আলোর দিশারি আবদুর রশিদ by আনোয়ার হোসেন
(বাড়ির পাশে বাঁশবাগানের ছায়ায় শিশুদের পাঠদান করছেন আবদুর রশিদ l ছবি: প্রথম আলো) গ্রামে পরিচয় ছিল ‘ডাক্তার’ হিসেবে। এখন সবাই ডাকেন ‘রশিদ মাস্টার’ বলে। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার দূরে শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী চরাঞ্চলের নিভৃত গ্রাম তারাপুর। শ পাঁচেক পরিবারের বসবাস। অধিকাংশই অভাবী। গ্রামের অনেক শিশুই বিদ্যালয়ে যায় না। যারা যায় তাদের মধ্যে অনেকেই ঝরে পড়ে। এসব ঝরে পড়া শিশু ও নিরক্ষর বয়স্কদের লেখাপড়া শেখানোর দায়িত্ব পালন করছেন পল্লি চিকিৎসক আবদুর রশিদ। আলো ছড়ানোর এই কাজটি তিনি নীরবে, নিঃস্বার্থে করে যাচ্ছেন ৩৩ বছর ধরে।
আবদুর রশিদের খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল, তাঁর ওষুধের দোকানটি বন্ধ। গিয়ে বসি সামনের এক ফলের দোকানে। রশিদের কথা বলতেই ফলের দোকানদার সৈয়ব আলী (৪৫) শুরু করেন তাঁর গল্প। এই সাহাপাড়া হাট ও বাজারে এখন প্রায় ৪০০ দোকানদার। অর্ধেকের বেশি ছিল নিরক্ষর। রশিদ মাস্টারের জন্য এখন এরা লিখতে-পড়তে পারে। বললেন, ‘আমি অন্যজনকে দিয়ে হিসাবের খাতা লিখাতাম। তিন বছর থেকে নিজেই লিখি।’
কথা চলতে থাকে, একে একে জড়ো হন অনেকেই। সবারই এক কথা, রশিদ মাস্টারের মতো লোক হয় না। নিজেরই সংসার চলে না, অথচ ছেলেমেয়েদের খাতা-পেনসিলও কিনে দেন। বিদ্যুৎ না থাকলে নিজে কুপির তেল কিনে ক্লাবঘরে বয়স্কদের পড়ান। ব্যবসায়ী মানারুল বললেন, ‘এগলা করতে যায়্যা সংসার চলে না ঠিকমতো। তাও ক্যানে করেন এগলা? জিজ্ঞাস করলি কোনো উত্তর দেয় না রশিদ মাস্টার, খালি হাসে। তার মতো পরোপকারী লোক দেখিনি এই জীবনে।’
গ্রামের দাড়িপাড়ায় আধা পাকা টিনের ছাউনির দুই কক্ষের বাড়ি আবদুর রশিদের। গিয়ে দেখা গেল ঘরের পেছনে বাঁশবাগানের ছায়ায় খেজুরের পাটি বিছিয়ে তিনি শিশুদের পাঠদানে ব্যস্ত। ছাত্রছাত্রীরা নানা বয়সী, সবাই হতদরিদ্র। একেবারে ছোট শিশুদের এখানে পাঠানো হয় প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য। রশিদ মাস্টার নিজেও অনেকের বাড়ি থেকে শিশুদের ডেকে নিয়ে আসেন।
কথা হয় চর জামালপুর রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির বিউটি খাতুন, জুয়েল আলী, দ্বিতীয় শ্রেণির রেশমি খাতুন, মুনজিলা খাতুন, আমেনা খাতুন ও নতুন চর তারাপুর রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া খাতুনসহ অনেকের সঙ্গে। তারা জানাল, বিদ্যালয়ে খুব ভালো লেখাপড়া শিখতে পারছে না বলে এখানে এসেছে। তাদের অভিভাবকেরা নিরক্ষর, প্রাইভেট পড়ানোরও সামর্থ্য নেই। তাই রশিদ মাস্টারের কাছে বিনা পয়সায় পড়তে এসেছে। প্রতিদিন বেলা দুইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত এখানে পড়তে আসে তারা। এ ছাড়া সাহাপাড়া হাটখোলার ক্লাবঘরে ঝরে পড়া শিশুদের পাঠদান চলে বিকেল চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত এবং নিরক্ষর বয়স্কদের পাঠদান চলে রাত আটটা থেকে ১০টা পর্যন্ত।
আবদুর রশিদের বয়স ৬৫। দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম। শিবগঞ্জের আদিনা ফজলুল হক কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে এইচএসসি পাস করে আর এগোতে পারেননি। পরে এক বছরের প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন পল্লি চিকিৎসকের পেশা। এটাই তাঁর জীবিকার একমাত্র অবলম্বন।
একসময় তিনি দেখলেন, গ্রামের বহু ছেলেময়ে বিদ্যালয়ে যায় না। আর তখন বিদ্যালয়ও তেমন ছিল না। এসব শিশুকে ডেকে বাজারে তাঁর ওষুধের দোকানে পড়ানো শুরু করেন। সেটি ১৯৮১ সালের কথা। দিনে দিনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। শিশুদের পাশাপাশি নিরক্ষর বয়স্কদেরও পড়ালেখা শেখাতে শুরু করেন তিনি।
তবে রুটিন অনুযায়ী পালা করে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন ১৯৯১ সাল থেকে। বাড়ির পেছনে বাঁশবাগানে ও বাজারের ক্লাবঘরে তিন পালায় ক্লাস নেওয়া শুরু করেন তখন থেকেই।
স্বল্প আয়ের এই বিদ্যোৎসাহী মানুষটি অতিদরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের খাতাপত্র, পেনসিলও কিনে দেন। প্রথম দিকে এ নিয়ে বাড়িতে অশান্তি হতো। স্ত্রী মাজেরা বেগম বললেন, ‘নিত্য অভাবে থেকেও তাঁর বিনা পয়সার কাজে বিরক্ত হতাম ঠিকই। কিন্তু পরে মনে হয়েছে, এ কাজ করতে তাঁর ভালো লাগে, করুক। কজন মানুষ পারেন এমন ভালো কাজ করতে।’
আবদুর রশীদের তিন ছেলে। বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার করেন। অপর দুই ছেলের একটি উচ্চমাধ্যমিক এবং ছোটটি এবার জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। পাঁচ মেয়ের মধ্যে চারজনের বিয়ে হয়েছে। সবার ছোট মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সামির উদ্দীন বললেন, এলাকাটা বড়ই অভাবী। একসময় তো আশপাশে স্কুলই ছিল না। এখনো অনেক শিশু স্কুলে যায় না। অনেকে ঝরে পড়ে। এ অবস্থায় আবদুর রশিদের ভূমিকা সত্যিই প্রশংসনীয়। তাঁর এই মহতী উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কেরামত আলীও।
আবদুর রশিদের খোঁজ করতে গিয়ে দেখা গেল, তাঁর ওষুধের দোকানটি বন্ধ। গিয়ে বসি সামনের এক ফলের দোকানে। রশিদের কথা বলতেই ফলের দোকানদার সৈয়ব আলী (৪৫) শুরু করেন তাঁর গল্প। এই সাহাপাড়া হাট ও বাজারে এখন প্রায় ৪০০ দোকানদার। অর্ধেকের বেশি ছিল নিরক্ষর। রশিদ মাস্টারের জন্য এখন এরা লিখতে-পড়তে পারে। বললেন, ‘আমি অন্যজনকে দিয়ে হিসাবের খাতা লিখাতাম। তিন বছর থেকে নিজেই লিখি।’
কথা চলতে থাকে, একে একে জড়ো হন অনেকেই। সবারই এক কথা, রশিদ মাস্টারের মতো লোক হয় না। নিজেরই সংসার চলে না, অথচ ছেলেমেয়েদের খাতা-পেনসিলও কিনে দেন। বিদ্যুৎ না থাকলে নিজে কুপির তেল কিনে ক্লাবঘরে বয়স্কদের পড়ান। ব্যবসায়ী মানারুল বললেন, ‘এগলা করতে যায়্যা সংসার চলে না ঠিকমতো। তাও ক্যানে করেন এগলা? জিজ্ঞাস করলি কোনো উত্তর দেয় না রশিদ মাস্টার, খালি হাসে। তার মতো পরোপকারী লোক দেখিনি এই জীবনে।’
গ্রামের দাড়িপাড়ায় আধা পাকা টিনের ছাউনির দুই কক্ষের বাড়ি আবদুর রশিদের। গিয়ে দেখা গেল ঘরের পেছনে বাঁশবাগানের ছায়ায় খেজুরের পাটি বিছিয়ে তিনি শিশুদের পাঠদানে ব্যস্ত। ছাত্রছাত্রীরা নানা বয়সী, সবাই হতদরিদ্র। একেবারে ছোট শিশুদের এখানে পাঠানো হয় প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার উপযোগী করে গড়ে তোলার জন্য। রশিদ মাস্টার নিজেও অনেকের বাড়ি থেকে শিশুদের ডেকে নিয়ে আসেন।
কথা হয় চর জামালপুর রেজিস্টার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির বিউটি খাতুন, জুয়েল আলী, দ্বিতীয় শ্রেণির রেশমি খাতুন, মুনজিলা খাতুন, আমেনা খাতুন ও নতুন চর তারাপুর রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্রী সুমাইয়া খাতুনসহ অনেকের সঙ্গে। তারা জানাল, বিদ্যালয়ে খুব ভালো লেখাপড়া শিখতে পারছে না বলে এখানে এসেছে। তাদের অভিভাবকেরা নিরক্ষর, প্রাইভেট পড়ানোরও সামর্থ্য নেই। তাই রশিদ মাস্টারের কাছে বিনা পয়সায় পড়তে এসেছে। প্রতিদিন বেলা দুইটা থেকে তিনটা পর্যন্ত এখানে পড়তে আসে তারা। এ ছাড়া সাহাপাড়া হাটখোলার ক্লাবঘরে ঝরে পড়া শিশুদের পাঠদান চলে বিকেল চারটা থেকে পাঁচটা পর্যন্ত এবং নিরক্ষর বয়স্কদের পাঠদান চলে রাত আটটা থেকে ১০টা পর্যন্ত।
আবদুর রশিদের বয়স ৬৫। দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম। শিবগঞ্জের আদিনা ফজলুল হক কলেজ থেকে ১৯৭২ সালে এইচএসসি পাস করে আর এগোতে পারেননি। পরে এক বছরের প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু করেন পল্লি চিকিৎসকের পেশা। এটাই তাঁর জীবিকার একমাত্র অবলম্বন।
একসময় তিনি দেখলেন, গ্রামের বহু ছেলেময়ে বিদ্যালয়ে যায় না। আর তখন বিদ্যালয়ও তেমন ছিল না। এসব শিশুকে ডেকে বাজারে তাঁর ওষুধের দোকানে পড়ানো শুরু করেন। সেটি ১৯৮১ সালের কথা। দিনে দিনে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। শিশুদের পাশাপাশি নিরক্ষর বয়স্কদেরও পড়ালেখা শেখাতে শুরু করেন তিনি।
তবে রুটিন অনুযায়ী পালা করে ক্লাস নেওয়া শুরু করেন ১৯৯১ সাল থেকে। বাড়ির পেছনে বাঁশবাগানে ও বাজারের ক্লাবঘরে তিন পালায় ক্লাস নেওয়া শুরু করেন তখন থেকেই।
স্বল্প আয়ের এই বিদ্যোৎসাহী মানুষটি অতিদরিদ্র ছাত্রছাত্রীদের খাতাপত্র, পেনসিলও কিনে দেন। প্রথম দিকে এ নিয়ে বাড়িতে অশান্তি হতো। স্ত্রী মাজেরা বেগম বললেন, ‘নিত্য অভাবে থেকেও তাঁর বিনা পয়সার কাজে বিরক্ত হতাম ঠিকই। কিন্তু পরে মনে হয়েছে, এ কাজ করতে তাঁর ভালো লাগে, করুক। কজন মানুষ পারেন এমন ভালো কাজ করতে।’
আবদুর রশীদের তিন ছেলে। বড় ছেলে বিয়ে করে আলাদা সংসার করেন। অপর দুই ছেলের একটি উচ্চমাধ্যমিক এবং ছোটটি এবার জেএসসি পরীক্ষা দিয়েছে। পাঁচ মেয়ের মধ্যে চারজনের বিয়ে হয়েছে। সবার ছোট মেয়ে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছেন।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য সামির উদ্দীন বললেন, এলাকাটা বড়ই অভাবী। একসময় তো আশপাশে স্কুলই ছিল না। এখনো অনেক শিশু স্কুলে যায় না। অনেকে ঝরে পড়ে। এ অবস্থায় আবদুর রশিদের ভূমিকা সত্যিই প্রশংসনীয়। তাঁর এই মহতী উদ্যোগের প্রশংসা করেছেন শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কেরামত আলীও।
No comments