‘ডার্ক’ সাইট বন্ধ করা আরও আগে উচিত ছিল
একটি খবর দেখে ভালো লাগল৷ বিশ্বজুড়ে আড়িপাতার দুই বাঘা সংস্থা আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসএ) এবং ব্রিটিশ জিসিএইচকিউ-র নেতৃত্বে পশ্চিমী দুনিয়ার অন্তত চারশ’টি সাইটকে ‘ডার্ক’ বা দুষ্ট বলে চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো হয়েছে৷ এই ধরনের অভিযান আরও আগে চালানো উচিত ছিল৷ অন্তত এই দুটি সংস্থা চাইলে তা অনেক আগেই শুরু করতে পারত৷ বিশ্বজোড়া সাইবার ক্রাইমের জাল কতদূর এবং কীভাবে ছড়িয়েছে, ইন্টারনেটের সুযোগ নিয়ে কে কোথায় নষ্টামি করে বেড়াচ্ছে, তা এনএসএ আর তার উপযুক্ত দোসর জিসিএইচকিউ-র চাইতে ভালো করে আর কার পক্ষেই বা জানা সম্ভব? দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে এই দুই সংস্থার মধ্যে যে সখ্যতা গড়ে উঠেছিল, আজও তা অটুট৷ যদিও তখন এনএসএ আজকের মতো বিরাট আকার নেয়নি কিংবা এই নামেও পরিচিত ছিল না৷ স্বনামে এর প্রথম যাত্রা শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, রুশ-মার্কিন ঠান্ডা যুদ্ধের জমানায়৷ দীর্ঘকাল ধরেই এই দুই সংস্থা যাবতীয় সাংকেতিক বার্তা, বিশেষ করে গুপ্ত রেডিও মেসেজ ও সিগন্যাল পুনরুদ্ধার করতে সিদ্ধহস্ত৷ পৃথিবীর হেন কোনও ভাষা নেই, যার বিশেষজ্ঞ এনএসএ-তে নেই৷ কয়েক হাজার বাঘা ক্রিপটোলজিস্ট দিনরাত এক করে মাথা খাটান সেখানে৷ তা সত্ত্বেও ঠান্ডাযুদ্ধ-পরবর্তী পৃথিবীর অভিশাপ যে কট্টরপন্থী মুসলিম সন্ত্রাসবাদ, তাকে কাবু করার ক্ষেত্রে এই দুই আড়িপাতা সংস্থাই কোনো সুফল ফলাতে পারল না৷ প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন স্যাটেলাইটগুলিকে কাজে লাগিয়ে এক সময় ‘সর্বশক্তিমান’ মার্কিন প্রশাসন কক্ষপথ-অবরোধ করে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন শহরে তাপ-পরমাণু আক্রমণের প্ন্যান পর্যন্ত করেছিল৷ আর সেই তাদেরই জমিতে কি না ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আত্মঘাতী জঙ্গি বিমান হানার ঘটনা ঘটল! ঠিক একইভাবে সাইট-বিরোধী অভিযানে তাদের এতদিনকার কালকর্তনকেও দায়ী করা চলে৷ আজ বাদে কাল বার্লিন প্রাচীর ভাঙার ২৫ বছর পূর্ণ হতে চলেছে৷ এই প্রাচীর যখন স্বমহিমায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল, সেই সত্তরের শেষ ও আশির দশকেই আমেরিকা খবর পায়, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পূর্ব জার্মানির জনাকয় তুখোড় গুপ্তচর পশ্চিম বার্লিনের একটি গোপন ডেরায় বসে ন্যাটোর কম্পিউটারাইজড মিলিটারি প্রোগ্রাম হ্যাক করছে৷ সেই সময়েই তারা কিন্তু সেই হ্যাকিং বানচাল করে দিয়েছিল এবং ওয়ারশ গোষ্ঠীর গুপ্তচরদের হাতেনাতে ধরেও ফেলেছিল৷ বলা বাহুল্য, এই সাফন্যের পিছনে ছিল এনএসএ-র মস্তিষ্ক৷ স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে, ওই সময়ে হ্যাকার-গুপ্তচরদের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে যারা সফল হতে পারে, আজকের নেটময় দুনিয়ায় ৪০০টি ‘ডার্ক’ সাইট খুঁজতে তাদের এত দিন লেগে গেল? মানবসভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই জৈবিক প্রবৃত্তির বিকারে রূপান্তর ঘটেছে নানা পন্থায়৷ কিন্তু এখন ইন্টারনেটের হাত ধরে তা যেন এক সর্বজনীন বিভীষিকার চেহারা নিয়েছে৷ নারী ও শিশুদের উপর পৈশাচিক অত্যাচারের নিত্যনতুন ফিকির বের হচ্ছে, আর তার সংখ্যাও বেড়ে চলেছে চক্রবৃদ্ধি হারে৷ নাবালকত্ব থেকে সাবালকত্বে পৌঁছানোর প্রাকৃতিক নিয়মও আর পাত্তা পাচ্ছে না এই সর্বগ্রাসী নেটক্ষুধার কাছে৷ অবস্থা এতটাই সাঙ্ঘাতিক যে, বহু শিশু আজ তার নিজের ঘরেও নিরাপদ নয়৷ যে অভিশাপ আজ ভারতের মতো দেশকেও সাইবার ক্রাইমের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে উদ্যোগী করেছে, সেই অভিশাপ সম্পর্কে কি আমেরিকার মতো উন্নত দেশের আরও আগে সতর্ক হওয়া উচিত ছিল না? নাকি একদিন যেভাবে বিপুল সাম্রাজ্য, ক্ষমতা আর বৈভব রোমকে নামিয়ে গিয়েছিল বিকারের পঙ্কিল আবর্তে, প্রায় সেই একই ঢংয়ে আজ নিজেই নিজের চোরাবালি রচনা করেছে উচ্চকোটির আমেরিকা ও তার সহচর পশ্চিমী দুনিয়া৷ সে কারণেই কি ‘ডার্ক’ সাইটগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এনএসএ এবং জিসিএইচকিউ-র মতো আড়িপাতা সংস্থাগুলির এত দেরি হলো?
No comments