শাবিতে আতঙ্ক, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার- আগের রাতেই ক্যাম্পাস দখলের পরিকল্পনা হয় by ওয়েছ খছরু
অঞ্জন গ্রুপের অস্ত্রের যোগান দিয়েছিল ‘ছাত্রলীগ ক্যাডার’ শিপলু। রিভলবার, পাইপগান, চাপাতিসহ সব অস্ত্রের ভাণ্ডার হিসেবে গড়ে তোলেছিল তার বাসা। আগের রাতে শিপলু বাসার অদূরে পাঠানটুলা পয়েন্টের কাছে বসে ক্যাম্পাস দখলের পরিকল্পনা করেছিল ছাত্রলীগের অঞ্জন গ্রুপের ক্যাডাররা। আর ঘটনার দিন শিপলুর বাসার সামনে এসে জড়ো হয় বহিরাগত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। এ সময় শিপলুর বাসা থেকে সিএনজি অটোরিকশা করে নিয়ে আসা হয় অস্ত্রের চালান। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এসব অস্ত্র নিয়ে ঢুকেছিল ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। সংঘর্ষের ঘটনার পরপরই সিলেটের জালালাবাদ থানা পুলিশ অস্ত্র উদ্ধার অভিযান শুরু করে। এর প্রেক্ষিতে রাতেই পুলিশ নগরীর পাঠানটুলাস্থ রাগিব-রাবেয়া হাসপাতালের পার্শ্ববর্তী এলাকার মজুমদার কটেজস্থ শিপলুর বাড়ি থেকে গুলিভর্তি একটি কালো রঙের রিভলবার, গুলি ও ১৯টি রামদা উদ্ধার করে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, ছাত্রলীগ ক্যাডার শিপলুর বাসা ছিল কাশ্মির গ্রুপ ছাত্রলীগের অস্ত্রের আড়ত। এই সংবাদের পরিপ্রেক্ষিতে রাতেই বিশেষ অপারেশন শুরু করা হয় শিপলুর বাসায়। এ সময় শিপলু বাসাতেই ছিল। পুলিশের অভিযান টের পেয়ে সে পালিয়ে যায়। তবে, তার বাসা থেকে অস্ত্রের সঙ্গে এমদাদুল নামের এক ছাত্রলীগ ক্যাডারকে গ্রেপ্তার করেছে। শুধু শিপলুর বাসাই নয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহপরান হলও ছিল ছাত্রলীগের অস্ত্রাগার। আগ্নেয়াস্ত্র থেকে শুরু করে সব ধরনের অস্ত্র হলে রাখতো ছাত্রলীগ কর্মীরা। বেশ কয়েক মাস ধরে ওই হল নিয়ন্ত্রণ ছিল ছাত্রলীগের উত্তমের। হলের নিয়ন্ত্রণের জের ধরে উত্তমকে কোপানো হয়েছিল। হলে বসবাসরত শিক্ষার্থীরা জানায়, শাহপরান হল বর্তমানের ছাত্রলীগের দখলে থাকায় বেশির ভাগ কক্ষেই ছাত্রলীগ কর্মীরা বসবাস করতো। এ কারণে হলের ভেতরেই আগ্নেয়াস্ত্র সহ দা, রামদা, চাপাতি রাখা হতো। ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত কয়েকটি কক্ষেই এসব অস্ত্র রাখা হলেও প্রশাসনের পক্ষ থেকে কখনোই অভিযান চালানো হয়। সংঘর্ষের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সহকারী প্রক্টর ক্ষোভ জানিয়ে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, বারবার প্রক্টরিয়াল বডির পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে অস্ত্র উদ্ধারে হল তল্লাশি করার অনুরোধ জানানো হয়েছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেদিকে কর্ণপাত করেনি। বৃহস্পতিবার সংঘর্ষের শুরুতেই হল থেকে ছাত্রলীগের একটি অংশ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে। আর অঞ্জনের নেতৃত্বে অপর অংশটি নগরীর পাঠানটুলা দিয়ে নয়াবাজার হয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে। ফলে দুটি গ্রুপের কর্মীরা অন্তত ১০-১২টি আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে গোলাগুলিতে শরিক হয়। এ সময় একপক্ষ অপর পক্ষকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো গুলি ছোড়ে। গুলির শব্দে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। সিলেটের জালালাবাদ থানার ওসি আক্তার হোসেন জানিয়েছেন, সংঘর্ষ থামার পর রাতেই পুলিশের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হয়। পুলিশের বেশ কয়েকটি টিম একযোগে নগরীতে অভিযানে নামে। অভিযানকালে শিপলুর বাসা থেকে আগ্নেয়াস্ত্রের চালান উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া নগরীর কুয়ারপাড় থেকে সন্ত্রাসী অনিক ও জয়ন্তকে গ্রেপ্তার করা হয়। জালালাবাদ থানা পুলিশ মোট ৫ জনকে গ্রেপ্তার করেছে বলে জানান তিনি। এদিকে, শাবিতে সংঘর্ষের ঘটনায় শুক্রবার সকালে জালালাবাদ থানা পুলিশ বাদী হয়ে ২৪০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। গ্রেপ্তারকৃত ৫ জনকে ওই মামলায় আসামি করা হয়েছে। ওসি আক্তার হোসেন জানান, পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় এ মামলা করা হয়। এদিকে, শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় গোটা নগরীতে অভিযান জোরদার করেছে পুলিশ। গতকাল বিকাল পর্যন্ত পুলিশ অভিযান চালিয়ে মোট ২৩ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এর মধ্যে ১৮ জনকে গ্রেপ্তার করেছে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। কোতোয়ালি পুলিশ জানিয়েছে, গ্রেপ্তারকৃতদের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় আসামি করা হয়েছে। সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের এডিসি মিডিয়া মো. রহমতুল্লাহ জানিয়েছেন, পুলিশ অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি অস্ত্রবাজদের গ্রেপ্তারে অভিযান চালাচ্ছে।
অস্ত্র আড়ত শাবির চারপাশ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশের ছাত্র ম্যাচ ও রাজনৈতিক ক্যাডারদের বাড়ি ঘরকে অস্ত্রের আড়ত হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এ কারণে ক্যাম্পাসে কিছু ঘটলে দ্রুত অস্ত্র চলে যায় ক্যাডারদের হাতে। পার্শ্ববর্তী নয়াবাজার, টিলাগাঁও, কালিবাড়ি, টুকের বাজার এলাকায় এসব অস্ত্র রাখা হয়। সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ভৌগোলিক কারণে ক্যাম্পাসের চারপাশে গ্রাম ও বাড়িঘর রয়েছে। এসব এলাকায় অনেক ছাত্র ম্যাচ রয়েছে। এসব ছাত্র মেসে ভয়ঙ্কর আগ্নেয়াস্ত্রগুলো রাখা হয়েছিল। আর বৃহস্পতিবার সংঘর্ষের দিন ছাত্রলীগের পার্থ গ্রুপের কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ এলাকা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যায়। ওই গ্রুপের কর্মীরা দা, রামদা ও চাপাতি নিয়ে আসে ছাত্রহল থেকে। একই সঙ্গে অঞ্জন গ্রুপের কর্মীরা নগরীর কুয়ারপাড়, আম্বরখানা, বাগবাড়ি এলাকা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছিল। সংঘর্ষের সময় ছাত্রদের ব্যাগে রক্ষিত ছিল ককটেল। আর ওই ককটেলগুলো ব্যহার করা হয় সংঘর্ষের দিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ: সংঘর্ষের ঘটনায় বৃহস্পতিবার সকালেই তিনটি ছাত্রহল বন্ধ করে দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ কারণে প্রশাসনের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই হল ছেড়ে চলে যায় শিক্ষার্থীরা। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলে অবস্থানকারী ছাত্রীরা হল ছাড়েন গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত। রাতে উৎকণ্টয় কাটানো পর ভোর হতেই ছাত্রীরা হল ছাড়তে শুরু করেন। এ সময় তারা সাংবাদিকদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আনিকা নামের এক ছাত্রী মানবজমিনকে জানান, তার বাসা ঢাকায়। স্বল্প সময়ের নোটিশে তাকে হল ছেড়ে দিতে হয়েছে। ওদিকে সিলেটে তিনি প্রাইভেট টিউশনি করান। এ অবস্থায় তাকে বাধ্য হয়ে সিলেটে থাকতে হচ্ছে। কয়েকজন ছাত্র জানান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব কম অংশ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এরপরও রাজনীতির কারণে বারবার বাধাগ্রস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা। এদিকে, গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ছাত্রহল ও দুটি ছাত্রী হলই ফাঁকা হয়ে গেছে। সকাল ৯টার মধ্যে শিক্ষার্থীরা হল ছেড়ে চলে গেছে। তবে, প্রতিটি হলেই বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। ওদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় ফটকেও পুলিশের পক্ষ থেকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছাড়া ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। গোলচত্বর এলাকায়ও রয়েছে পুলিশ মোতায়েন।
আতঙ্কিত শিক্ষকরাও: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি বিনিময় ও ছাত্রলীগ নেতা সুমন নিহত হওয়ার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও আতঙ্কিত হয়েছে পড়েছেন। ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে বহিরাগতদের অস্ত্রের ব্যবহার ও ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় শিক্ষকদের আতঙ্কের বিষয়টি ভিসিকে জানিয়েছেন শিক্ষক সমিতির নেতারা। গতকাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. ইউনূস মানবজমিনকে জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কখনোই অস্ত্রের ব্যবহার করে না। বহিরাগতরা অস্ত্র নিয়ে এসে ক্যাম্পাসে গোলাগুলি করে। আর এবার গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিমাদ্রি শেখরও আহত হয়েছেন। তিনি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শাবি প্রশাসনকে অনুরোধ জানান। একই কথা জানিয়ে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমদ জানিয়েছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে সিলেটের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। যেভাবে হোক ক্যাম্পাসে বহিরাগত ঠেকাতে হবে এবং আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার কমাতে হবে। নতুন ক্যাম্পাসে থাকা ৫ শতাধিক শিক্ষকও নিরাপদ থাকতে পারবেন না।
প্রশাসনের ব্যর্থতার অভিযোগ: ক্যাম্পাসে পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের অস্ত্রবাজির ঘটনায় প্রশাসনের ব্যর্থতার বিষয়টি প্রকাশ্য এসেছে। বলা হচ্ছে, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তবে এ অভিযোগটি মানতে নারাজ জালালাবাদ থানার ওসি। তিনি জানান, পুলিশ ৯৩ রাউন্ড রাবার বুলেট ও প্রচুর সংখ্যক টিয়ারশেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর পুলিশের ওপর আঘাত এলেও পুলিশ পিছু না হটিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ক্যাম্পাসে সকাল থেকেই পুলিশ মোতায়েন ছিল। এর মধ্যে শাহপরান হল এলাকায় অবস্থানরত পুলিশ দলকে ছাত্রলীগের একটি অংশ তালাবদ্ধ করে বন্দি করে ফেলে। আর বড় অংশটি অবস্থান করছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। ঘটনার দিনও এডিসি মিডিয়া মো. রহমতুল্লাহ মানবজমিনকে জানিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যতটুকু সহায়তা চেয়েছে ততটুকু দেয়া হয়েছে। কোন গাফলতি করা হয়নি। ঘটনার দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সদ্যসরা পুলিশ ছাড়াই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বারবার চেষ্টা চালান। এ কারণে অ্যাকশনে যেতে পুলিশকে অনুমতি দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন। পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠার পর প্রশাসনকে অ্যাকশনের অনুমতি দেয়া হয়।
জরুরি বৈঠক ও ভিসির বক্তব্য: শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় রাতেই সিন্ডিকেট সভা করে প্রফেসর ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাসকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মামলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এরপরও সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গতকাল সকালে সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে সভার আহ্বান করেন ভিসি প্রফেসর ড. আমিনুল হক ভুঁইয়া। গতকাল তিনি জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়েল সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে পর্যারোচনা বৈঠক হয়েছে। এ বৈঠকে সব কিছু নিয়ে আলোচনা করা হয়। তিনি বলেন, আশা করি খুব দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষা শুরু করা হবে।
নিহত সুমনের লাশ গ্রামের বাড়িতে: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত ছাত্রলীগ কর্মী সুমন ছিল সিলেট ইন্টারন্যশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ঘটনার পর বিকালে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুমনের লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়। রাতে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শ্যামাচর গ্রামে। সেখানে তার লাশ নিয়ে কান্নার রোল পড়ে পরিবারে সদস্যদের মধ্যে। সুমনের সহপাঠী আরেক সুমন গতকাল মানবজমিনকে জানিয়েছেন, রাতেই সুমনের মরদেহ দাহ করা হয়েছে। তবে, গতকাল পর্যন্ত সুমনের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করা হয়নি। পুলিশ জানিয়েছে, সুমনের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দেয়া হলে পুলিশ সেটি গ্রহণ করে অভিযান শুরু করবে।
অস্ত্র আড়ত শাবির চারপাশ: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশের ছাত্র ম্যাচ ও রাজনৈতিক ক্যাডারদের বাড়ি ঘরকে অস্ত্রের আড়ত হিসেবে গড়ে তোলা হয়েছে। এ কারণে ক্যাম্পাসে কিছু ঘটলে দ্রুত অস্ত্র চলে যায় ক্যাডারদের হাতে। পার্শ্ববর্তী নয়াবাজার, টিলাগাঁও, কালিবাড়ি, টুকের বাজার এলাকায় এসব অস্ত্র রাখা হয়। সাধারণ শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ভৌগোলিক কারণে ক্যাম্পাসের চারপাশে গ্রাম ও বাড়িঘর রয়েছে। এসব এলাকায় অনেক ছাত্র ম্যাচ রয়েছে। এসব ছাত্র মেসে ভয়ঙ্কর আগ্নেয়াস্ত্রগুলো রাখা হয়েছিল। আর বৃহস্পতিবার সংঘর্ষের দিন ছাত্রলীগের পার্থ গ্রুপের কর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশ এলাকা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে যায়। ওই গ্রুপের কর্মীরা দা, রামদা ও চাপাতি নিয়ে আসে ছাত্রহল থেকে। একই সঙ্গে অঞ্জন গ্রুপের কর্মীরা নগরীর কুয়ারপাড়, আম্বরখানা, বাগবাড়ি এলাকা থেকে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেছিল। সংঘর্ষের সময় ছাত্রদের ব্যাগে রক্ষিত ছিল ককটেল। আর ওই ককটেলগুলো ব্যহার করা হয় সংঘর্ষের দিন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ: সংঘর্ষের ঘটনায় বৃহস্পতিবার সকালেই তিনটি ছাত্রহল বন্ধ করে দিয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ কারণে প্রশাসনের বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যেই হল ছেড়ে চলে যায় শিক্ষার্থীরা। তবে, বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি হলে অবস্থানকারী ছাত্রীরা হল ছাড়েন গতকাল সকাল ৯টা পর্যন্ত। রাতে উৎকণ্টয় কাটানো পর ভোর হতেই ছাত্রীরা হল ছাড়তে শুরু করেন। এ সময় তারা সাংবাদিকদের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আনিকা নামের এক ছাত্রী মানবজমিনকে জানান, তার বাসা ঢাকায়। স্বল্প সময়ের নোটিশে তাকে হল ছেড়ে দিতে হয়েছে। ওদিকে সিলেটে তিনি প্রাইভেট টিউশনি করান। এ অবস্থায় তাকে বাধ্য হয়ে সিলেটে থাকতে হচ্ছে। কয়েকজন ছাত্র জানান, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে খুব কম অংশ রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। এরপরও রাজনীতির কারণে বারবার বাধাগ্রস্ত শিক্ষা ব্যবস্থা। এদিকে, গতকাল সকালে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ছাত্রহল ও দুটি ছাত্রী হলই ফাঁকা হয়ে গেছে। সকাল ৯টার মধ্যে শিক্ষার্থীরা হল ছেড়ে চলে গেছে। তবে, প্রতিটি হলেই বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। ওদিকে, বিশ্ববিদ্যালয় ফটকেও পুলিশের পক্ষ থেকে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারী ছাড়া ভেতরে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। গোলচত্বর এলাকায়ও রয়েছে পুলিশ মোতায়েন।
আতঙ্কিত শিক্ষকরাও: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে গুলি বিনিময় ও ছাত্রলীগ নেতা সুমন নিহত হওয়ার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও আতঙ্কিত হয়েছে পড়েছেন। ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে বহিরাগতদের অস্ত্রের ব্যবহার ও ছাত্র মৃত্যুর ঘটনায় শিক্ষকদের আতঙ্কের বিষয়টি ভিসিকে জানিয়েছেন শিক্ষক সমিতির নেতারা। গতকাল শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যায়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি প্রফেসর ড. ইউনূস মানবজমিনকে জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কখনোই অস্ত্রের ব্যবহার করে না। বহিরাগতরা অস্ত্র নিয়ে এসে ক্যাম্পাসে গোলাগুলি করে। আর এবার গুলিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর হিমাদ্রি শেখরও আহত হয়েছেন। তিনি এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে শাবি প্রশাসনকে অনুরোধ জানান। একই কথা জানিয়ে শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহমদ জানিয়েছেন, পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হলে সিলেটের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। যেভাবে হোক ক্যাম্পাসে বহিরাগত ঠেকাতে হবে এবং আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার কমাতে হবে। নতুন ক্যাম্পাসে থাকা ৫ শতাধিক শিক্ষকও নিরাপদ থাকতে পারবেন না।
প্রশাসনের ব্যর্থতার অভিযোগ: ক্যাম্পাসে পুলিশের সামনেই ছাত্রলীগের অস্ত্রবাজির ঘটনায় প্রশাসনের ব্যর্থতার বিষয়টি প্রকাশ্য এসেছে। বলা হচ্ছে, পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তবে এ অভিযোগটি মানতে নারাজ জালালাবাদ থানার ওসি। তিনি জানান, পুলিশ ৯৩ রাউন্ড রাবার বুলেট ও প্রচুর সংখ্যক টিয়ারশেল ছুড়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। এরপর পুলিশের ওপর আঘাত এলেও পুলিশ পিছু না হটিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন, ক্যাম্পাসে সকাল থেকেই পুলিশ মোতায়েন ছিল। এর মধ্যে শাহপরান হল এলাকায় অবস্থানরত পুলিশ দলকে ছাত্রলীগের একটি অংশ তালাবদ্ধ করে বন্দি করে ফেলে। আর বড় অংশটি অবস্থান করছিল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে। ঘটনার দিনও এডিসি মিডিয়া মো. রহমতুল্লাহ মানবজমিনকে জানিয়েছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যতটুকু সহায়তা চেয়েছে ততটুকু দেয়া হয়েছে। কোন গাফলতি করা হয়নি। ঘটনার দিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডির সদ্যসরা পুলিশ ছাড়াই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বারবার চেষ্টা চালান। এ কারণে অ্যাকশনে যেতে পুলিশকে অনুমতি দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন। পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠার পর প্রশাসনকে অ্যাকশনের অনুমতি দেয়া হয়।
জরুরি বৈঠক ও ভিসির বক্তব্য: শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘর্ষের ঘটনায় রাতেই সিন্ডিকেট সভা করে প্রফেসর ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাসকে প্রধান করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে মামলা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এরপরও সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করতে গতকাল সকালে সিনিয়র শিক্ষকদের নিয়ে সভার আহ্বান করেন ভিসি প্রফেসর ড. আমিনুল হক ভুঁইয়া। গতকাল তিনি জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়েল সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে পর্যারোচনা বৈঠক হয়েছে। এ বৈঠকে সব কিছু নিয়ে আলোচনা করা হয়। তিনি বলেন, আশা করি খুব দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ও পরীক্ষা শুরু করা হবে।
নিহত সুমনের লাশ গ্রামের বাড়িতে: শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিহত ছাত্রলীগ কর্মী সুমন ছিল সিলেট ইন্টারন্যশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্র। ঘটনার পর বিকালে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সুমনের লাশের ময়না তদন্ত সম্পন্ন করা হয়। রাতে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার শ্যামাচর গ্রামে। সেখানে তার লাশ নিয়ে কান্নার রোল পড়ে পরিবারে সদস্যদের মধ্যে। সুমনের সহপাঠী আরেক সুমন গতকাল মানবজমিনকে জানিয়েছেন, রাতেই সুমনের মরদেহ দাহ করা হয়েছে। তবে, গতকাল পর্যন্ত সুমনের পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় মামলা করা হয়নি। পুলিশ জানিয়েছে, সুমনের পরিবারের পক্ষ থেকে মামলা দেয়া হলে পুলিশ সেটি গ্রহণ করে অভিযান শুরু করবে।
No comments