বিমানের ফ্লাইট কেনাবেচা
মধ্যপ্রাচ্যগামী বিমানের ফ্লাইট বিক্রি হচ্ছে। নিজেদের কেনা ক্রু দিয়ে চালানো হচ্ছে এ ধরনের ফ্লাইট। এয়ারক্রাফট ভর্তি হয়ে আসছে সোনা, ওষুধ এবং বিদেশী মুদ্রার চালান। চোরাই পণ্যের চালান নির্বিঘ্নে পার করতে বিমানবন্দরে কর্মরত সব সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কিনে ফেলা হচ্ছে। এরপরও মুনাফা হচ্ছে শত কোটি টাকা। ভাগ যাচ্ছে বিমানের সংশ্লিষ্ট শাখার অসাধু কর্মকর্তাদের কাছে। টাকার লোভে বিমান ও এয়ারপোর্টের প্রায় সব শাখার অসৎ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং বাইরে অসাধু ব্যবসায়ী একবিন্দুতে মিলে একটি চক্র গড়ে তুলেছে। এরা কয়েক বছর ধরে নির্বিঘ্নে চোরাই পণ্যের ব্যবসা করে যাচ্ছে। বিমানের এমডি ক্যাপ্টেন মোসাদ্দেক আহম্মেদ যুগান্তরকে জানান, বিভিন্ন এয়ারলাইন্সকে ব্যবহার করে চোরাকারবারিরা বিভিন্ন ধরনের চোরাচালান করছে এটা ঠিক। বিমানের কয়েকটি ফ্লাইট থেকে চোরাই পণ্য উদ্ধার হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত থাকায় কতিপয় ক্রুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নেয়া হয়েছে। চার্জশিট হয়েছে। অনেকের বিরুদ্ধে মামলা বিচারাধীন আছে। তিনি বলেন, যারাই এসব চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে বিমান জিরো টলারেন্স দেখাবে। তবে সিডিউলিং বিভাগে এ ধরনের ফ্লাইট বেচাকেনার কথা শুনে তিনি আঁতকে ওঠেন। বলেন, এটা তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার। তদন্তে প্রমাণ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে আশ্বাস দেন। তার মতে, ক্রু সিডিউলিং অটোমোশন প্রক্রিয়াটি ‘লাইভ’ শুরু হলে এ রকম কিছু আর থাকবে না। শিগগিরই এটা চালু করা হবে বলেও তিনি জানান।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চোরাচালানিদের কাছে সবচেয়ে দামি রুট হচ্ছে দুবাই, জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম ও কুয়েত। মধ্যপ্রাচ্যের এসব রুটে বিমান নিজস্ব এয়ারক্রাফট পরিচালনা করে আসছে। বিমানের সিডিউলিং, অপারেশন ও ট্রেনিং শাখার কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা সিন্ডিকেটের কাছে ফ্লাইট বিক্রির সঙ্গে জড়িত। প্রতি ফ্লাইটের জন্য এরা নিচ্ছে ১০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা। এরপর সংশ্লিষ্ট ফ্লাইটে চক্রটির আগাম কেনা ককপিট ও কেবিন ক্রুদের ডিউটি দিচ্ছে। এদের মধ্যে কেবিন ক্রুরা মূলত চোরাই পণ্যের ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কেবিন ক্রুদের অধিকাংশই বিমানে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত। চোরাই সিন্ডিকেটের কাছে ক্রু বিক্রির জন্য, মূলত সংশ্লিষ্ট বিভাগ ক্রু সিডিউলিং অটোমেশন করছে না। কাজটি তারা এখনও ম্যানুয়েলি সারছেন। অথচ এ কাজের জন্য ২০ কোটি টাকায় অত্যাধুনিক মেশিন কেনা হয়েছে। এটা চালু হলে সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে এ আশংকায় অটোমেশন চালু হচ্ছে না।
বিমানের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিমান কেনাবেচার বিষয়টি বায়বীয়, দেখা যায় না। মূলত বিক্রি হয় ক্রু। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশগামী নির্দিষ্ট ফ্লাইটে মোটা অর্থের বিনিময়ে ওইসব ক্রুর ডিউটি দেয়া হয়। যারা চোরাচালানিদের হয়ে কাজ করে। শাহজালালে ক্রুদের ব্যাগ সেভাবে তল্লাশি না করায় তারা নিরাপদে কাজটি করতে পারছেন। ফ্লাইট সিডিউল বিভাগের একজন কর্মী জানান, ফ্লাইট ক্রুর নির্দেশনা ছাড়া ওই এয়ারক্রাফটে কোনোভাবেই চোরাই পণ্য তোলা সম্ভব নয়।
অভিযোগ রয়েছে, বিমানের সিডিউলিং বিভাগে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বসে ফ্লাইট বেচাকেনার হাট। একই বিভাগের একজন পাইলটের কক্ষে বসে এই কেনাবেচার টাকা ভাগবাটোয়ারা হয়। চোরাচালান সিন্ডিকেটের পক্ষে পলাশ নামে এক ব্যক্তি এই ফ্লাইট কেনাবেচার কাজ করে আসছে অনেক দিন ধরে। এই পলাশ বিমানের কোনো কর্মকর্তা নয়, তবু অধিকাংশ পরিচালকের কক্ষে তার অবাধ যাতায়াত। নিজেকে বিমানের একজন কেবিন ক্রুর স্বামী পরিচয় দিলেও তার মূল কাজ চোরাচালান আর ফ্লাইট কেনা। মূলত তার পছন্দ অনুযায়ীই ওইসব ফ্লাইটের জন্য ক্রু নিয়োগ দেয়া হয়। রুট এবং চোরাই পণ্যের চালানের ওপর ভিত্তি করে সে ক্রুর চাহিদা দিয়ে থাকে। তার চাহিদার ভিত্তিতেই ডিউটি দেয়া হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্রুরা চোরাচালানের পণ্য পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করছে। বিমানে এ ধরনের ক্রুর সংখ্যা হাতেগোনা। এদের বেশির ভাগই চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত। কিছু আছেন যারা নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে চাকরিচ্যুত হয়েও আদালতের রায় নিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন। এরা সংখ্যায় কম হলেও খুবই শক্তিশালী। এদের বেশির ভাগই অসীম ক্ষমতাধর চোরাচালান চক্রের সদস্য। দৈনিক বেতনের ভিত্তিতে অস্থায়ী চাকরি করায় এরা কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করে না। বেশির ভাগেরই রয়েছে একাধিক দেশের নাগরিকত্ব। নামে-বেনামে এরা কোটি কোটি টাকার মালিক। দেশে-বিদেশে বাড়ি-গাড়ির মালিক।
নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট ওজনের বেশি হলেই যে কোনো ব্যক্তি বিমানের ক্রু (কেবিন) হিসেবে থাকতে পারেন না। কিন্তু ওই ক্রু যদি অসীম ক্ষমতাবান পলাশ চক্রের সদস্য হয় তবে তার জন্য প্রচলিত আইন প্রযোজ্য নয়। বিমানের চোরাচালান চক্র ও ক্যারিয়ার নামধারী ক্রুদের অনেকের চাকরির বয়স ৫০-৬০ বছরের বেশি। অধিকাংশের ওজন ৮০ থেকে ১০০ কেজির বেশি। এরা এতটাই প্রভাবশালী চাকরি হারানোর ভয়ে কোনো কর্মকর্তাও এদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করার সাহস পায় না। বিরুদ্ধে কথা বললেই নানা ধরনের কেলেংকারিতে জড়িয়ে যাওয়ার আশংকা। এই সিন্ডিকেটের কারণেই ১০ বছর ধরে আটকে আছে বিমানের স্থায়ী পদে কর্মরত ১০২ জন জুনিয়র পার্সারের (কেবিন ক্রু) পদোন্নতি। বিমানের প্রায় সবগুলো শাখার নানা পর্যায়ে চেষ্টা তদবিরের পরও এই ১০২ জন জুনিয়র পার্সারের নাম এফসিপি লিস্টে (ফাইনাল ক্রু পজিশন) দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া অসংখ্য কেবিন ক্রু আছেন, যারা পলাশের কথা না শুনে এখন চাকরি হারিয়ে পথে পথে ঘুরছেন। জানা গেছে, পলাশ সিন্ডিকেটের কথা না শুনলে উল্টো তার বিরুদ্ধে মিথ্যা চোরাচালানের মামলা ঠুকে দেয়া হচ্ছে। নানাভাবে হেনস্থা, চাকরিচ্যুতি ও নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়ানো হচ্ছে।
শুধু কেবিন ক্রু নয়, বিমানের ককপিট ক্রুদের (পাইলট) সিডিউলিং নিয়েও আছে নানা অভিযোগ। এয়ারলাইন্সকেন্দ্রিক এই চোরাচালানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই পলাশ সিন্ডিকেটের মধ্যে বেশ কজন ককপিট ক্রুরও (পাইলট) সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে বর্তমানে এদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাই বিমানের সাবেক ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার শামীম ইস্কান্দারের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জোট সরকারের আমলে দীর্ঘ ৬ বছর তিনি বিমানের ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের ট্রেনিং শাখার গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে উপস্থিত থাকা, জোট সরকারের আমলে ভিভিআইপি ফ্লাইট পরিচালনা এবং ক্রু ট্রেনিং নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ ছিল। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাকে বিমান থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু ২০১১ সালে আদালতের রায়ে তিনি চাকরি ফিরে পেয়ে আবার বিমানে যোগদান করেন। ২০১৩ সালে তিনি অবসরে চলে যাওয়ার পর চোরাচালান সিন্ডিকেটের গডফাদারদের সুপারিশে তাকে আবারও বিমানে পাইলট হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগ পেয়েই তিনি আবারও তার পুরনো গ্র“প নিয়ে বিমানে গড়ে তুলেছেন বড় ধরনের চোরাচালান সিন্ডিকেট।
এ প্রসঙ্গে বিমানের প্ল্যানিং অ্যান্ড সিডিউলিংয়ে বিভাগের প্রধান ক্যাপ্টেন আসলাম শহীদ যুগান্তরকে জানান, এ ধরনের কোনো অভিযোগ তার জানা নেই। তিনি বলেন, হজের সময় মোটামুটি সবাইকে ফ্লাইট দেয়া হয়েছে। ক্রু সিডিউলিংয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করে অটোমেশিন করা হলেও তা ম্যানুয়েলি করার কারণ সম্পর্কে তিনি জানান, বিভিন্ন সমস্যার কারণে এটা চালু করা যাচ্ছে না। তবে আগামী বছর থেকে চালু করা সম্ভব হবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত একটি প্রভাবশালী গ্র“পের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এ প্রসঙ্গে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। পলাশ নামে কাউকে তিনি চেনেন না বলেও জানান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই চোরাচালান সিন্ডিকেট ফ্লাইট কেনাবেচা ও চোরাচালান নির্বিঘ্ন করতে বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ম্যানেজ করে ফেলেন। জানা গেছে, বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দামি হল জেদ্দা ও দুবাইগামী ফ্লাইট। সপ্তাহে জেদ্দা আর দুবাই মিলে মোট ১১টি ফ্লাইট চলাচল করে। প্রতিটি ফ্লাইট গড়ে ১০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। এ হিসাবে সপ্তাহে ৫ কোটি টাকার বেশি অর্থ শুধু ফ্লাইট বেচাকেনার নামে লেনদেন হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাস্টমস বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, শর্ষের মধ্যে ভূত থাকায় চোরাকারবারিদের ধরতে তাদের বেশি কষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, যদি একটি ফ্লাইট কিনতে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা ব্যয় হয়। তবে প্রতি ফ্লাইটে কি পরিমাণ চোরাচালান হচ্ছে তা অনুমান করাও কঠিন। শুধু ফ্লাইট কেনা নয়, ঘাটে ঘাটে টাকা খরচ করছে চোরাকারবারিরা। তিনি বলেন, বিমানের অসাধু পাইলট থেকে ঝাড়ুদার পর্যন্ত সব বিভাগের এই সিন্ডিকেটের সদস্য রয়েছে। এ কারণে চোরচালান বন্ধ করা যাচ্ছে না।
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আলমগীর হোসেন শিমুল যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ জন্মের পর থেকে এযাবৎকাল যত স্বর্ণ উদ্ধার হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় চালান ছিল শাহজালালে ১২৪ কেজি ও ১০৫ কেজি আর চট্টগ্রামের শাহ আমানতে ১০৬ কেজি। আর এই তিনটি চালানই উদ্ধার করা হয়েছে বাংলাদেশ বিমান থেকে। কাজেই বিমানের পাইলট, কেবিন ক্রু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পৃক্ততা ছাড়া তাদের উড়োজাহাজে স্বর্ণ চোরাচালান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বিমানে এই চোরাচালানের সঙ্গে বিশাল ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। বিদেশী সিন্ডিকেটও এদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিমানের সঙ্গে জড়িত সিভিল এভিয়েশনেরও কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। তার মতে, এরা এতটাই শক্তিশালী যে, রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ছাড়া তাদের চোরাচালান বন্ধ করা সম্ভব নয়।
শিমুল বলেন, বাংলাদেশ স্বর্ণ চোরাচালানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জন্য এখন একটি বড় রুট। কারণ মাত্র ৫ কেজি স্বর্ণ ভারতে চালান করতে পারলে ৪০ লাখ টাকা লাভ হচ্ছে। ভারতে স্বর্ণ চোরাচালান কঠিন হয়ে যাওয়ায় তারা এখন বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। শিমুল বলেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বিমানবন্দরে লাগেজ স্ক্যানিং বেল্টেই লাগেজ তল্লাশি হয়ে যায়। যাত্রীদের জন্য রয়েছে আলাদা স্ক্যানিং পথ। কিন্তু শাহজালালে কোনো বেল্টেই লাগেজ স্ক্যান হচ্ছে না। বিমানের পাইলট ও ক্রুরা নামমাত্র স্ক্যানিং হয়ে নির্বিঘ্নে বিমানবন্দরে আসা-যাওয়া করতে পারছে। এতে চোরাচালান রোধ করা যাচ্ছে না।
চোরাচালানের মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে : জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গঠিত তদন্ত কমিটি স্বর্ণ চোরাচালানে বিমানের ১৪ কর্মীকে চিহ্নিত করলেও অভিযোগ রয়েছে, এক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। জানা গেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানের একটি ফ্লাইট থেকে ২৪ জুলাই ১২৪ কেজি স্বর্ণবার উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দারা। এ সোনার মূল্য প্রায় ৫৪ কোটি টাকা। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাসহ সোনা চোরাচালানের সঙ্গে কারা জড়িত তা চিহ্নিত করার জন্য এনবিআর ২২ সেপ্টেম্বর একটি আন্তঃবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মইনুল খানের নেতৃত্বে কমিটি দীর্ঘ তদন্ত শেষে ৩৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে বলা হয়, দেশের ইতিহাসে চাঞ্চল্যকর এই স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় সংঘবদ্ধ অপরাধসহ নিরাপত্তা ঝুঁকি বিদ্যমান। এসব অপরাধীর সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় অন্য কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকারও সম্ভাবনা রয়েছে।
তদন্তে অভিযুক্ত ১৪ জনের মধ্যে ১০ জনই বিমানের প্রকৌশলসহ বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী। ১২৪ কেজি সোনার বার আটকের আগে ২৬ এপ্রিল একই বিমানবন্দরে ১০৫ কেজি স্বর্ণবার আটক করা হয়। কমিটির মতে, এ দুটি ঘটনায়ই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এয়ারক্রাফট ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে এয়ারক্রাফটের যাত্রী টয়লেটের প্যানেল স্ক্রু খুলে জাহাজের বডিতে (ফিউজলেজ) একটি ফাঁকা গর্ত দিয়ে কৌশলে কার্গো হোল্ডে স্বর্ণ বারগুলো রাখা হয়। বিমানবন্দরে কর্মরত বা এয়ারলাইন্সের কারও সহায়তা ছাড়া এ ধরনের চোরাচালান সম্ভব নয়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা জানান, এই চোরাচালান সিন্ডিকেট শুধু চোরাচালানই নয়, এদের কারণে গোটা আকাশপথই এখন বড় ধরনের নিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২৪ কেজি স্বর্ণবার এককভাবে কারও পক্ষে পাচার করা অসম্ভব। বিমানের ফ্লাইট সার্ভিস, সিডিউলিং, অপারেশন ও প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তা ছাড়া এ ধরনের চোরাচালানি নেটওয়ার্ক সম্ভব নয়। তদন্তের প্রয়োজনে কমিটির সদস্যরা দুবাই এয়ারপোর্টও পরিদর্শন করেন। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, দুবাই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কয়েক স্তরে বিন্যস্ত ও কঠোর। অনুমোদিত জিনিস ছাড়া এই নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করা সম্ভব নয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দুবাই এয়ারপোর্ট সব পণ্যের জন্য উন্মুক্ত। এ সুযোগে একাধিক যাত্রী বা চোরাচালান চক্র হ্যান্ড লাগেজ হিসেবে স্বর্ণবারের চালানটি বিমানের ভেতরে নিয়ে আসে।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চোরাচালানিদের কাছে সবচেয়ে দামি রুট হচ্ছে দুবাই, জেদ্দা, রিয়াদ, দাম্মাম ও কুয়েত। মধ্যপ্রাচ্যের এসব রুটে বিমান নিজস্ব এয়ারক্রাফট পরিচালনা করে আসছে। বিমানের সিডিউলিং, অপারেশন ও ট্রেনিং শাখার কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা সিন্ডিকেটের কাছে ফ্লাইট বিক্রির সঙ্গে জড়িত। প্রতি ফ্লাইটের জন্য এরা নিচ্ছে ১০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা। এরপর সংশ্লিষ্ট ফ্লাইটে চক্রটির আগাম কেনা ককপিট ও কেবিন ক্রুদের ডিউটি দিচ্ছে। এদের মধ্যে কেবিন ক্রুরা মূলত চোরাই পণ্যের ক্যারিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কেবিন ক্রুদের অধিকাংশই বিমানে অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত। চোরাই সিন্ডিকেটের কাছে ক্রু বিক্রির জন্য, মূলত সংশ্লিষ্ট বিভাগ ক্রু সিডিউলিং অটোমেশন করছে না। কাজটি তারা এখনও ম্যানুয়েলি সারছেন। অথচ এ কাজের জন্য ২০ কোটি টাকায় অত্যাধুনিক মেশিন কেনা হয়েছে। এটা চালু হলে সিন্ডিকেট ভেঙে যাবে এ আশংকায় অটোমেশন চালু হচ্ছে না।
বিমানের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বিমান কেনাবেচার বিষয়টি বায়বীয়, দেখা যায় না। মূলত বিক্রি হয় ক্রু। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশগামী নির্দিষ্ট ফ্লাইটে মোটা অর্থের বিনিময়ে ওইসব ক্রুর ডিউটি দেয়া হয়। যারা চোরাচালানিদের হয়ে কাজ করে। শাহজালালে ক্রুদের ব্যাগ সেভাবে তল্লাশি না করায় তারা নিরাপদে কাজটি করতে পারছেন। ফ্লাইট সিডিউল বিভাগের একজন কর্মী জানান, ফ্লাইট ক্রুর নির্দেশনা ছাড়া ওই এয়ারক্রাফটে কোনোভাবেই চোরাই পণ্য তোলা সম্ভব নয়।
অভিযোগ রয়েছে, বিমানের সিডিউলিং বিভাগে প্রতিদিন সন্ধ্যার পর বসে ফ্লাইট বেচাকেনার হাট। একই বিভাগের একজন পাইলটের কক্ষে বসে এই কেনাবেচার টাকা ভাগবাটোয়ারা হয়। চোরাচালান সিন্ডিকেটের পক্ষে পলাশ নামে এক ব্যক্তি এই ফ্লাইট কেনাবেচার কাজ করে আসছে অনেক দিন ধরে। এই পলাশ বিমানের কোনো কর্মকর্তা নয়, তবু অধিকাংশ পরিচালকের কক্ষে তার অবাধ যাতায়াত। নিজেকে বিমানের একজন কেবিন ক্রুর স্বামী পরিচয় দিলেও তার মূল কাজ চোরাচালান আর ফ্লাইট কেনা। মূলত তার পছন্দ অনুযায়ীই ওইসব ফ্লাইটের জন্য ক্রু নিয়োগ দেয়া হয়। রুট এবং চোরাই পণ্যের চালানের ওপর ভিত্তি করে সে ক্রুর চাহিদা দিয়ে থাকে। তার চাহিদার ভিত্তিতেই ডিউটি দেয়া হয়। দায়িত্বপ্রাপ্ত ক্রুরা চোরাচালানের পণ্য পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করছে। বিমানে এ ধরনের ক্রুর সংখ্যা হাতেগোনা। এদের বেশির ভাগই চুক্তিভিত্তিক অস্থায়ী ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত। কিছু আছেন যারা নানা অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে চাকরিচ্যুত হয়েও আদালতের রায় নিয়ে বহাল তবিয়তে আছেন। এরা সংখ্যায় কম হলেও খুবই শক্তিশালী। এদের বেশির ভাগই অসীম ক্ষমতাধর চোরাচালান চক্রের সদস্য। দৈনিক বেতনের ভিত্তিতে অস্থায়ী চাকরি করায় এরা কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করে না। বেশির ভাগেরই রয়েছে একাধিক দেশের নাগরিকত্ব। নামে-বেনামে এরা কোটি কোটি টাকার মালিক। দেশে-বিদেশে বাড়ি-গাড়ির মালিক।
নিয়ম অনুযায়ী নির্দিষ্ট ওজনের বেশি হলেই যে কোনো ব্যক্তি বিমানের ক্রু (কেবিন) হিসেবে থাকতে পারেন না। কিন্তু ওই ক্রু যদি অসীম ক্ষমতাবান পলাশ চক্রের সদস্য হয় তবে তার জন্য প্রচলিত আইন প্রযোজ্য নয়। বিমানের চোরাচালান চক্র ও ক্যারিয়ার নামধারী ক্রুদের অনেকের চাকরির বয়স ৫০-৬০ বছরের বেশি। অধিকাংশের ওজন ৮০ থেকে ১০০ কেজির বেশি। এরা এতটাই প্রভাবশালী চাকরি হারানোর ভয়ে কোনো কর্মকর্তাও এদের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দ করার সাহস পায় না। বিরুদ্ধে কথা বললেই নানা ধরনের কেলেংকারিতে জড়িয়ে যাওয়ার আশংকা। এই সিন্ডিকেটের কারণেই ১০ বছর ধরে আটকে আছে বিমানের স্থায়ী পদে কর্মরত ১০২ জন জুনিয়র পার্সারের (কেবিন ক্রু) পদোন্নতি। বিমানের প্রায় সবগুলো শাখার নানা পর্যায়ে চেষ্টা তদবিরের পরও এই ১০২ জন জুনিয়র পার্সারের নাম এফসিপি লিস্টে (ফাইনাল ক্রু পজিশন) দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া অসংখ্য কেবিন ক্রু আছেন, যারা পলাশের কথা না শুনে এখন চাকরি হারিয়ে পথে পথে ঘুরছেন। জানা গেছে, পলাশ সিন্ডিকেটের কথা না শুনলে উল্টো তার বিরুদ্ধে মিথ্যা চোরাচালানের মামলা ঠুকে দেয়া হচ্ছে। নানাভাবে হেনস্থা, চাকরিচ্যুতি ও নানা অপকর্মের সঙ্গে জড়ানো হচ্ছে।
শুধু কেবিন ক্রু নয়, বিমানের ককপিট ক্রুদের (পাইলট) সিডিউলিং নিয়েও আছে নানা অভিযোগ। এয়ারলাইন্সকেন্দ্রিক এই চোরাচালানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এই পলাশ সিন্ডিকেটের মধ্যে বেশ কজন ককপিট ক্রুরও (পাইলট) সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে বর্তমানে এদের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাই বিমানের সাবেক ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার শামীম ইস্কান্দারের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জোট সরকারের আমলে দীর্ঘ ৬ বছর তিনি বিমানের ফ্লাইট অপারেশন বিভাগের ট্রেনিং শাখার গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। তার বিরুদ্ধে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে উপস্থিত থাকা, জোট সরকারের আমলে ভিভিআইপি ফ্লাইট পরিচালনা এবং ক্রু ট্রেনিং নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ ছিল। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তাকে বিমান থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়। কিন্তু ২০১১ সালে আদালতের রায়ে তিনি চাকরি ফিরে পেয়ে আবার বিমানে যোগদান করেন। ২০১৩ সালে তিনি অবসরে চলে যাওয়ার পর চোরাচালান সিন্ডিকেটের গডফাদারদের সুপারিশে তাকে আবারও বিমানে পাইলট হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগ পেয়েই তিনি আবারও তার পুরনো গ্র“প নিয়ে বিমানে গড়ে তুলেছেন বড় ধরনের চোরাচালান সিন্ডিকেট।
এ প্রসঙ্গে বিমানের প্ল্যানিং অ্যান্ড সিডিউলিংয়ে বিভাগের প্রধান ক্যাপ্টেন আসলাম শহীদ যুগান্তরকে জানান, এ ধরনের কোনো অভিযোগ তার জানা নেই। তিনি বলেন, হজের সময় মোটামুটি সবাইকে ফ্লাইট দেয়া হয়েছে। ক্রু সিডিউলিংয়ে কোটি কোটি টাকা খরচ করে অটোমেশিন করা হলেও তা ম্যানুয়েলি করার কারণ সম্পর্কে তিনি জানান, বিভিন্ন সমস্যার কারণে এটা চালু করা যাচ্ছে না। তবে আগামী বছর থেকে চালু করা সম্ভব হবে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন। চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত একটি প্রভাবশালী গ্র“পের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এ প্রসঙ্গে কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। পলাশ নামে কাউকে তিনি চেনেন না বলেও জানান।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই চোরাচালান সিন্ডিকেট ফ্লাইট কেনাবেচা ও চোরাচালান নির্বিঘ্ন করতে বিমানবন্দরে কর্মরত বিভিন্ন সংস্থার অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ম্যানেজ করে ফেলেন। জানা গেছে, বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে দামি হল জেদ্দা ও দুবাইগামী ফ্লাইট। সপ্তাহে জেদ্দা আর দুবাই মিলে মোট ১১টি ফ্লাইট চলাচল করে। প্রতিটি ফ্লাইট গড়ে ১০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। এ হিসাবে সপ্তাহে ৫ কোটি টাকার বেশি অর্থ শুধু ফ্লাইট বেচাকেনার নামে লেনদেন হচ্ছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কাস্টমস বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, শর্ষের মধ্যে ভূত থাকায় চোরাকারবারিদের ধরতে তাদের বেশি কষ্ট হচ্ছে। তিনি বলেন, যদি একটি ফ্লাইট কিনতে ৫০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা ব্যয় হয়। তবে প্রতি ফ্লাইটে কি পরিমাণ চোরাচালান হচ্ছে তা অনুমান করাও কঠিন। শুধু ফ্লাইট কেনা নয়, ঘাটে ঘাটে টাকা খরচ করছে চোরাকারবারিরা। তিনি বলেন, বিমানের অসাধু পাইলট থেকে ঝাড়ুদার পর্যন্ত সব বিভাগের এই সিন্ডিকেটের সদস্য রয়েছে। এ কারণে চোরচালান বন্ধ করা যাচ্ছে না।
আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) শাহজালাল (র.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আলমগীর হোসেন শিমুল যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশ জন্মের পর থেকে এযাবৎকাল যত স্বর্ণ উদ্ধার হয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় চালান ছিল শাহজালালে ১২৪ কেজি ও ১০৫ কেজি আর চট্টগ্রামের শাহ আমানতে ১০৬ কেজি। আর এই তিনটি চালানই উদ্ধার করা হয়েছে বাংলাদেশ বিমান থেকে। কাজেই বিমানের পাইলট, কেবিন ক্রু থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সম্পৃক্ততা ছাড়া তাদের উড়োজাহাজে স্বর্ণ চোরাচালান কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তিনি বলেন, বিমানে এই চোরাচালানের সঙ্গে বিশাল ও শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। বিদেশী সিন্ডিকেটও এদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বিমানের সঙ্গে জড়িত সিভিল এভিয়েশনেরও কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারী। তার মতে, এরা এতটাই শক্তিশালী যে, রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ছাড়া তাদের চোরাচালান বন্ধ করা সম্ভব নয়।
শিমুল বলেন, বাংলাদেশ স্বর্ণ চোরাচালানে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের জন্য এখন একটি বড় রুট। কারণ মাত্র ৫ কেজি স্বর্ণ ভারতে চালান করতে পারলে ৪০ লাখ টাকা লাভ হচ্ছে। ভারতে স্বর্ণ চোরাচালান কঠিন হয়ে যাওয়ায় তারা এখন বাংলাদেশকে রুট হিসেবে ব্যবহার করছে। শিমুল বলেন, বিশ্বের অধিকাংশ দেশের বিমানবন্দরে লাগেজ স্ক্যানিং বেল্টেই লাগেজ তল্লাশি হয়ে যায়। যাত্রীদের জন্য রয়েছে আলাদা স্ক্যানিং পথ। কিন্তু শাহজালালে কোনো বেল্টেই লাগেজ স্ক্যান হচ্ছে না। বিমানের পাইলট ও ক্রুরা নামমাত্র স্ক্যানিং হয়ে নির্বিঘ্নে বিমানবন্দরে আসা-যাওয়া করতে পারছে। এতে চোরাচালান রোধ করা যাচ্ছে না।
চোরাচালানের মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে : জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গঠিত তদন্ত কমিটি স্বর্ণ চোরাচালানে বিমানের ১৪ কর্মীকে চিহ্নিত করলেও অভিযোগ রয়েছে, এক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। জানা গেছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে বিমানের একটি ফ্লাইট থেকে ২৪ জুলাই ১২৪ কেজি স্বর্ণবার উদ্ধার করে শুল্ক গোয়েন্দারা। এ সোনার মূল্য প্রায় ৫৪ কোটি টাকা। চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাসহ সোনা চোরাচালানের সঙ্গে কারা জড়িত তা চিহ্নিত করার জন্য এনবিআর ২২ সেপ্টেম্বর একটি আন্তঃবিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করে। শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক মইনুল খানের নেতৃত্বে কমিটি দীর্ঘ তদন্ত শেষে ৩৩ পৃষ্ঠার প্রতিবেদন জমা দেয়। এতে বলা হয়, দেশের ইতিহাসে চাঞ্চল্যকর এই স্বর্ণ চোরাচালানের ঘটনায় সংঘবদ্ধ অপরাধসহ নিরাপত্তা ঝুঁকি বিদ্যমান। এসব অপরাধীর সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় অন্য কোনো অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকারও সম্ভাবনা রয়েছে।
তদন্তে অভিযুক্ত ১৪ জনের মধ্যে ১০ জনই বিমানের প্রকৌশলসহ বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারী। ১২৪ কেজি সোনার বার আটকের আগে ২৬ এপ্রিল একই বিমানবন্দরে ১০৫ কেজি স্বর্ণবার আটক করা হয়। কমিটির মতে, এ দুটি ঘটনায়ই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এয়ারক্রাফট ব্যবহার করা হয়েছে। বিশেষ কৌশল অবলম্বন করে এয়ারক্রাফটের যাত্রী টয়লেটের প্যানেল স্ক্রু খুলে জাহাজের বডিতে (ফিউজলেজ) একটি ফাঁকা গর্ত দিয়ে কৌশলে কার্গো হোল্ডে স্বর্ণ বারগুলো রাখা হয়। বিমানবন্দরে কর্মরত বা এয়ারলাইন্সের কারও সহায়তা ছাড়া এ ধরনের চোরাচালান সম্ভব নয়। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা জানান, এই চোরাচালান সিন্ডিকেট শুধু চোরাচালানই নয়, এদের কারণে গোটা আকাশপথই এখন বড় ধরনের নিরাপত্তার ঝুঁকিতে রয়েছে।
তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ১২৪ কেজি স্বর্ণবার এককভাবে কারও পক্ষে পাচার করা অসম্ভব। বিমানের ফ্লাইট সার্ভিস, সিডিউলিং, অপারেশন ও প্রকৌশল বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সহায়তা ছাড়া এ ধরনের চোরাচালানি নেটওয়ার্ক সম্ভব নয়। তদন্তের প্রয়োজনে কমিটির সদস্যরা দুবাই এয়ারপোর্টও পরিদর্শন করেন। এ প্রসঙ্গে বলা হয়, দুবাই বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা কয়েক স্তরে বিন্যস্ত ও কঠোর। অনুমোদিত জিনিস ছাড়া এই নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করা সম্ভব নয়। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দুবাই এয়ারপোর্ট সব পণ্যের জন্য উন্মুক্ত। এ সুযোগে একাধিক যাত্রী বা চোরাচালান চক্র হ্যান্ড লাগেজ হিসেবে স্বর্ণবারের চালানটি বিমানের ভেতরে নিয়ে আসে।
No comments