রাজনৈতিক চাপে ব্যাংক কিনছে খেলাপি ঋণ



রাজনৈতিক চাপে এক হাজার ২০০ কোটি টাকার কু বা মন্দ ঋণ কিনেছে সরকারি খাতের তিন ব্যাংক, যা আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এসব ঋণের বিপরীতে কোনো জামানতও নেই। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি ৯৫০ কোটি টাকার মন্দ ঋণ কিনেছে সরকারি জনতা ব্যাংক। এরপর জালিয়াতির ঘটনায় দুর্বল বেসিক ব্যাংক প্রায় ১৫০ কোটি এবং অপর সরকারি সোনালী ব্যাংক কিনেছে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ঋণ। এর বিপরীতে আরও নতুন ঋণ দিয়ে এসব ব্যাংক সেগুলোকে নবায়নও করেছে। বর্তমানে ওইসব ঋণের বেশির ভাগই খেলাপি। এর বাইরে নতুন ও পুরনো আরও কিছু ব্যাংক মন্দ ঋণ কিনে নবায়ন করেছে। কিন্তু তা নিয়মিত হিসাবে ধরে রাখতে না পারায় আবার খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, সরকারি ব্যাংকগুলোর ওপর সব সময়ই রাজনৈতিক চাপ থাকে। আগে ছিল ঋণ দেয়া ও খেলাপি ঋণ নবায়ন করার চাপ। সাম্প্রতিক সময়ে এই চাপের পাশাপাশি আরও একটি চাপ আসতে শুরু করেছে, তা হল অন্য ব্যাংকের মন্দ ঋণ কেনা। কোনো উদ্যোক্তা হয়তো বেসরকারি ব্যাংকে খেলাপি হয়ে আছে। নতুন ঋণ পাচ্ছে না। তখন রাজনৈতিক চাপ সৃষ্টি করে এটি সরকারি ব্যাংক দিয়ে কেনায়। ঋণের সীমা বাড়িয়ে আরও নতুন ঋণ নেয়। এভাবে তারা বেসরকারি ও সরকারি দুই ব্যাংকই খাচ্ছে।
সম্প্রতি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শীর্ষ নির্বাহীদের সঙ্গে এক বৈঠকে ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী মন্দ ঋণ কেনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘ব্যাংকগুলো সাম্প্রতিক সময়ে অনেক মন্দ ঋণ কিনছে। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদ্বিগ্ন। কোনোক্রমেই মন্দ ঋণ কেনা যাবে না। ঋণ কেনার আগে অবশ্যই এর গুণগত মান যাচাই করে নিতে হবে।’ ওই বৈঠকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমানও মন্দ ঋণ কেনার বিষয়ে ব্যাংকগুলোর প্রতি কঠোর হুশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন।
ঋণ কেনাবেচা : ব্যাংকগুলোতে বর্তমানে যে কোনো পণ্যের মতো ঋণ কেনাবেচা হয়। এক্ষেত্রে ঋণের গুণগত মান বিবেচনা করেই ঋণ বেচাকেনার সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাংক। ঋণ কিনতে হয় নগদ টাকার বিনিময়ে। যে ব্যাংক থেকে ঋণ কেনা হবে ওই ব্যাংকে ঋণের সুদসহ সমুদয় টাকা পরিশোধ করে দিলে গ্রাহককে ওই ব্যাংক ঋণের দায় থেকে অব্যাহতি দেয়। ঋণটি চলে আসে যে ব্যাংক কিনল সেখানে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর ভালো গ্রাহকের বা আদায়যোগ্য ঋণ কেনার কথা। কিন্তু তা না করে রাজনৈতিক প্রভাবে এসব ব্যাংক অবাধে কিনছে মন্দ ঋণ।
সূত্র মতে, যেসব গ্রাহক খেলাপি হয়ে নতুন ঋণ পাচ্ছেন না, তারা রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে সরকারি ব্যাংকগুলোকে তাদের মন্দ ঋণ কেনাতে বাধ্য করছে। পরে তা বিশেষ বিবেচনায় হয়ে যাচ্ছে নিয়মিত ঋণ। আগে ঋণটি খেলাপি হওয়ায় গ্রাহক নতুন ঋণ পাচ্ছিল না। নতুন ব্যাংকে আসার পর বেড়ে যাচ্ছে ঋণের সীমা। তখন গ্রাহক আরও বেশি নতুন ঋণ পাচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় কিছুদিন চলার পর তারা আবার খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। মাঝপথে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে ঋণের নামে মোটা অংকের টাকা।
এদিকে এই প্রক্রিয়ায় ঋণ কেনাবেচার সুযোগ করে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকও খেলাপি ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দিচ্ছে। এই সুযোগে গত কয়েক বছর ধরে নতুন ব্যাংকগুলো ব্যাপক হারে আগের ঋণ কিনেছে। তারা সেসব গ্রাহককেই আরও ঋণ দিয়ে ব্যবসা করার সুযোগ দিয়েছে। এভাবে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপে ঋণ কেনাবেচার মাধ্যমে অসাধু কিছু উদ্যোক্তা বেসরকারি ব্যাংকের পাশাপাশি সরকারি ব্যাংক থেকেও মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
সোনালী ব্যাংক : রাজনৈতিক বিবেচনায় আগে সবচেয়ে বেশি ঋণ কিনত সোনালী ব্যাংক। এখানে রাজনৈতিক ঋণ গ্রহীতাদের একটি তালিকাই রয়েছে। যাদের সরকার বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিআইপি ট্রিটমেন্ট দেয়ার প্রবণতা শুরু হয়ে যায়। ওইসব ভিআইপির মন্দ ঋণ এবং জালজালিয়াতির ভারে আক্রান্ত হয়ে সোনালী ব্যাংক এখন আর তাদের ভার বহন করতে পারছে না। ফলে এই ব্যাংকে এখন ঋণ কেনার চাপও কিছুটা কমেছে। আর্থিক দুরবস্থার কারণে ব্যাংক এখন যেসব খেলাপিকে নতুন ঋণ সুবিধা দিতে পারছে না, তাদের ঋণ সরকারের চাপে অন্য ব্যাংক কিনে নিচ্ছে।
সোনালী ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে অভ্যন্তরীণ বিল বা বৈদেশিক বিল কিনছে। এর মধ্যে অনেক বিল ভুয়া বলে ধরা পড়েছে। ফলে ওইসব বিলের বিপরীতে এখন আর টাকা আদায় হচ্ছে না। ওইগুলো খেলাপি হয়ে পড়েছে। এভাবে চারটি শাখায় প্রায় ১০০ কোটি টাকার ভুয়া বিল ধরা পড়েছে। এর মধ্যে ঢাকার স্থানীয় কার্যালয়ে ৩২ কোটি, বৈদেশিক বাণিজ্য শাখায় ৩ কোটি, রমনা কর্পোরেট শাখায় ১২ কোটি, আগ্রাবাদ শাখায় ৫১ কোটি টাকার ভুয়া বিল রয়েছে। এগুলো নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ও দুর্নীতি দমন কমিশন তদন্ত করছে।
সূত্র জানায়, হলমার্ক জালিয়াতির সময়ে সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা হোটেল শাখায়ও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। ওই সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ইস্যু করা বিল ক্রয় বা গ্যারান্টি দিয়েছিল শাখাটি।
এ প্রসঙ্গে সোনালী ব্যাংকের এমডি প্রদীপ কুমার দত্ত যুগান্তরকে বলেন, আগের কিছু অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। নতুন করে এখন আর এসব প্রশ্রয় দেয়া হচ্ছে না। ফলে ব্যাংকের কিছু দুর্বলতা ছিল সেগুলো কাটিয়ে এখন আমরা ভালোর দিকে যাচ্ছি। আশা করি দ্রুতই ক্ষতগুলো কটিয়ে উঠতে পারব।
জনতা ব্যাংক : জনতা ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা আগে থেকেই কিছুটা ভালো হওয়ায় রাজনৈতিক চাপে ঋণ কেনার তদবির এই ব্যাংকেই সবচেয়ে বেশি। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সময়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ ৯৫০ কোটি টাকার ঋণ কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। এ প্রসঙ্গে ব্যাংকের একজন শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা যুগান্তরকে জানান, ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা আগে যথেষ্ট ভালো ছিল। কিন্তু ব্যাপক হারে মন্দ ঋণ কেনায় ছন্দপতন ঘটেছে। অবশ্য তার দাবি, তারা নিয়মিত ঋণগুলো কিনেছেন। কোনো মন্দ ঋণ কেনেনি। ঋণ আগে কি ছিল তা দেখার বিষয় নয়। তারা যখন কিনেছেন তখন তা নিয়মিত ছিল। ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, নগদ টাকায় কেনা বেশির ভাগ ঋণের বিপরীতেই এখন যথেষ্ট জামানত নেই। কিস্তি আদায় হচ্ছে না। কিছু ঋণের মেয়াদ ও সীমা বাড়িয়েও নিয়মিত রাখা যাচ্ছে না।
সূত্র জানায়, ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে জনতা ব্যাংক কিনেছে ২৫০ কোটি টাকার একটি ঋণ। রাজনৈতিক চাপে ব্যাংক এই ঋণ কিনতে বাধ্য হয়েছে। গ্লোব গ্র“প অব কোম্পানিজের নামে সোনালী ব্যাংকে ২৫০ কোটি টাকার একটি ঋণ ছিল, যা মন্দ হিসেবে চিহ্নিত। খেলাপি থাকার কারণে এই হিসাবের বিপরীতে কোনো নতুন ঋণ নিতে পারছিল না গ্রাহক। এ বছরের মাঝামাঝি সময়ে ঋণটি সোনালী ব্যাংক থেকে কিনে নেয় জনতা ব্যাংক। তারা ঋণটি একেবারে নতুন হিসাবে পেয়েছে। ঋণের সীমা এবং মেয়াদ বাড়িয়ে নতুন করে পুনর্গঠন করেছে। ফলে এর বিপরীতে গ্রাহক আরও টাকা নিতে পারছে।
২০১১ সালে কিনেছে ৭৩ কোটি টাকার ঋণ। এর মধ্যে রেফকো ল্যাবরেটরিজের ৩৭ কোটি, এভারেস্ট পাওয়ার জেনারেশনের ৩৬ কোটি টাকা। ২০১০ সালে ব্যাংক ৫০০ কোটি টাকার ঋণ কেনার প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। এর মধ্যে পারটেক্স সুগার মিলসের নামে থাকা ৯১ কোটি টাকা ঋণ কেনার প্রস্তাব ২০১০ সালের ১০ মে অনুমোদন করা হয়। একই বছরে ইস্টার্ন রি-রোলিং মিলের ২০ কোটি, এপেক্স নিট কমপোজিটের ৪১ কোটি, ইউনিক পাওয়ারের ১৮ কোটি, রিলায়েবল সিএনজি অ্যান্ড পেট্রল পাম্পের আড়াই কোটি এবং বীকন ফার্মার ৪০ কোটি টাকার ঋণ কেনার প্রস্তাব পর্ষদ অনুমোদন করেছে।
বেসিক ব্যাংক : বেসিক ব্যাংক নগদ টাকায় প্রচলিত নিয়ম ভঙ্গ করে ১৪৭ কোটি টাকার মন্দ ঋণ কিনেছে। এগুলো এতটাই খারাপ ছিল যে, নবায়ন করেও এখন নিয়মিত রাখা যাচ্ছে না। ফলে আবার খেলাপি হয়ে পড়েছে। ঋণের বিপরীতে যথেষ্ট জামানতও নেই ব্যাংকের কাছে। বেসরকারি খাতের পাঁচটি ব্যাংক থেকে বেসিক ব্যাংকের চারটি শাখা পর্ষদের অনুমোদন ছাড়াই এসব ঋণ কিনেছে। ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুর প্রভাবে এসব ঋণ কিনতে ব্যাংক বাধ্য হয়েছিল। এখন ব্যাংকের নতুন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ওই ঋণের গ্রাহকদের সঙ্গে আলোচনা করে নিয়মিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
সূত্র জানায়, ব্যাংকটির দিলকুশা শাখা প্রিমিয়ার ব্যাংকের ওয়েল টেক্সটাইলের ২২ কোটি টাকা, আদিব ডাইংয়ের ২৮ কোটি, এক্সিম ব্যাংকের অ্যাটলাস ভেসেলের ১৬ কোটি টাকার ঋণ কিনেছে। এই ঋণগুলো ওই ব্যাংকে খেলাপি হয়েছিল। ওয়ান ব্যাংক ও ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) থেকে ইব্রাহিম নিটওয়্যারের ২৯ কোটি টাকার ঋণ কিনেছে ব্যাংকের গুলশান শাখা। ওই ঋণ দুই ব্যাংকেই খেলাপি অবস্থায় ছিল। ফলে ইউসিবি ও ওয়ান ব্যাংক থেকে গ্রাহক নতুন কোনো ঋণ পাচ্ছিল না। এই খেলাপি প্রতিষ্ঠানকে সাবেক চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চু প্রভাব খাটিয়ে বেসিক ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় নিয়ে নতুন ঋণ দিয়েছেন। আর ওই ঋণের টাকা দিয়ে প্রতিষ্ঠানগুলো অন্য ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের রফতানি বিলের বিপরীতে ৫২ কোটি টাকার ঋণ কিনেছে ব্যাংক। পরে ওইসব রফতানি বিল আর দেশে আসেনি। মেয়াদ পূর্তির পর ব্যাংক তা খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো পণ্য রফতানিই করেনি। উল্টো রফতানির ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বাজারে রফতানি বিল ইস্যু করে ব্যাংক থেকে ওই টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, যা ব্যাংকের কাঁধে দায় হিসেবে পড়েছে। এই ব্যাংকে ঋণ কেনার নামে এরকম আরও জালিয়াতি থাকতে পারে বলে আশংকা করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

No comments

Powered by Blogger.