সামনে কী? বঙ্গোপসাগর! by ফরহাদ মজহার
সামনে কী? এটাই এখনকার প্রশ্ন।
অনেকে খোলাসা করে বলেন না, বলতে চান না বা বলতে ভয় পান। কিন্তু নীরব থাকলেও যে নীরব উৎকণ্ঠা এখন সর্বব্যাপী সেটা হল, এভাবেই কি দেশ চলবে? উত্তর : হ্যাঁ, চলবে। আপনাআপনি কোনো কিছুই বদলায় না। তাছাড়া দেশ খারাপ চলছে কোথায়? দুর্নীতি, দুর্বৃত্তপনা, খুন, গুম-খুন, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিরোধী মত ও চিন্তাকে কঠোরভাবে দমন, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনকে দলীয় হাতিয়ারে পরিণত করা, বিরোধী দলকে আস্তে আস্তে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া- সবই খারাপ কাজ। আলবৎ। এতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা তো সরকারবিরোধীদের সমস্যা। সরকারেরও না, দেশেরও না। যদি না দেশ বলতে সুনির্দিষ্টভাবে নাগরিকদের বুঝি।
দেশের সমস্যা কী আসলে? দেশ তো বিমূর্ত কিছু নয়। যদি বর্তমান সমস্যা সমাধানের পথ থাকা সত্ত্বেও নাগরিকরা ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে সরাতে না পারে, কেবল তখনই দেশের সমস্যা কথাটা অর্থপূর্ণ হয়। যদি যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন হয়তো ক্ষমতার হাতবদলে দেশের সমস্যার কী সমাধান হবে? যদি বিরোধী রাজনীতির মধ্যে এসবের অবসান ঘটার অঙ্গীকার পাওয়া যেত, তাহলে বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের রাজনীতি আপনাতেই দানা বাঁধত। তখন অঙ্গীকারকে বাস্তবে রূপ দেয়ার নীতি ও কৌশল নিয়ে কথা উঠত। রাজনীতির ইতিবাচক মেরুকরণ ঘটত। এ কথাগুলো বারবার বলা হয়েছে। কিন্তু বিরোধী রাজনীতি সেসব কথা কানে তোলেনি। ফলে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। অচিরে এর অবসান ঘটবে তার কোনো কারণ দেখি না।
বিরোধী রাজনীতি বর্তমান অবস্থা থাকে উত্তরণের কথা ভাবছে বা এ বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে চায়, তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে ন্যূনতম কোনো প্রতিশ্র“তি পাওয়া গেলে অন্তত চিন্তাভাবনার দিক থেকে পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা শুরু হতো। বিরোধী দল বা জোট কীভাবে তাদের অঙ্গীকার বা প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়ন করবে তার নীতি ও কৌশল নিয়ে সমাজে কথাবার্তা শুরু হয়ে যেত, জনগণ কোনো দল বা পক্ষ হিসেবে নয়, একটা রাজনীতির পক্ষে এসে দাঁড়াতে শুরু করত, নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যেত। একেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বলা হয়। যদি আমরা নিশ্চিত হতে পারতাম যে, ক্ষমতাসীনদের বিদায় দিয়ে যাদের আমরা ক্ষমতায় আনতে চাই তারা এমনভাবে দেশ চালাবেন যাতে ওপরে যা কিছু মন্দ ব্যাপারের কথা বলা হল সেসব আর ঘটবে না, তখন পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নিত। না, সেটা বিরোধী রাজনীতির সদিচ্ছার ওপর আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। কী ধরনের আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা তারা নেবেন যাতে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনা এখনকার মতো দুষ্ট ক্ষতের রূপ নেবে না, সেটা তাদের কংক্রিট ভাষায় বলার জন্যই আমরা বলতে থাকব। যেমন, একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন একটি প্রস্তাব হতে পারে। খুন, গুমখুন, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি বন্ধ করা যাবে কীভাবে? দল, মত, ধর্ম, বিশ্বাস, সম্প্রদায় নির্বিশেষে নাগরিকদের মানবিক অধিকার সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত ও প্রশাসনিকভাবে বলবৎ করার মধ্য দিয়ে; সেটা করতে হলে সংবিধান সংস্কারের দরকার হবে। প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে দলীয়করণ থেকে মুক্ত করতে হবে। এগুলো তো অতি প্রাথমিক প্রত্যাশা। এরপর অর্থনৈতিক উন্নতি, কাজ সৃষ্টি ও কর্মোদ্যোগের প্রেরণা তৈরি- ইত্যাদি তো আছেই। সর্বোপরি দিল্লির সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্ন। বাংলাদেশ কি নিজের হিম্মত নিয়ে দাঁড়াতে পারবে?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কি নতজানু নয়? কিন্তু সেটা তো এখন হয়নি। আজকালের ব্যাপার কি? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে যে রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছে, প্রথম থেকেই দিল্লি তার ওপর প্রভুত্ব করতে চেয়েছে। এখন হা-হুতাশের কী আছে? ভাগ্য ভালো যে আমি কে তুমি কে বাঙালি বাঙালি বলতে বলতে আমরা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে এখনও যুক্ত হয়ে যাওয়ার দাবি তুলিনি। আমরা তো একই জাতি। একই আমাদের ভাষা, একই আমাদের সংস্কৃতি। ফলে একত্রিত হয়ে যাওয়াই তো এই জাতির নিয়তির বিধান ছিল। কেন হল না, সেটাই বরং ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রহস্য।
ধর্ম? না সেটা অবশ্য এক নয়। অতএব ধর্মই এই একত্রীকরণ প্রক্রিয়া বা ঐক্যের পথে প্রধান বাধা। সব দোষের মূল হিন্দুত্ববাদ! না না, থুক্কু, ইসলাম। ইসলামই বাঙালিদের একত্রিত হওয়ার পথে প্রধান বাধা। এই চিন্তাই তো আমাদের গ্রাস করে থাকে। ফলে আমরা বাঙালি হওয়ার জন্য ইসলামবিদ্বেষী হয়ে যাই, ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম-আতংকে ভুগি। একদল মনে করে, টুপি পরা পাঞ্জাবি পরা মাদ্রাসার ছেলেদের জঙ্গি বলে ধরিয়ে দিয়েই বঙ্গভূমিকে ইসলামমুক্ত রাখা যাবে। বিদেশে ইংরেজের দেশে বড় হওয়া ছেলেমেয়ে- যারা আরবি বা নিজের মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে ইসলামের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পর্যন্ত পায়নি- দেখি যে তারা কড়া ইসলামপন্থায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। বিশ্ব পরিস্থিতির মধ্যে কী এমন বদল ঘটছে, যার ফলে বড় একটি জেনারেশনের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার অভিমুখ এত তাড়াতাড়ি বদলে গেল! না, আমাদের সেটা বোঝার সময় নাই। চতুর্দিকে আমরা শুধু ইসলামী জঙ্গির ভূত দেখি।
এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় আমরা আবার অতিরিক্ত মুসলমান বনে যাই, বাংলা সংস্কৃতি মানেই যে হিন্দুর সংস্কৃতি এ কথা বলতে আমাদের মুখে বাধে না। বাঙালির সংস্কৃতির কথা শুনলেই মনে করি এ দেশ হিন্দুদের দেশ হয়ে গিয়েছে। আমাদের ভাব হয়, আমরা বুঝি এইমাত্র মদিনা থেকে খেজুর খেতে খেতে ঢাকায় এসে নেমেছি। এ দেশের ভূগোল, তার প্রাণ ও প্রকৃতি, তার খাদ্য ব্যবস্থা, সংস্কৃতি- সবকিছুর মধ্যেই হিন্দুয়ানা আবিষ্কার করা দ্বীনি কর্তব্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের মধ্যে আমরা মরুভূমি খুঁজতে থাকি। খুঁজে না পেয়ে অস্থির হয়ে যাই। ভুলে যাই, সিন্ধু থেকে হিন্দু- আর সিন্ধু নদীর এপাশে যারা বাস করে তারা সবাই হিন্দু। এটা হিন্দুদেরই দেশ। ধর্ম, বর্ণ, জাত, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই হিন্দু। হিন্দু একসময় কোনো ধর্মের নাম ছিল না। সেই ইতিহাস আমরা ভুলে গিয়েছি। মুসলমানরাই এই উপমহাদেশের নাম রেখেছে হিন্দুস্তান। তাই না? সিন্ধু নদের এপাশের অধিবাসীদের হিন্দু বলতে বলতে অবশেষে ধর্ম হিসেবে এর রূপান্তর ঐতিহাসিক বাস্তবতা। এটা এখন আর শুধু ধর্ম মাত্র নয়। পরিচয়েরও সূত্র। আমি যদি মুসলমান হই তো সে হিন্দু হবে না কেন? মুসলমান তার আরব-ইরানি বা মুসলমানি পরিচয়কেই একমাত্র পরিচয়ে রূপান্তর করলে, সিন্ধু নদের অধিবাসীদের ইতিহাস বিস্মৃত হলে এবং তার ভূগোল ও প্রকৃতিকে অস্বীকার করলে হিন্দুও হিন্দুই হবে। আর কী হতে পারত!
রাজনীতি একদিকে খুবই সহজ-সরল বোধ ও উপলব্ধির ওপর দাঁড়ায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা দর্শনের গালভরা ইংরেজি নামও আছে। ইথোস, পলিটি ইত্যাদি। অন্যদিকে যখন সেই বোধের ওপর জং ধরে এবং আমরা আমাদের বুদ্ধি, বিবেক, হুঁশজ্ঞান বিস্মৃত হই, তখন রাজনীতি খুবই কঠিন একটা ব্যাপার হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে কঠিন কাজ সহজ ও সরলভাবে ভাবতে শেখা। সমাজকে সমাজ হিসেবেই তার বৈচিত্র্য, বিভিন্নতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতসহ বোঝার চেষ্টা করা। নিজের মনগড়া ধ্যান-ধারণা ও কেচ্ছাকাহিনী বয়ে বেড়ালে রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়বেই। বাঁকা চিন্তা নিয়ে বাঁকা পথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা বঙ্কিম হয়ে গিয়েছি। কুকুরের লেজের মতো। সোজা করে ধরলে সেটা আবার গোল হয়ে পেঁচিয়ে যায়। তারপর আবার নড়ে, নাড়ায়! আশ্চর্য! অকুল সাগরে খাবি খাচ্ছি আমরা। সামনে কী? বঙ্গোপসাগর।
দুই হতাশা দিয়ে কোনো লেখা শেষ করা আমার ধাতে নাই। আমি মনে করি, এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব। ভাবগম্ভীর কথা না বলে কাজের কথায় আসি।
শেখ হাসিনার সরকার নৈতিক ও সাংবিধানিক দুই দিক থেকেই অবৈধ। সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে অনেকে তর্ক করেন। তারা বলেন, ঠিক আছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আদর্শ নির্বাচন নয়, কিন্তু এটা সাংবিধানিকভাবে বৈধ। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল, নির্বাচন হয়েছে। যারা আসেনি, সেটা তাদের সমস্যা।
এই তর্ক ধোপে টেকে না। কারণ সংবিধান বদলিয়েছেন শেখ হাসিনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না করে তাকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, জনগণকে ভোট দেয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিশালসংখ্যক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এটাকে নির্বাচন বলে না। নির্বাচনের জন্য সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মানে নির্বাচনের নামে তামাশা করা নয়। ক্ষমতাসীনরা অতএব অনৈতিক ও অসাংবিধানিক।
নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক মহলে দুটি ধারা আমরা লক্ষ করি। একদিকে দিল্লির অবস্থান। তার সার কথা কী? সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল, নির্বাচন হয়ে গিয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হলে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন থাকা জরুরি। বিশেষত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। এখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড- বিশেষত ব্যবসা ও বিনিয়োগই বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে।
দ্বিতীয় ধারা দিল্লিবিরোধী। বিশেষত মার্কিন ও ইউরোপীয় দেশগুলো যে ধারার সমর্থক। তারা নির্বাচনকে গ্রহণ করেনি। তাদের যুক্তি হচ্ছে, বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার একটাই পথ। সেটা হচ্ছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে সব পক্ষকে ধরে রাখা।
শুরুতে দ্বিতীয় ধারার পক্ষেই আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ভারী ছিল। বিরোধী দল যদি এই সময়টা কাজে লাগাত, তাহলে আরেকটি নির্বাচন ক্ষমতাসীনরা দিতে বাধ্য হতো। কিন্তু বিরোধী রাজনীতি আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। কেন তারা সরে দাঁড়ালেন তার কারণ বোঝা মুশকিল। ইতিমধ্যে বেশ বড় একটা সময় কেটে গিয়েছে। এখনও অনিশ্চয়তার মধ্যেই সবকিছু আন্দোলিত হচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা প্রশাসনিক, বিচার ও বল প্রয়োগের সব হাতিয়ার নিয়ে অনেক বেশি সংগঠিত। গণমাধ্যম স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সবার পক্ষে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না, এই থিসিস মূলত বিরোধী দলের অদূরদর্শিতার কারণে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। অস্থিতিশীলতা কোথায়? শেখ হাসিনা পিটিয়ে সব ঠাণ্ডা করে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মহল নৈতিকতা ও বৈধতা নিয়ে কথা বলে বটে; কিন্তু তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে এই মুহূর্তে দরকার শেখ হাসিনার সরকার।
আন্তর্জাতিক মহলে এই ভাবনা শুরু হয়েছে যে, ক্ষমতাসীনরা উন্নয়নে মনোযোগ দিলে এবং তাদের জন্য উপযুক্ত আন্তর্জাতিক সহায়তা দেয়া হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। দিল্লির থিসিস সত্য প্রমাণিত হতে চলেছে।
কিন্তু এসবই তো ফের হতাশার কথাই হল। ঠিক। আশার কথা হচ্ছে, যদি সেটা সত্য হয়, তাহলে বিরোধী রাজনীতির মধ্যে এই হুঁশ ফিরে আসতে দেরি হওয়ার কথা নয় যে, আন্দোলন ছাড়া তাদের আর কোনো গতি নাই। দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলনে তাদের জনগণের ওপরই নির্ভর করতে হবে, কোনো বিদেশী শক্তির ওপর নয়। এর অর্থ কী?
সামাজিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির বিদেশ-নির্ভরতা কমতে পারে। বাধ্য হয়ে। বিএনপিকে তার ঘর গোছাতে হবে। সংগঠনের সংস্কার নির্বাচনী দল হিসেবে গোছালে হবে না। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার সাংগঠনিক শক্তি বিকাশের দরকারে গোছাতে হবে। বিএনপিকে এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এর আগে হতে হয়নি। নির্বাচনী দল থেকে বিএনপি আন্দোলনের দল হতে পারবে কি? কে জানে! তবুও দেখা যাক। ঠেকায় পড়ে অনেক কিছুই ঘটানো যায়।
দ্বিতীয়ত, এর ফলে দলে যারা আন্দোলন চায় না, নির্বাচন চায়; আর যারা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক বিকাশ চায় তাদের মধ্যে বিরোধ প্রকট হবে। এটা বিএনপির জন্য ইতিবাচক হতে পারে। বিএনপি দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসে গণতান্ত্রিক রাজনীতির কাতারে শামিল হতে বাধ্য হবে কি-না জানি না, কিন্তু একটা শর্ত তৈরি হবে যা বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ খানিকটা ঠিক করে দেবে। তার মানে বিএনপিতে জেল-জুলুম খাটা কর্মীদের অবস্থান শক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে হলফ করে বলতে পারি না, কিন্তু এছাড়া বিএনপির আর বিকল্প কী? সংগঠন হিসেবে ক্ষয়ে যাওয়া, ক্ষয় ত্বরান্বিত হওয়া। বিএনপি নিশ্চয়ই সেটা চাইবে না।
তৃতীয়ত, বিএনপি তার জোটের শরিকদের সঙ্গে মতাদর্শিক আলোচনা করতে বাধ্য হবে। এটা আশা করা অতি আশা বলে মনে হয় না। নির্বাচনী মোর্চা এক জিনিস, আর আন্দোলন-সংগ্রামের মৈত্রী ভিন্ন ব্যাপার। আমার যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভেজাব না ধরনের সুবিধাবাদী রাজনীতি বিএনপি পরিহার করতে বাধ্য হবে। ইসলামপন্থীদের নিয়ে যদি গণতান্ত্রিক কিংবা লিবারেল রাজনীতি বিএনপি করতে চায়, তাহলে ইসলাম প্রশ্নে তার রাজনীতি সুস্পষ্ট করতে হবে। ইসলামপন্থীরা রাস্তায় প্রাণ দেবে আর বিএনপির দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজরা এমপি-মন্ত্রী হয়ে আবার লুটতরাজ করবে সেটা ইসলামপন্থীরা এখন চাইবে কিনা সন্দেহ।
ধরা যাক বিএনপি কিছুই করল না। তাহলে? সেক্ষেত্রে? ক্ষমতাসীনরা বিএনপির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার জন্য সব কিছুই করবে। তারপর জামায়াতে ইসলামীকেও। নিষিদ্ধ করবে কিনা সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু ইসলামপন্থীদের ওপর আওয়ামী দমনপীড়ন কমবে না। বাড়বে।
সেটাও খারাপ হবে না। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের দ্রুত সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে ক্যাটালিস্টের ভূমিকা পালন করবেন। বর্তমান অবস্থা ও ব্যবস্থা থেকে জনগণ মুক্তি চাইছে। প্রধান বিরোধী দল যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে কিছুই বসে থাকবে না। বিরোধী রাজনীতি ভিন্নভাবে সংগঠিত হবে। ইসলামপন্থাই একমাত্র বিকল্প হিসেবে হাজির হবে। বামপন্থার কথা বলা যেত, কিন্তু এই যুগেও তাদের ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলাম আতংক এত প্রবল যে, জাতীয় রাজনীতির হিসাব-নিকাশে পৌঁছাতে হলে তাদের বহু কাঠখড় পাড়ি দিয়ে আসতে হবে। ইনু-মেননের মন্ত্রিত্বের কথা বাদ দিলেও মানসিক ও মতাদর্শিকভাবে তারা তো শেখ হাসিনার সঙ্গেই আছেন।
আর বর্তমানে শেখ হাসিনার চেয়ে বাংলাদেশে ইসলাম দরদি আর কে আছে! আমি তো দেখি না। তিনিই, ইনশাল্লাহ, এ দেশে ইসলামকে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হাজির হওয়ার সব শর্ত পূরণ করে যাবেন।
খারাপ কী? ভালোই তো।
অনেকে খোলাসা করে বলেন না, বলতে চান না বা বলতে ভয় পান। কিন্তু নীরব থাকলেও যে নীরব উৎকণ্ঠা এখন সর্বব্যাপী সেটা হল, এভাবেই কি দেশ চলবে? উত্তর : হ্যাঁ, চলবে। আপনাআপনি কোনো কিছুই বদলায় না। তাছাড়া দেশ খারাপ চলছে কোথায়? দুর্নীতি, দুর্বৃত্তপনা, খুন, গুম-খুন, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, বিরোধী মত ও চিন্তাকে কঠোরভাবে দমন, বিচার বিভাগ ও প্রশাসনকে দলীয় হাতিয়ারে পরিণত করা, বিরোধী দলকে আস্তে আস্তে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া- সবই খারাপ কাজ। আলবৎ। এতে কোনোই সন্দেহ নেই। কিন্তু সেটা তো সরকারবিরোধীদের সমস্যা। সরকারেরও না, দেশেরও না। যদি না দেশ বলতে সুনির্দিষ্টভাবে নাগরিকদের বুঝি।
দেশের সমস্যা কী আসলে? দেশ তো বিমূর্ত কিছু নয়। যদি বর্তমান সমস্যা সমাধানের পথ থাকা সত্ত্বেও নাগরিকরা ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে সরাতে না পারে, কেবল তখনই দেশের সমস্যা কথাটা অর্থপূর্ণ হয়। যদি যাহা বাহান্ন তাহাই তেপ্পান্ন হয়তো ক্ষমতার হাতবদলে দেশের সমস্যার কী সমাধান হবে? যদি বিরোধী রাজনীতির মধ্যে এসবের অবসান ঘটার অঙ্গীকার পাওয়া যেত, তাহলে বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণের রাজনীতি আপনাতেই দানা বাঁধত। তখন অঙ্গীকারকে বাস্তবে রূপ দেয়ার নীতি ও কৌশল নিয়ে কথা উঠত। রাজনীতির ইতিবাচক মেরুকরণ ঘটত। এ কথাগুলো বারবার বলা হয়েছে। কিন্তু বিরোধী রাজনীতি সেসব কথা কানে তোলেনি। ফলে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে। অচিরে এর অবসান ঘটবে তার কোনো কারণ দেখি না।
বিরোধী রাজনীতি বর্তমান অবস্থা থাকে উত্তরণের কথা ভাবছে বা এ বিষয় নিয়ে ভাবনাচিন্তা করতে চায়, তাদের কাছ থেকে এ বিষয়ে ন্যূনতম কোনো প্রতিশ্র“তি পাওয়া গেলে অন্তত চিন্তাভাবনার দিক থেকে পরিস্থিতি বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা শুরু হতো। বিরোধী দল বা জোট কীভাবে তাদের অঙ্গীকার বা প্রতিশ্র“তি বাস্তবায়ন করবে তার নীতি ও কৌশল নিয়ে সমাজে কথাবার্তা শুরু হয়ে যেত, জনগণ কোনো দল বা পক্ষ হিসেবে নয়, একটা রাজনীতির পক্ষে এসে দাঁড়াতে শুরু করত, নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণের প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে যেত। একেই রাজনৈতিক প্রক্রিয়া বলা হয়। যদি আমরা নিশ্চিত হতে পারতাম যে, ক্ষমতাসীনদের বিদায় দিয়ে যাদের আমরা ক্ষমতায় আনতে চাই তারা এমনভাবে দেশ চালাবেন যাতে ওপরে যা কিছু মন্দ ব্যাপারের কথা বলা হল সেসব আর ঘটবে না, তখন পরিস্থিতি ভিন্ন মোড় নিত। না, সেটা বিরোধী রাজনীতির সদিচ্ছার ওপর আমরা ছেড়ে দিতে পারি না। কী ধরনের আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা তারা নেবেন যাতে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তপনা এখনকার মতো দুষ্ট ক্ষতের রূপ নেবে না, সেটা তাদের কংক্রিট ভাষায় বলার জন্যই আমরা বলতে থাকব। যেমন, একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী দুর্নীতি দমন কমিশন গঠন একটি প্রস্তাব হতে পারে। খুন, গুমখুন, আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি বন্ধ করা যাবে কীভাবে? দল, মত, ধর্ম, বিশ্বাস, সম্প্রদায় নির্বিশেষে নাগরিকদের মানবিক অধিকার সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত ও প্রশাসনিকভাবে বলবৎ করার মধ্য দিয়ে; সেটা করতে হলে সংবিধান সংস্কারের দরকার হবে। প্রশাসন ও বিচার বিভাগকে দলীয়করণ থেকে মুক্ত করতে হবে। এগুলো তো অতি প্রাথমিক প্রত্যাশা। এরপর অর্থনৈতিক উন্নতি, কাজ সৃষ্টি ও কর্মোদ্যোগের প্রেরণা তৈরি- ইত্যাদি তো আছেই। সর্বোপরি দিল্লির সঙ্গে সম্পর্কের প্রশ্ন। বাংলাদেশ কি নিজের হিম্মত নিয়ে দাঁড়াতে পারবে?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি কি নতজানু নয়? কিন্তু সেটা তো এখন হয়নি। আজকালের ব্যাপার কি? একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে যে রাষ্ট্রটির জন্ম হয়েছে, প্রথম থেকেই দিল্লি তার ওপর প্রভুত্ব করতে চেয়েছে। এখন হা-হুতাশের কী আছে? ভাগ্য ভালো যে আমি কে তুমি কে বাঙালি বাঙালি বলতে বলতে আমরা পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে এখনও যুক্ত হয়ে যাওয়ার দাবি তুলিনি। আমরা তো একই জাতি। একই আমাদের ভাষা, একই আমাদের সংস্কৃতি। ফলে একত্রিত হয়ে যাওয়াই তো এই জাতির নিয়তির বিধান ছিল। কেন হল না, সেটাই বরং ইতিহাসের সবচেয়ে বড় রহস্য।
ধর্ম? না সেটা অবশ্য এক নয়। অতএব ধর্মই এই একত্রীকরণ প্রক্রিয়া বা ঐক্যের পথে প্রধান বাধা। সব দোষের মূল হিন্দুত্ববাদ! না না, থুক্কু, ইসলাম। ইসলামই বাঙালিদের একত্রিত হওয়ার পথে প্রধান বাধা। এই চিন্তাই তো আমাদের গ্রাস করে থাকে। ফলে আমরা বাঙালি হওয়ার জন্য ইসলামবিদ্বেষী হয়ে যাই, ইসলামোফোবিয়া বা ইসলাম-আতংকে ভুগি। একদল মনে করে, টুপি পরা পাঞ্জাবি পরা মাদ্রাসার ছেলেদের জঙ্গি বলে ধরিয়ে দিয়েই বঙ্গভূমিকে ইসলামমুক্ত রাখা যাবে। বিদেশে ইংরেজের দেশে বড় হওয়া ছেলেমেয়ে- যারা আরবি বা নিজের মাতৃভাষার মধ্য দিয়ে ইসলামের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পর্যন্ত পায়নি- দেখি যে তারা কড়া ইসলামপন্থায় বিশ্বাসী হয়ে উঠেছে। বিশ্ব পরিস্থিতির মধ্যে কী এমন বদল ঘটছে, যার ফলে বড় একটি জেনারেশনের রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার অভিমুখ এত তাড়াতাড়ি বদলে গেল! না, আমাদের সেটা বোঝার সময় নাই। চতুর্দিকে আমরা শুধু ইসলামী জঙ্গির ভূত দেখি।
এর পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় আমরা আবার অতিরিক্ত মুসলমান বনে যাই, বাংলা সংস্কৃতি মানেই যে হিন্দুর সংস্কৃতি এ কথা বলতে আমাদের মুখে বাধে না। বাঙালির সংস্কৃতির কথা শুনলেই মনে করি এ দেশ হিন্দুদের দেশ হয়ে গিয়েছে। আমাদের ভাব হয়, আমরা বুঝি এইমাত্র মদিনা থেকে খেজুর খেতে খেতে ঢাকায় এসে নেমেছি। এ দেশের ভূগোল, তার প্রাণ ও প্রকৃতি, তার খাদ্য ব্যবস্থা, সংস্কৃতি- সবকিছুর মধ্যেই হিন্দুয়ানা আবিষ্কার করা দ্বীনি কর্তব্য হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের মধ্যে আমরা মরুভূমি খুঁজতে থাকি। খুঁজে না পেয়ে অস্থির হয়ে যাই। ভুলে যাই, সিন্ধু থেকে হিন্দু- আর সিন্ধু নদীর এপাশে যারা বাস করে তারা সবাই হিন্দু। এটা হিন্দুদেরই দেশ। ধর্ম, বর্ণ, জাত, লিঙ্গ নির্বিশেষে সবাই হিন্দু। হিন্দু একসময় কোনো ধর্মের নাম ছিল না। সেই ইতিহাস আমরা ভুলে গিয়েছি। মুসলমানরাই এই উপমহাদেশের নাম রেখেছে হিন্দুস্তান। তাই না? সিন্ধু নদের এপাশের অধিবাসীদের হিন্দু বলতে বলতে অবশেষে ধর্ম হিসেবে এর রূপান্তর ঐতিহাসিক বাস্তবতা। এটা এখন আর শুধু ধর্ম মাত্র নয়। পরিচয়েরও সূত্র। আমি যদি মুসলমান হই তো সে হিন্দু হবে না কেন? মুসলমান তার আরব-ইরানি বা মুসলমানি পরিচয়কেই একমাত্র পরিচয়ে রূপান্তর করলে, সিন্ধু নদের অধিবাসীদের ইতিহাস বিস্মৃত হলে এবং তার ভূগোল ও প্রকৃতিকে অস্বীকার করলে হিন্দুও হিন্দুই হবে। আর কী হতে পারত!
রাজনীতি একদিকে খুবই সহজ-সরল বোধ ও উপলব্ধির ওপর দাঁড়ায়। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বা দর্শনের গালভরা ইংরেজি নামও আছে। ইথোস, পলিটি ইত্যাদি। অন্যদিকে যখন সেই বোধের ওপর জং ধরে এবং আমরা আমাদের বুদ্ধি, বিবেক, হুঁশজ্ঞান বিস্মৃত হই, তখন রাজনীতি খুবই কঠিন একটা ব্যাপার হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে কঠিন কাজ সহজ ও সরলভাবে ভাবতে শেখা। সমাজকে সমাজ হিসেবেই তার বৈচিত্র্য, বিভিন্নতা ও দ্বন্দ্ব-সংঘাতসহ বোঝার চেষ্টা করা। নিজের মনগড়া ধ্যান-ধারণা ও কেচ্ছাকাহিনী বয়ে বেড়ালে রাজনীতিতে তার প্রভাব পড়বেই। বাঁকা চিন্তা নিয়ে বাঁকা পথে হাঁটতে হাঁটতে আমরা বঙ্কিম হয়ে গিয়েছি। কুকুরের লেজের মতো। সোজা করে ধরলে সেটা আবার গোল হয়ে পেঁচিয়ে যায়। তারপর আবার নড়ে, নাড়ায়! আশ্চর্য! অকুল সাগরে খাবি খাচ্ছি আমরা। সামনে কী? বঙ্গোপসাগর।
দুই হতাশা দিয়ে কোনো লেখা শেষ করা আমার ধাতে নাই। আমি মনে করি, এ অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব। ভাবগম্ভীর কথা না বলে কাজের কথায় আসি।
শেখ হাসিনার সরকার নৈতিক ও সাংবিধানিক দুই দিক থেকেই অবৈধ। সাংবিধানিক বৈধতা নিয়ে অনেকে তর্ক করেন। তারা বলেন, ঠিক আছে ৫ জানুয়ারির নির্বাচন আদর্শ নির্বাচন নয়, কিন্তু এটা সাংবিধানিকভাবে বৈধ। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল, নির্বাচন হয়েছে। যারা আসেনি, সেটা তাদের সমস্যা।
এই তর্ক ধোপে টেকে না। কারণ সংবিধান বদলিয়েছেন শেখ হাসিনা। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না করে তাকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, জনগণকে ভোট দেয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বিশালসংখ্যক প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। এটাকে নির্বাচন বলে না। নির্বাচনের জন্য সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মানে নির্বাচনের নামে তামাশা করা নয়। ক্ষমতাসীনরা অতএব অনৈতিক ও অসাংবিধানিক।
নির্বাচনের পর আন্তর্জাতিক মহলে দুটি ধারা আমরা লক্ষ করি। একদিকে দিল্লির অবস্থান। তার সার কথা কী? সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ছিল, নির্বাচন হয়ে গিয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে হলে শেখ হাসিনার সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন থাকা জরুরি। বিশেষত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে। এখন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড- বিশেষত ব্যবসা ও বিনিয়োগই বাংলাদেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখবে।
দ্বিতীয় ধারা দিল্লিবিরোধী। বিশেষত মার্কিন ও ইউরোপীয় দেশগুলো যে ধারার সমর্থক। তারা নির্বাচনকে গ্রহণ করেনি। তাদের যুক্তি হচ্ছে, বাংলাদেশের স্থিতিশীলতার একটাই পথ। সেটা হচ্ছে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন এবং নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির পথে সব পক্ষকে ধরে রাখা।
শুরুতে দ্বিতীয় ধারার পক্ষেই আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ভারী ছিল। বিরোধী দল যদি এই সময়টা কাজে লাগাত, তাহলে আরেকটি নির্বাচন ক্ষমতাসীনরা দিতে বাধ্য হতো। কিন্তু বিরোধী রাজনীতি আন্দোলন থেকে সরে দাঁড়ায়। কেন তারা সরে দাঁড়ালেন তার কারণ বোঝা মুশকিল। ইতিমধ্যে বেশ বড় একটা সময় কেটে গিয়েছে। এখনও অনিশ্চয়তার মধ্যেই সবকিছু আন্দোলিত হচ্ছে। ক্ষমতাসীনরা প্রশাসনিক, বিচার ও বল প্রয়োগের সব হাতিয়ার নিয়ে অনেক বেশি সংগঠিত। গণমাধ্যম স্বেচ্ছায় বা বাধ্য হয়ে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে সবার পক্ষে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা আসবে না, এই থিসিস মূলত বিরোধী দলের অদূরদর্শিতার কারণে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। অস্থিতিশীলতা কোথায়? শেখ হাসিনা পিটিয়ে সব ঠাণ্ডা করে দিয়েছেন। আন্তর্জাতিক মহল নৈতিকতা ও বৈধতা নিয়ে কথা বলে বটে; কিন্তু তারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছে যে এই মুহূর্তে দরকার শেখ হাসিনার সরকার।
আন্তর্জাতিক মহলে এই ভাবনা শুরু হয়েছে যে, ক্ষমতাসীনরা উন্নয়নে মনোযোগ দিলে এবং তাদের জন্য উপযুক্ত আন্তর্জাতিক সহায়তা দেয়া হলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে। দিল্লির থিসিস সত্য প্রমাণিত হতে চলেছে।
কিন্তু এসবই তো ফের হতাশার কথাই হল। ঠিক। আশার কথা হচ্ছে, যদি সেটা সত্য হয়, তাহলে বিরোধী রাজনীতির মধ্যে এই হুঁশ ফিরে আসতে দেরি হওয়ার কথা নয় যে, আন্দোলন ছাড়া তাদের আর কোনো গতি নাই। দ্বিতীয়ত, এই আন্দোলনে তাদের জনগণের ওপরই নির্ভর করতে হবে, কোনো বিদেশী শক্তির ওপর নয়। এর অর্থ কী?
সামাজিকভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে বিএনপির বিদেশ-নির্ভরতা কমতে পারে। বাধ্য হয়ে। বিএনপিকে তার ঘর গোছাতে হবে। সংগঠনের সংস্কার নির্বাচনী দল হিসেবে গোছালে হবে না। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার সাংগঠনিক শক্তি বিকাশের দরকারে গোছাতে হবে। বিএনপিকে এ ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি এর আগে হতে হয়নি। নির্বাচনী দল থেকে বিএনপি আন্দোলনের দল হতে পারবে কি? কে জানে! তবুও দেখা যাক। ঠেকায় পড়ে অনেক কিছুই ঘটানো যায়।
দ্বিতীয়ত, এর ফলে দলে যারা আন্দোলন চায় না, নির্বাচন চায়; আর যারা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক বিকাশ চায় তাদের মধ্যে বিরোধ প্রকট হবে। এটা বিএনপির জন্য ইতিবাচক হতে পারে। বিএনপি দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে এসে গণতান্ত্রিক রাজনীতির কাতারে শামিল হতে বাধ্য হবে কি-না জানি না, কিন্তু একটা শর্ত তৈরি হবে যা বাংলাদেশের রাজনীতির ভবিষ্যৎ খানিকটা ঠিক করে দেবে। তার মানে বিএনপিতে জেল-জুলুম খাটা কর্মীদের অবস্থান শক্ত হওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে হলফ করে বলতে পারি না, কিন্তু এছাড়া বিএনপির আর বিকল্প কী? সংগঠন হিসেবে ক্ষয়ে যাওয়া, ক্ষয় ত্বরান্বিত হওয়া। বিএনপি নিশ্চয়ই সেটা চাইবে না।
তৃতীয়ত, বিএনপি তার জোটের শরিকদের সঙ্গে মতাদর্শিক আলোচনা করতে বাধ্য হবে। এটা আশা করা অতি আশা বলে মনে হয় না। নির্বাচনী মোর্চা এক জিনিস, আর আন্দোলন-সংগ্রামের মৈত্রী ভিন্ন ব্যাপার। আমার যেমন বেণী তেমনি রবে চুল ভেজাব না ধরনের সুবিধাবাদী রাজনীতি বিএনপি পরিহার করতে বাধ্য হবে। ইসলামপন্থীদের নিয়ে যদি গণতান্ত্রিক কিংবা লিবারেল রাজনীতি বিএনপি করতে চায়, তাহলে ইসলাম প্রশ্নে তার রাজনীতি সুস্পষ্ট করতে হবে। ইসলামপন্থীরা রাস্তায় প্রাণ দেবে আর বিএনপির দুর্বৃত্ত ও দুর্নীতিবাজরা এমপি-মন্ত্রী হয়ে আবার লুটতরাজ করবে সেটা ইসলামপন্থীরা এখন চাইবে কিনা সন্দেহ।
ধরা যাক বিএনপি কিছুই করল না। তাহলে? সেক্ষেত্রে? ক্ষমতাসীনরা বিএনপির মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়ার জন্য সব কিছুই করবে। তারপর জামায়াতে ইসলামীকেও। নিষিদ্ধ করবে কিনা সেটা এখনও স্পষ্ট নয়। কিন্তু ইসলামপন্থীদের ওপর আওয়ামী দমনপীড়ন কমবে না। বাড়বে।
সেটাও খারাপ হবে না। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের দ্রুত সংগঠিত হওয়ার ক্ষেত্রে ক্যাটালিস্টের ভূমিকা পালন করবেন। বর্তমান অবস্থা ও ব্যবস্থা থেকে জনগণ মুক্তি চাইছে। প্রধান বিরোধী দল যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে কিছুই বসে থাকবে না। বিরোধী রাজনীতি ভিন্নভাবে সংগঠিত হবে। ইসলামপন্থাই একমাত্র বিকল্প হিসেবে হাজির হবে। বামপন্থার কথা বলা যেত, কিন্তু এই যুগেও তাদের ইসলাম বিদ্বেষ ও ইসলাম আতংক এত প্রবল যে, জাতীয় রাজনীতির হিসাব-নিকাশে পৌঁছাতে হলে তাদের বহু কাঠখড় পাড়ি দিয়ে আসতে হবে। ইনু-মেননের মন্ত্রিত্বের কথা বাদ দিলেও মানসিক ও মতাদর্শিকভাবে তারা তো শেখ হাসিনার সঙ্গেই আছেন।
আর বর্তমানে শেখ হাসিনার চেয়ে বাংলাদেশে ইসলাম দরদি আর কে আছে! আমি তো দেখি না। তিনিই, ইনশাল্লাহ, এ দেশে ইসলামকে প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হাজির হওয়ার সব শর্ত পূরণ করে যাবেন।
খারাপ কী? ভালোই তো।
No comments