সৃষ্টিশীল শিল্পের উত্থান by মাসুম আলী ও আবুল হাসনাত
দেশে সৃজনশীল শিল্পের আকার ক্রমশ বড় হচ্ছে, পরিধিও বাড়ছে। এটি এখন আনুমানিক ১২ হাজার কোটি টাকার শিল্প। এখানে কর্মসংস্থান হয়েছে অন্তত তিন লাখ মানুষের।
রেডিও-টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও জনসংযোগ, ডিজিটাল মিডিয়া সংস্থা, নানা ধরনের সফটওয়্যার তৈরি, মোবাইল অ্যাপস, অ্যানিমেশন, চলচ্চিত্র, নাটক, অনুষ্ঠান নির্মাণ তথা বিনোদনশিল্প—এসব নিয়েই সৃজনশীল শিল্প। দেশে এসব খাতকে আলাদা করে দেখা হলেও বিভিন্ন দেশে এদের একত্রে সৃজনশীল শিল্প বলা হয়। বহু দেশে এই সৃজনশীল অর্থনীতির পরিমাণ ব্যাপক।
সৃজনশীল অর্থনীতির দিক দিয়ে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। দেশটির ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) ২০১১ সালে করা এক গবেষণায় বলা হয়, ওই বছরে তাদের সৃজনশীল অর্থনীতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৭৩ হাজার ৮০০ কোটি রুপিতে, যা আগের বছর ছিল ৬৫ হাজার ২০০ কোটি রুপি।
বিজ্ঞাপন নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান গ্রে বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ গাউসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখন একটা সৃজনশীল যুগে পৌঁছেছি। বুদ্ধি বিক্রি করে আমরা অনেকেই বেঁচে আছি। ১৫ বছর আগেও এটা চিন্তা করতে পারিনি। আমাদের সৃজনশীল শিল্পের আকার এখনো তত বড় না। তবে এটা ক্রমেই বড় হচ্ছে।’
বিজ্ঞাপন: কয়েক দশক ধরেই দেশে রেডিও-টেলিভিশনের জন্য বিজ্ঞাপন তৈরি হচ্ছে। এর সঙ্গে আছে বিলবোর্ড ও সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনও। ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে পাঁচ শতাধিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা রয়েছে। বিজ্ঞাপনের বাজারের অর্ধেকই বড় ১০-১৫টি প্রতিষ্ঠানের দখলে। এ খাতে সব মিলিয়ে আট-দশ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর সংগঠন অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এএএবি) হিসাবে, সব মিলিয়ে দেশের বিজ্ঞাপনের বাজার আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকার। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও বিজ্ঞাপনী সংস্থা ইউনিট্রেন্ডের চেয়ারম্যান মুনীর আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর বিজ্ঞাপনের বাজার ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে।
বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো কিছু ক্ষেত্রে নিজেরাই বিজ্ঞাপন বানায়। আবার প্রোডাকশন হাউসকে দিয়েও বানিয়ে নেয়। বিজ্ঞাপননির্মাতা বড় প্রোডাবষন হাউস আছে ১৫টির মতো। ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০-৬০টি প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন বানায়। বছর দশেক আগেও বিজ্ঞাপনের প্রায় ৩০ শতাংশ কাজ করা হতো ভারত থেকে। বর্তমানে বিজ্ঞাপনের প্রায় ৯৯ শতাংশ কাজ দেশেই হয়।
বড় বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর প্রায় সবারই মিডিয়া বায়িং হাউসও আছে। এই সংস্থাগুলো গণমাধ্যমের জায়গা কিংবা সময় কিনে নেয়। প্রতিষ্ঠানগুলো অনুষ্ঠান কিংবা নাটক প্রচারেও নিয়ে এসেছে নতুনত্ব।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও জনসংযোগ: বিজ্ঞাপন এখন আর রেডিও-টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। গ্রাহকদের জন্য নানা ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন, কোনো একটি ব্র্যান্ডকে উৎসাহিত করা (ব্র্যান্ড অ্যাকটিভেশন), এমনকি জনসংযোগ কার্যক্রমও করে দেওয়া হচ্ছে।
দেশে অসংখ্য ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তবে বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান আছে ৩০-৪০টি। এসব প্রতিষ্ঠান কনসার্ট আয়োজন, সংবাদ সম্মেলন, বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম), ইনডোর ইভেন্ট, ইত্যাদির আয়োজন করে থাকে। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপের বাংলাদেশ অংশের উদ্বোধন কিংবা ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’র মতো অনুষ্ঠানও আয়োজন করে দিয়েছে বেসরকারি একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান।
এসব অনুষ্ঠানের কিছু অবশ্য জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানও আয়োজন করে থাকে। তারা মূলত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তাদের প্রচারণার দিকটি দেখে। দেশে বড় জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান আছে এখন পাঁচটি।
ডিজিটাল মিডিয়া: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডিজিটাল মিডিয়ার সংস্থা এখন সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। দেশে ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোকে ডিজিটাল ব্যবস্থায় যেতে হচ্ছে। অনলাইন গ্রাহকদের বেশির ভাগই যেহেতু তরুণ সেদিকে নজর দিতে হচ্ছে বেশি। তাই তো বড় একটি ডিজিটাল মিডিয়া সংস্থা নামই রেখেছে ‘বাঘের বাচ্চা ডিজিটাল’।
এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশনসের নির্বাহী পরিচালক ফেরদৌস হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে এখন যারা ডিজিটাল ব্যবস্থায় না যাবে সে-ই পিছিয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞাপনের আয়ের ৫০ শতাংশই আসে ডিজিটাল মাধ্যম থেকে। দেশে এ হার খুবই কম। তবে আগামী পাঁচ বছরে বিজ্ঞাপনের আয়ের ১৫ থেকে ২০ শতাংশই এখান থেকে আসবে।’
বিনোদনশিল্প: বাংলা চলচ্চিত্রে বর্তমানে পুরোপুরি ডিজিটালপ্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ছবি নির্মাণে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ বাড়ছে। এ শিল্প সম্ভাবনাময়ও হয়ে উঠছে। প্রতিবছরই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আয়োজিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের পূর্ণদৈর্ঘ্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য এবং প্রামাণ্য চলচ্চিত্র মুক্তি পাচ্ছে। এমনকি দেশীয় চলচ্চিত্র এসব উৎসবে পুরস্কৃতও হচ্ছে। ফ্রান্সের ‘গ্রাঁ প্রি’-তে পুরস্কার জিতেছে দেশীয় ছবি শুনতে কি পাও।
দেশীয় চলচ্চিত্র এখন রপ্তানিও হচ্ছে, সাড়াও মিলছে। সময়ের আলোচিত নায়ক ও প্রযোজক অনন্ত জলিল জানান, ইউরোপে মোস্ট ওয়েলকাম টু ছবিটি রপ্তানি করে ইতিবাচক ফল পেয়েছেন তিনি।
আরও কয়েকটি চলচ্চিত্র মালয়েশিয়া, বাহরাইন, দুবাইতে মুক্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিয়া আলাউদ্দিন জানান, সারা দেশে ৩০০-এর বেশি প্রেক্ষাগৃহে নতুন ছবি মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। বড় পর্দায় মুক্তি পাওয়া ছবিতে বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়ছে। এখন অনেক চলচ্চিত্র তিন কোটি টাকায় নির্মাণও হচ্ছে। কয়েক বছর আগেও একটি ছবি নির্মাণে কোটি টাকা বিনিয়োগ ছিল রীতিমতো অস্বাভাবিক।
নাটক, টেলিফিল্ম, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, রিয়ালিটি শো, তথ্যচিত্রসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠান নির্মাণে এখন মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বলছে, তাদের সদস্যসংখ্যা ১৭৫ ছাড়িয়ে গেছে। এর বাইরেও ৩৫০-৪০০টি অনুষ্ঠান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও নাট্যব্যক্তিত্ব তারিক আনাম খান প্রথম আলোকে জানান, প্রথম, দ্বিতীয় এবং অন্যান্য—এই তিন বিভাগে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সপ্তাহে অন্তত তিনটি নাটক কিংবা তিন পর্বের নাটক প্রচারিত হয়। এর বাইরে বিভিন্ন চ্যানেলে প্রতি ঈদে অন্তত ২০০টি নাটক জমা পড়ে, যা প্রতিটি সোয়া দুই লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকায় বিনিময় হয়। ক্ষেত্রবিশেষে ঈদের নাটকে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকাও লগ্নি করা হয়। সে হিসাবে, টেলিভিশন নাটকে বছরে আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়। এ ছাড়া নানা ধরনের অনুষ্ঠান নির্মাণে বছরে আনুমানিক আরও ৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়।
এ ছাড়া অডিওশিল্পে প্রতিবছর দেশে ১০০ কোটির বেশি অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে বলে জানা গেছে।
সফটওয়্যার ও অ্যানিমেশন: সৃজনশীলতার বড় ক্ষেত্র এখন সফটওয়্যার তৈরি। এ খাতে কাজ করা ৭৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান বেসিসের সদস্য। এসব প্রতিষ্ঠানে আছে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ কর্মী। সদস্যের বাইরে আছে আরও দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ব্যক্তি পর্যায়ে কাজ করছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার লোক।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) হিসাবে, রপ্তানি ও স্থানীয় বাজার মিলিয়ে দেশের সফটওয়্যার খাতের বাজার ১০০ কোটি ডলার বা সাত হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
বেসিসের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তসলীম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে কয়টি খাতে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে তার একটি সফটওয়্যার তৈরি। অ্যানিমেশন, মোবাইল অ্যাপস, গ্রাফিকসসহ সৃজনশীল খাতে কাজ করতে এখন লোকজন এগিয়ে আসছে।’
দেশের বহুল প্রচারিত মীনা কার্টুনটি ভারতের তৈরি। তখন অ্যানিমেশন তৈরির সক্ষমতা দেশে ছিল না। এখন দেশের ১৫-২০টি প্রতিষ্ঠান অ্যানিমেশন তৈরি করছে। আগে টুডি কার্টুন তৈরি হলেও এখন থ্রিডি কার্টুনও তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যে ঠাকুরমার ঝুলি নামের একটি অ্যানিমেশন জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।
বেসিসের তথ্য অনুযায়ী, ৪০-৫০টি প্রতিষ্ঠান এখন নানা ধরনের মোবাইল অ্যাপস তৈরি করছে। এই অ্যাপসের কারণেই এখন মুঠোফোনেই হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় উপন্যাসগুলো পড়া যাচ্ছে। সফটওয়্যার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের ওয়েবপেইজ তৈরি করে দিচ্ছে এবং গ্রাফিকস ডিজাইনও করে দিচ্ছে।
রেডিও-টেলিভিশনের বিজ্ঞাপন, ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও জনসংযোগ, ডিজিটাল মিডিয়া সংস্থা, নানা ধরনের সফটওয়্যার তৈরি, মোবাইল অ্যাপস, অ্যানিমেশন, চলচ্চিত্র, নাটক, অনুষ্ঠান নির্মাণ তথা বিনোদনশিল্প—এসব নিয়েই সৃজনশীল শিল্প। দেশে এসব খাতকে আলাদা করে দেখা হলেও বিভিন্ন দেশে এদের একত্রে সৃজনশীল শিল্প বলা হয়। বহু দেশে এই সৃজনশীল অর্থনীতির পরিমাণ ব্যাপক।
সৃজনশীল অর্থনীতির দিক দিয়ে ভারত বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে। দেশটির ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফআইসিসিআই) ২০১১ সালে করা এক গবেষণায় বলা হয়, ওই বছরে তাদের সৃজনশীল অর্থনীতির পরিমাণ দাঁড়াতে পারে ৭৩ হাজার ৮০০ কোটি রুপিতে, যা আগের বছর ছিল ৬৫ হাজার ২০০ কোটি রুপি।
বিজ্ঞাপন নির্মাতাপ্রতিষ্ঠান গ্রে বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ গাউসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখন একটা সৃজনশীল যুগে পৌঁছেছি। বুদ্ধি বিক্রি করে আমরা অনেকেই বেঁচে আছি। ১৫ বছর আগেও এটা চিন্তা করতে পারিনি। আমাদের সৃজনশীল শিল্পের আকার এখনো তত বড় না। তবে এটা ক্রমেই বড় হচ্ছে।’
বিজ্ঞাপন: কয়েক দশক ধরেই দেশে রেডিও-টেলিভিশনের জন্য বিজ্ঞাপন তৈরি হচ্ছে। এর সঙ্গে আছে বিলবোর্ড ও সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপনও। ছোট-বড় মিলিয়ে দেশে পাঁচ শতাধিক বিজ্ঞাপনী সংস্থা রয়েছে। বিজ্ঞাপনের বাজারের অর্ধেকই বড় ১০-১৫টি প্রতিষ্ঠানের দখলে। এ খাতে সব মিলিয়ে আট-দশ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে।
বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর সংগঠন অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (এএএবি) হিসাবে, সব মিলিয়ে দেশের বিজ্ঞাপনের বাজার আড়াই থেকে তিন হাজার কোটি টাকার। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও বিজ্ঞাপনী সংস্থা ইউনিট্রেন্ডের চেয়ারম্যান মুনীর আহমেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর বিজ্ঞাপনের বাজার ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে।
বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলো কিছু ক্ষেত্রে নিজেরাই বিজ্ঞাপন বানায়। আবার প্রোডাকশন হাউসকে দিয়েও বানিয়ে নেয়। বিজ্ঞাপননির্মাতা বড় প্রোডাবষন হাউস আছে ১৫টির মতো। ছোট-বড় মিলিয়ে ৫০-৬০টি প্রতিষ্ঠান বিজ্ঞাপন বানায়। বছর দশেক আগেও বিজ্ঞাপনের প্রায় ৩০ শতাংশ কাজ করা হতো ভারত থেকে। বর্তমানে বিজ্ঞাপনের প্রায় ৯৯ শতাংশ কাজ দেশেই হয়।
বড় বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোর প্রায় সবারই মিডিয়া বায়িং হাউসও আছে। এই সংস্থাগুলো গণমাধ্যমের জায়গা কিংবা সময় কিনে নেয়। প্রতিষ্ঠানগুলো অনুষ্ঠান কিংবা নাটক প্রচারেও নিয়ে এসেছে নতুনত্ব।
ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ও জনসংযোগ: বিজ্ঞাপন এখন আর রেডিও-টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। গ্রাহকদের জন্য নানা ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন, কোনো একটি ব্র্যান্ডকে উৎসাহিত করা (ব্র্যান্ড অ্যাকটিভেশন), এমনকি জনসংযোগ কার্যক্রমও করে দেওয়া হচ্ছে।
দেশে অসংখ্য ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তবে বড় ও মাঝারি প্রতিষ্ঠান আছে ৩০-৪০টি। এসব প্রতিষ্ঠান কনসার্ট আয়োজন, সংবাদ সম্মেলন, বার্ষিক সাধারণ সভা (এজিএম), ইনডোর ইভেন্ট, ইত্যাদির আয়োজন করে থাকে। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত আইসিসি ক্রিকেট বিশ্বকাপের বাংলাদেশ অংশের উদ্বোধন কিংবা ‘লাখো কণ্ঠে সোনার বাংলা’র মতো অনুষ্ঠানও আয়োজন করে দিয়েছে বেসরকারি একটি ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠান।
এসব অনুষ্ঠানের কিছু অবশ্য জনসংযোগ প্রতিষ্ঠানও আয়োজন করে থাকে। তারা মূলত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষে তাদের প্রচারণার দিকটি দেখে। দেশে বড় জনসংযোগ প্রতিষ্ঠান আছে এখন পাঁচটি।
ডিজিটাল মিডিয়া: সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ডিজিটাল মিডিয়ার সংস্থা এখন সবচেয়ে সম্ভাবনাময়। দেশে ইন্টারনেট এবং স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়তে থাকায় বিজ্ঞাপনী সংস্থাগুলোকে ডিজিটাল ব্যবস্থায় যেতে হচ্ছে। অনলাইন গ্রাহকদের বেশির ভাগই যেহেতু তরুণ সেদিকে নজর দিতে হচ্ছে বেশি। তাই তো বড় একটি ডিজিটাল মিডিয়া সংস্থা নামই রেখেছে ‘বাঘের বাচ্চা ডিজিটাল’।
এশিয়াটিক মার্কেটিং কমিউনিকেশনসের নির্বাহী পরিচালক ফেরদৌস হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের মধ্যে এখন যারা ডিজিটাল ব্যবস্থায় না যাবে সে-ই পিছিয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্রে বিজ্ঞাপনের আয়ের ৫০ শতাংশই আসে ডিজিটাল মাধ্যম থেকে। দেশে এ হার খুবই কম। তবে আগামী পাঁচ বছরে বিজ্ঞাপনের আয়ের ১৫ থেকে ২০ শতাংশই এখান থেকে আসবে।’
বিনোদনশিল্প: বাংলা চলচ্চিত্রে বর্তমানে পুরোপুরি ডিজিটালপ্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ছবি নির্মাণে নতুন প্রজন্মের আগ্রহ বাড়ছে। এ শিল্প সম্ভাবনাময়ও হয়ে উঠছে। প্রতিবছরই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আয়োজিত আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের পূর্ণদৈর্ঘ্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য এবং প্রামাণ্য চলচ্চিত্র মুক্তি পাচ্ছে। এমনকি দেশীয় চলচ্চিত্র এসব উৎসবে পুরস্কৃতও হচ্ছে। ফ্রান্সের ‘গ্রাঁ প্রি’-তে পুরস্কার জিতেছে দেশীয় ছবি শুনতে কি পাও।
দেশীয় চলচ্চিত্র এখন রপ্তানিও হচ্ছে, সাড়াও মিলছে। সময়ের আলোচিত নায়ক ও প্রযোজক অনন্ত জলিল জানান, ইউরোপে মোস্ট ওয়েলকাম টু ছবিটি রপ্তানি করে ইতিবাচক ফল পেয়েছেন তিনি।
আরও কয়েকটি চলচ্চিত্র মালয়েশিয়া, বাহরাইন, দুবাইতে মুক্তি দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মিয়া আলাউদ্দিন জানান, সারা দেশে ৩০০-এর বেশি প্রেক্ষাগৃহে নতুন ছবি মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। বড় পর্দায় মুক্তি পাওয়া ছবিতে বিনিয়োগের পরিমাণও বাড়ছে। এখন অনেক চলচ্চিত্র তিন কোটি টাকায় নির্মাণও হচ্ছে। কয়েক বছর আগেও একটি ছবি নির্মাণে কোটি টাকা বিনিয়োগ ছিল রীতিমতো অস্বাভাবিক।
নাটক, টেলিফিল্ম, বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান, রিয়ালিটি শো, তথ্যচিত্রসহ নানা ধরনের অনুষ্ঠান নির্মাণে এখন মানুষের আগ্রহ বেড়েছে। টেলিভিশন প্রোগ্রাম প্রডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ বলছে, তাদের সদস্যসংখ্যা ১৭৫ ছাড়িয়ে গেছে। এর বাইরেও ৩৫০-৪০০টি অনুষ্ঠান নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কাজ করছে।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ও নাট্যব্যক্তিত্ব তারিক আনাম খান প্রথম আলোকে জানান, প্রথম, দ্বিতীয় এবং অন্যান্য—এই তিন বিভাগে বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সপ্তাহে অন্তত তিনটি নাটক কিংবা তিন পর্বের নাটক প্রচারিত হয়। এর বাইরে বিভিন্ন চ্যানেলে প্রতি ঈদে অন্তত ২০০টি নাটক জমা পড়ে, যা প্রতিটি সোয়া দুই লাখ থেকে পাঁচ লাখ টাকায় বিনিময় হয়। ক্ষেত্রবিশেষে ঈদের নাটকে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকাও লগ্নি করা হয়। সে হিসাবে, টেলিভিশন নাটকে বছরে আনুমানিক ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়। এ ছাড়া নানা ধরনের অনুষ্ঠান নির্মাণে বছরে আনুমানিক আরও ৩০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ হয়।
এ ছাড়া অডিওশিল্পে প্রতিবছর দেশে ১০০ কোটির বেশি অর্থ বিনিয়োগ হয়েছে বলে জানা গেছে।
সফটওয়্যার ও অ্যানিমেশন: সৃজনশীলতার বড় ক্ষেত্র এখন সফটওয়্যার তৈরি। এ খাতে কাজ করা ৭৫০টির বেশি প্রতিষ্ঠান বেসিসের সদস্য। এসব প্রতিষ্ঠানে আছে ৮০ হাজার থেকে এক লাখ কর্মী। সদস্যের বাইরে আছে আরও দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান। ফ্রিল্যান্সার হিসেবে ব্যক্তি পর্যায়ে কাজ করছে ৬০ থেকে ৭০ হাজার লোক।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) হিসাবে, রপ্তানি ও স্থানীয় বাজার মিলিয়ে দেশের সফটওয়্যার খাতের বাজার ১০০ কোটি ডলার বা সাত হাজার ৮০০ কোটি টাকা।
বেসিসের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি তসলীম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যে কয়টি খাতে বাংলাদেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে তার একটি সফটওয়্যার তৈরি। অ্যানিমেশন, মোবাইল অ্যাপস, গ্রাফিকসসহ সৃজনশীল খাতে কাজ করতে এখন লোকজন এগিয়ে আসছে।’
দেশের বহুল প্রচারিত মীনা কার্টুনটি ভারতের তৈরি। তখন অ্যানিমেশন তৈরির সক্ষমতা দেশে ছিল না। এখন দেশের ১৫-২০টি প্রতিষ্ঠান অ্যানিমেশন তৈরি করছে। আগে টুডি কার্টুন তৈরি হলেও এখন থ্রিডি কার্টুনও তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যে ঠাকুরমার ঝুলি নামের একটি অ্যানিমেশন জনপ্রিয়তাও পেয়েছে।
বেসিসের তথ্য অনুযায়ী, ৪০-৫০টি প্রতিষ্ঠান এখন নানা ধরনের মোবাইল অ্যাপস তৈরি করছে। এই অ্যাপসের কারণেই এখন মুঠোফোনেই হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় উপন্যাসগুলো পড়া যাচ্ছে। সফটওয়্যার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো নানা ধরনের ওয়েবপেইজ তৈরি করে দিচ্ছে এবং গ্রাফিকস ডিজাইনও করে দিচ্ছে।
No comments