কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ by দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
আজ জননেতা ও বাংলাদেশের বাম গণতান্ত্রিক
আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মোহাম্মদ ফরহাদের ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী।
প্রয়াত মানুষদের বয়স বাড়ে না। তাই মোহাম্মদ ফরহাদ আজও আমার স্মৃতিতে ৪৯
বছরের একজন পূর্ণ মানুষ।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সম্ভবত সর্বাপেক্ষা সফল সংগঠক মোহাম্মদ ফরহাদের নাতিদীর্ঘ কিন্তু বহুমাত্রিক জীবন নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে শুদ্ধ রাজনীতির দৈন্যদশার পরিপ্রেক্ষিতে তা আরও বেশি। আজ তাঁর ২৭তম তিরোধান বার্ষিকীতে অত্যন্ত সংক্ষেপে তাঁর প্রভূত অবদানের থেকে পাঁচটি বিষয় স্মরণ করতে ইচ্ছে করছি।
প্রথমত, আমার দৃষ্টিতে মোহাম্মদ ফরহাদ হলেন সেই প্রজন্মের প্রতিভূ, যাঁদের মাধ্যমে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট আন্দোলন পুনর্জন্ম লাভ করে। ১৯৪৭-এর প্রাক্কালে এই অঞ্চলে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বে হিন্দু পরিবার থেকে আসা ব্যক্তিদেরই প্রাধান্য ছিল। সে সময় বিকাশমান নব্য মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং তাদের দ্রুত নেতৃত্বে নিয়ে আসা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। মোহাম্মদ ফরহাদ নিজ গুণে এই উত্তরণকালীন-প্রক্রিয়ার মূল ধারক ছিলেন। ১৯৫৪ সালে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদে দীক্ষিত ১৬ বছরের কিশোর আট মাস জেল খাটেন। আর মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
দ্বিতীয় যে কথাটি আরও মনে পড়ে, তা হলো আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তথা শিক্ষা আন্দোলন রূপায়ণে তাঁর মেধাদীপ্ত অবদানের কথা। তিনি এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন আর ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পুরো সময়টাই তাঁকে হুলিয়া মাথায় নিয়ে পলাতক থাকতে হয়েছে। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানসহ স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালের সব আন্দোলনেই ছিল তাঁর নিয়ামক অংশগ্রহণ।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষ করে সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রামে, বামপন্থীদের অবদানের মূর্ত প্রতীক ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। কমিউনিস্ট-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ গেরিলা বাহিনীর তিনি ছিলেন সংগঠক ও অধিনায়ক। প্রবাসী সরকার এ সময় কমরেড মণি সিংহ ও তাঁর মাধ্যমে পেয়েছে প্রভূত সমর্থন, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। সশস্ত্র যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা তাঁর স্বাধীনতা-উত্তর ‘দেশ গড়া’র চেতনাকে আরও শাণিত করে তোলে।
চতুর্থত, অনেকেই মনে করেন, জাতীয় রাজনীতিতে মোহাম্মদ ফরহাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হলো নব্বইয়ের দশকে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনকে একটি সুস্পষ্ট অবয়ব দান। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫-দলীয় জোট ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭-দলীয় জোটকে একতাবদ্ধভাবে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে তাঁর উদ্যোগী ভূমিকা বিশেষভাবে স্মর্তব্য। সংসদের প্রার্থিতা মনোনয়নে দুই নেত্রীর মাঝে তাঁর ৫০-৫০ আসন ভাগের প্রস্তাব সে সময় ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করে।
পঞ্চমত, এবং আমার মতে তাঁর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো, সে সময় সিপিবিকে একটি ক্যাডারভিত্তিক পার্টি থেকে জনমানুষের পার্টিতে পরিণত করা। মোহাম্মদ ফরহাদ কৃষক ও শ্রমিক ফ্রন্টকে দলের জনসমাবেশ শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাংগঠনিক গুরুত্ব দেন। এর পাশাপাশি তিনি কমিউনিস্টদের নির্বাচনী রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং ১৯৮৬ সালে নিজে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হন। এককথায়, তিনি নিজ দলকে জাতীয় মূলধারার রাজনীতিতে দৃশ্যমান করে তোলেন। এসব তিনি করতে সক্ষম হন যখন তিনি স্বাধীন দেশে বারবার কারাবরণ করেছেন, দল নিষিদ্ধ হয়েছে এবং কর্মীরা ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এককথায়, তিনি ছিলেন আশির দশকের সিপিবির স্বর্ণযুগের স্থপতি।
দেশে দেশে বিদগ্ধসমাজ প্রায়ই পেছনের কথা বলতে গিয়ে ইতিহাসের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ভূমিকার পুনর্বিবেচনায় ব্যাপৃত হয়। মোহাম্মদ ফরহাদও এই পশ্চাদ্দৃষ্টিভিত্তিক এই বিশ্লেষণী চেষ্টার আওতার বাইরে নন। কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলবেন ১৯৭৫ সালে তাঁর নেতৃত্বে সিপিবির বিরাগহীনভাবে বাকশালে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে। আবার কেউ প্রশ্ন করবেন ১৯৭৭ সালের গণভোটে দলের ‘হ্যাঁ’ ভোট দেওয়া অথবা সে সময়ের ‘খাল কাটার’ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে। প্রয়াত মানুষদের সুবিধা হলো, তাঁদের কোনো চলমান বিতর্কের উত্তর দিতে হয় না।
তবে আমার মতো অনেকেই, নিজের সঙ্গে নিজের সংলাপে হয়তো প্রশ্ন করেন, মোহাম্মদ ফরহাদ যদি ১৯৯৩ সালে জীবিত থাকতেন, তাহলে কি সিপিবি এ রকম বহুধাবিভক্ত হতে পারত? পৃথিবীব্যাপী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কি মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের তত্ত্ব ও প্রয়োগের পুনর্বিশ্লেষণ করে দলকে নতুন ভিত্তি ও কাঠামোতে সংহত করতে সক্ষম হতেন? নাকি তিনি বিশ্ব অভিজ্ঞতার নবলব্ধ নির্যাস নিয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতায় শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক-সাংগঠনিক ধারা বা কাঠামোর কথা চিন্তা করতেন। এই প্রতিবাস্তব প্রশ্নের কোনো নিশ্চিত উত্তর আছে বলে মনে হয় না। তবে এতটুকু বলতে পারি, মোহাম্মদ ফরহাদের মতো প্রাজ্ঞ, নিবেদিতপ্রাণ ও কৌশলী কমিউনিস্ট দলের ব্যাপকতর সদস্যের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান হয়তো বের করতে পারতেন।
আমার সঙ্গে মোহাম্মদ ফরহাদের পরিচয় স্বাধীনতার পর, যখন আমি ছাত্রকর্মী হিসেবে সিপিবির রাজনীতিতে সক্রিয়। পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের (১৯৭৩) প্রস্তুতিকালে তাঁর কাজ আমার আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। তবে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয় যখন আমি মস্কোতে অধ্যয়নরত। ১৯৮৪ সালে দেশে ফেরার পরবর্তী বছরগুলোতে এই বিরল রাজনৈতিক বীক্ষাসম্পন্ন, অতুলনীয় সাংগঠনিক ক্ষমতাধর ও ব্যাপক মানবীয় গুণাবলিসিক্ত মানুষটির সঙ্গে প্রতিনিয়ত তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। একটাই প্রশ্ন, কোন রাজনৈতিক পথে বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের আর্থসামাজিক বিকাশ নিশ্চিত হবে তা নিয়ে। কঠিন আদর্শবাদী একজন মানুষের সংবেদনশীল এই বাস্তবতাবোধ আমাকে আশ্চর্য করত।
মনে পড়ে, ১৯৮২ সালে মস্কোতে গভীর রাতের প্রলম্বিত এক আলোচনায় ফরহাদ ভাইকে প্রশ্ন করেছিলাম, দলকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন কী? তিনি তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন: বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে কমিউনিস্টদের একটি গ্রুপ গঠন, দলের একটি নিজস্ব ভবন থেকে কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং দলের পত্রিকা একতাকে দৈনিকে পরিণত করা। তাঁর অবশিষ্ট সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি ১৯৮৬-র নির্বাচনে সংসদে পাঁচজন সিপিবির সদস্য পান। সিপিবিকে একটি স্থায়ী ঠিকানা দেওয়াকেও তিনি নিশ্চিত করেন। এবং আশির দশকে একতার প্রচারসংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। মনে প্রশ্ন জাগে, আজ যদি দেশের বর্তমান জাতীয় ও দলীয় রাজনীতি নিয়ে আবার তাঁকে প্রশ্ন করতাম, তাহলে তিনি কী উত্তর দিতেন।
ল্যাটিন মহিলা ঔপন্যাসিক ইসাবেল আলেন্দের লেখায় পড়েছিলাম, ‘মৃত্যু বলে কিছু নেই, মানুষের মৃত্যু ঘটে যখন আমরা তাঁকে ভুলে যাই’। আজও মোহাম্মদ ফরহাদকে মনে পড়ে। তাই তাঁর মৃত্যু নেই।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: অর্থনীতিবিদ।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের সম্ভবত সর্বাপেক্ষা সফল সংগঠক মোহাম্মদ ফরহাদের নাতিদীর্ঘ কিন্তু বহুমাত্রিক জীবন নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে শুদ্ধ রাজনীতির দৈন্যদশার পরিপ্রেক্ষিতে তা আরও বেশি। আজ তাঁর ২৭তম তিরোধান বার্ষিকীতে অত্যন্ত সংক্ষেপে তাঁর প্রভূত অবদানের থেকে পাঁচটি বিষয় স্মরণ করতে ইচ্ছে করছি।
প্রথমত, আমার দৃষ্টিতে মোহাম্মদ ফরহাদ হলেন সেই প্রজন্মের প্রতিভূ, যাঁদের মাধ্যমে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট আন্দোলন পুনর্জন্ম লাভ করে। ১৯৪৭-এর প্রাক্কালে এই অঞ্চলে কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বে হিন্দু পরিবার থেকে আসা ব্যক্তিদেরই প্রাধান্য ছিল। সে সময় বিকাশমান নব্য মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং তাদের দ্রুত নেতৃত্বে নিয়ে আসা অত্যন্ত প্রয়োজন ছিল। মোহাম্মদ ফরহাদ নিজ গুণে এই উত্তরণকালীন-প্রক্রিয়ার মূল ধারক ছিলেন। ১৯৫৪ সালে মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদে দীক্ষিত ১৬ বছরের কিশোর আট মাস জেল খাটেন। আর মাত্র ৩৫ বছর বয়সে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
দ্বিতীয় যে কথাটি আরও মনে পড়ে, তা হলো আইয়ুববিরোধী আন্দোলন তথা শিক্ষা আন্দোলন রূপায়ণে তাঁর মেধাদীপ্ত অবদানের কথা। তিনি এ সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন আর ১৯৬২ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত পুরো সময়টাই তাঁকে হুলিয়া মাথায় নিয়ে পলাতক থাকতে হয়েছে। ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানসহ স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালের সব আন্দোলনেই ছিল তাঁর নিয়ামক অংশগ্রহণ।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে, বিশেষ করে সশস্ত্র স্বাধীনতাসংগ্রামে, বামপন্থীদের অবদানের মূর্ত প্রতীক ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। কমিউনিস্ট-ন্যাপ-ছাত্র ইউনিয়নের সমন্বয়ে গঠিত যৌথ গেরিলা বাহিনীর তিনি ছিলেন সংগঠক ও অধিনায়ক। প্রবাসী সরকার এ সময় কমরেড মণি সিংহ ও তাঁর মাধ্যমে পেয়েছে প্রভূত সমর্থন, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে। সশস্ত্র যুদ্ধে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের অভিজ্ঞতা তাঁর স্বাধীনতা-উত্তর ‘দেশ গড়া’র চেতনাকে আরও শাণিত করে তোলে।
চতুর্থত, অনেকেই মনে করেন, জাতীয় রাজনীতিতে মোহাম্মদ ফরহাদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হলো নব্বইয়ের দশকে স্বৈরশাসনবিরোধী আন্দোলনকে একটি সুস্পষ্ট অবয়ব দান। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৫-দলীয় জোট ও বিএনপির নেতৃত্বাধীন ৭-দলীয় জোটকে একতাবদ্ধভাবে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে তাঁর উদ্যোগী ভূমিকা বিশেষভাবে স্মর্তব্য। সংসদের প্রার্থিতা মনোনয়নে দুই নেত্রীর মাঝে তাঁর ৫০-৫০ আসন ভাগের প্রস্তাব সে সময় ব্যাপক মনোযোগ আকর্ষণ করে।
পঞ্চমত, এবং আমার মতে তাঁর সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অবদান হলো, সে সময় সিপিবিকে একটি ক্যাডারভিত্তিক পার্টি থেকে জনমানুষের পার্টিতে পরিণত করা। মোহাম্মদ ফরহাদ কৃষক ও শ্রমিক ফ্রন্টকে দলের জনসমাবেশ শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সাংগঠনিক গুরুত্ব দেন। এর পাশাপাশি তিনি কমিউনিস্টদের নির্বাচনী রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং ১৯৮৬ সালে নিজে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত হন। এককথায়, তিনি নিজ দলকে জাতীয় মূলধারার রাজনীতিতে দৃশ্যমান করে তোলেন। এসব তিনি করতে সক্ষম হন যখন তিনি স্বাধীন দেশে বারবার কারাবরণ করেছেন, দল নিষিদ্ধ হয়েছে এবং কর্মীরা ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
এককথায়, তিনি ছিলেন আশির দশকের সিপিবির স্বর্ণযুগের স্থপতি।
দেশে দেশে বিদগ্ধসমাজ প্রায়ই পেছনের কথা বলতে গিয়ে ইতিহাসের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ভূমিকার পুনর্বিবেচনায় ব্যাপৃত হয়। মোহাম্মদ ফরহাদও এই পশ্চাদ্দৃষ্টিভিত্তিক এই বিশ্লেষণী চেষ্টার আওতার বাইরে নন। কেউ হয়তো প্রশ্ন তুলবেন ১৯৭৫ সালে তাঁর নেতৃত্বে সিপিবির বিরাগহীনভাবে বাকশালে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়ে। আবার কেউ প্রশ্ন করবেন ১৯৭৭ সালের গণভোটে দলের ‘হ্যাঁ’ ভোট দেওয়া অথবা সে সময়ের ‘খাল কাটার’ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার যৌক্তিকতা নিয়ে। প্রয়াত মানুষদের সুবিধা হলো, তাঁদের কোনো চলমান বিতর্কের উত্তর দিতে হয় না।
তবে আমার মতো অনেকেই, নিজের সঙ্গে নিজের সংলাপে হয়তো প্রশ্ন করেন, মোহাম্মদ ফরহাদ যদি ১৯৯৩ সালে জীবিত থাকতেন, তাহলে কি সিপিবি এ রকম বহুধাবিভক্ত হতে পারত? পৃথিবীব্যাপী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি কি মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের তত্ত্ব ও প্রয়োগের পুনর্বিশ্লেষণ করে দলকে নতুন ভিত্তি ও কাঠামোতে সংহত করতে সক্ষম হতেন? নাকি তিনি বিশ্ব অভিজ্ঞতার নবলব্ধ নির্যাস নিয়ে বাংলাদেশের বাস্তবতায় শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে ভিন্ন কোনো রাজনৈতিক-সাংগঠনিক ধারা বা কাঠামোর কথা চিন্তা করতেন। এই প্রতিবাস্তব প্রশ্নের কোনো নিশ্চিত উত্তর আছে বলে মনে হয় না। তবে এতটুকু বলতে পারি, মোহাম্মদ ফরহাদের মতো প্রাজ্ঞ, নিবেদিতপ্রাণ ও কৌশলী কমিউনিস্ট দলের ব্যাপকতর সদস্যের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান হয়তো বের করতে পারতেন।
আমার সঙ্গে মোহাম্মদ ফরহাদের পরিচয় স্বাধীনতার পর, যখন আমি ছাত্রকর্মী হিসেবে সিপিবির রাজনীতিতে সক্রিয়। পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসের (১৯৭৩) প্রস্তুতিকালে তাঁর কাজ আমার আরও কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়। তবে তাঁর সঙ্গে আমার পরিচয় ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয় যখন আমি মস্কোতে অধ্যয়নরত। ১৯৮৪ সালে দেশে ফেরার পরবর্তী বছরগুলোতে এই বিরল রাজনৈতিক বীক্ষাসম্পন্ন, অতুলনীয় সাংগঠনিক ক্ষমতাধর ও ব্যাপক মানবীয় গুণাবলিসিক্ত মানুষটির সঙ্গে প্রতিনিয়ত তর্ক-বিতর্ক হয়েছে। একটাই প্রশ্ন, কোন রাজনৈতিক পথে বাংলাদেশের খেটে খাওয়া মানুষের আর্থসামাজিক বিকাশ নিশ্চিত হবে তা নিয়ে। কঠিন আদর্শবাদী একজন মানুষের সংবেদনশীল এই বাস্তবতাবোধ আমাকে আশ্চর্য করত।
মনে পড়ে, ১৯৮২ সালে মস্কোতে গভীর রাতের প্রলম্বিত এক আলোচনায় ফরহাদ ভাইকে প্রশ্ন করেছিলাম, দলকে নিয়ে তাঁর স্বপ্ন কী? তিনি তিনটি বিষয় উল্লেখ করেছিলেন: বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে কমিউনিস্টদের একটি গ্রুপ গঠন, দলের একটি নিজস্ব ভবন থেকে কর্মকাণ্ড পরিচালনা এবং দলের পত্রিকা একতাকে দৈনিকে পরিণত করা। তাঁর অবশিষ্ট সংক্ষিপ্ত জীবনে তিনি ১৯৮৬-র নির্বাচনে সংসদে পাঁচজন সিপিবির সদস্য পান। সিপিবিকে একটি স্থায়ী ঠিকানা দেওয়াকেও তিনি নিশ্চিত করেন। এবং আশির দশকে একতার প্রচারসংখ্যাও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। মনে প্রশ্ন জাগে, আজ যদি দেশের বর্তমান জাতীয় ও দলীয় রাজনীতি নিয়ে আবার তাঁকে প্রশ্ন করতাম, তাহলে তিনি কী উত্তর দিতেন।
ল্যাটিন মহিলা ঔপন্যাসিক ইসাবেল আলেন্দের লেখায় পড়েছিলাম, ‘মৃত্যু বলে কিছু নেই, মানুষের মৃত্যু ঘটে যখন আমরা তাঁকে ভুলে যাই’। আজও মোহাম্মদ ফরহাদকে মনে পড়ে। তাই তাঁর মৃত্যু নেই।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য: অর্থনীতিবিদ।
No comments