ছবি আঁকেননি কখনো, আঁকলেন শহীদ মিনার by নাসির আলী মামুন
ভাষা-মতিন। তিনি এমন একজন, বাংলা ভাষায় এ
নামে আর কেউ নেই। গতকাল বুধবার আমাদের সবাইকে ব্যাকুল করে নিরঙ্কুশ বিদায়
নিয়ে চলে গেলেন মহাকালে। রেখে গেলেন আমরি বাংলা ভাষা।
প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিকে জাতিসংঘ ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে মান্য করে। সারা পৃথিবীর বহু ভাষাভাষী জানে, কেন এই মাতৃভাষা দিবস। বাংলার গৌরব মহিমান্বিত হয়েছে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে। সেদিন ভাষা আন্দোলনকারীরা শহীদ হয়েছেন, অসহনীয় নির্যাতন সইতে হয়েছে। কারাবরণ করেছেন প্রায় সবাই। সবার কথা সমানভাবে মনে রাখিনি আমরা।
আবদুল মতিন—নির্ভেজাল ও নিরহংকার এই মানুষ বায়ান্ন সালে বাংলা ভাষার দাবিতে যে আন্দোলন করেছিলেন, সেটি তিনি পরবর্তী সময়ে জীবনের প্রতিটি বাঁকে শাণিত করে আমাদের জন্য উপহার দিয়ে গেছেন বাঙালির একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বাংলা। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। এ নিয়ে কিছু বিতর্ক থাকলেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁর এক ভাই ও বাবাকে হত্যা করেছে। বাম রাজনীতি করেছেন আজীবন, যুক্ত ছিলেন কৃষক-শ্রমিকদের সঙ্গে। সমকালে মওলানা ভাসানী ছিলেন তাঁর আদর্শ। গৌরবময় ইতিহাসের নায়ক কীভাবে জীবিতকালে লোকচক্ষুর আড়ালের কারাগারে দীর্ঘকাল বন্দী থেকে এবং সুযোগ্য সম্মান না পেয়ে আমাদের এই রাজধানীতে বসবাস করে গেলেন—ভাবলে দুঃখ পাই। বিলম্বে জুটেছিল রাষ্ট্রীয় পুরস্কার। বাংলা ভাষার এই দেশে যেন তিনি ছিলেন এক আগন্তুক। কোনো সরকার তাঁকে চিনতে চায়নি। তাঁকে কখনো ব্যক্তিগত বিষয়-আশয় নিয়ে আক্ষেপ বা ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখিনি।
তাঁকে প্রথম দেখি ১৯৭৮ সালে টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব ফজলে লোহানীর বাড়িতে। সেই থেকে বহুবার তাঁর ছবি তুলেছি। তাঁকে শহীদ মিনারে নিয়ে গিয়ে ছবি তোলা আমার জীবনের এক স্মরণীয় ঘটনা।
বাংলা ভাষা নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা হতো। প্রমিত ভাষার বাইরেও যে আরেকটি সাবলীল ভাষা আছে, যা কথ্য বা মুখের ভাষা, সে ভাষায়ও যে সাহিত্য রচনা সম্ভব, এটা তিনি মানতেন। সাহিত্যে আঞ্চলিক ভাষা, আদিবাসী ভাষার প্রবেশে তাঁর দ্বিমত ছিল না।
কিছু লিখে দেওয়ার জন্য একবার তাঁকে আমি আমার অটোগ্রাফ খাতাটা দিয়েছিলাম। অনুরোধ করেছিলাম একটা ছবি এঁকে দিতে। তিনি বলেছিলেন, জীবনে কখনো ছবি আঁকেননি। তারপর সাবলীলভাবে আঁকলেন শহীদ মিনারের ছবি, যে মিনার ছিল তাঁর মনের ভেতর।
দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রামী আবদুল মতিন দরিদ্রতা পরিহার করতে পারেননি। তাঁকে এই অভিশাপ থেকে উদ্ধার করে একটু স্বস্তি দেওয়ার দায়িত্ব ছিল রাষ্ট্রের। কিন্তু কোনো সরকার তাঁর এই বাস্তবতাকে সমর্থন দেয়নি, করেনি যোগ্য সম্মান। মতিন সাহেব ছিলেন এমন একজন, যিনি শুধু দিয়ে গেলেন, পেলেন না তেমন কিছু। আর যা দিলেন, তা হলো বাঙালির আত্মপরিচয়, বাংলা ভাষা। আমাদের সবচেয়ে বড় অহংকার। এভাবে ভাষা-মতিন আমাদের অনিবার্য নায়ক। বাংলা ভাষার মতিন, আপনাকে বাঙালি জাতি কোনো দিন ভুলে থাকতে পারবে না। বিপুল আয়োজন ও আন্দোলনের ভেতর দিয়ে বাংলা ভাষাকে আপনি সমৃদ্ধ করেছেন। আপনি আমাদের সবচেয়ে সম্মানিত মানুষদের অন্যতম।
নাসির আলী মামুন: আলোকচিত্রী
No comments