অভিমত : গ্রহীতা দোষী হলে দাতা কেন নয় by রিন্টু আনোয়ার

তারা সম্মানে মহীয়ান। পদ-পদবিতে মহোদয়-মহাশয়। রাষ্ট্র তাদের এ সম্মানের আসন দিয়েছে। যোগ্যতা আছে বলেই তো তারা এমন আসন পেয়েছেন। প্রতিযোগিতামূলক কঠিন পরীার মাধ্যমে সরকারি উচ্চ শ্রেণীতে বসতে পেরেছেন; কিন্তু কার্যকলাপে তারা মাঝে মধ্যেই এই মেধা ও সততার চিহ্ন রাখছেন না। পেশাদার জালিয়াতদেরও হার মানিয়ে দিচ্ছেন। সর্বশেষ করলেন আমাদের জাতীয় অস্তিত্বের অহঙ্কার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। চেতনার কী দশা তাদের! কী নমুনা নৈতিকতার! জালিয়াতির দৌড়ে তারা নির্ঘাত চ্যাম্পিয়নই হবেন বলা যায়। আবার লজ্জাহীনতায়ও শীর্ষত্ব পাবেন আশা করা যায়। তাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ জালিয়াতি প্রমাণ হয়েছে। তাই পাঁচ সচিবের চারজনের সনদ বাতিল। একজনের করা হয়েছে স্থগিত। সিদ্ধান্তটি নিয়েছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশন দুদক তদন্তে সত্যতা পেয়েছে। এরপর দুদক তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চিঠি দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে। ভুয়া এই মুক্তিযোদ্ধা সচিবদের ছবিসহ বিভিন্ন পত্রিকায় সংবাদটি ছাপা হয়েছে। গত ক’দিনে গণমাধ্যমগুলোতে নিয়মিত প্রচারিত হচ্ছে ‘মহোদয়’দের নাম ও ছবি। কোনো রাষ্ট্রের জনপ্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তি মানে জাতির মেধাবী সুযোগ্য সন্তান। শিাজীবনে তারা ছিলেন কৃতী ছাত্র। সামাজিক জীবনে সম্মানের। পারিবারিক জীবনে গর্ব। অথচ কী মেধা এবং শীর্ষত্ব দেখালেন তারা জাতিকে। অভিযোগ ওঠার পরও তারা টলেননি। লজ্জাও পাননি। বহাল তবিয়তে আরামকেদারা অলঙ্কৃত করে রেখেছেন। সরকার থেকেও তাদের কোনো ভর্ৎসনা বা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, এমন খবর পাওয়া যায়নি, বরং উৎসাহ ও সাহসই পেয়েছেন। এতে তাদের দৌরাত্ম্য আরো বেড়েছে। লজ্জাহীনতা হয়েছে আরো গাঢ়। তদন্ত চলতে থাকা অবস্থায়ও কেউ ভাব বা ভঙ্গি কোনোটাতেই কমতি দেখাননি। পদত্যাগ বা দুঃখপ্রকাশ করে শেষ আব্রুটুকুও রার চেষ্টা করেননি। একজন তো প্রধানমন্ত্রীর সাথে নিউ ইয়র্ক সফরেও গেছেন। তাদের লজ্জা আসলেই ফরমালিন বা কোনো কেমিক্যাল মাখা। তাই মান-অপমানের ধার ধারেননি সর্বোচ্চ শ্রেণীর প্রশাসনিক কর্মকর্তা একজন সচিব ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট দিয়ে পদোন্নতি ও চাকরির বয়স বাড়ানোসহ সুযোগ সুবিধা নেবেন, এটা কেউ কল্পনা করতে পারে না। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন জাগে, এমন ব্যক্তিদের কেমন শাস্তি হতে পারে? তাদের মুক্তিযোদ্ধা সনদ বাতিলই কি যথেষ্ট? এ ছাড়া জাল করা তো জালিয়াতিই। জাল সনদ বাতিল হওয়া, না হওয়াতে তেমন তফাত কোথায়? সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলাবিধি অনুযায়ী কোনো সরকারি কর্মকর্তার অপরাধের বিভাগীয় বিচারের ভার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের; কিন্তু এটি কি যেনতেন অপরাধ? তাদের উপযুক্ত শাস্তি না হলে জালিয়াতদের নিন্দা বা খারাপ বলার নৈতিক অধিকার আর থাকবে না। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় তাদের শেষ পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তি দেবে কি না বা দিতে পারবে কি না এ প্রশ্নও রয়েছে। কারণ অতীতে দেখেছি রাজনৈতিক কারণে এ দেশে বিশেষত প্রশাসনে বড় বড় অনেক অপরাধের বিচার হয় না। এখন অভিযুক্ত এই মহাশয়রা যে এই রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাকে ব্যবহার করবেন না, এর কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? তাদের এত দূর আসার পেছনে মেধার চেয়ে রাজনৈতিক কানেকশনই হয়তো বেশি প্রয়োগ হয়েছে। সরকার কেন এ ধরনের অসৎ ব্যক্তির অপকর্মের দায় নেবে? তবে সরকারের কোনো ব্যক্তি এ রকম জালিয়াতির পেছনে প্রণোদনা জুগিয়ে থাকলে সেটা ভিন্ন কথা। শোনা যায়, এ কাণ্ড ঘটানোর পেছনে ভিন্ন কিছু অবশ্যই রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রাজনীতি, ব্যবসায়, খবরদারি করার একটি মওকা এ দেশে প্রচলিত আছে বহু দিন ধরেই। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধারা অনেক সুযোগ-সুবিধা নিয়েছে। আর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধারা না খেয়ে মরছেন। তারা রিকশা চালিয়ে, মুটে-কুলির কাজ করে জীবন সাঙ্গ করছেন, এমন খবরের সাথে আমরা পরিচিত। শেষমেশ প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ পদবিধারী রাজকর্তা সচিবেরাও দেখালেন, তারা কত দূর যেতে পারেন। খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবই যখন এই অপরাধ ঘটালেন তখন দেশটির কী ভাবমূর্তি দাঁড়াল? মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই বা কী দশা হলো? অথচ এখন মতায় আসীন মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী শক্তি।
জাতিগতভাবে আমাদের দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। স্বর্ণের ক্রেস্ট দেয়ার নামেও মুক্তিযুদ্ধের সাথে প্রতারণা করা হলো। বিদেশী বন্ধুদের কাছে বাংলাদেশের সম্মান হানি ঘটল। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকার কথা বলেও এ দেশে কম দুর্নীতি হয়নি। স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরও মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করতে হচ্ছে, এর চেয়ে দুঃখজনক ও অবিশ্বাস্য আর কী হতে পারে? এক সরকার যাবে আরেক সরকার আসবে, আবার নিজেদের সুবিধামতো মুক্তিযোদ্ধার তালিকা হবে? এ নিয়ে ধান্ধাবাণিজ্য আর কত? ক’দিন আগে খবর পাওয়া গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন-চারজন শিক্ষকেরও মুক্তিযোদ্ধা সনদ আছে, এ উসিলা দিয়ে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা হাতিয়ে নিয়েছেন। কর্তৃপ তাদের সেই সুযোগ-সুবিধা হাতানোর অনুকূল পরিবেশ করে দিয়েছে। অর্থ কী দাঁড়াল? এমন কাজ সচিবেরা করলে শিকেরাও পারেন। অথবা শিকেরা করলে সচিবেরাও পারেন। তাহলে বাকি থাকলেন কারা? এ রকম শিক ছাত্রদের কী শিা দেবেন, আর এ রকম শিকদের ছাত্ররা এক সময় প্রশাসনে ঢুকে চেয়ারে বসে কী-না করবেন।
প্রশাসনে অনেক সিনিয়র, সৎ, দ, যোগ্য কর্মকর্তা রয়েছেন যারা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার অভাবে পদোন্নতিবঞ্চিত। তাদের অনেকে চাকরি ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন অথবা চাকরিচ্যুত। ওএসডির সংখ্যাও বেশুমার। এ েেত্র ‘যুক্তি’ হচ্ছে, তারা পূর্ববর্তী সরকারের পোষ্য-তোষ্য ছিলেন। তাই তাদের এমন শাস্তি। অর্থাৎ পোষ্য-ভোজ্য হতে হবে বর্তমান সরকারের। এই নিয়মে আগামী দিনে নতুন সরকার তার আগের সরকারের তোষ্যদের বিতাড়িত করবেÑ এটা নিয়মে পরিণত হতে বসেছে।
মুক্তিযোদ্ধা সনদসহ ভুয়া বিভিন্ন সনদ ও দলবাজির গুণে পদ-পদবি বাগিয়ে সুবিধা হাসিলের নজির অনেক। সঠিক তদন্ত হলে ওই পাঁচ গুণধরের মতো আরো বহু নাম বেরিয়ে আসবে। এই ভুয়ারা ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে। একটি অন্যায় আরেকটি অন্যায়কে প্রলুব্ধ করে। তাই এ শ্রেণীর ভুয়াদের অপকাণ্ডে নতুন ভুয়া জন্মাবে, তা নিশ্চিত বলা যায়। এ রকম সনদ কর্তৃপ দিয়েছে এবং সনদের ছুতায় যারা সুবিধার ডেকচি খুলে দিচ্ছেন যারা তারাও কি এর দায়মুক্ত? গ্রহীতা দোষী হলে দাতা নির্দোষ হন কিভাবে?
রিন্টু আনোয়ার
rintuanowar@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.