সাক্ষাৎকার -বিনম্র শ্রদ্ধায়... ‘আগে নিজের ভাষা শিখুক তারপর অন্যটা’ by সুমনা শারমীন
১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৩। সকাল নয়টা ২০ মিনিট। ১১৪ নম্বর মনেশ্বর রোড, জিগাতলা। সরু একচিলতে প্যাসেজ, একটা ঘর পেরিয়ে একটা ছোট বারান্দা। মধ্যবিত্তের বারান্দা। অপ্রয়োজনীয় জিনিসে ঠাসা। এর মধ্যে দুটো আচারের শিশি রোদ পোহাচ্ছে। অনেকগুলো ফুলের টব। যত্নের ছাপ। অপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলোকে ঢেকে দেওয়া হয়েছে একটি পরিষ্কার কাপড়ে। তার ওপর ঝুঁকে লিখে চলছেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী বর্ষীয়ান ব্যক্তিত্ব আবদুল মতিন। এরই মধ্যে জায়গা করে নিল একটা চেয়ার, আগন্তুকের জন্য। মুখোমুখি হলাম তাঁর। যিনি ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ ভাষা আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রেখেছিলেন এবং সেতুর মতো কাজ করেছিলেন নানাভাবে। একটা সাদা হাফ শার্ট, একটা সাদা ফুল প্যান্ট পরে একটা সাইকেল সম্বল করে এক হল থেকে অন্য হলে হন্যে হয়ে ঘুরে ঘুরে যিনি আন্দোলনকে জিইয়ে রেখেছিলেন। প্রথম থেকেই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যাঁর ছিল ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ, ‘যিনি রাষ্ট্রভাষা মতিন’ বলেই পরিচিত, ১৯৫০ সালে গঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন যিনি, কমিউনিস্ট দল ও কৃষক সংগঠনে বিগত চার দশকব্যাপী কর্মরত এবং বর্তমানে সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয়, মুখোমুখি হলাম তাঁর। সাক্ষাৎকারটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভোরের কাগজ -এর বিশেষ ক্রোড়পত্রে।
—সুমনা শারমীন
প্রশ্ন: এই যে ফেব্রুয়ারি এলেই পত্রপত্রিকা থেকে, রেডিও-টেলিভিশন থেকে লোক আসে, আপনাদের নিয়ে শুরু হয়ে যায় টানাহেঁচড়া। বিষয়টাকে কী চোখে দেখেন?
আবদুল মতিন: তবু তো বছরের একটি মাসে ভাষা আন্দোলনের ওপর লেখালেখি হয়, আলোচনা হয়, এ মাসের জন্য হলেও লোকজন ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চায়। আমাদের কাছে আসে। যদি একেবারেই না আসত, তাহলে তো করার কিছু ছিল না।
প্রশ্ন: ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিত্ব অনেকেই জীবিত আছেন। অনেকেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখেছেন বইতে, সংকলনে। কিন্তু দেখা যায় একই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জড়িত ব্যক্তিরাই একেকজন একেক রকম ভাষ্য দিচ্ছেন। কেন?
আবদুল মতিন: এ প্রশ্ন আমারও। সামগ্রিকভাবে ভাষা আন্দোলনকে উপস্থাপন না করে সংকীর্ণভাবে উপস্থাপন করলে ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য হবেই।
প্রশ্ন: ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ নিয়েও আছে নানা ভাষ্য। এ বিষয়ে আপনার কী বক্তব্য?
আবদুল মতিন: আমি মনে করি, ১৯৫২ সালের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ছিল বিজয় অর্জনের সূচনা। সেদিন ১৪৪ ধারা না ভাঙা হলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সফল হতো না। এবং এর জের হিসেবেই পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হলো। হলো অভ্যুত্থান। যারা সেদিন ১৪৪ ধারা ভাঙতে চায়নি তারা ভেবেছিল ভাষার দাবি গতানুগতিক গতিতেই চলবে। মনে আছে, ২০ তারিখ রাতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে ভোটাভুটিতে পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে ভোট পড়ে ১১টি। পক্ষে মাত্র ৩টি। এর মধ্যে ছিলাম আমি, অলি আহাদ এবং মেডিকেল কলেজের গোলাম মাওলা। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে পরদিন অর্থাৎ ২১ তারিখের সমাবেশে দুটি প্রস্তাবই উত্থাপন করা হবে। সমাবেশের সবাই যেটা মেনে নেবে, সেটাই হবে সিদ্ধান্ত। ঠিক হলো সংখ্যাগরিষ্ঠদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব উত্থাপন করবেন আওয়ামী মুসলিম লীগের শামসুল হক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে বৈঠকে গৃহীত সংখ্যাগরিষ্ঠদের প্রস্তাব উত্থাপন করব আমি। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, জনাব এম আর আখতার মুকুল ২০ তারিখ রাতে ফজলুল হক হলের পুকুরপাড়ে বসে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্তের যে বর্ণনা দিয়েছেন ১৯৯১ সালের দেশ পত্রিকার একুশে সংখ্যায়, সেটি ঠিক নয়। এবং এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই আমি বাংলাবাজার পত্রিকায় লিখিতভাবে জানিয়েছি। পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারিতে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষের সামনে দুটো প্রস্তাবই উত্থাপন করা হয়। এ সভার সভাপতি ছিলেন গাজীউল হক। গাজীউল হক তখন বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। যা-ই হোক, সবাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তাব মেনে নেয়। এবং এর পরই ছোট ছোট দলে ছাত্র-জনতা বেরিয়ে পড়ে।
১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল যারা অর্থাৎ তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগ মনে করেছিল হয়তো ছাত্ররা ১৪৪ ধারার ভয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হবে না, হলেও ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার প্রস্তাব মেনে নেবে। একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি চলার ও তাতে অসংখ্য ছাত্র আহত ও নিহত হওয়ার পর আন্দোলন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না ভেবে এই ‘মহান বাস্তববাদীরা’ ২২ ফেব্রুয়ারির গায়েবি জানাজার আহ্বানসংবলিত কর্মসূচিতে তাদের স্বাক্ষর দেয়নি। এর বিপরীতে যারা ১৪৪ ধারা অমান্য করার ও ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি দৃঢ়তার সঙ্গে পালন করার পক্ষপাতী ছিল তারাই যে বাস্তবতা, ছাত্র ও জনগণের চিন্তাভাবনার, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার অনেক কাছাকাছি ছিল ঘটনার বিকাশই তা প্রমাণ করেছিল।
প্রশ্ন: ১৯৯৩-এর একুশে কিছু বলবেন?
আবদুল মতিন: এত বছর পরও বলতে বাধ্য হচ্ছি বাংলা ভাষার মর্যাদা এখনো দেওয়া হচ্ছে না। আন্তর্জাতিকতা এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে ইংরেজি ও আরবিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে অযথা। এটা একটা ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রে রয়েছে আমলা ও পুঁজিপতিরা। ষড়যন্ত্র রোধের ব্যাপারে সচেতন হওয়া দরকার। ইংরেজি বা আরবি ভাষা শিক্ষার আমি বিরোধী নই। তবে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষাই চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। আগে নিজের ভাষা শিখুক, তারপর অন্যটা। নয়তো কোনোটাই শেখা হচ্ছে না।
সুমনা শারমীন: সাংবাদিক
—সুমনা শারমীন
প্রশ্ন: এই যে ফেব্রুয়ারি এলেই পত্রপত্রিকা থেকে, রেডিও-টেলিভিশন থেকে লোক আসে, আপনাদের নিয়ে শুরু হয়ে যায় টানাহেঁচড়া। বিষয়টাকে কী চোখে দেখেন?
আবদুল মতিন: তবু তো বছরের একটি মাসে ভাষা আন্দোলনের ওপর লেখালেখি হয়, আলোচনা হয়, এ মাসের জন্য হলেও লোকজন ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে জানতে চায়। আমাদের কাছে আসে। যদি একেবারেই না আসত, তাহলে তো করার কিছু ছিল না।
প্রশ্ন: ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ব্যক্তিত্ব অনেকেই জীবিত আছেন। অনেকেই ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস লিখেছেন বইতে, সংকলনে। কিন্তু দেখা যায় একই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জড়িত ব্যক্তিরাই একেকজন একেক রকম ভাষ্য দিচ্ছেন। কেন?
আবদুল মতিন: এ প্রশ্ন আমারও। সামগ্রিকভাবে ভাষা আন্দোলনকে উপস্থাপন না করে সংকীর্ণভাবে উপস্থাপন করলে ভিন্ন ভিন্ন ভাষ্য হবেই।
প্রশ্ন: ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ নিয়েও আছে নানা ভাষ্য। এ বিষয়ে আপনার কী বক্তব্য?
আবদুল মতিন: আমি মনে করি, ১৯৫২ সালের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ ছিল বিজয় অর্জনের সূচনা। সেদিন ১৪৪ ধারা না ভাঙা হলে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সফল হতো না। এবং এর জের হিসেবেই পরবর্তী সময়ে ১৯৫৪-এর নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি হলো। হলো অভ্যুত্থান। যারা সেদিন ১৪৪ ধারা ভাঙতে চায়নি তারা ভেবেছিল ভাষার দাবি গতানুগতিক গতিতেই চলবে। মনে আছে, ২০ তারিখ রাতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে ভোটাভুটিতে পরদিন ১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিপক্ষে ভোট পড়ে ১১টি। পক্ষে মাত্র ৩টি। এর মধ্যে ছিলাম আমি, অলি আহাদ এবং মেডিকেল কলেজের গোলাম মাওলা। তবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে পরদিন অর্থাৎ ২১ তারিখের সমাবেশে দুটি প্রস্তাবই উত্থাপন করা হবে। সমাবেশের সবাই যেটা মেনে নেবে, সেটাই হবে সিদ্ধান্ত। ঠিক হলো সংখ্যাগরিষ্ঠদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব উত্থাপন করবেন আওয়ামী মুসলিম লীগের শামসুল হক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে বৈঠকে গৃহীত সংখ্যাগরিষ্ঠদের প্রস্তাব উত্থাপন করব আমি। এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, জনাব এম আর আখতার মুকুল ২০ তারিখ রাতে ফজলুল হক হলের পুকুরপাড়ে বসে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্তের যে বর্ণনা দিয়েছেন ১৯৯১ সালের দেশ পত্রিকার একুশে সংখ্যায়, সেটি ঠিক নয়। এবং এ বিষয়ে ইতিমধ্যেই আমি বাংলাবাজার পত্রিকায় লিখিতভাবে জানিয়েছি। পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারিতে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষের সামনে দুটো প্রস্তাবই উত্থাপন করা হয়। এ সভার সভাপতি ছিলেন গাজীউল হক। গাজীউল হক তখন বেশ জনপ্রিয় ছিলেন। যা-ই হোক, সবাই ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রস্তাব মেনে নেয়। এবং এর পরই ছোট ছোট দলে ছাত্র-জনতা বেরিয়ে পড়ে।
১৪৪ ধারা ভঙ্গের বিরোধিতা করেছিল যারা অর্থাৎ তৎকালীন আওয়ামী মুসলিম লীগ মনে করেছিল হয়তো ছাত্ররা ১৪৪ ধারার ভয়ে একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে সমবেত হবে না, হলেও ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার প্রস্তাব মেনে নেবে। একুশে ফেব্রুয়ারি গুলি চলার ও তাতে অসংখ্য ছাত্র আহত ও নিহত হওয়ার পর আন্দোলন আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না ভেবে এই ‘মহান বাস্তববাদীরা’ ২২ ফেব্রুয়ারির গায়েবি জানাজার আহ্বানসংবলিত কর্মসূচিতে তাদের স্বাক্ষর দেয়নি। এর বিপরীতে যারা ১৪৪ ধারা অমান্য করার ও ২১ ফেব্রুয়ারির কর্মসূচি দৃঢ়তার সঙ্গে পালন করার পক্ষপাতী ছিল তারাই যে বাস্তবতা, ছাত্র ও জনগণের চিন্তাভাবনার, তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার অনেক কাছাকাছি ছিল ঘটনার বিকাশই তা প্রমাণ করেছিল।
প্রশ্ন: ১৯৯৩-এর একুশে কিছু বলবেন?
আবদুল মতিন: এত বছর পরও বলতে বাধ্য হচ্ছি বাংলা ভাষার মর্যাদা এখনো দেওয়া হচ্ছে না। আন্তর্জাতিকতা এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে ইংরেজি ও আরবিকে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে অযথা। এটা একটা ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রে রয়েছে আমলা ও পুঁজিপতিরা। ষড়যন্ত্র রোধের ব্যাপারে সচেতন হওয়া দরকার। ইংরেজি বা আরবি ভাষা শিক্ষার আমি বিরোধী নই। তবে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত বাংলা ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষাই চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। আগে নিজের ভাষা শিখুক, তারপর অন্যটা। নয়তো কোনোটাই শেখা হচ্ছে না।
সুমনা শারমীন: সাংবাদিক
No comments