ব্যর্থতার দায় স্বীকার করুন by একেএম শাহনাওয়াজ
দেশের একটি নামি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার
সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বরাবর এই স্কুলের এসএসসি পর্যন্ত সব পরীক্ষার ফলাফল
ভালো। ফলাফল বিচারে দেশের সেরা বিশটি স্কুলের ভেতর তার স্কুলের নামও যুক্ত
থাকে। দুঃখ করে বললেন, আগে স্কুলের ভালো ফলাফল গলা উঁচিয়ে জানাতাম। এখন
বিব্রতবোধ করি। আমি নিশ্চিত পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশকালে
শিক্ষামন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সরকারের সাফল্য বলে যে উচ্ছ্বাস
প্রকাশ করেন, অচিরেই সে পথ বন্ধ হবে। তারাও এই রকম ভালো ফলাফলের জ্বালাতনে
আমার মতোই বিব্রত হবেন। এই ধারার ফলাফল গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা
হারিয়ে করুণার বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। এতে সামগ্রিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের
ভাবমূর্তি। শিক্ষা ও পরীক্ষা পদ্ধতির ভিত্তিতে ফাটল ধরবে। কঠিন হয়ে পড়বে এই
ফাটল মেরামত করা। মেধাবী ছাত্রছাত্রী ও তাদের অভিভাবকরা হতাশায় ডুববেন। এই
সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় নিয়ে জনমনে একটি উচ্চ ধারণা ছিল। ক্রমে
সাধারণ্যে মন্ত্রণালয়টি বুলিসর্বস্ব এবং দুরাচারী হিসেবে নিন্দিত হচ্ছে। এর
সঙ্গে কচি শিশুদের পিইসি নামের পাবলিক পরীক্ষার আওতায় আনার ছেলেখেলা করে
এবং প্রশ্ন ফাঁস ও নকলবাজির হাতেখড়ি দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও
দেশের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মতো মাকাল ফল হওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে।
বুঝলাম প্রাজ্ঞ শিক্ষিকা খুব ক্ষেপেছেন। তার দুঃখ, কোথাও ভুল হলে বা কোনো অন্যায় যদি দৃশ্যমান হয়, তবে দায়িত্বশীল সরকার, মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রীরা তো অগ্রাধিকার দিয়ে এসব নষ্ট ভাইরাস খুঁজে বের করবেন। শক্ত হাতে অন্যায়ের প্রতিবিধান করবেন। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে উদ্ধার করবেন দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে। শিক্ষা ব্যবস্থার ফাটল সংস্কার করবেন। অথচ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিবরা এই ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল দস্যুতার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ফাঁস ও ফলাফল ভালো করার ইঞ্জিনিয়ারিং
বিষয়টি ক্রমাগত অস্বীকার করে যাচ্ছেন। দেখেশুনে মনে হয়, আমরা যারা মাঠপর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত আছি, সবাই অন্য গ্রহের বাসিন্দা।
সেদিন একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্য শুনে বিস্মিত ও হতাশ হলাম। পিইসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিবদের মতোই মন্তব্য করলেন। এসবের বাস্তবতা তিনি নাকি খুঁজে পাননি। যখন বলা হল শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ও পরীক্ষা হলের প্রশ্ন পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন, অনেক ওয়েবসাইটে পরীক্ষার আগের রাতেই প্রশ্ন চলে আসছে আর পরদিনের প্রশ্নের সঙ্গে তা মিলে যাচ্ছে তখন বিস্ময় ছড়িয়ে তিনি বললেন এর কোনো কিছুই তার চোখে পড়েনি। দর্শক-শ্রোতারা তো থ। যে মন্ত্রণালয় আয়োজিত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়, মিডিয়াতে লেখালেখি, তথ্য প্রকাশ- সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয় এসব কিছুতে নজর দেয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। আমরা তো জানি মন্ত্রণালয়ের একটি পিআরও সেকশন থাকে। এ দফতর থেকে মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট তথ্য ও রিপোর্ট ফাইল করে মন্ত্রী মহোদয়ের সামনে উপস্থাপন করা হয়। তাহলে কী দাঁড়াল? এভাবে অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ করা যাবে?
এই তো কদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম, সম্ভবত কোরিয়ায় একটি পাবলিক পরীক্ষায় দুটি প্রশ্ন ভুল ছাপা হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। আমরা মন্ত্রীদের পদত্যাগ করার মতো কঠিন প্রস্তাব করতে চাই না। আমাদের চাওয়া প্রশ্ন ফাঁসের মতো অনাচার হলে তাকে অস্বীকার না করে সংকটের মুখোমুখি হওয়ার নৈতিক সাহস দেখানোর মতো মনোবল সংশ্লিষ্টজনের থাকুক। অস্বীকার করে অন্যায় প্রতিরোধ করা যায় না। এতে অন্যায়কারীরা শুধু পার পেয়েই যায় না- উৎসাহিতও হয়। সাধারণ মানুষের প্রতি যদি শ্রদ্ধা থাকে তাহলে তাদের বিশ্বাসকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে। এই ডিজিটাল যুগে কোনো কিছু লুকানো-ছাপানোর অবকাশ নেই। ভুক্তভোগী অভিভাবক, শিক্ষক আর শিক্ষার্থীরা আগের রাতে যে প্রশ্ন দেখতে পাচ্ছেন, পরদিন পরীক্ষা হলে সরবরাহকৃত প্রশ্নের সঙ্গে তা প্রায় হুবহু মিলে যাচ্ছে। তাহলে তাদের বিশ্বাসকে মন্ত্রী মহোদয়রা টলাবেন কোন শব্দ চয়নে! রাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া আমাদের বিবেককে অন্ধ করে দেয়। গত সপ্তাহে একটি টিভি চ্যানেলে পিইসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে টকশো হচ্ছিল। বিষয়ের আকর্ষণে আমি কষ্ট করে রাত জেগে অনুষ্ঠানটি দেখলাম। পরে মনে হল আমার কষ্টের ষোলো আনাই মিছে। আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন শিক্ষা সচিব, একজন প্রাক্তন সচিব, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং একজন নতুন ধারার সংগঠনের পরিচিত রাজনীতিক। উপস্থাপকের জন্য আমার কষ্ট হল। তিনি বারবার মূল বক্তব্যে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। আমার মনে হল বিষয় বিচারে অতিথি নির্বাচন যথাযথ হয়নি। সচিব মহোদয়ের তো হিজ মাস্টার্স ভয়েজ। তিনি স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ফাঁসের বাস্তবতা খুঁজে পাননি। সাবেক সচিবের লেখা কলাম ও টকশো আমার ভালো লাগে; কিন্তু এখানে দেখা গেল তিনি পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি বরঞ্চ প্রশ্ন ফাঁসের পক্ষে সাফাই গাইলেন। তার মতে, প্রশ্ন ফাঁস নতুন কিছু নয়। ষাটের দশকেও তিনি প্রশ্ন ফাঁস হতে দেখেছেন। আমার মনে হল ফাঁসকারীরা এখান থেকে উৎসাহিত হওয়ার উপাদান পাবে। বিব্রত হলাম আমার সহকর্মী ভিসি মহোদয়ের জবানি শুনে। একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে বিবেক থেকে কথা বলবেন এটিই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু রাজনীতির নষ্ট সময় আমরা পার করছি। পরীক্ষিত দলীয় কর্মীরা এ জাতীয় পদ-পদবি পেয়ে থাকেন। এখানে বিবেক আর মুক্তচিন্তা থাকে না। তাই মন্ত্রীদের মতোই শিক্ষাবিদ প্রশ্ন ফাঁসসহ সব অপকর্ম অস্বীকার করলেন। জীবনের শুরুতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কেমন করে এসব রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পাবে তেমন কথা প্রত্যাশিত হলেও তিনি সেসব প্রসঙ্গে না গিয়ে অযথা সরকারের ইমেজ সংরক্ষণে ব্যস্ত থাকলেন। বাকি ভরসা ছিল এককালের তুখোড় ছাত্রনেতা বর্তমানে রাজনীতিকের ওপর। তিনি চেষ্টা করলেন। তবে মনে হল স্কুল পর্যায়ের পড়া ও পরীক্ষা পদ্ধতির বিষয়ে তার ততটা খোঁজ নেই।
শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবালের লেখাতেই জানলাম শিক্ষানীতিতে পিইসি পরীক্ষার ব্যাপারে কোনো সুপারিশ ছিল না। এগুলো নাকি আমাদের বিজ্ঞ আমলাদের চিন্তাপ্রসূত সংযোজন। কিন্তু কী উদ্দেশ্যে তারা এই সংযোজন ঘটালেন এবং সরকার শিক্ষানীতির বাইরে থেকে কেন এমন বিশাল এক আয়োজন করল তা আমার জানা নেই। তবে আমি সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের কারও কারও মতামত জেনে বিষণ্ন বোধ করেছি। শিক্ষকরা এ ধারার পরীক্ষায় প্রকৃত প্রাপ্তি কী বুঝতে পারছেন না। তবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী উভয়েই যে এমন পরীক্ষার প্রস্তুতি ও আয়োজন করতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় চাপের মুখে পড়ছেন তা খুব জোর করেই বললেন। শিক্ষকদের বিশ্বাস এই পদ্ধতি বয়স বিচারে শিক্ষার্থীদের মানসিক এবং শারীরিকভাবে যে চাপের মধ্যে ফেলেছে, তাতে আখেরে ক্ষতি বৈ লাভ হবে না।
ঢাকার পলাশীতে বাস করা গৃহবধূ পলাশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন। রাগের সঙ্গে বললেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বোধ হয় কোচিং সেন্টারগুলোর সম্পর্ক আছে। মুখে কোচিং বন্ধের কথা বলছে, তলে তলে কোচিংয়ের পথ উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। তিনি দেখালেন গণিত পর্যন্ত সৃজনশীল প্রশ্ন রয়েছে। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেকের কাছেই সৃজনশীল স্পষ্ট নয়। বললেন ছেলেকে তিনিই পড়াতেন। এসব সৃজনশীল তিনি বুঝতে পারছেন না। ভবিষ্যতের ভর্তি প্রতিযোগিতার জন্য ছেলের ভালো রেজাল্ট চাই। সুতরাং ছুটতে হচ্ছে কোচিং সেন্টারে। ছাপোষা চাকুরে বাবার গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। একই রকম অভিব্যক্তি গ্রিনরোডের গৃহবধূ জেবিকা জোবান দীপার। তার ছেলেও পিএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। তিনিও অভিভাবকের পকেট কাটা আর শিক্ষার্থীর মাথায় অহেতুক বোঝা চাপানো ছাড়া এই পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে অন্য কোনো লাভ খুঁজে পাচ্ছেন না। এই দুই অভিভাবক মনে করেন এসব নিরীক্ষার বদলে মন্ত্রণালয় স্কুলগুলোর ওপর নজর দিক। যথাযথ শিক্ষাদান এবং স্কুলের পরীক্ষাগুলো দায়িত্বের সঙ্গে নিতে
পারলে শিক্ষার্থীর সবচেয়ে বেশি উপকার হবে। সৃজনশীলের নিরীক্ষায় যেখানে ঢাকা শহরের নামি স্কুলের শিক্ষকরাই খাবি খাচ্ছেন, গ্রামগঞ্জের অসংখ্য স্কুলের যেখানে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার
ক্ষমতা নেই, সেখানকার দশা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে!
আমাকে গাইড ছাপানো ও বিক্রি করা একজন প্রকাশক জানালেন, এখন নাকি প্রকাশকরা স্কুল কিনে নেন। কথাটি প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে তিনি পরিষ্কার করলেন। এক এক প্রকাশক নির্দিষ্ট স্কুল বা স্কুলসমূহ ম্যানেজ করেন। সেই স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের এই গাইড বই কিনতে প্রায় বাধ্য করা হয়। কারণ স্কুলের পরীক্ষাগুলোতে এই গাইড বইতে দেয়া সৃজনশীল প্রশ্নই আসবে। সুতরাং শিক্ষার্থী মুখস্থ করে ঠিকই উতরে যাবে। শিক্ষক-অভিভাবকদেরও আর গলদঘর্ম হতে হবে না। এই যদি হয় বাস্তবতা, তবে সৃজনশীল প্রশ্ন দিয়ে সৃজনশীল মেধা বিকাশের সুযোগটা আর রইল কোথায়?
সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনরা হয়তো ভালো উদ্দেশ্যে কারিকুলামে বড় পরিবর্তন এনেছিলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো অনেক হল। এখন পুনর্মূল্যায়নে বসা উচিত বলে আমরা মনে করি। এই ধারায় শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ ঘটবে বলে যদি মনে করেন, তাহলে জেএসসি থেকে পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা থাক। কচি শিশুদের রেহাই দিন। মেধা বিকাশের স্বাভাবিক দরজা- জানালাগুলো খোলা রাখুন। ভালো ফলাফল দেখানোর জন্য প্রশ্ন ফাঁস, নকলের দীক্ষা এবং অস্বাভাবিক নিয়মে ফলাফলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চূড়ান্ত বিচারে ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে বলে আমাদের মনে হয় না। নন্দিত হতে গিয়ে যে প্রয়াস নিন্দার কারণ হয়ে দেখা দেয়, তা থেকে দ্রুত সরে আসাটাই বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত। পাবলিক পরীক্ষায় শতভাগ পাস এবং জিপিএ-৫-এর ছড়াছড়ি না হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে না, এমন অসুস্থ চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
বুঝলাম প্রাজ্ঞ শিক্ষিকা খুব ক্ষেপেছেন। তার দুঃখ, কোথাও ভুল হলে বা কোনো অন্যায় যদি দৃশ্যমান হয়, তবে দায়িত্বশীল সরকার, মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রীরা তো অগ্রাধিকার দিয়ে এসব নষ্ট ভাইরাস খুঁজে বের করবেন। শক্ত হাতে অন্যায়ের প্রতিবিধান করবেন। ধ্বংসের দ্বারপ্রান্ত থেকে উদ্ধার করবেন দেশের লাখ লাখ শিক্ষার্থীকে। শিক্ষা ব্যবস্থার ফাটল সংস্কার করবেন। অথচ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিবরা এই ডিজিটাল যুগে ডিজিটাল দস্যুতার সামনে দাঁড়িয়ে প্রশ্ন ফাঁস ও ফলাফল ভালো করার ইঞ্জিনিয়ারিং
বিষয়টি ক্রমাগত অস্বীকার করে যাচ্ছেন। দেখেশুনে মনে হয়, আমরা যারা মাঠপর্যায়ে শিক্ষা কার্যক্রমে জড়িত আছি, সবাই অন্য গ্রহের বাসিন্দা।
সেদিন একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাননীয় মন্ত্রীর বক্তব্য শুনে বিস্মিত ও হতাশ হলাম। পিইসি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে তিনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-সচিবদের মতোই মন্তব্য করলেন। এসবের বাস্তবতা তিনি নাকি খুঁজে পাননি। যখন বলা হল শিক্ষাবিদ মুহম্মদ জাফর ইকবাল ফাঁস হওয়া প্রশ্ন ও পরীক্ষা হলের প্রশ্ন পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন, অনেক ওয়েবসাইটে পরীক্ষার আগের রাতেই প্রশ্ন চলে আসছে আর পরদিনের প্রশ্নের সঙ্গে তা মিলে যাচ্ছে তখন বিস্ময় ছড়িয়ে তিনি বললেন এর কোনো কিছুই তার চোখে পড়েনি। দর্শক-শ্রোতারা তো থ। যে মন্ত্রণালয় আয়োজিত পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড়, মিডিয়াতে লেখালেখি, তথ্য প্রকাশ- সেই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয় এসব কিছুতে নজর দেয়ার প্রয়োজন মনে করেন না। আমরা তো জানি মন্ত্রণালয়ের একটি পিআরও সেকশন থাকে। এ দফতর থেকে মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্ট তথ্য ও রিপোর্ট ফাইল করে মন্ত্রী মহোদয়ের সামনে উপস্থাপন করা হয়। তাহলে কী দাঁড়াল? এভাবে অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ করা যাবে?
এই তো কদিন আগে পত্রিকায় দেখলাম, সম্ভবত কোরিয়ায় একটি পাবলিক পরীক্ষায় দুটি প্রশ্ন ভুল ছাপা হওয়ায় দুঃখ প্রকাশ করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। আমরা মন্ত্রীদের পদত্যাগ করার মতো কঠিন প্রস্তাব করতে চাই না। আমাদের চাওয়া প্রশ্ন ফাঁসের মতো অনাচার হলে তাকে অস্বীকার না করে সংকটের মুখোমুখি হওয়ার নৈতিক সাহস দেখানোর মতো মনোবল সংশ্লিষ্টজনের থাকুক। অস্বীকার করে অন্যায় প্রতিরোধ করা যায় না। এতে অন্যায়কারীরা শুধু পার পেয়েই যায় না- উৎসাহিতও হয়। সাধারণ মানুষের প্রতি যদি শ্রদ্ধা থাকে তাহলে তাদের বিশ্বাসকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দেয়ার প্রবণতা থেকে সরে আসতে হবে। এই ডিজিটাল যুগে কোনো কিছু লুকানো-ছাপানোর অবকাশ নেই। ভুক্তভোগী অভিভাবক, শিক্ষক আর শিক্ষার্থীরা আগের রাতে যে প্রশ্ন দেখতে পাচ্ছেন, পরদিন পরীক্ষা হলে সরবরাহকৃত প্রশ্নের সঙ্গে তা প্রায় হুবহু মিলে যাচ্ছে। তাহলে তাদের বিশ্বাসকে মন্ত্রী মহোদয়রা টলাবেন কোন শব্দ চয়নে! রাজনীতিকরণ প্রক্রিয়া আমাদের বিবেককে অন্ধ করে দেয়। গত সপ্তাহে একটি টিভি চ্যানেলে পিইসি পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে টকশো হচ্ছিল। বিষয়ের আকর্ষণে আমি কষ্ট করে রাত জেগে অনুষ্ঠানটি দেখলাম। পরে মনে হল আমার কষ্টের ষোলো আনাই মিছে। আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন শিক্ষা সচিব, একজন প্রাক্তন সচিব, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি এবং একজন নতুন ধারার সংগঠনের পরিচিত রাজনীতিক। উপস্থাপকের জন্য আমার কষ্ট হল। তিনি বারবার মূল বক্তব্যে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছিলেন। আমার মনে হল বিষয় বিচারে অতিথি নির্বাচন যথাযথ হয়নি। সচিব মহোদয়ের তো হিজ মাস্টার্স ভয়েজ। তিনি স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ফাঁসের বাস্তবতা খুঁজে পাননি। সাবেক সচিবের লেখা কলাম ও টকশো আমার ভালো লাগে; কিন্তু এখানে দেখা গেল তিনি পথ খুঁজে পাচ্ছেন না। তিনি বরঞ্চ প্রশ্ন ফাঁসের পক্ষে সাফাই গাইলেন। তার মতে, প্রশ্ন ফাঁস নতুন কিছু নয়। ষাটের দশকেও তিনি প্রশ্ন ফাঁস হতে দেখেছেন। আমার মনে হল ফাঁসকারীরা এখান থেকে উৎসাহিত হওয়ার উপাদান পাবে। বিব্রত হলাম আমার সহকর্মী ভিসি মহোদয়ের জবানি শুনে। একজন শিক্ষাবিদ হিসেবে বিবেক থেকে কথা বলবেন এটিই প্রত্যাশিত ছিল। কিন্তু রাজনীতির নষ্ট সময় আমরা পার করছি। পরীক্ষিত দলীয় কর্মীরা এ জাতীয় পদ-পদবি পেয়ে থাকেন। এখানে বিবেক আর মুক্তচিন্তা থাকে না। তাই মন্ত্রীদের মতোই শিক্ষাবিদ প্রশ্ন ফাঁসসহ সব অপকর্ম অস্বীকার করলেন। জীবনের শুরুতে কোমলমতি শিক্ষার্থীরা কেমন করে এসব রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পাবে তেমন কথা প্রত্যাশিত হলেও তিনি সেসব প্রসঙ্গে না গিয়ে অযথা সরকারের ইমেজ সংরক্ষণে ব্যস্ত থাকলেন। বাকি ভরসা ছিল এককালের তুখোড় ছাত্রনেতা বর্তমানে রাজনীতিকের ওপর। তিনি চেষ্টা করলেন। তবে মনে হল স্কুল পর্যায়ের পড়া ও পরীক্ষা পদ্ধতির বিষয়ে তার ততটা খোঁজ নেই।
শ্রদ্ধেয় জাফর ইকবালের লেখাতেই জানলাম শিক্ষানীতিতে পিইসি পরীক্ষার ব্যাপারে কোনো সুপারিশ ছিল না। এগুলো নাকি আমাদের বিজ্ঞ আমলাদের চিন্তাপ্রসূত সংযোজন। কিন্তু কী উদ্দেশ্যে তারা এই সংযোজন ঘটালেন এবং সরকার শিক্ষানীতির বাইরে থেকে কেন এমন বিশাল এক আয়োজন করল তা আমার জানা নেই। তবে আমি সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, শিক্ষার্থী এবং অভিভাবকদের কারও কারও মতামত জেনে বিষণ্ন বোধ করেছি। শিক্ষকরা এ ধারার পরীক্ষায় প্রকৃত প্রাপ্তি কী বুঝতে পারছেন না। তবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী উভয়েই যে এমন পরীক্ষার প্রস্তুতি ও আয়োজন করতে গিয়ে অপ্রয়োজনীয় চাপের মুখে পড়ছেন তা খুব জোর করেই বললেন। শিক্ষকদের বিশ্বাস এই পদ্ধতি বয়স বিচারে শিক্ষার্থীদের মানসিক এবং শারীরিকভাবে যে চাপের মধ্যে ফেলেছে, তাতে আখেরে ক্ষতি বৈ লাভ হবে না।
ঢাকার পলাশীতে বাস করা গৃহবধূ পলাশ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করলেন। রাগের সঙ্গে বললেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বোধ হয় কোচিং সেন্টারগুলোর সম্পর্ক আছে। মুখে কোচিং বন্ধের কথা বলছে, তলে তলে কোচিংয়ের পথ উন্মুক্ত করে দিচ্ছে। তিনি দেখালেন গণিত পর্যন্ত সৃজনশীল প্রশ্ন রয়েছে। স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেকের কাছেই সৃজনশীল স্পষ্ট নয়। বললেন ছেলেকে তিনিই পড়াতেন। এসব সৃজনশীল তিনি বুঝতে পারছেন না। ভবিষ্যতের ভর্তি প্রতিযোগিতার জন্য ছেলের ভালো রেজাল্ট চাই। সুতরাং ছুটতে হচ্ছে কোচিং সেন্টারে। ছাপোষা চাকুরে বাবার গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। একই রকম অভিব্যক্তি গ্রিনরোডের গৃহবধূ জেবিকা জোবান দীপার। তার ছেলেও পিএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। তিনিও অভিভাবকের পকেট কাটা আর শিক্ষার্থীর মাথায় অহেতুক বোঝা চাপানো ছাড়া এই পরীক্ষা পদ্ধতি থেকে অন্য কোনো লাভ খুঁজে পাচ্ছেন না। এই দুই অভিভাবক মনে করেন এসব নিরীক্ষার বদলে মন্ত্রণালয় স্কুলগুলোর ওপর নজর দিক। যথাযথ শিক্ষাদান এবং স্কুলের পরীক্ষাগুলো দায়িত্বের সঙ্গে নিতে
পারলে শিক্ষার্থীর সবচেয়ে বেশি উপকার হবে। সৃজনশীলের নিরীক্ষায় যেখানে ঢাকা শহরের নামি স্কুলের শিক্ষকরাই খাবি খাচ্ছেন, গ্রামগঞ্জের অসংখ্য স্কুলের যেখানে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেয়ার
ক্ষমতা নেই, সেখানকার দশা কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে!
আমাকে গাইড ছাপানো ও বিক্রি করা একজন প্রকাশক জানালেন, এখন নাকি প্রকাশকরা স্কুল কিনে নেন। কথাটি প্রথমে বুঝতে পারিনি। পরে তিনি পরিষ্কার করলেন। এক এক প্রকাশক নির্দিষ্ট স্কুল বা স্কুলসমূহ ম্যানেজ করেন। সেই স্কুলে ছাত্রছাত্রীদের এই গাইড বই কিনতে প্রায় বাধ্য করা হয়। কারণ স্কুলের পরীক্ষাগুলোতে এই গাইড বইতে দেয়া সৃজনশীল প্রশ্নই আসবে। সুতরাং শিক্ষার্থী মুখস্থ করে ঠিকই উতরে যাবে। শিক্ষক-অভিভাবকদেরও আর গলদঘর্ম হতে হবে না। এই যদি হয় বাস্তবতা, তবে সৃজনশীল প্রশ্ন দিয়ে সৃজনশীল মেধা বিকাশের সুযোগটা আর রইল কোথায়?
সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনরা হয়তো ভালো উদ্দেশ্যে কারিকুলামে বড় পরিবর্তন এনেছিলেন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা তো অনেক হল। এখন পুনর্মূল্যায়নে বসা উচিত বলে আমরা মনে করি। এই ধারায় শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ ঘটবে বলে যদি মনে করেন, তাহলে জেএসসি থেকে পাবলিক পরীক্ষার ব্যবস্থা থাক। কচি শিশুদের রেহাই দিন। মেধা বিকাশের স্বাভাবিক দরজা- জানালাগুলো খোলা রাখুন। ভালো ফলাফল দেখানোর জন্য প্রশ্ন ফাঁস, নকলের দীক্ষা এবং অস্বাভাবিক নিয়মে ফলাফলে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে চূড়ান্ত বিচারে ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে বলে আমাদের মনে হয় না। নন্দিত হতে গিয়ে যে প্রয়াস নিন্দার কারণ হয়ে দেখা দেয়, তা থেকে দ্রুত সরে আসাটাই বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত। পাবলিক পরীক্ষায় শতভাগ পাস এবং জিপিএ-৫-এর ছড়াছড়ি না হলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ঔজ্জ্বল্য বাড়ে না, এমন অসুস্থ চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা উচিত।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
No comments