সাত নভেম্বরের সভার অনুমতি না দেয়ায় কার লাভ হল? by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
সাত নভেম্বরের তথাকথিত সিপাহি-জনতার বিপ্লব দিবস উপলক্ষে গত আট নভেম্বর ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আহূত বিএনপির জনসভা অনুষ্ঠানে সরকার অনুমতি দেয়নি। কেন এই অনুমতি দেয়া হয়নি তার কারণও নাকি দর্শানো হয়নি। এই জনসভা অনুষ্ঠানের সরকারি অনুমতি না পাওয়ায় বিএনপি-জোট দেশব্যাপী বিক্ষোভ প্রদর্শন ও মিটিং মিছিল করার কর্মসূচি দিয়েছে। গতকাল (রোববার) এই কর্মসূচি পালিত হওয়ার সময় গাজীপুরে পুলিশ-বিএনপির সংঘর্ষে ৫০ জন আহত হয়েছে।
বিএনপি-জোটের এই কর্মসূচি এই মুহূর্তে সরকারের জন্য বিপজ্জনক তা বলি না। বিএনপি এই মুহূর্তে বড়সড় আন্দোলন পরিচালনায় সক্ষম নয় তাও সরকার জানে। আর সেটা জেনেশুনেই কি সরকার ক্ষমতার দাপট দেখানোর জন্য একটি বিরোধী দলীয় জোটের জনসভা অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিল? তাতে সরকার শুধু একটি বিরোধী দলীয় জোটের সভা-মিছিল করার বৈধ ও নিয়মতান্ত্রিক অধিকারেই বাধা দিল না, জনসাধারণের মধ্যেও এই ধারণা জন্মাতে দিল যে, সরকার দেশ পরিচালনায় গণতান্তিক পথ থেকে সরে যাচ্ছে এবং বিরোধী দলগুলোকে তাদের বৈধ অধিকারও ভোগ করতে দিতে চাচ্ছে না।
এই ধারণা যদি দেশবাসীর মনে ধীরে ধীরে বদ্ধমূল হতে থাকে, তাহলে বিএনপি-জোটের দিকে তাদের সহানুভূতি বাড়বে এবং সেই সহানুভূতি বিএনপির প্রতি সমর্থনে পরিণত হলে তখন দল বা জোটটি আজকের অসফল কর্মসূচির বদলে সফল কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে পারবে। তারা যাতে তা পারে, সরকার তাদের জন্য সে পথই করে দিচ্ছে। সাত নভেম্বর পালন উপলক্ষে বিএনপি হরতাল ডাকেনি। হরতাল সফল করার জন্য জামায়াতের সহযোগিতায় রাজপথে সশস্ত্র ক্যাডার নামায়নি। তারা অতীতের একটি ঘটনায় বার্ষিকী পালন উপলক্ষে জনসভা ডেকেছিলেন। সরকার কী কারণে তাদের এই সভানুষ্ঠানে বাধা দিল?
এই সভানুষ্ঠানের পর যদি বিএনপি কোনো জঙ্গি মিছিল বের করত, শান্তি-শৃংখলা ভঙ্গের চেষ্টা চালাত এবং এই সম্পর্কিত কোনো আগাম খবর সরকারের কাছে এসে থাকে, তাহলে সরকারের আইন-শৃংখলা বাহিনীই তা শক্ত হাতে দমন করার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারত। তাহলে সাধারণ মানুষও দেখত বিএনপি এখনও কীভাবে তার নিয়মতান্ত্রিক অধিকারের অপব্যবহার করে দেশে শান্তি-শৃংখলা নষ্ট করার কাজে রত। তাতে বিএনপির ক্ষতি হতো, সরকারের ক্রেডিবিলিটি বাড়ত। এখন উল্টো হল। বর্তমান সরকার ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিতর্ক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়েছে তা নয়। তার ওপর সরকারের এই ধরনের কার্যকলাপ এই বিতর্ককে আরও বাড়তে সুযোগ দেবে।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লব ছিল বলে বিশ্বাস করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আমার কাছে নেই। এই দিবসটি ছিল একটি প্রতিবিপ্লবী দিবস। জেলে চার জাতীয় নেতা ও বাইরে জেনারেল খালেদ মোশাররফ তার সহকর্মীদেরসহ নিহত হওয়ার পর তৎকালীন জাসদের ভ্রান্তি ও অ্যাডভেঞ্চার কিছু সিপাহিকে বিভ্রান্ত করে রক্তক্ষয়ী উচ্ছৃংখলতায় উৎসাহ জোগায় এবং সব প্রতিবিপ্লবী চক্রান্তের নায়ক ক্ষমতালোভী জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতা দখলে সাহায্য দেয়। ক্ষমতায় বসে জেনারেল জিয়াউর রহমান তার সাহায্যদাতাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। জাসদের মূল নেতৃত্বকে তিনি জেলে ঢোকান এবং গণসেনাবাহিনী গঠনের পরিকল্পক কর্নেল তাহেরকে বিচার প্রহসনে হত্যা করেন।
এজন্যই বিএনপি এবং বর্তমান জাসদের (বিভক্ত) কাছে সাত নভেম্বরের তাৎপর্য দুই রকমের। এটা এক জেনারেলের অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের দিবসকে বিপ্লবের মোড়ক পরিয়ে পালনের চেষ্টা করছে বিএনপি। অন্যদিকে এই দিবসটিকে সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের খোলস পরিয়ে নিজেদের অতীতের ইনফেনটাইল অ্যাডভেঞ্চারিজমকে ঢাকা দেয়ার চাতুর্য করছে জাসাদের একশ্রেণীর ব্যর্থ ও বিভ্রান্ত নেতা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করেন, পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের আসল কারণ যারা অনুধাবন করেন, তাদের কাছে সাত নভেম্বরের সিপাহি-জনতা বিপ্লবের স্বরূপ ব্যাখ্যা করার কোনো দরকার আছে বলে মনে করি না। এই তথাকথিত বিপ্লব বা ট্রাজেডি অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ৩৯ বছর কেটে গেছে। এতদিনে রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় আমাদের সাবালকত্ব অর্জনের কথা। আমরা নিশ্চয়ই তা করেছি। তাই সচেতন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে সাত নভেম্বরের তেমন কোনো গুরুত্বই এখন আর নেই। বর্তমান সরকার এখনও এই দিবসটি কেউ যদি পালন করতে চায় তাকে কেন বাধা দেবে অথবা ভয় পাবে তা আমি বুঝি না।
সরকার যেখানে একাত্তরের ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের পালের গোঁদা গোলাম আযমের মৃত্যুর পর ঢাকায় সরকারি মসজিদ বায়তুল মোকাররমে সরকারি পাহারায় তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠানে অনুমতি দিয়েছে এবং ধর্মীয় বিধান ভঙ্গ করে দুদিন যাবৎ লাশ কবর না দিয়ে জামায়াতিরা সারা দেশ থেকে লোক সংগ্রহ করে জানাজায় বিশাল জনতার সমাবেশ ঘটানোর ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও সরকার বাধা দেয়নি, সেখানে সাত নভেম্বরের তখাকথিত সিপাহি-জনতার বিপ্লব দিবস পালনের সভানুষ্ঠানে সরকার কেন বাধা দিল তা আমার বুদ্ধির অগম্য।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হতে পারে, সাত নভেম্বর কোনো বিপ্লব দিবস নয়, স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্রান্ত দিবস। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এখন ক্ষমতায়। তারা এই দিবস পালনে অনুমতি দিতে পারে না। এই যুক্তি যদি তারা দেখান তা হবে নেহাত খোঁড়া যুক্তি। সাত নভেম্বর তার শক্তি ও তাৎপর্য বহু আগে হারিয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এই ধরনের ভোঁতা রাজনৈতিক অস্ত্র ব্যবহারকে কেউ গুরুত্ব দেয় না, বাধা দেয় না।
ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল হিন্দু মহাসভার সঙ্গে যুক্ত নাথুরাম গড়সে। বীর সাভারকর ছিলেন তখন বিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের বড় নেতা। গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্রে তিনি যুক্ত ছিলেন বলে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এই সাভারকরকে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় পূজা করে। কিন্তু তার রাজনৈতিক গুরুত্ব এখন নেই। বিজেপি আগের বার ক্ষমতায় এসেই ভারতের পার্লামেন্ট ভবনে সাভারকরের ছবি টানিয়েছে, এমনকি মহাত্মা গান্ধীর ছবির পাশে তার স্থান দিয়েছে। তারা প্রতি বছর বীর সাভারকর দিবসও পালন করে। কংগ্রেস ও তার সমমনা দলগুলো তার কোনো প্রতিবাদ করেনি। সাভারকর দিবস পালনেও কোনো বাধা দেয়নি। সাভারকরের রাজনৈতিক গুরুত্ব ভারতের জাতীয় জীবনে বেড়ে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
বাংলাদেশেও ঘটা করে শহীদ জিয়া দিবস পালন বা সাত নভেম্বরের তথাকথিত সিপাহি-জনতার বিপ্লব দিবস পালিত হলে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির অথবা সরকারের চিন্তিত বা ভীত হওয়ার কিছু নেই। এই দিবসগুলোর স্বরূপ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও তার ব্যবহার সম্পর্কে দেশের মানুষ দিন দিন সচেতন হয়ে উঠছে। এসব দিবস পালনে বাধা দিলেই মাত্র সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত ও বিপক্ষ শিবিরে ঠেলে দেয়া হবে।
সাত নভেম্বরের দিবস পালনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরকার বিএনপিকে সভা করতে দেয়নি। কিন্তু এই ব্যাপারে একটি মজার কথা বলেছে। সরকার বলেছে, বিএনপি জোট ইচ্ছা করলে ঘরে বা তাদের অফিসে বসে দিবসটি পালন করতে পারে। খবরটি জেনে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলের একটি ঘটনা মনে পড়ল। এই স্বৈরাচারী শাসক দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার অধিকার না দিয়ে শর্ত দিয়েছিলেন, তারা বাইরে কোনো সভা-মিছিল করতে পারবে না। ঘরের দরজা বন্ধ করে তারা রাজনৈতিক সভা করতে পারবে। জিয়ার এই আদেশকে ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি বলে সরকারি ব্যাখ্যা দেয়া হলেও সাধারণ মানুষের কাছে তা পরিচিত হয়েছিল তালাবদ্ধ ঘরের রাজনীতি হিসেবে।
অদৃষ্টের কী পরিহাস, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে যে তালাবদ্ধ ঘরের রাজনীতি প্রবর্তন করেছিলেন, তা আজ তার দল বিএনপির কাঁধেই চেপেছে। তা চাপুক। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো একটি গণতান্ত্রিক সরকার কি জিয়াউর রহমানের স্বৈরাচারী আমলের ঘরোয়া রাজনীতি দেশে পুনঃপ্রবর্তন করতে চায়? চাইলে তার পরিণতিও ভালো হবে না। বরং বিএনপি এখন আন্দোলন গড়ে তোলায় যত শক্তিহীন হোক, সরকারের ভুল পদক্ষেপই তাকে আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে সক্ষম হতে সহায়তা জোগাবে।
আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারকে তাদের শুভাকাক্সক্ষী হিসেবেই একটা কথা বলি। তারা এখন দেশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করছেন। এই ক্ষমতা যেন তাদের গণতান্ত্রিক চেতনা ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধতাকে অন্ধ করে না ফেলে। তারা যেন অতীতের ক্ষমতাঅন্ধ সরকারগুলোর পরিণতির দিকে তাকান। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
প্রতাপ যখন চেঁচিয়ে করে বড়াই
জেনো মনে তখন তাহার বিধির সঙ্গে লড়াই।
কামনা করি, আওয়ামী লীগ সরকার যেন ক্ষমতায় অন্ধ হয়ে গণবিধাতার বিধানের সঙ্গে লড়াই শুরু না করে।
বিএনপি-জোটের এই কর্মসূচি এই মুহূর্তে সরকারের জন্য বিপজ্জনক তা বলি না। বিএনপি এই মুহূর্তে বড়সড় আন্দোলন পরিচালনায় সক্ষম নয় তাও সরকার জানে। আর সেটা জেনেশুনেই কি সরকার ক্ষমতার দাপট দেখানোর জন্য একটি বিরোধী দলীয় জোটের জনসভা অনুষ্ঠান বন্ধ করে দিল? তাতে সরকার শুধু একটি বিরোধী দলীয় জোটের সভা-মিছিল করার বৈধ ও নিয়মতান্ত্রিক অধিকারেই বাধা দিল না, জনসাধারণের মধ্যেও এই ধারণা জন্মাতে দিল যে, সরকার দেশ পরিচালনায় গণতান্তিক পথ থেকে সরে যাচ্ছে এবং বিরোধী দলগুলোকে তাদের বৈধ অধিকারও ভোগ করতে দিতে চাচ্ছে না।
এই ধারণা যদি দেশবাসীর মনে ধীরে ধীরে বদ্ধমূল হতে থাকে, তাহলে বিএনপি-জোটের দিকে তাদের সহানুভূতি বাড়বে এবং সেই সহানুভূতি বিএনপির প্রতি সমর্থনে পরিণত হলে তখন দল বা জোটটি আজকের অসফল কর্মসূচির বদলে সফল কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামতে পারবে। তারা যাতে তা পারে, সরকার তাদের জন্য সে পথই করে দিচ্ছে। সাত নভেম্বর পালন উপলক্ষে বিএনপি হরতাল ডাকেনি। হরতাল সফল করার জন্য জামায়াতের সহযোগিতায় রাজপথে সশস্ত্র ক্যাডার নামায়নি। তারা অতীতের একটি ঘটনায় বার্ষিকী পালন উপলক্ষে জনসভা ডেকেছিলেন। সরকার কী কারণে তাদের এই সভানুষ্ঠানে বাধা দিল?
এই সভানুষ্ঠানের পর যদি বিএনপি কোনো জঙ্গি মিছিল বের করত, শান্তি-শৃংখলা ভঙ্গের চেষ্টা চালাত এবং এই সম্পর্কিত কোনো আগাম খবর সরকারের কাছে এসে থাকে, তাহলে সরকারের আইন-শৃংখলা বাহিনীই তা শক্ত হাতে দমন করার জন্য প্রস্তুত থাকতে পারত। তাহলে সাধারণ মানুষও দেখত বিএনপি এখনও কীভাবে তার নিয়মতান্ত্রিক অধিকারের অপব্যবহার করে দেশে শান্তি-শৃংখলা নষ্ট করার কাজে রত। তাতে বিএনপির ক্ষতি হতো, সরকারের ক্রেডিবিলিটি বাড়ত। এখন উল্টো হল। বর্তমান সরকার ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের বিতর্ক থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়েছে তা নয়। তার ওপর সরকারের এই ধরনের কার্যকলাপ এই বিতর্ককে আরও বাড়তে সুযোগ দেবে।
১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর সিপাহি-জনতার বিপ্লব ছিল বলে বিশ্বাস করার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ আমার কাছে নেই। এই দিবসটি ছিল একটি প্রতিবিপ্লবী দিবস। জেলে চার জাতীয় নেতা ও বাইরে জেনারেল খালেদ মোশাররফ তার সহকর্মীদেরসহ নিহত হওয়ার পর তৎকালীন জাসদের ভ্রান্তি ও অ্যাডভেঞ্চার কিছু সিপাহিকে বিভ্রান্ত করে রক্তক্ষয়ী উচ্ছৃংখলতায় উৎসাহ জোগায় এবং সব প্রতিবিপ্লবী চক্রান্তের নায়ক ক্ষমতালোভী জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতা দখলে সাহায্য দেয়। ক্ষমতায় বসে জেনারেল জিয়াউর রহমান তার সাহায্যদাতাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেন। জাসদের মূল নেতৃত্বকে তিনি জেলে ঢোকান এবং গণসেনাবাহিনী গঠনের পরিকল্পক কর্নেল তাহেরকে বিচার প্রহসনে হত্যা করেন।
এজন্যই বিএনপি এবং বর্তমান জাসদের (বিভক্ত) কাছে সাত নভেম্বরের তাৎপর্য দুই রকমের। এটা এক জেনারেলের অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের দিবসকে বিপ্লবের মোড়ক পরিয়ে পালনের চেষ্টা করছে বিএনপি। অন্যদিকে এই দিবসটিকে সিপাহি-জনতার অভ্যুত্থানের খোলস পরিয়ে নিজেদের অতীতের ইনফেনটাইল অ্যাডভেঞ্চারিজমকে ঢাকা দেয়ার চাতুর্য করছে জাসাদের একশ্রেণীর ব্যর্থ ও বিভ্রান্ত নেতা।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যারা বিশ্বাস করেন, পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বরের হত্যাকাণ্ডের আসল কারণ যারা অনুধাবন করেন, তাদের কাছে সাত নভেম্বরের সিপাহি-জনতা বিপ্লবের স্বরূপ ব্যাখ্যা করার কোনো দরকার আছে বলে মনে করি না। এই তথাকথিত বিপ্লব বা ট্রাজেডি অনুষ্ঠিত হওয়ার পর ৩৯ বছর কেটে গেছে। এতদিনে রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় আমাদের সাবালকত্ব অর্জনের কথা। আমরা নিশ্চয়ই তা করেছি। তাই সচেতন এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের কাছে সাত নভেম্বরের তেমন কোনো গুরুত্বই এখন আর নেই। বর্তমান সরকার এখনও এই দিবসটি কেউ যদি পালন করতে চায় তাকে কেন বাধা দেবে অথবা ভয় পাবে তা আমি বুঝি না।
সরকার যেখানে একাত্তরের ঘৃণ্য যুদ্ধাপরাধীদের পালের গোঁদা গোলাম আযমের মৃত্যুর পর ঢাকায় সরকারি মসজিদ বায়তুল মোকাররমে সরকারি পাহারায় তার জানাজার নামাজ অনুষ্ঠানে অনুমতি দিয়েছে এবং ধর্মীয় বিধান ভঙ্গ করে দুদিন যাবৎ লাশ কবর না দিয়ে জামায়াতিরা সারা দেশ থেকে লোক সংগ্রহ করে জানাজায় বিশাল জনতার সমাবেশ ঘটানোর ব্যবস্থা করা সত্ত্বেও সরকার বাধা দেয়নি, সেখানে সাত নভেম্বরের তখাকথিত সিপাহি-জনতার বিপ্লব দিবস পালনের সভানুষ্ঠানে সরকার কেন বাধা দিল তা আমার বুদ্ধির অগম্য।
আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে যুক্তি দেখানো হতে পারে, সাত নভেম্বর কোনো বিপ্লব দিবস নয়, স্বাধীনতাবিরোধী একটি চক্রান্ত দিবস। স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এখন ক্ষমতায়। তারা এই দিবস পালনে অনুমতি দিতে পারে না। এই যুক্তি যদি তারা দেখান তা হবে নেহাত খোঁড়া যুক্তি। সাত নভেম্বর তার শক্তি ও তাৎপর্য বহু আগে হারিয়েছে। একটি গণতান্ত্রিক দেশে এই ধরনের ভোঁতা রাজনৈতিক অস্ত্র ব্যবহারকে কেউ গুরুত্ব দেয় না, বাধা দেয় না।
ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধীকে হত্যা করেছিল হিন্দু মহাসভার সঙ্গে যুক্ত নাথুরাম গড়সে। বীর সাভারকর ছিলেন তখন বিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসীদের বড় নেতা। গান্ধী হত্যার ষড়যন্ত্রে তিনি যুক্ত ছিলেন বলে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। এই সাভারকরকে ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলগুলো প্রায় পূজা করে। কিন্তু তার রাজনৈতিক গুরুত্ব এখন নেই। বিজেপি আগের বার ক্ষমতায় এসেই ভারতের পার্লামেন্ট ভবনে সাভারকরের ছবি টানিয়েছে, এমনকি মহাত্মা গান্ধীর ছবির পাশে তার স্থান দিয়েছে। তারা প্রতি বছর বীর সাভারকর দিবসও পালন করে। কংগ্রেস ও তার সমমনা দলগুলো তার কোনো প্রতিবাদ করেনি। সাভারকর দিবস পালনেও কোনো বাধা দেয়নি। সাভারকরের রাজনৈতিক গুরুত্ব ভারতের জাতীয় জীবনে বেড়ে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই।
বাংলাদেশেও ঘটা করে শহীদ জিয়া দিবস পালন বা সাত নভেম্বরের তথাকথিত সিপাহি-জনতার বিপ্লব দিবস পালিত হলে স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির অথবা সরকারের চিন্তিত বা ভীত হওয়ার কিছু নেই। এই দিবসগুলোর স্বরূপ এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ও তার ব্যবহার সম্পর্কে দেশের মানুষ দিন দিন সচেতন হয়ে উঠছে। এসব দিবস পালনে বাধা দিলেই মাত্র সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত ও বিপক্ষ শিবিরে ঠেলে দেয়া হবে।
সাত নভেম্বরের দিবস পালনে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সরকার বিএনপিকে সভা করতে দেয়নি। কিন্তু এই ব্যাপারে একটি মজার কথা বলেছে। সরকার বলেছে, বিএনপি জোট ইচ্ছা করলে ঘরে বা তাদের অফিসে বসে দিবসটি পালন করতে পারে। খবরটি জেনে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের আমলের একটি ঘটনা মনে পড়ল। এই স্বৈরাচারী শাসক দেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার অধিকার না দিয়ে শর্ত দিয়েছিলেন, তারা বাইরে কোনো সভা-মিছিল করতে পারবে না। ঘরের দরজা বন্ধ করে তারা রাজনৈতিক সভা করতে পারবে। জিয়ার এই আদেশকে ঘরোয়া রাজনীতির অনুমতি বলে সরকারি ব্যাখ্যা দেয়া হলেও সাধারণ মানুষের কাছে তা পরিচিত হয়েছিল তালাবদ্ধ ঘরের রাজনীতি হিসেবে।
অদৃষ্টের কী পরিহাস, জিয়াউর রহমান বাংলাদেশে যে তালাবদ্ধ ঘরের রাজনীতি প্রবর্তন করেছিলেন, তা আজ তার দল বিএনপির কাঁধেই চেপেছে। তা চাপুক। কিন্তু আওয়ামী লীগের মতো একটি গণতান্ত্রিক সরকার কি জিয়াউর রহমানের স্বৈরাচারী আমলের ঘরোয়া রাজনীতি দেশে পুনঃপ্রবর্তন করতে চায়? চাইলে তার পরিণতিও ভালো হবে না। বরং বিএনপি এখন আন্দোলন গড়ে তোলায় যত শক্তিহীন হোক, সরকারের ভুল পদক্ষেপই তাকে আন্দোলন গড়ে তোলার কাজে সক্ষম হতে সহায়তা জোগাবে।
আওয়ামী লীগের বর্তমান সরকারকে তাদের শুভাকাক্সক্ষী হিসেবেই একটা কথা বলি। তারা এখন দেশে নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ভোগ করছেন। এই ক্ষমতা যেন তাদের গণতান্ত্রিক চেতনা ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধতাকে অন্ধ করে না ফেলে। তারা যেন অতীতের ক্ষমতাঅন্ধ সরকারগুলোর পরিণতির দিকে তাকান। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন,
প্রতাপ যখন চেঁচিয়ে করে বড়াই
জেনো মনে তখন তাহার বিধির সঙ্গে লড়াই।
কামনা করি, আওয়ামী লীগ সরকার যেন ক্ষমতায় অন্ধ হয়ে গণবিধাতার বিধানের সঙ্গে লড়াই শুরু না করে।
No comments