘিরে ধরছে। তাদের মালামাল নিয়ে ট্রেন উঠছে। নারীদের আটকানোও সম্ভব হচ্ছে না। আটকাতে চাইলেই মহিলা, শিশু ও হিজড়া চোরাকারবারিরা তাদেও গায়ের জামা-কাপড় ছিঁড়তে থাকেন। কখনও কখনও ব্লেড দিয়ে শরীর কাটতে শুরু করে। হিজড়ারা একেবারেই নগ্ন হয়ে পড়ে। তারপরও যথাসম্ভব মালামাল উদ্ধারের চেষ্টা করেন তারা।
স্টেশনে কর্তব্যরত রেলওয়ের দুই কর্মচারী জানান, চোরাকারবারিদের মধ্যে মেয়ে, মা, নানি কিংবা দাদি একসঙ্গে নেমেছে এ ব্যবসায়। সঙ্গে রয়েছে স্থানীয় চোরাচালান চক্রের গডফাদাররা। এ অঞ্চলের চোরাকারবারিদের একমাত্র ভরসাই হচ্ছে ট্রেন। ট্রেনে করেই সব মালামাল রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় পাচার করা হয়।
চোরাকারবারি কহিনূর আক্তার (৪২) জানালেন, প্রায় ৬ বছর ধরে এ (হিলি) সীমান্তে মাদক থেকে শুরু করে নানা অবৈধ পণ্য ট্রেনে করে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে পাচার করে আসছেন। সঙ্গে ২ ছেলে ও ১ মেয়ে এ কাজে জড়িত। রয়েছে তার ননদ পারভীন আক্তারও। পারভীনের স্বামী ৪ বছর আগে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এরপর থেকেই সে এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। জিরা, চিনি কিংবা মশলা জাতীয় প্যাকেট-বস্তার ভেতর অস্ত্র কিংবা গুলি পাচার হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের উত্তরে কহিনূর বললেন, সাধারণত একজন চোরাকারবারি জিরা, চিনি কিংবা মশলা সামগ্রীর বস্তা-প্যাকেট ট্রেনে করে ঢাকা বা রাজশাহীতে পৌঁছে দিলে ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা পেয়ে থাকে। অন্যদিকে কিছু কিছু বস্তা কিংবা প্যাকেট পৌঁছে দিলে তারা ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত পেয়ে থাকে। আর ওইসব বস্তা কিংবা প্যাকেটের ভেতরই অস্ত্র, গুলি ও নানা বিস্ফোরকদ্রব্য পাচার হয়। এ কাজে শিশু ও উঠতি বয়সী ছেলেমেয়েদের বেশি ব্যবহার করা হয়।
দিনাজপুর, শান্তাহার ও কমলাপুর রেলওয়ে থানা এবং জয়পুরহাট ৩ বিজিবি ব্যাটালিয়ন সূত্রে জানা গেছে, জব্দকৃত চিনি ও জিরার প্যাকেট কিংবা বস্তা থেকে অস্ত্র ও মাদক উদ্ধার করা হয়েছে। শান্তাহার রেলওয়ে থানার ওসি মো. সাঈদ ইকবাল জানান, ঢাকাগামী নীলসাগর এক্সপ্রেস থেকে মার্চ মাসে ২টি অস্ত্র পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। অস্ত্রগুলো জিরার প্যাকেটের ভেতর ছিল। দিনাজপুর রেলওয়ে থানার ওসি মো. সামসুল আলম জানান, দিনাজপুর রেলওয়ে সীমান্ত ঘেঁষা এলাকায় নারী-শিশুরা চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত সবচেয়ে বেশি। দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. মোশায়ের-উল ইসলাম জানান, সীমান্ত এলাকায় নারী-শিশুরা শরীরে বেঁধে মাদকসহ বিভিন্ন মালামাল বহন করায় নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভারি বস্তু রশি দিয়ে কোমর, পেট কিংবা বুকে বাঁধা থাকায় তাদের কিডনি নষ্টসহ ক্যান্সারও হতে পারে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ও বিজিবি সদস্যরা আরও তৎপরতা হলেই এমন অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
হাকিমপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আজাহারুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, সীমান্তবর্তী রেলওয়ে স্টেশন তথা সীমান্তকে কেন্দ্র করে নারী-শিশু তথা হিজড়া ও প্রতিবন্ধীরা ট্রেনে চোরাই পণ্য পরিবহনের সঙ্গে জড়িত। ট্রেনে অস্ত্র ও গুলি পাচারের বিষয়ে তিনি বলেন, এলাকার চিহ্নিত অস্ত্র ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীরসহ ৩-৪ জনের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে মামলা রয়েছে। তারা জামিনে রয়েছে। জিরা, চিনি ও নানা মশলা সামগ্রী চোরাচালানের অন্তরালে অস্ত্র ও গুলির ব্যবসা হতেও পারে। তিনি বলেন, কিছু এলাকা রয়েছে, সীমানা পিলার না দেখলে বোঝার কোনো উপায় নেই যে, কোনটা বাংলাদেশ আর কোনটা ভারত। ফলে চোরাকারবারিরা কোনো মতে ভারতীয় পণ্য নিয়ে দেশের মাটিতে পা রাখতে পারলেই বিভিন্ন ট্রেনে করে তা গন্তব্যে পৌঁছে দিয়ে টাকা আয় করছে।
জয়পুরহাট ৩ বিজিবি ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক (অপারেশন অফিসার) মেজর নাসির উদ্দিন রুমি যুগান্তরকে জানান, হিলিসহ সীমান্ত এলাকায় বিজিবি সদস্যরা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন। মানবতা ও মানবাধিকার বিষয়টির কথা চিন্তা করে নারী-শিশু তথা হিজড়া ও প্রতিবন্ধী চোরাকারবারিদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। মহিলা বিজিবি সদস্য না থাকায় তাদের পর্যাপ্ত আটক কিংবা তল্লাশিও করা যাচ্ছে না। চলতি বছরে প্রায় ৮০ কোটি টাকার ভারতীয় মাদকদ্রব্যসহ নানা অবৈধ পণ্য আটক করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, একই সময়ে ৩টি অস্ত্রও উদ্ধার করা হয়েছে। অস্ত্রগুলো জিরা ও চিনির বস্তা তল্লাশি করে পাওয়া যায়।
এদিকে ঢাকার রেলওয়ে সূত্র জানায়, প্রতিদিন গড়ে ৮৬টি যাত্রীবাহী ট্রেন রাজধানী হয়ে চলাচল করে। এ পথে চলাচলরত আন্তঃনগর, লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেনগুলোতে প্রতিদিন প্রায় দুই লাখ যাত্রী যাতায়াত করে। টঙ্গী, বনানী, বিমানবন্দর, ক্যান্টনমেন্ট, তেজগাঁও ও কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন হয়ে বিনা তল্লাশিতেই যাত্রীরা রাজধানীতে প্রবেশ করছে। এদের মধ্যে অনেকেই বহন করছে মাদক, আগ্নেয়াস্ত্র, না হয় সোনা। ঢাকা রেলওয়ে জিআরপি থানা সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ করে উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল থেকে আসা যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোতে চোরাকারবারিরা যাত্রীবেশে ভারতীয় মাদকদ্রব্যসহ অস্ত্র, গোলাবারুদ ও বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ে ঢাকায় নামছে।
যাত্রীবাহী ট্রেনগুলোতে মাদকদ্রব্যের পাশাপাশি অস্ত্র, গুলি ও বিস্ফোরকদ্রব্য পরিবহনের কথা স্বীকার করেন কমলাপুর জিআরপি থানার ওসি মোহাম্মদ আবদুল মজিদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, টঙ্গী থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত ৬টি স্টেশন হয়ে প্রতিদিন লাখ লাখ যাত্রী বিনা তল্লাশিতে রাজধানীতে প্রবেশ করছে। যাত্রীবেশে চোরাকারবারি অস্ত্র, গুলি, বিস্ফোরক ও নানা মাদকদ্রব্য নিয়ে ট্রেনে ঢাকায় এসে নামছে। এদের সবাইকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, চলতি বছর ১৩টি অস্ত্র উদ্ধারসহ ৬ জন অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অস্ত্রগুলো অভিনব কায়দায় ভারতীয় চিনি, জিরা ও নানা মশলা সামগ্রী প্যাকেটের ভেতর ট্রেনযোগে রাজধানীতে আনা হচ্ছিল। ট্রেন থেকে চলতি বছরে প্রায় অর্ধকোটি টাকার মাদকদ্রব্যসহ নানা অবৈধপণ্য আটক করা হয়েছে। চোরাই ব্যবসায়ীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত বলে জানান জিআরপির এই কর্মকর্তা।
রেলওয়ে উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মল্লিক ফখরুল ইসলাম যুগান্তরকে জানান, রেলপথে মাদক ও অস্ত্র ব্যবসা রোধে তার সদস্যরা দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে এলেও যথাযথ সফলতা আসছে না। প্রতিদিন কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন হয়ে প্রায় আড়াই লাখ যাত্রী চলাচল করে। প্রায় ৯৫ শতাংশ যাত্রীই তল্লাশির বাইরে থেকে যায়। লোকবল স্বল্পতা তথা নানা সীমাবদ্ধতা থাকায় যাত্রীদের তল্লাশি করা যাচ্ছে না। তবে যাত্রীসাধারণ সচেতন হলে রেলপথে চোরাচালান অনেকাংশই কমে আসবে। কারণ যাত্রীবেশেই চোরাকারবারিরা ট্রেনে ভ্রমণ করছেন।
No comments