কমার্স ব্যাংকে ২০৫ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতি
বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের (বিসিবি) দুটি শাখা থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রায় ২০৫ কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে ব্যাংকের বংশাল শাখা থেকে ১৫৫ কোটি ১১ লাখ টাকা এবং দিলকুশা শাখা থেকে প্রায় ৫০ কোটি টাকা। ব্যাংক কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ৭টি প্রতিষ্ঠান ব্যাংকিং রীতিনীতি লংঘন করে তুলে নিয়েছে এসব টাকা। এর মধ্যে বংশাল শাখার সাবেক ব্যবস্থাপকসহ কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা নিজেদের যোগসাজশে বেনামি প্রতিষ্ঠানের নামেও টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা ধরা পড়েছে। সাবেক শাখা ব্যবস্থাপকের স্ত্রীর নামে বেনামি হিসাব খুলে কোটি কোটি টাকা অন্য হিসাবে স্থানান্তর করে আত্মসাৎ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পৃথক দুটি তদন্ত প্রতিবদন থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, একটি গ্রাহক প্রতিষ্ঠান একই জামানত তিন ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে ঋণ নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এর মধ্যে কমার্স ব্যাংকের বংশাল শাখাও রয়েছে। এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম শিথিল করতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একজন রাজনৈতিক নেতা জোরালো তদবির করেছেন বলে জানা গেছে।
এই ঘটনায় ব্যাংকের একজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এএমডি) ৭ কর্মকর্তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে নানা ধরনের পদক্ষেপ। গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি জামানত নেয়ার প্রক্রিয়াও চলছে। ঋণ পরিশোধের অঙ্গীকার করেও গ্রাহকরা টাকা দিচ্ছে না বলে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবু সাদেক মো. সোহেল যুগান্তরকে জানান, ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঘটনার ব্যাপারে আরও তদন্ত চলছে। এর ভিত্তিতে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাওয়া টাকা আদায়ে জোরালো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, অচিরেই টাকা আদায় করা সম্ভব হবে। এছাড়া চট্টগ্রামের ব্যাংকের দুটি শাখায় আগের জালিয়াতির প্রায় শত কোটি টাকা এখনও আদায় হয়নি।
সূত্র জানায়, বংশাল শাখায় ২০১৩ সালের জুন থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে শাখায় ওই জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। ব্যাংক থেকে ওইসব টাকা নিয়ে এলসির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করে তা বিক্রির মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা শোধ করার কথা ছিল। কিন্তু গ্রাহকরা পণ্য বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা শোধ করেননি। এদিকে কয়েকটি গ্রাহক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তারা ব্যাংক থেকে পুরো টাকা পাননি। তাদের নামে টাকা তুলে ব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তা নিজেরা আত্মসাৎ করেছে। তাদের দিয়েছে অনেক কম টাকা। এর মধ্যে যমুনা এগ্রো নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেয়া হয়েছে ১১২ কোটি টাকা। এই পুরো টাকা গ্রাহক পাননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর একটি বড় অংশ শাখার কর্মকর্তারা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ বিষয়ে গ্রাহক ব্যাংকের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলাও করেছেন। এদিকে গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাংক নতুন করে জামানত নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ব্যাপক অনিয়ম পাওয়া গেছে।
পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিকীর মালিকানাধীন সিদ্দিক ট্রেডিংয়ের নামে নেয়া হয়েছে ১২ কোটি টাকা। ওই পুরো টাকাও তিনি পাননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পারভেজ আলী চৌধুরীর মালিকানাধীন মদিনা এন্টারপ্রাইজের নামে নেয়া হয়েছে ৪ কোটি টাকা। রাজীব ট্রেডার্সের নামে নেয়া হয়েছে ১৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ইউসা ট্রেডিংয়ের নামে নেয়া হয়েছে ১১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এটি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপক ইফতেখার আহমেদের একটি বেনামি প্রতিষ্ঠান বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে ইফতেখার আহমেদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এছাড়া শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক হাবিবুল ইসলাম সুমনের স্ত্রী মালিকানাধীন ফারহান ট্রেডিং নামেও ঋণ নেয়া হয়েছে। ওই টাকা এখন আদায় হয়েছে। তবে ওই হিসাবের মাধ্যমে টাকা অন্য হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানসহ ৭ কর্মকর্তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন বংশাল শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক হাবিবুল ইসলাম সুমন, সাবেক ব্যবস্থাপক ইফতেখার আহেমদ, অফিসার শিরিন নিজামী। প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা শফিকুর রহমান। প্রধান কার্যালয়ে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা বানু রঞ্জন চক্রবর্তীর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তার মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বংশাল শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক আলী আজম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তিনি প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়া ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানও এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি। জালিয়াতির সময়ে তিনি ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্বে ছিলেন।
কমার্স ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে এসবি গ্র“পকে ৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ঋণের বিপরীতে যথেষ্ট জামানত নেয়া হয়নি। যেসব জামানত নিয়ে ঋণ দেয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ভুয়া বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে ব্যাংক আরও জামানত নিতে বাধ্য হয়েছে। ঋণ শোধের ব্যাপারে গ্রাহক এখন পর্যন্ত আট দফা অঙ্গীকার করেও পুরো ঋণ শোধ করেননি।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংকের এমডি আবু সাদেক মো. সোহেল যুগান্তরকে জানান, তিনি আশা করছেন আগামী সাত দিনের মধ্যে এসবি গ্র“পের কাছ থেকে টাকা আদায় হবে।
সূত্র জানায়, ২০১১ সালে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক দিলকুশা শাখা থেকে ৫০ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে। ২০১১ সালে ২১ কোটি ৫৭ লাখ টাকার ১৮টি এলসি খোলে। ২০১২ সালে ১৭ কোটি টাকার আরও ১৮টি এলসি খোলে। এসব এলসির বিপরীতে মোট ৪০টি এলটিআর খোলা হয়েছিল। ২০১২ সালের শেষদিকে গ্রাহক ২৬টি এলসি সমন্বয় করে দেন। বাকিগুলো এখনও সমন্বয় করেননি।
ঋণ হিসাবের বিপরীতে ঢাকার নন্দীপাড়ায় ৭৬ দশমিক ৩৩ শতক জমি বন্ধক রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯ শতক জমির কাগজপত্র ত্র“টিপূর্ণ। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে ঋণ হিসাবকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করে।
পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে গ্রাহকের কাছ থেকে মাতুয়াইলের ৬ শতক জমি, ওই জমিতে ৩ তলা একটি ভবন, ৩ শতক খালি জমি এবং কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ১৪০ শতক জমি নতুন করে ঋণের বিপরীতে জামানত হিসাবে নেয়া হয়েছে। ব্যাংক মনে করে এখন ঋণটি নিরাপদ মাত্রায় রয়েছে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, বন্ধকি জমি বিক্রি করে ব্যাংক ঋণ আদায় করতে পারবে না। কেননা অনেক গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাংক তা করতে পারছে না। এদিকে গ্রাহক বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ঋণ শোধ করছে না।
ওই ঋণটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৩ সালের আগস্টে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করে। এরপর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে গ্রাহক ৫ কোটি ৫৭ লাখ ৪২ হাজার টাকা ব্যাংকে পরিশোধ করে। ২০১৩ সালের শেষে রাজনৈতিক অস্থিরতায় গ্রাহকের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তার তিনটি প্রতিষ্ঠানের সমুদয় ঋণ নবায়ন করে পুনরায় ব্যবসা করার সুযোগ চায়। এ লক্ষ্যে এককালীন জমা বাবদ ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে কমার্স ব্যাংকের ২৩১তম পর্ষদ সভায় ব্যাংকের স্বার্থে গ্রাহক ব্যাংকার সম্পর্কের ভিত্তিতে বড় অংকের ঋণটি কমিয়ে ৫০ কোটি টাকার পরিবর্তে ২৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে পর্ষদ ঋণটি নবায়নের প্রস্তাব অনুমোদন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নেয়ার নির্দেশ দেয়। এর আলোকে ২১ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নেয়া হয়। বিষয়টি গত ফেব্র“য়ারিতে গ্রাহককে জানানো হলে গ্রাহক সমুদয় নির্দেশনা পরিপালন করে দ্রুত ঋণ পরিশোধের অঙ্গীকার করেন। সে অনুযায়ী গ্রাহক ফেব্র“য়ারি এবং মার্চেও কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেনি। ফলে ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রবল চাপ প্রয়োগ করা হয়। প্রবল চাপে পড়ে গ্রাহক শাখাকে আশ্বস্ত করে, প্রতিষ্ঠানের কোল্ডস্টোরেজে বিপুল পরিমাণ ইলিশ মাছ জমা রয়েছে। বৈশাখ উপলক্ষে বাজারে ইলিশের দাম বাড়বে। তখন ইলিশ বিক্রির টাকায় ব্যাংকের দেনা শোধ করে দেবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গ্রাহকের কথায় ব্যাংক বিশ্বাস স্থাপন করে ঋণ নবায়ন করে গ্রাহককে নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যবসা করার সুযোগ দেয়। পহেলা বৈশাখের ৩-৪ দিন আগে থেকেই গ্রাহক তার কোল্ডস্টোরেজের ইলিশ বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু ইলিশ বিক্রির কোনো টাকা কমার্স ব্যাংকে জমা না করে অন্যত্র জমা করতে শুরু করেন। ফলে ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরও চাপ প্রয়োগ করা হলে তিনি ৩০ অক্টোবরের মধ্যে সমুদয় টাকা পরিশোধের অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু ওই সময়েও তিনি টাকা পরিশোধ করেনি।
এদিকে চট্টগ্রামে কমার্স ব্যাংকের মেরিন ভেজিটেবল অয়েলের নামে ৪৭ কোটি টাকা এবং নুরুন্নবীর নামে ৪৫ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এর বিপরীতেও জালিয়াতির ঘটনা রয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, একটি গ্রাহক প্রতিষ্ঠান একই জামানত তিন ব্যাংকে বন্ধক দিয়ে ঋণ নেয়ার ঘটনাও ঘটেছে। এর মধ্যে কমার্স ব্যাংকের বংশাল শাখাও রয়েছে। এ ঘটনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কার্যক্রম শিথিল করতে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের একজন রাজনৈতিক নেতা জোরালো তদবির করেছেন বলে জানা গেছে।
এই ঘটনায় ব্যাংকের একজন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ (এএমডি) ৭ কর্মকর্তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংক থেকে নেয়া হয়েছে নানা ধরনের পদক্ষেপ। গ্রাহকদের কাছ থেকে বাড়তি জামানত নেয়ার প্রক্রিয়াও চলছে। ঋণ পরিশোধের অঙ্গীকার করেও গ্রাহকরা টাকা দিচ্ছে না বলে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
এ বিষয়ে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আবু সাদেক মো. সোহেল যুগান্তরকে জানান, ওই ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ঘটনার ব্যাপারে আরও তদন্ত চলছে। এর ভিত্তিতে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাওয়া টাকা আদায়ে জোরালো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, অচিরেই টাকা আদায় করা সম্ভব হবে। এছাড়া চট্টগ্রামের ব্যাংকের দুটি শাখায় আগের জালিয়াতির প্রায় শত কোটি টাকা এখনও আদায় হয়নি।
সূত্র জানায়, বংশাল শাখায় ২০১৩ সালের জুন থেকে ২০১৪ সালের জুন পর্যন্ত সময়ে শাখায় ওই জালিয়াতির ঘটনা ঘটেছে। ব্যাংক থেকে ওইসব টাকা নিয়ে এলসির মাধ্যমে পণ্য আমদানি করে তা বিক্রির মাধ্যমে ব্যাংকের টাকা শোধ করার কথা ছিল। কিন্তু গ্রাহকরা পণ্য বিক্রি করে ব্যাংকের টাকা শোধ করেননি। এদিকে কয়েকটি গ্রাহক প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, তারা ব্যাংক থেকে পুরো টাকা পাননি। তাদের নামে টাকা তুলে ব্যাংকের কতিপয় কর্মকর্তা নিজেরা আত্মসাৎ করেছে। তাদের দিয়েছে অনেক কম টাকা। এর মধ্যে যমুনা এগ্রো নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নেয়া হয়েছে ১১২ কোটি টাকা। এই পুরো টাকা গ্রাহক পাননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর একটি বড় অংশ শাখার কর্মকর্তারা হাতিয়ে নিয়েছেন। এ বিষয়ে গ্রাহক ব্যাংকের বিরুদ্ধে আদালতে একটি মামলাও করেছেন। এদিকে গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাংক নতুন করে জামানত নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। তবে ঋণ বিতরণ প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ব্যাপক অনিয়ম পাওয়া গেছে।
পুরান ঢাকার ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিকীর মালিকানাধীন সিদ্দিক ট্রেডিংয়ের নামে নেয়া হয়েছে ১২ কোটি টাকা। ওই পুরো টাকাও তিনি পাননি বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। পারভেজ আলী চৌধুরীর মালিকানাধীন মদিনা এন্টারপ্রাইজের নামে নেয়া হয়েছে ৪ কোটি টাকা। রাজীব ট্রেডার্সের নামে নেয়া হয়েছে ১৫ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ইউসা ট্রেডিংয়ের নামে নেয়া হয়েছে ১১ কোটি ৩১ লাখ টাকা। এটি ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপক ইফতেখার আহমেদের একটি বেনামি প্রতিষ্ঠান বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে ইফতেখার আহমেদের মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি। এছাড়া শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক হাবিবুল ইসলাম সুমনের স্ত্রী মালিকানাধীন ফারহান ট্রেডিং নামেও ঋণ নেয়া হয়েছে। ওই টাকা এখন আদায় হয়েছে। তবে ওই হিসাবের মাধ্যমে টাকা অন্য হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানসহ ৭ কর্মকর্তাকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে রয়েছেন বংশাল শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক হাবিবুল ইসলাম সুমন, সাবেক ব্যবস্থাপক ইফতেখার আহেমদ, অফিসার শিরিন নিজামী। প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তা শফিকুর রহমান। প্রধান কার্যালয়ে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তা বানু রঞ্জন চক্রবর্তীর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর তার মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি।
এ প্রসঙ্গে বংশাল শাখার বর্তমান ব্যবস্থাপক আলী আজম চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। তিনি প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন।
সাময়িকভাবে বরখাস্ত হওয়া ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামানও এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি। জালিয়াতির সময়ে তিনি ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডির দায়িত্বে ছিলেন।
কমার্স ব্যাংকের দিলকুশা শাখা থেকে এসবি গ্র“পকে ৫০ কোটি টাকা ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রেও বড় ধরনের অনিয়ম হয়েছে। ঋণের বিপরীতে যথেষ্ট জামানত নেয়া হয়নি। যেসব জামানত নিয়ে ঋণ দেয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অনেকগুলো ভুয়া বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে ব্যাংক আরও জামানত নিতে বাধ্য হয়েছে। ঋণ শোধের ব্যাপারে গ্রাহক এখন পর্যন্ত আট দফা অঙ্গীকার করেও পুরো ঋণ শোধ করেননি।
এ প্রসঙ্গে ব্যাংকের এমডি আবু সাদেক মো. সোহেল যুগান্তরকে জানান, তিনি আশা করছেন আগামী সাত দিনের মধ্যে এসবি গ্র“পের কাছ থেকে টাকা আদায় হবে।
সূত্র জানায়, ২০১১ সালে বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক দিলকুশা শাখা থেকে ৫০ কোটি টাকার ঋণ সুবিধা গ্রহণ করে। ২০১১ সালে ২১ কোটি ৫৭ লাখ টাকার ১৮টি এলসি খোলে। ২০১২ সালে ১৭ কোটি টাকার আরও ১৮টি এলসি খোলে। এসব এলসির বিপরীতে মোট ৪০টি এলটিআর খোলা হয়েছিল। ২০১২ সালের শেষদিকে গ্রাহক ২৬টি এলসি সমন্বয় করে দেন। বাকিগুলো এখনও সমন্বয় করেননি।
ঋণ হিসাবের বিপরীতে ঢাকার নন্দীপাড়ায় ৭৬ দশমিক ৩৩ শতক জমি বন্ধক রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৯ শতক জমির কাগজপত্র ত্র“টিপূর্ণ। এ কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ২০১২ সালের ৩১ ডিসেম্বর ভিত্তিক তথ্যের ভিত্তিতে ঋণ হিসাবকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করে।
পরবর্তীকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশে গ্রাহকের কাছ থেকে মাতুয়াইলের ৬ শতক জমি, ওই জমিতে ৩ তলা একটি ভবন, ৩ শতক খালি জমি এবং কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে ১৪০ শতক জমি নতুন করে ঋণের বিপরীতে জামানত হিসাবে নেয়া হয়েছে। ব্যাংক মনে করে এখন ঋণটি নিরাপদ মাত্রায় রয়েছে।
তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, বন্ধকি জমি বিক্রি করে ব্যাংক ঋণ আদায় করতে পারবে না। কেননা অনেক গ্রাহকের কাছ থেকে ব্যাংক তা করতে পারছে না। এদিকে গ্রাহক বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়েও ঋণ শোধ করছে না।
ওই ঋণটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ২০১৩ সালের আগস্টে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করে। এরপর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে গ্রাহক ৫ কোটি ৫৭ লাখ ৪২ হাজার টাকা ব্যাংকে পরিশোধ করে। ২০১৩ সালের শেষে রাজনৈতিক অস্থিরতায় গ্রাহকের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তার তিনটি প্রতিষ্ঠানের সমুদয় ঋণ নবায়ন করে পুনরায় ব্যবসা করার সুযোগ চায়। এ লক্ষ্যে এককালীন জমা বাবদ ৫০ লাখ টাকা পরিশোধ করে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে কমার্স ব্যাংকের ২৩১তম পর্ষদ সভায় ব্যাংকের স্বার্থে গ্রাহক ব্যাংকার সম্পর্কের ভিত্তিতে বড় অংকের ঋণটি কমিয়ে ৫০ কোটি টাকার পরিবর্তে ২৫ কোটি টাকা নির্ধারণ করা হয়। একই সঙ্গে পর্ষদ ঋণটি নবায়নের প্রস্তাব অনুমোদন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নেয়ার নির্দেশ দেয়। এর আলোকে ২১ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনুমোদন নেয়া হয়। বিষয়টি গত ফেব্র“য়ারিতে গ্রাহককে জানানো হলে গ্রাহক সমুদয় নির্দেশনা পরিপালন করে দ্রুত ঋণ পরিশোধের অঙ্গীকার করেন। সে অনুযায়ী গ্রাহক ফেব্র“য়ারি এবং মার্চেও কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধ করেনি। ফলে ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রবল চাপ প্রয়োগ করা হয়। প্রবল চাপে পড়ে গ্রাহক শাখাকে আশ্বস্ত করে, প্রতিষ্ঠানের কোল্ডস্টোরেজে বিপুল পরিমাণ ইলিশ মাছ জমা রয়েছে। বৈশাখ উপলক্ষে বাজারে ইলিশের দাম বাড়বে। তখন ইলিশ বিক্রির টাকায় ব্যাংকের দেনা শোধ করে দেবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে গ্রাহকের কথায় ব্যাংক বিশ্বাস স্থাপন করে ঋণ নবায়ন করে গ্রাহককে নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্যবসা করার সুযোগ দেয়। পহেলা বৈশাখের ৩-৪ দিন আগে থেকেই গ্রাহক তার কোল্ডস্টোরেজের ইলিশ বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু ইলিশ বিক্রির কোনো টাকা কমার্স ব্যাংকে জমা না করে অন্যত্র জমা করতে শুরু করেন। ফলে ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরও চাপ প্রয়োগ করা হলে তিনি ৩০ অক্টোবরের মধ্যে সমুদয় টাকা পরিশোধের অঙ্গীকার করেছেন। কিন্তু ওই সময়েও তিনি টাকা পরিশোধ করেনি।
এদিকে চট্টগ্রামে কমার্স ব্যাংকের মেরিন ভেজিটেবল অয়েলের নামে ৪৭ কোটি টাকা এবং নুরুন্নবীর নামে ৪৫ কোটি টাকার ঋণ রয়েছে। এর বিপরীতেও জালিয়াতির ঘটনা রয়েছে।
No comments