হতাশ অনুপ চেটিয়া
বাংলাদেশের কারাগারে দীর্ঘদিন ধরে বন্দী উত্তর-পূর্ব ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া দেশে ফিরতে না পেরে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছেন। ভারতীয় হাই কমিশনের মাধ্যমে কাশিমপুরের হাইসিকিউরিটি সেল থেকে পররাষ্ট্র সচিবের কাছে লেখা চিঠিতে অনুপ চেটিয়া বলেছেন,‘‘২০১৩ সালের ১৩ মে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারে অবস্থানরত অবস্থায় কারা মহাপরিদর্শকের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছে দাখিলকৃত রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাহার করে নিজ জন্মভূমিতে প্রত্যাবর্তনের জন্য আবেদন করেছিলাম। মহোদয়, সুদীর্ঘদিন সাক্ষাৎকারবিহীন বন্দিত্বের মধ্যে নিদারুণ কষ্টকর জীবন অতিবাহিত করে এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে পরিত্রাণের অসীম প্রত্যাশায়, আত্মীয়-স্বজনের কাছে ফিরে যাবো এ বিশ্বাস নিয়ে মনের মধ্যে উচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু অদ্যাবধি আমাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না নেয়ায় আমরা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছি। এমন অবস্থায় আমার দুই সহযোগী বন্দিসহ আমাদেরকে জন্মভূমিতে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মহোদয় সমীপে পুনরায় সবিনয় অনুরোধ জানাচ্ছি।’’ অনুপ চেটিয়ার দুই সহচর লক্ষ্মীপ্রসাদ গোস্বামী ও বাবুল শর্মাও ভারতে ফেরার জন্য আবেদন জানিয়েছেন। তাদের দেশে ফেরার আগ্রহের চিঠিগুলোর ভিত্তিতে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের পক্ষ থেকে পরষ্ট্র সচিবকে একটি চিঠি দেয়া হয়েছে। সে চিঠিতে দুই সহযোগীসহ অনুপ চেটিয়াকে দ্রুত ফেরত পাঠানানোর আবেদন জানানো হয়েছে। তাদের ফেরতের বিষয়টি সর্বোচ্চ মানবিক বিবেচনায় দেখার অনুরোধ করেছে ভারতীয় হাইকমিশন। পাশাপাশি তিন বন্দীর সঙ্গে ৩০ নভেম্বরের পরও সাক্ষাতের অনুমতি বহাল রাখার অনুরোধ করেছে। ওই চিঠির সঙ্গে অনুপ চেটিয়াসহ তিনজনের নিজ দেশে ফেরার আগ্রহ সংক্রান্ত চিঠি জুড়ে দেয়া হয়েছে। অনুপ চেটিয়া ইতিমধ্যেই বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য করা আবেদন প্রত্যাহারের অনুরোধ করে দুই দফা দেশে ফেরার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। দীর্ঘ ১৬ বছর পর সংবাদ মাধ্যমে খোলা চিঠি দিয়েও তার দেশের ফেরার আগ্রহের কথা প্রকাশ করেছিলেন অনুপ চেটিয়া। এর আগে গত জুনে অনুপ চেটিয়ার স্ত্রী মণিকা, বাবুল শর্মার ভাই দীপক শর্মা, লক্ষ্মী প্রসাদের ভাই পরিলক্ষ প্রসাদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দুই দেশের পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তাদের দেশে ফেরানোর জন্য আবেদন করেন। এর ভিত্তিতে ১১ নভেম্বর ভারতীয় হাই কমিশনের কর্মকর্তা জেপি সিং অনুপ চেতিয়াসহ তিন বন্দীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। সে সময় তার কাছে দেশে ফেরার আগ্রহ সম্বলিত আবেদনপত্র দেন তারা। এদিকে ভারতীয় হাইকমিশনের একটি সূত্র জানায়, অনুপ চেটিয়া ও তার দেহরক্ষী বাবুল শর্মাকে দেশে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া চালানো হচ্ছে। অনুপ চেটিয়ার অপর দেহরক্ষী লক্ষ্মী প্রসাদের বিষয়ে ভারত সরকারের আগ্রহ নেই। তবে কী কারণে লক্ষ্মী প্রসাদের বিষয়ে আগ্রহ নেই সে বিষয়ে জানায়নি ওই সূত্রটি। সূত্রটি জানায়, একারণে লক্ষ্মীপ্রসাদ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তিনি হার্টের সমস্যাসহ উচ্চ রক্তচাপ, ডিপ্রেশনে ভুগছেন। কামিশপুর কারাগারে দেখা করতে গেলে হাইকমিশনের কর্মকর্তাদের কাছে দেশে ফেরার আকুতি জানিয়ে ভেঙে পড়েন লক্ষ্মী প্রসাদ। পররাষ্ট্র সচিবের কাছে লেখা অনুপ চেটিয়ার সহচর লক্ষ্মীপ্রসাদ গোস্বামী তার চিঠিতে লিখেছেন, ‘‘আমি লক্ষ্মীপ্রসাদ গোস্বামী। সংযুক্ত মুক্তি বাহিনীর সদস্য (উলফা)। ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর অনুপ চেটিয়াসহ বাংলাদেশ আমাকে গ্রেফতার করে। আমি অনুপ চেটিয়াসহ বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন করেছি। কিন্তু সদুত্তর পাইনি। বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনে আমার পরিবার ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল। এ প্রেরণাই আমি আমার সংগঠনের করা আসামের স্বাধীনতা আন্দোলনে জড়িত হই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপ্রেরণা নিয়ে। এখন ১৬টা বছর ধরে কারাগারে বন্দি জীবনযাপন করছি। বন্দিত্ব অবস্থায় আমার পরিবারের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ পর্যন্ত করা যাচ্ছে না। এখন আমার সংগঠন ভারত সরকারের সঙ্গে আলোচনা করছে। তাই আমি আবেদন করছি আমার সম্মানজনক প্রত্যাবর্তন। সেটা অবশ্যই যেন রাজনৈতিকভাবে হয়।’’ লক্ষী প্রসাদ ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাসা থেকে অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে গ্রেফতার হন। ২০০৭ সালের ২৭ নভেম্বর তার সাজার মেয়াদ শেষ হয়। সেই থেকে তিনি দেশের বিভিন্ন কারাগারে নিরাপত্তা হেফাজতে রয়েছেন। সর্বশেষ ময়মনসিংহ কারাগার থেকে কাশিমপুর কারাগারে আনা হয়। অপর সহচর বাবুল শর্মা ইংরেজিতে লেখা আবেদনে বলেছেন, ১৯৯৮ সালে ৮ আগস্ট রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেছিলাম। ওই আবেদন প্রত্যাহার করে নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই। জাতির বৃহত্তর স্বার্থ ও পরিবারের কথা চিন্তা করে এ সিদ্ধান্ত নিয়েছি। ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাসা থেকে অনুপ চেটিয়াকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এরপর তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান এবং অবৈধভাবে বিদেশি মুদ্রা ও একটি স্যাটেলাইট ফোন রাখার অভিযোগে তিনটি মামলা হয়। পরে তিনটি মামলায় তাকে যথাক্রমে ৩, ৪ ও ৭ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় বাংলাদেশের আদালত। ২০০৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তার সাজার মেয়াদ শেষ হয়। অতীতে বিভিন্ন সময়ে অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করার জন্য ওই দেশের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে ২০০৩ সালের ২৩ আগস্ট হাইকোর্টে আবেদন করেন অনুপ চেটিয়া। এ কারণে তাকে হস্তান্তরে আইনি জটিলতা ও দুই দেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি না থাকার কথাও বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল। বর্তমান সরকার আমলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি হয়েছে। কিন্তু এখনো এ চুক্তির আওতায় দুই দেশের কোনো বন্দী বিনিময় হয়নি।
No comments