বাংলাদেশের উন্নয়নে কৌশলগত অংশীদারিত্ব by মুহাম্মদ রুহুল আমীন
এশিয়ার আরব রাষ্ট্রগুলোর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও গোত্রীয় দ্বন্দ্ব এবং তাদের আন্তঃরাষ্ট্রিক বিবাদ সত্ত্বেও দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার রাষ্ট্রগুলো আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিসরে কৌশলগত অংশীদারিত্বের (Strategic Partnership) নীতি অনুসরণ করছে। এ নীতির সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য হল এশিয়ার দেশগুলোর দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক আন্তঃরাষ্ট্রীয় দ্বন্দ্ব-সংঘাত সীমিত পর্যায়ে রেখে তাদের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক উন্নয়ন সাধনের মহাপরিকল্পনা বা কৌশল বাস্তবায়ন। একই ধরনের পরিকল্পনার অধীনে ইতিমধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম রাষ্ট্র ভারত এবং পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম রাষ্ট্র চীন ও জাপান নিজ নিজ নীতি-কৌশল এবং তার বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে নিরলস কাজ করে চলেছে। এশিয়ায় কৌশলগত অংশীদারিত্ব আঞ্চলিক সহযোগিতামূলক পরিবেশের সৃষ্টি করলেও প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের নীতির অঙ্গীকার বিশ্বব্যাপী পরিব্যাপ্ত। অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, পরিবর্তিত বিশ্ব বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক রাজনীতির পুনর্বিন্যাস প্রক্রিয়ায় এশিয়ার কৌশলগত অংশীদারিত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের আশু কর্তব্য হল, এশিয়ার এ নীতি পরিবর্তনের ধারাকে কাজে লাগিয়ে দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা।
এশিয়ার এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণের পারস্পরিক বৈরিতার বৈশিষ্ট্যে বিকশিত হয়। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বায়নের স্রোতে রাষ্ট্রগুলোর চিন্তায় পরিবর্তন আসে এবং বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ এলাকার বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিকতার (reciprocity) গুরুত্ব অনুধাবন করতে থাকে।
স্নায়ুযুদ্ধের বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানের সখ্য গড়ে ওঠে এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের মিত্রতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর ভারত ও জাপান উভয়ে যুক্তরাষ্ট্রমুখী হয়ে পড়ে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে চীন-জাপান বৈরিতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে জাপানের সঙ্গে চীনের উষ্ণ সম্পর্ক কখনও তৈরি হয়নি। আবার ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ এবং স্নায়ুযুদ্ধোত্তর কালের ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠতার কারণে ভারতের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্ব তৈরির প্রেক্ষাপট রচিত হতে পারেনি।
উপরোক্ত অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব এবং আন্তঃরাষ্ট্রিক বিবাদ-বিসংবাদ কমে আসছে সাম্প্রতিক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বলয়ের পরিবর্তিত বাস্তবতার কারণে। চীন, ভারত ও জাপান- এ অঞ্চলের এই তিনটি রাষ্ট্র এখন তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিচ্ছে এবং তাদের এ নির্মীয়মাণ সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। অর্থাৎ এশিয়ার কৌশলগত অংশীদারিত্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অন্তর্ভুক্তি এশিয়ায় আঞ্চলিক সম্পর্ক এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় শক্তির নতুন ভারসাম্য তৈরি করছে। বিশ্লেষকরা এ পরিবর্তিত ধারাকে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব হিসেবে অভিহিত করছেন। এশিয়ায় আঞ্চলিক অংশীদারিত্বের সঙ্গে বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের সম্মিলন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনীতির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করছে, যেখানে বাংলাদেশসহ এশিয়ার অন্য রাষ্ট্রগুলো তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের রূপরেখা প্রণয়নের সুযোগ লাভ করতে পারে।
এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি রাষ্ট্র ভারত ও চীন যেভাবে পারস্পরিক বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে, তার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অন্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। নরেন্দ্র মোদি ভারতের শাসনভার গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক সমঝোতার উদ্যোগ জোরদার হতে থাকে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাম্প্রতিক ভারত সফর দেশ দুটিকে কৌশলগত মিত্রতায় বেঁধে ফেলে। শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে চীন অনুসৃত দ্বৈত পুনঃভারসাম্য নীতি (dual rebalance) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চীন-ভারত মিত্রতার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে তীব্রভাবে। চীন তার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অগ্রসরতার ধারা ধরে রাখতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌহার্দ্য সৃষ্টির নতুন নীতি অনুসরণ করছে। চীনের এ মহাপরিকল্পনা বা কৌশল এখন আর ভারতকে প্রতিদ্বন্দ্বীর আসনে না বসিয়ে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যের ঐতিহ্যবাহী রেশমি সড়ক (সিল্ক রোড) এবং ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোজুড়ে গঠিত একবিংশ শতাব্দীর সামুদ্রিক রেশমি সড়ক এখন চীনের বহিঃবাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কূটনীতির মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।
চীন-ভারত নির্মীয়মাণ অংশীদারিত্বের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল দেশ দুটির মধ্যে স্বাক্ষরিত ১৫টি সহযোগিতা চুক্তি, যা শি জিনপিংয়ের ভারত সফরের সময়ই সম্পন্ন হয়েছে। এ চুক্তিগুলোর মাধ্যমে দেশ দুটি বাণিজ্য, অর্থ, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে তৎপর হয়েছে। ভারতের জীর্ণ-শীর্ণ রেলপথ পুনঃনির্মাণ করে রেলওয়ের উন্নয়নে ২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। চীনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি হল গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে দুটি শিল্পপার্ক প্রতিষ্ঠা। চীন-ভারত ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি দূরীকরণে চীনে বেশি বেশি ভারতীয় পণ্য প্রবেশের সুযোগ দিতে চীন সম্মত হয়েছে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে সহযোগিতার পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও চীন-ভারত সহযোগিতার পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এর ফলে হয়তো অচিরেই ভারত সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সদস্যপদ লাভ করবে। অপরদিকে ভারতের মধ্য এশিয়া যুক্তকরণ (connect central Asia) নীতি এবং উত্তর-দক্ষিণ করিডর প্রতিষ্ঠা চীনের জন্য একটি সুখবর। কারণ চীনের বিরোধপূর্ণ জিনজিয়াং প্রদেশ মধ্য এশিয়া সংলগ্ন হওয়ায় ভারতের ওই নীতি চীনের সঙ্গে মধ্য এশিয়ার সম্পর্কে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বিশ্ব রাজনীতির দুই মিত্ররাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান সাম্প্রতিককালে ভারতের উদীয়মান আন্তর্জাতিক গুরুত্ব অনুধাবন করে ভারতের সঙ্গে বৈশ্বিক অংশীদারিত্বে যুক্ত হতে তৎপর হচ্ছে। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতা গ্রহণের পর জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাকে গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর সারিতে বসাতে নানা তৎপরতা শুরু করেছে। চীনের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক ঝাও মিনঘাও মনে করেন, জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশের সমন্বয়ে এ অঞ্চলে একটি গণতান্ত্রিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে উঠছে। গত সেপ্টেম্বরে নরেন্দ্র মোদির জাপান সফরকালে ভারতের অবকাঠামো উন্নয়ন, বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি, সমুদ্র নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইত্যাদি খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন সাহায্য লাভের প্রতিশ্র“তি মিলেছে। এশিয়ার এ গুরুত্বপূর্ণ দেশ দুটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব বলয়ে যুক্ত হতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে দেশ দুটি বিশেষ কৌশলগত এবং বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব (Special strategic and global partnership) চুক্তিতে আবদ্ধ হতে সম্মত হয়েছে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক দৃঢ় হতে থাকে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর থেকে এবং সাম্প্রতিক সময়ে সে বন্ধুত্ব এতই দৃঢ়তর হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট নিকোলাস বার্নস ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এশীয় মিত্ররাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ইতিমধ্যে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ রাজনীতিকদের সরকারি সফর পর্যালোচনা করলে দেশ দুটির নিবিড় সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাক হেগেলের ভারত সফরের পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্রে সফরে গিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে তার সম্মানে আয়োজিত সমাবেশ দেখে মার্কিন নাগরিকরা অবাক হয়েছেন। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে প্রায় ২০ হাজার লোকের উপস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদি মার্কিন প্রশাসনের কাছে তার দেশের এমন ইমেজ পৌঁছ দিয়েছেন, যা আগামী দিনে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পকর্কে আরও দৃঢ় করবে।
এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা যখন আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের সঙ্গে একীভূত হয়ে উন্নয়নের বৈশ্বিক বলয় তৈরি করছে, তখন বাংলাদেশও সেই বলয়ে যুক্ত হয়ে দেশমাতৃকার প্রভূত উন্নয়ন সাধন করতে পারে। গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, বিদেশী বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিদ্যমান সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করতে আমাদের নীতিনির্ধারকদের উদ্যোগী হতে হবে। আশার কথা, বর্তমান সরকার ভারত, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিশ্বের উন্নত ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক সম্পর্ক রক্ষায় বেশ তৎপর হয়েছে। সাম্প্রতিককালে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব যদি আশাপ্রদ ভূমিকা রাখতে পারে এবং সেই অভিজ্ঞতা যদি অন্যান্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অঙ্গনে প্রতিফলিত করা সম্ভব হয়, তাহলে আগামী এক দশকেরও কম সময়ে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
মুহাম্মদ রুহুল আমীন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
এশিয়ার এ অঞ্চলের রাষ্ট্রগুলো স্নায়ুযুদ্ধ চলাকালে বিশ্ব রাজনীতির মেরুকরণের পারস্পরিক বৈরিতার বৈশিষ্ট্যে বিকশিত হয়। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর বিশ্বায়নের স্রোতে রাষ্ট্রগুলোর চিন্তায় পরিবর্তন আসে এবং বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এ এলাকার বৃহৎ রাষ্ট্রগুলো পারস্পরিকতার (reciprocity) গুরুত্ব অনুধাবন করতে থাকে।
স্নায়ুযুদ্ধের বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জাপানের সখ্য গড়ে ওঠে এবং সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতের মিত্রতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙনের পর ভারত ও জাপান উভয়ে যুক্তরাষ্ট্রমুখী হয়ে পড়ে। আঞ্চলিক রাজনীতিতে চীন-জাপান বৈরিতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে চীন-যুক্তরাষ্ট্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার কারণে জাপানের সঙ্গে চীনের উষ্ণ সম্পর্ক কখনও তৈরি হয়নি। আবার ১৯৬২ সালের ভারত-চীন যুদ্ধ এবং স্নায়ুযুদ্ধোত্তর কালের ভারত-যুক্তরাষ্ট্র ঘনিষ্ঠতার কারণে ভারতের সঙ্গে চীনের বন্ধুত্ব তৈরির প্রেক্ষাপট রচিত হতে পারেনি।
উপরোক্ত অভ্যন্তরীণ, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক দ্বন্দ্ব এবং আন্তঃরাষ্ট্রিক বিবাদ-বিসংবাদ কমে আসছে সাম্প্রতিক আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বলয়ের পরিবর্তিত বাস্তবতার কারণে। চীন, ভারত ও জাপান- এ অঞ্চলের এই তিনটি রাষ্ট্র এখন তাদের পারস্পরিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিচ্ছে এবং তাদের এ নির্মীয়মাণ সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হতে চাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। অর্থাৎ এশিয়ার কৌশলগত অংশীদারিত্বের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত অন্তর্ভুক্তি এশিয়ায় আঞ্চলিক সম্পর্ক এবং বৃহত্তর আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় শক্তির নতুন ভারসাম্য তৈরি করছে। বিশ্লেষকরা এ পরিবর্তিত ধারাকে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব হিসেবে অভিহিত করছেন। এশিয়ায় আঞ্চলিক অংশীদারিত্বের সঙ্গে বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের সম্মিলন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনীতির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করছে, যেখানে বাংলাদেশসহ এশিয়ার অন্য রাষ্ট্রগুলো তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের রূপরেখা প্রণয়নের সুযোগ লাভ করতে পারে।
এশিয়ার প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি রাষ্ট্র ভারত ও চীন যেভাবে পারস্পরিক বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে, তার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য অন্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য অনুকরণীয় হতে পারে। নরেন্দ্র মোদি ভারতের শাসনভার গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে আঞ্চলিক সমঝোতার উদ্যোগ জোরদার হতে থাকে। চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সাম্প্রতিক ভারত সফর দেশ দুটিকে কৌশলগত মিত্রতায় বেঁধে ফেলে। শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে চীন অনুসৃত দ্বৈত পুনঃভারসাম্য নীতি (dual rebalance) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে চীন-ভারত মিত্রতার প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছে তীব্রভাবে। চীন তার অভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক অগ্রসরতার ধারা ধরে রাখতে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সৌহার্দ্য সৃষ্টির নতুন নীতি অনুসরণ করছে। চীনের এ মহাপরিকল্পনা বা কৌশল এখন আর ভারতকে প্রতিদ্বন্দ্বীর আসনে না বসিয়ে উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করছে। বৈশ্বিক বাণিজ্যের ঐতিহ্যবাহী রেশমি সড়ক (সিল্ক রোড) এবং ভারত মহাসাগরের তীরবর্তী দেশগুলোজুড়ে গঠিত একবিংশ শতাব্দীর সামুদ্রিক রেশমি সড়ক এখন চীনের বহিঃবাণিজ্য ও অর্থনৈতিক কূটনীতির মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়েছে।
চীন-ভারত নির্মীয়মাণ অংশীদারিত্বের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ অবদান হল দেশ দুটির মধ্যে স্বাক্ষরিত ১৫টি সহযোগিতা চুক্তি, যা শি জিনপিংয়ের ভারত সফরের সময়ই সম্পন্ন হয়েছে। এ চুক্তিগুলোর মাধ্যমে দেশ দুটি বাণিজ্য, অর্থ, সংস্কৃতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে পারস্পরিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করতে তৎপর হয়েছে। ভারতের জীর্ণ-শীর্ণ রেলপথ পুনঃনির্মাণ করে রেলওয়ের উন্নয়নে ২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন। চীনের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি হল গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে দুটি শিল্পপার্ক প্রতিষ্ঠা। চীন-ভারত ক্রমবর্ধমান বাণিজ্য ঘাটতি দূরীকরণে চীনে বেশি বেশি ভারতীয় পণ্য প্রবেশের সুযোগ দিতে চীন সম্মত হয়েছে।
ভারতের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নে সহযোগিতার পাশাপাশি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও চীন-ভারত সহযোগিতার পুনর্মূল্যায়ন করা হচ্ছে। এর ফলে হয়তো অচিরেই ভারত সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার সদস্যপদ লাভ করবে। অপরদিকে ভারতের মধ্য এশিয়া যুক্তকরণ (connect central Asia) নীতি এবং উত্তর-দক্ষিণ করিডর প্রতিষ্ঠা চীনের জন্য একটি সুখবর। কারণ চীনের বিরোধপূর্ণ জিনজিয়াং প্রদেশ মধ্য এশিয়া সংলগ্ন হওয়ায় ভারতের ওই নীতি চীনের সঙ্গে মধ্য এশিয়ার সম্পর্কে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তরকালে বিশ্ব রাজনীতির দুই মিত্ররাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও জাপান সাম্প্রতিককালে ভারতের উদীয়মান আন্তর্জাতিক গুরুত্ব অনুধাবন করে ভারতের সঙ্গে বৈশ্বিক অংশীদারিত্বে যুক্ত হতে তৎপর হচ্ছে। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতা গ্রহণের পর জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে এশীয়-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকাকে গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত রাষ্ট্রগুলোর সারিতে বসাতে নানা তৎপরতা শুরু করেছে। চীনের পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক ঝাও মিনঘাও মনে করেন, জাপান, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশের সমন্বয়ে এ অঞ্চলে একটি গণতান্ত্রিক নিরাপত্তা বলয় গড়ে উঠছে। গত সেপ্টেম্বরে নরেন্দ্র মোদির জাপান সফরকালে ভারতের অবকাঠামো উন্নয়ন, বেসামরিক পারমাণবিক কর্মসূচি, সমুদ্র নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইত্যাদি খাতে বিলিয়ন বিলিয়ন সাহায্য লাভের প্রতিশ্র“তি মিলেছে। এশিয়ার এ গুরুত্বপূর্ণ দেশ দুটি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক জোরদার করে বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব বলয়ে যুক্ত হতে যাচ্ছে। এ লক্ষ্যে দেশ দুটি বিশেষ কৌশলগত এবং বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব (Special strategic and global partnership) চুক্তিতে আবদ্ধ হতে সম্মত হয়েছে।
ভারত-যুক্তরাষ্ট্র দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক দৃঢ় হতে থাকে স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর থেকে এবং সাম্প্রতিক সময়ে সে বন্ধুত্ব এতই দৃঢ়তর হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক আন্ডার সেক্রেটারি অব স্টেট নিকোলাস বার্নস ভারতকে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ এশীয় মিত্ররাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করেছেন। ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ইতিহাসে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। ইতিমধ্যে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ রাজনীতিকদের সরকারি সফর পর্যালোচনা করলে দেশ দুটির নিবিড় সম্পর্কের প্রমাণ পাওয়া যায়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী চাক হেগেলের ভারত সফরের পরপরই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যুক্তরাষ্ট্রে সফরে গিয়ে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। মোদির যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে তার সম্মানে আয়োজিত সমাবেশ দেখে মার্কিন নাগরিকরা অবাক হয়েছেন। ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে প্রায় ২০ হাজার লোকের উপস্থিতিতে নরেন্দ্র মোদি মার্কিন প্রশাসনের কাছে তার দেশের এমন ইমেজ পৌঁছ দিয়েছেন, যা আগামী দিনে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র সম্পকর্কে আরও দৃঢ় করবে।
এশিয়ার আঞ্চলিক সহযোগিতা যখন আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের সঙ্গে একীভূত হয়ে উন্নয়নের বৈশ্বিক বলয় তৈরি করছে, তখন বাংলাদেশও সেই বলয়ে যুক্ত হয়ে দেশমাতৃকার প্রভূত উন্নয়ন সাধন করতে পারে। গত ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তিতে যে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, তা কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশকে বৈশ্বিক অংশীদারিত্বের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি, বিদেশী বিনিয়োগ, রেমিট্যান্স ইত্যাদি ক্ষেত্রে বিদ্যমান সম্ভাবনাকে শক্তিশালী করতে আমাদের নীতিনির্ধারকদের উদ্যোগী হতে হবে। আশার কথা, বর্তমান সরকার ভারত, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডাসহ বিশ্বের উন্নত ও গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সামরিক সম্পর্ক রক্ষায় বেশ তৎপর হয়েছে। সাম্প্রতিককালে জাপানের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক অংশীদারিত্ব যদি আশাপ্রদ ভূমিকা রাখতে পারে এবং সেই অভিজ্ঞতা যদি অন্যান্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অঙ্গনে প্রতিফলিত করা সম্ভব হয়, তাহলে আগামী এক দশকেরও কম সময়ে বাংলাদেশ আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে যুগান্তকারী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।
মুহাম্মদ রুহুল আমীন : অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments